রানু জানল, সে না আসতেও পারত। তাকে মা বাবা চায়নি সে আসুক, তবু সে এসে গেছে। রানু কেমন শূন্য হয়ে গেল। এ পৃথিবীতে তার না আসবার, না থাকবার কথাই তো সবচেয়ে বেশি ছিল। এই যে সন্ধেবেলায় এমন আলোয় ভরা লোকজনভরা শহরের পথ দিয়ে সে হেঁটে চলেছে এই চলবার কোনো কথা ছিল না।
প্রতিদিনের অভ্যাসে বাড়ি ফেরা রানু আজ বিরক্ত বাড়ির উপর। মায়ের কাছে গেল না অভিমান আর রাগে। তাকে চায়নি মা বাবা। এই গল্প ক্রমশ নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের দীনতার ভিতরে ঢুকে পড়ে। বাবা হেমাঙ্গ বাড়ি ফিরে রানুর কাছে খোঁজ নেয় তার কী হয়েছে যে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে? তারপর হেমাঙ্গ বেরোয় টাকা ধারের জন্য হাতিবাগানের দিকে। মাসের শেষ যে। রানুর দুই ভাই, বাড়ির দুই বালক খাওয়া নিয়ে বায়না করে। শুধু ডাল ভাত খেতে চায় না। রানুর পরের বোন বুলু জেরবার। রানুর মা, অভাবী সংসারের অসুস্থ গৃহিনী অপারগ স্বামীর প্রতি অভিযোগ জানায় নিজের মনে, খেতে দিতে না পারলে জন্ম দেওয়া কেন? মায়ের আক্ষেপ, ভাই দুটির না মেটা ক্ষুধার বাস্তবতা রানুকে ধীরে ধীরে নিজের সত্তার কাছে ফেরায়। সে ঘরের অন্ধকার থেকে বেরোয়। তাদের শোয়ার ঘর আর রান্না ঘরের মাঝখানে একফালি উঠন। তার উপরে তারায় তারায় ভরা আকাশ। রানু অনুভব করে, সে না এলে এই বিরাট আকাশ আর বিপুলা পৃথিবীর হয়তো কিছুই এসে যেত না। কিন্তু সে যখন কোন না কোন ভাবে একবার এসে পড়েছে, তখন এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে। এই গল্প ফিরে ফিরে পড়ি। নরেন্দ্রনাথ মিত্র নীরবতার ভিতরে ১০০- পার হয়ে গেছেন। তিনি হৃদয়ে জড়িয়ে থাকুন।
সিন্ধুতীরে ফেরা-শ্যামলবাবু
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কী বলব। কী লিখব তার সৃষ্টিশীল জীবনের বিস্তার নিয়ে, তার আন্দাজ নেওয়া কঠিন হয়ে গেছে আমার পক্ষে। গত তিরিশ বছর ধরে যে লেখককে পড়ছি নিবিষ্ট হয়ে, বছর চব্বিশ যাকে দেখেছি খুব কাছ থেকে তাঁর এই অসম্ভব মৃত্যু নিশ্চিতভাবে আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। মানুষ কত নিরুপায়। মানুষ আর একটা অবিকল মানুষ তৈরি করতে যাচ্ছে, স্মৃতি হারানো মানুষের ব্রেন-সেলে নতুন ভ্রূণের মস্তিষ্ক কোষ স্থাপন করতে শিখেছে নাকি, কত রকম মারণাস্ত্র, যুদ্ধ বিমান, মারণ গ্যাস, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে শিখেছে, খাদ্যের প্রয়োজনে চার ঠ্যাংওয়ালা মুরগি তৈরি করছে কী মহান জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিদ্যা প্রয়োগ করে, আবার জাপানে গরু ষাঁড়ের ঘাড়ে, হিপে ইলেকট্রিক জার্কার বসিয়ে তাদের গায়ের মাংসে যাতে ফাইবার না গড়ে উঠতে পারে তার ব্যবস্থা করছে সুস্বাদু মাংসের প্রয়োজনে— এত সব করেও কিনা একটা প্রবল ভাবে বেঁচে থাকতে চাওয়া, বেঁচে থেকে সৃজনকর্মে বিভোর হয়ে থাকতে চাওয়া একটা মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে না। সারিয়ে তুলতে পারে না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ নামের আখ্যানটি যদি কেউ এই সময়ে আবার পড়ে নেন তবে এইসব প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ নামের ক্ষুদ্র উপন্যাসটি পড়তে পড়তে এখন আচমকা আমার মনে হচ্ছে শ্যামলবাবু কি টের পেয়েছিলেন তাঁর জাগতিক জীবনের ভবিতব্য? এমনই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন তিনি? নাকি এ আমার নিতান্তই কষ্টকল্পনা। কিন্তু প্রাণরহস্যের, জীবনজন্মের যে আশ্চর্য কাহিনি লিখেছিলেন শ্যামল বাবু তাঁর অসুখের কয়েকমাস আগে, তার তুল্য অন্তর্ভেদী, হৃদয়বিজড়িত, এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্নেভরা কাহিনী আমি বহুদিন পড়িনি। বহুকাল।
হৃদয়বেত্তা এবং যুক্তির ভিতরে নাকি দ্বন্দ্ব প্রবল। হৃদয় যখন বিস্তারিত হয়, যুক্তির জাল তাতে ভেসে যায়, আবার যুক্তির জাল যখন ছেয়ে ফেলে সব, হৃদয় নাকি তাতে চাপা পড়ে যায়— ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ নামের আখ্যানটি পড়তে পড়তে ভাবছি হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করেছে যে কাহিনি, তার ভিতরে শ্যামলবাবুর দুই নবীন বিজ্ঞানী, স্বামী স্ত্রী, আলাপে বসে বলছে—“আমার মনে হয়— আমরা সায়ান্টিস্ট সেজে যা কিছু করছি তার অনেকটাই চলে যাবে— যাচ্ছে ব্যবসায়— মানুষের ভোগে— আরও রুটি মাংস খাব— আরও আরও— আরও বেশি ভোগ করব— এই বিলাসে— এই ডলারে। এর ভেতর বিজ্ঞান কোথায়? গবেষণা কোথায়? প্রাণের জিন এপাশ ওপাশ সেপাশ করে দিয়ে যা করতে চলেছি— তার অনেকটাই তো চলে যাচ্ছে-যাবে যুদ্ধের কাজে। কে বলতে পারে যাবে না?
(দশলক্ষ বছর আগে পৃঃ ৩০)
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি শেষ থেকে স্মরণ করছি। তিনি যেভাবে ২০০০ সালে বসে ফিরে যেতে পারতেন দশলক্ষ বছর আগের অতিকায় ডায়নোসরের যুগে, সেই সূত্র ধরেই শ্যামলবাবুর শেষ ছোটগল্প ‘সে’ থেকে আমি না হয় পিছিয়ে গেলাম কুবেরের বিষয় আশয়, রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলার সময়ে যখন বাতাস ছিল আলোয় ভরা, আলোও ছিল আলোর মতন, মদন বদন নামের নিরন্ন দুই ভূমিহীন যুবক, একটি কুকুর, একটি হুলোবিড়াল, দুটি রাজহাঁস, একটি গাইগরু ও তার তাগড়াই বলদ বাছুর, গোটা আটেক পাতিহাঁস, কোম্পানি বাঁধের ভিতরে গর্তে বাস করা বিষধরদের নিয়ে খোলা মাঠের ভিতরে দালান কোঠা বানিয়ে দুটি বালিকা-কন্যা আর বউ নিয়ে সাপুড়ে মহম্মদ বাজিগর বা গো-বদ্যি বিরজা ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করে ঈশ্বরীতলায় বাস করা অনাথবন্ধু।