শ্বেতময়ূর গল্পে দাদার বন্ধু জার্মান যুবক কদিন অতিথি হয়েছিল তাদের বাড়ি। কিশোরী মেয়েটি জানে না সেই যুবকের মনে প্রেমের সঞ্চার হয়েছে তার প্রতি, যেমন হয়েছিল তারও। যাওয়ার দিন সেই জার্মান যুবক নিজের ভাষায় তার যে আবেগ প্রকাশ করল তা কিশোরী মেয়েটির মন দুমড়ে দিল। প্রেমের ভাষা কেউ চিনতে ভুল করে না। একজন জার্মান, অন্যজন বাংলায় কথা বলে যাচ্ছিল। বাংলা ভাষায় এমন প্রেমের গল্প আমরা খুব কম পড়েছি। আমি বলছি অন্য এক গল্প “রানু যদি না হত”র কথা। নরেন্দ্রনাথ ছিলেন অসামান্য গল্প বলিয়ে। তাঁর মতো গল্প কথক আমাদের সাহিত্যে আর আসেননি। নরেন্দ্রনাথের গল্প পড়তে পড়তে মনে হয় তিনি যেন আকাশ থেকে গল্প নামিয়ে আনতেন। তিনি যেন প্রাচীন কালের গ্রামবৃদ্ধের মতো শোনাতে পারতেন কতকালের পুরোন সব কাহিনি। বৎসরাজ উদয়ন আর বাসবদত্তার কাহিনি। নিরূপায় মানুষ, দুঃখী মানুষ, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মানুষ তাঁর গল্পের মানুষ।
হেডমাস্টার গল্পের কথা মনে করি। দেশভাগের পর হিন্দু ছাত্ররা ওপার থেকে এপারে চলে আসায় পূর্ববঙ্গের সাগরপুর এম.ই. ইস্কুলের হেড মাস্টার মশায়ের ছাত্র কমে গিয়েছিল খুব। দেশভাগের পর তিনি ঠিক করেছিলেন ওপার থেকে আসবেন না, কিন্তু আসতে বাধ্য হন, ইস্কুল চলছিল না। যা ছাত্র ছিল, তাদের সকলের কাছ থেকে বেতন আদায় হয় না। বুড়ো হয়েছেন। কলকাতায় এসে তাঁর দিন চলবে কী করে পরিবার নিয়ে? পঞ্চাশোর্ধ হেড মাস্টার মশায় সওদাগরী অফিসে চাকরি খুঁজতে বেরিয়েছেন। গ্রামের ছাত্রর অফিসে এসে তার কাছেই চাকরি প্রার্থনা করছেন। একটি মেয়ের বিয়ে হয়নি, তিনটি নাবালক পুত্রও আছে। কত বড় সংসার, কী করে চলবে? হেড মাস্টার মশায়কে তার ব্যাঙ্কে ক্লার্কের চাকরি দিয়েছিল ছাত্র নিরুপম। হেড মাস্টার মশায় খুব ভালো ইংরিজি পড়াতেন। তাঁর ছাত্ররা কৃতী। তিনি তাঁর এতকালের অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। গল্পটি এত হৃদয় গ্রাহ্য, এত মানবিক যে পড়তে পড়তে স্তম্ভিত হয়ে থাকতে হয়। পার্টিশন আমাদের জীবনকে কত রকম ভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল তা নরেন্দ্রনাথের গল্পে ধরা যায়। মানুষের বেঁচে থাকার ভিতরেও যে নির্মমতা তৈরি হয়েছিল, তা তাঁকে না পড়লে ধরা যায় না। নরেন্দ্রনাথের অধিকাংশ গল্প জীবিকার কথা বলেছে। পার্টিশন জীবিকা বদল করে দিয়েছিল। মেয়েদের ঘর থেকে বাইরে এনেছিল জীবিকার খোঁজে(অবতরনিকা, যা সত্যজিৎ রায়ের মহানগর সিনেমা)। কত আধুনিক ছিলেন তিনি।
“রানু যদি না হত” এই শহরের এক সতের বছরের মেয়ে রানুর গল্প। এই শহর মানে এই ২০১৬-র শহর তো নয়। সেই শহর আমার ছোটবেলার। ষাটের দশক হতে পারে। পঞ্চাশের দশকও হতে পারে গত শতাব্দীর। তারপর পৃথিবী অনেকখানি পথ পার হয়েছে। পুরনো ধ্যান ধারনা বদলে গেছে অনেক। নরেন্দ্রনাথ তাঁর চারপাশের মানুষের মুখ আঁকতেন নানা রঙে। আমি বার বার মৃদুভাষী, আত্মমগ্ন এই লেখককে দেখে আপ্লুত হয়েছি। রানুর গল্পটি এক আত্মমগ্ন মেয়ের গল্প। নিতান্ত মধ্যবিত্ত কেরানি বাবার কন্যা রানু। কলেজে পড়ে। মা থাকে প্রায়ই অসুস্থ। রানুকে সব দেখতে হয়। সে তো মা বাবার প্রথম সন্তান। তার পরে আর এক বোন বুলু, দুইটি বালক ভাই। নরেন্দ্রনাথ যে নিম্নবিত্তের সংসার আঁকেন, সেই সংসারেই আমরা বড় হয়েছি। এই বয়সে তাঁর গল্প পড়তে গেলে সেই কলকাতা সেই ছোটবেলাকে দেখা যায়। বিস্মৃতি স্মৃতিতে ফিরে আসে।
রানুর মায়ের অসুখ, জ্বর। বুড়ো ডাক্তার বলেছে বিকেলে এসে মিকশ্চার নিয়ে যেতে। ডিসপেন্সারিতে মিকশ্চারের শিশি রেখে রানু কলেজে গেল, ফিরল সাড়ে চারটে নাগাদ সেই বুড়ো ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে। ডাক্তার বিকেলে থাকে না। থাকে যে কম্পাউন্ডার সেও বুড়ো। এই ডিসপেনসারি তাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূর, এর চেয়ার টেবিল থেকে সমস্ত ফার্নিচার পুরোন। এখানে যে কেন আসে বাবা মা বার বার। বুড়ো ডাকতারের বুড়ো কম্পাউন্ডার নেই। তার টেবিলে রানুর রেখে যাওয়া শিশিটি রয়েছে। রানু বসে আছে। ডিসপেনসারিতে আছে বুড়ি ধাই সারদা। হতাশ বিরক্ত রানু যখন চলে যাবে ভাবে, ধাই বুড়িকে সেই কথা বলতে সে রানুর হাত ধরে ফেলে। আর একটু বস। কম্পাউন্ডার এসে যাবে। বুড়ি বলে, তার হাতেই জন্ম হয়েছিল রানুর। সে-ই খালাশ করেছিল তাকে। জানে রানু তা। বাড়িতেই শুনেছে সে কথা। কিন্তু এর পর বুড়ি যা বলে তার জন্য রানু প্রস্তুত ছিল না। বুড়ি বলছে, রানু তো জন্মাত না, শুধু মেয়েমানুষের জান বলে আসতে পেরেছে। সে আবার কেমন কথা? রানু কৌতুহলী হয়। বুড়ি কথাটা ভাঙতে শুরু করে ধীরে ধীরে। সেই সতের বছর আগে এক দুপুরে এই ডাক্তারখানায় রানুর ঠাকুরদা এল হাঁপাতে হাঁপাতে। কী হয়েছে, না তার তিন মাসের পোয়াতি বউমা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার বোধহয় সব্বোনাশ হয়ে গেল। ডাক্তার আর ধাই ছুটল সেই বাড়ি। দেখল সত্যি। ধাই তো সব বোঝে। ডাক্তার চিকিৎসা করে বাঁচাল বউকে আর তার পেটেরটাকে। কিন্তু হল কেন অমন? ডাক্তারের জেরায় রানুর বাবা গোপনে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, তার চাকরি নেই, বউকে সে পড়াবেও ভেবেছে, এখন সন্তান হলে খুব অসুবিধে হয়ে যাবে ভেবেছিল, সন্তানটিকে নষ্ট করতে চেয়েছিল সে।