এই সময় থেকে সেই সময়ে ফেরা মানে শ্যামলবাবুর দশ লক্ষ বছর আগে নামের ক্ষুদ্র উপন্যাসটির চরিত্র, সেই জন্মসূত্রে আইরিশ কিন্তু বহুকাল আমেরিকাবাসী টিচবোর্ন পরিবারের জেনেটিক বিজ্ঞানী কন্যা এলসা টিচবোর্নের সংহতি কলোনিতে গভীর রাতে দেখা কোটি কোটি বছর আগে নিশ্চিহ্ন ডায়নোসরের কাছে ফিরে যাওয়া যেন। কে কার উত্তরাধিকার বহন করছে, ডায়নোসর থেকে কে হয়ে গেছে পাখি, কে হয়ে গেছে বাঘডাঁশা নামের অতিক্ষুদ্র এক প্রাণী কিংবা পথের সেই কুকুর-জাল কণ্ঠি, চিনে নেওয়া কঠিন, কিন্তু শ্যামলবাবু সেই দুর্জ্ঞেয় পথের খোঁজেই যেন বেরিয়েছিলেন ওই ক্ষুদ্র আখ্যানে। প্রাণের বিবর্তনে সময়ের ভূমিকাকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন বাংলা ভাষার এই লেখক। নতুন করে পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল অতি সম্প্রতি সুখ্যাত বিজ্ঞানী দীপঙ্কর হোম মহাশয়ের একটি বক্তৃতার কথা। একটি ঘরোয়া সভায় বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞানী যে কথা বলেছিলেন, তারপর যে যে কথা উঠে এসেছিল লেখক শিল্পীদের কাছ থেকে, তার থেকেও যেন অনেক বেশি প্রশ্ন উঠে আসে ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ পড়লে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণাগারটি জাপানের কোবে শহরে। চৌষট্টিজন বিজ্ঞানী মানে চৌষট্টিটি মেধাবী মানুষ। চৌষট্টিজন সমস্তদিন একটিও কথা বলে না, তাদের কোনো বিনোদন নেই, নিঃশব্দে গবেষণাগারে দিন কাটায়, নিঃশব্দে ফিরে এসে ঘুমিয়ে নেয়। শুধু আমেরিকার এলসা আর কলকাতার সংহতি কলোনির পরিতোষ কুণ্ডু নিজেরা কথা বলতে পারে। বলতে হয়। তাদের প্রেমের পর পরিণয় হয়েছে। কলকাতায় এসেছিল এলসা। মধ্যরাতে সংহতি কলোনির বাড়ির দোতলা থেকে পেছন দিকের ঝোপ জঙ্গল এবং শুকনো পড়ে থাকা পুকুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা এক অতিকায় প্রাণীকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়েছিল সে। সে নিজেই প্রাণের রহস্য উন্মোচনে ব্রতী, সে নিজেই দেখেছে কোটি কোটি বছর আগে নিশ্চিহ্ন প্রাণ ডায়নোসরকে শুকনো জলাশয়ের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে। আসলে ওই গর্তে বাস করে একটি অদ্ভুত প্রাণী, উদবেড়াল নয়, বাঘরোল নয়, খটাশ নয়, কিছুটা কুকুর কিছুটা বিড়াল বা বাঘের মতো, যাকে কিনা পাশের বাড়ির পাগলা রাখাল মাস্টার বলে বাঘডাঁশা। এ এক এমন প্রাণী যা ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে, যেভাবে প্রায় মুছে গেছে বাঘরোল, বনবেড়াল এবং শিয়াল খটাশও। এলসা ওই বাঘডাশার গর্ত থেকেই বেরিয়ে আসতে দেখেছিল অতিকায় ডায়নোসরকে— এ কি মাইক্রো বায়োলজি, জিন-প্রযুক্তি জানা, প্রাণের রহস্য উদ্ধারে বিভোর, কৃত্রিম প্রাণ সৃজনে নিমগ্ন এলসা কুণ্ডু (টিচবোর্ন)-র শুধুই বিভ্রম? কল্পনা! নাকি অন্তরের সত্য দর্শন? সে তো জানে তার গবেষণা শেষ অবধি মানব কল্যাণে কতটা যাবে, কতটা যাবে যুদ্ধের প্রয়োজন মেটাতে, ব্যবসা আর ডলার উৎপাদনে। পড়তে পড়তে কত মাত্রা যে উদ্ভাসিত হয়ে যায় নতুন আলোর মতো। আচমকা মনে হয় লেখক কি নিজেকে চিনে নিতে চেয়েছিলেন সৃষ্টির আদিরহস্য উন্মোচন করে। ভ্রূণের স্মৃতিতে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কী আশ্চর্য এই আখ্যান। জলধর কুণ্ডুর স্মৃতি আচমকা নষ্ট হয়ে যায়, মনের ভিতরে জেগে ওঠে বিচিত্র পাপবোধ। সেই জলধরকে তার পুত্রবধূ এলসা জাপান থেকে উড়ে এসে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চায়, তার মরে যাওয়া ব্রেন সেল রিপ্লেস করবে তাজা ব্রেন সেল দিয়ে। তাজা ব্রেন সেল আসবে সদ্যসৃষ্ট ভ্রূণ থেকে। সেই ভ্রূণ দেবে এলসা নিজে। তার গর্ভে তখন এসে গেছে প্রাণ, যে প্রাণ বয়ে নিয়ে যাবে জলধর কুণ্ডুর বংশধারাকে। এই ক্ষুদ্র উপন্যাসটি তখন এক ঐশ্বর্যময় আখ্যানে পৌছে যায়। এই আখ্যানটিতে শ্যামলবাবু পৌঁছেছেন কুবের সাধুখার কদমপুর, মেদন মল্লর চর থেকে অনাথবন্ধুর ঈশ্বরীতলা থেকে, বিদ্যাধরীর মরা খাত থেকে কলকাতার উপকণ্ঠের সংহতি কলোনি হয়ে জাপানের কোবে শহরের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণাগারে—প্রাণ উৎপাদনের কারখানার হিমশীতল নৈঃশব্দে। ঈশ্বরীতলার রূপো কথা, কুবেরের বিষয় আশয় বা আর একটি ক্ষুদ্র উপন্যাস গঙ্গা একটি নদীর নাম-এ কুকুর, বিড়াল, পশু পাখির নানারকম উপস্থিতি। তাদের ভাষা বোঝে যেন অনাথ কিংবা হাজরা হালদার। পশুপাখি এমন কি গঙ্গার অতল তলে ভেসে আসা গাভীন ইলিশও স্বপ্নের ভিতরে মানুষের ভাষায় কথা বলে, প্রাণীর সঙ্গে প্রাণীকীট পতঙ্গের সম্পর্কটি খাদ্য খাদকের। একে অন্যকে খেয়ে বেঁচে আছে, এই নির্মম সত্যটি উদঘাটন করতে করতে শ্যামলবাবু পৌঁছে যান সৃষ্টির রহস্য উদ্ধারে।
‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’ উপন্যাসে বজ্জাত নামের একটি হলো বেড়াল ছিল। সেই বেড়ালটি পাখির ছানা খেতে,পাখির ডিম চুরি করে খেতে উঠে যায় হরিতকি গাছটিতে, নিঃশব্দে। শ্যামলবাবুর বর্ণনায়:
“এই বজ্জাত নেমে আয়!
বজ্জাত তখন একটা উঁচু ডালের পাতার ঝুপসিতে ঢাকা পড়ে গেছে।
দশ গোনার সময়ও পেরোয়নি। ডালপালার ভেতর থেকে বজ্জাত ফ্যাঁস মত একটি আওয়াজ করল।
আহারে! চোখ বুজে ফেলল শান্তা। কোন পাখির প্রাণ গেল!
এবার অনেক জোরে। ডালপালার ভেতরে গা ঘষটানোর আওয়াজ। শান্তা দেখতে দেখতে একেবারে স্ট্যাচু হয়ে গেল। বজ্জাত ঘুরতে ঘুরতে ধপাস করে নীচে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে একপাল ঘনকালো মাছি নেমে এল। সাদা বজ্জাতকে মাছিরা ঢেকে কালো করে ফেলল। তারই ভেতর একবার বোধহয় একটু পাশ ফেরার চেষ্টা করল বজ্জাত।