সেই বুড়োর সঙ্গে মায়ার কথা হয় একটি দুটি। বুড়োর সঙ্গে মায়া নরম মনে কথা বলে। অস্থিসার সেই বুড়ো একদিন বলে, দিদিকে দেখলে তার ওই ডালিম চারাটির কথা মনে হয়। কোন ডালিম চারা? লেখক লিখছেন, “লম্বা ঋজু একটি মেয়ের সুন্দর দুটো বাহুলতার মতন সুগোল মসৃণ দুটো কাণ্ড আকাশের দিকে একটু খানি উঠে তারপর থেমে গেছে। তারপর কচি কচি ডাল।…।” নতুন গাছ, যৌবন লেগেছে গায়ে। বুড়ো গাছগাছালি, প্রকৃতির মত দেখে যুবতী মায়াকে। মায়ার সঙ্গে কথা বলে ধন্য হয়। মায়াও গোপনে টের পায় বুড়ো তার রূপে মুগ্ধ। তার রূপ দেখে বুড়ো, যেমন দেখে গাছগাছালি, পাখিরা, হাজার পাতার চোখ নিয়ে নিম গাছটি, ফড়িং, প্রজাপতি, কাক, বুলবুলি, শালিক যখন মায়ার হাত দেখছে, পা দেখছে, পিঠ, কোমর, ভুরু, চোখ, চুল, নখ – সে তো রাগ করে না, খুশি হয়। বুড়ো তো তেমনিই কেউ। দেখে, তাই মনে হয় বেঁচে আছে। বুড়ো যেন আয়না। গল্প থেকে শেষটুকু উদ্ধৃত করি, ‘এই জংলা ছিটের সায়াটা আমাকে কেমন মানিয়েছে বলছেন না তো, কেমন দেখাচ্ছে?’
খসখসে গলায় ভুবন হাসল।
‘বলব, বলছি, ওটা পরনে দেখে তখন থেকেই তুলনাটা আমার মনের মধ্যে কেবল নাড়াচাড়া করছে। চিতাবাঘিনী, বনের চিতার মতন চমৎকার সরু ছিমছাম মাজাঘষা কোমর দিদির।’
‘তাই নাকি, ঘরে গিয়ে আয়নায় দেখব তুলনাটা ঠিক হল কিনা।’
‘কেন, আবার আয়না কেন, আমার চোখকে কি দিদির বিশ্বাস হয় না?’…
মায়া বলেছিল, ‘বিশ্বাস করি, তা না হলে কি আর দুপুর রাত্রে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই আয়নার সামনে দাঁড়াই, নিজেকে দেখি, বলুন?’
গিরগিটি গল্প যৌনতার নয়, সৌন্দর্যের। এমন সৌন্দর্যের গল্প আমাদের সাহিত্যে আর নেই। আমরা এমন গল্প পড়তে অভ্যস্ত ছিলাম না। আমরা কাহিনির নানা ঘোরপ্যাঁচে অভ্যস্ত। মনের অতলে প্রবেশ করতে আমাদের খুবই অনীহা। আমরা রূপ-অরূপের খোঁজ রাখিনা, তাই গিরগিটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই সম্পাদককে নিরূপায় হয়ে কিছু অংশ বাদ দিতে হয়। তবু তিনি ছেপেছিলেন সাহিত্যের সত্যকে চিনে। এই কথা তাঁর কাছ থেকে শুনেছি ভারবি থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলেন মূল পাঠ, তাঁর মূল গল্পটি ছাপা হল না এডিট করা অংশ ছাপা হল। হ্যাঁ, এডিট করা গল্প শ্রেষ্ঠ শারদীয়ায় ছাপার পর গেল গেল রব উঠেছিল। অশ্লীল বলে তাঁকে দুষেছিল। এই চিৎকার তাঁর ছিদ্র গল্পের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। খুব লেগেছিল গড়পড়তা পাঠকের। এতটা সত্য কি সহ্য করা যায়! গল্প এগোতে এগোতে যে ওই সব দুর্জ্ঞেয় জায়গায় পৌঁছতে পারে তা আমাদের ধারণার অতীত ছিল। ভারবি প্রকাশিত সেই শ্রেষ্ঠ গল্পটি তিনি স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন আমাদের। বইটি আমার কাছে রয়েছে। কতদিন আগের কথা এসব। বইটিতে কী করে ঘুণ ধরল তা আমি জানিনা। আলাদা করে রেখে দিয়েছি। আমার ঈশ্বরের ছোঁয়া রয়েছে যে।
শতবর্ষে নরেন্দ্রনাথ মিত্র
বাংলাদেশের তরুণ বন্ধু, লেখক স্বকৃত নোমান ফরিদপুর গিয়েছিল নরেন্দ্রনাথ মিত্রর গ্রামে শতবর্ষ উদযাপনে ২০১৬-র ৩০শে জানুয়ারি। সেই উদযাপনে নরেন্দ্রনাথের পুত্র অভিজিৎ মিত্র গিয়েছিলেন আমন্ত্রিত হয়ে। স্বকৃত নোমান আমাকে ছবি পাঠিয়েছিল আন্তর্জালে। সমস্ত রাত ধরে অনুষ্ঠান, গল্প পাঠ, কবিতা পাঠ, স্মৃতি চারণ, আলোচনা নিয়ে শতবর্ষ উদযাপন। সারারাত সেই গ্রাম জেগেছিল। সারা দেশ থেকে বহু সাহিত্য অনুরাগী শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন এই মহৎ সাহিত্যিককে। আমাদের এখানে ২০১৬-য় নরেন্দ্রনাথ একশো বছর অতিক্রান্ত হন এক বিস্ময়কর নীরবতার ভিতর দিয়ে।
আমি আমার কৈশোরে, সদ্য যৌবনে এই বড় লেখককে দেখেছি। একই অঞ্চলে আমাদের বসবাস। তাঁর গল্প পড়ে বড় হয়েছি। যদি লিখতে শিখে থাকি, তাঁকে পড়েই অনেকটা। মাঘে জন্ম নরেন্দ্রনাথের। এই সেই মাঘ মাস। আর তখনো ছিল এই মাঘ মাস, তখনো কোনো এক পল্লীর গাছি মোতালেফ রসের কলসি নামিয়ে আনছে খেজুর গাছ ছুলে। ঘরে রূপসী বউ ফুলবানু, তার হাতে রসের জ্বাল ভাল হয় না। পুড়ে যায় গুড়, ধরে যায়। মোতালেফ ভেবেছিল অমন সুন্দর বিবি, তার হাতের জ্বালে খেজুর রসের গুড়ের স্বাদ কত না সুন্দর হবে। মোতালেফ কী করেছিল, যার হাতে হতো গুড়ের অপূর্ব সোয়াদ সেই অতি সাধারণ, কুরূপা মাজুবিবিকে তালাক দিয়েছিল জীবন রসের ভিয়েন সুস্বাদু করতে। তালাক দেওয়ায় মাজুবিবি চলে গিয়েছিল নাদির শেখের বিবি হয়ে। এক রসের লোভে আর এক রসের কুম্ভ বুঝি ভেঙে দিয়েছিল মোতালেফ। বেওয়া মাজুবিবিকে সে শাদি করেছিল রসের সিজিনে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির জন্য। মাজুবিবি ছিল এই কাজে শিল্পী। তার হাতের গুড় হয় অমৃত। সেইবার গুড় বেচে প্রচুর টাকা লাভ করে মাজুবিবিকে তালাক দিয়ে সুন্দরী ফুলবানুকে ঘরে নিয়ে আসে মোতালেফ। ফুলবানুর পণের টাকা জোগাড় করার জন্যই না মাজুবিবিকে শাদি করা। টাকা উঠে গেলে আর মাজুবিবিকে রাখবে কেন সে? ফুলবানু রূপসী বটে, কিন্তু রস জ্বাল দেওয়ায় আনাড়ি। পরের সনে মোতালেফের গুড়ের খ্যাতি গেল। আগের সনের গুড় আর এই সনের গুড়ে আকাশ পাতাল পার্থক্য। হাটের লোক ছ্যা ছ্যা করতে লাগল। মোতালেফ নিজেও তো শিল্পী। মরমে মরে গেল। ফুলবানুর সঙ্গে তার পীরিতি গেল। শুধু বাহিরের রূপ আর জেল্লা নিয়ে সে কী করবে? সে মাজুবিবির কাছে রওনা হলো। ভিটেয় ফুলবানু বসে কাঁদে। এ এক অপরূপ প্রেমের গল্প। রস-এর মতো গল্প বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। গিয়েছে সেই মাঘ মাস, সেই মাসে গোটা দেশ ছিল উৎসবে মত্ত। রসের কারবারি মোতালেফ মিঞার কথা ভুলে গেলাম আমরা? রসের উৎসব, সাহিত্যের উৎসব, লিটারারি মিট, সেখানে চিত্র তারকা থেকে ইংরেজিতে লেখা কুলীন ঔপন্যাসিকের ভীড় ছিল। চিত্র তারকা তাঁর জীবন দর্শন বলছেন। কেউ কেউ কত বই বিক্রি হয় তার হিসেব কষছেন। এরই ভিতর নিঃশব্দে তিনি ১০০। বড় খারাপ লেগেছিল। এমনই নিঃশব্দে শতবর্ষ পার করেছেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ২০১২-এ। নরেন্দ্রনাথের তাঁর মতো বড় ছোটগল্পের লেখক এই উপমহাদেশে জন্মাননি। আমাদের বিস্মরণ সীমাহীন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে দেখতে দেখতে আমি বড় হয়েছি। ধুতি আর খুব সম্ভবত শাদা আর্দির পাঞ্জাবি পরা নরেন্দ্রনাথকে আমি দেখেছি পাইক পাড়ার দিক থেকে হেঁটে আসছেন বেলগাছিয়ার রাস্তায়, একা একা, নিজ মনে। তাঁর রস, শ্বেতময়ূর, পালঙ্ক, এক পো দুধ, টিকিট, চিলেকোঠা, হেড মাস্টার, চোর, চাঁদ মিঞা, বিলম্বিত লয় – এই সব গল্পের সঙ্গে তখন পরিচয় হচ্ছে ধীরে ধীরে। কত তুচ্ছ ঘটনা, কত তুচ্ছ মুহূর্ত থেকেই না তিনি গল্প বের করতে পারতেন। আর সেই গল্প হত কী অনুভূতিময়। পাঠক আপনি টিকিট গল্পটির কথা স্মরণ করুন। ছেলেটির অভ্যাস প্রতিদিন বাবা বাড়ি ফিরলে টিকিটটি সংগ্রহ করা। ট্রামে টিকিট ফাঁকি দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল বাবা। বাড়ি ফিরে শিশু সন্তানের হাতে ধরা পড়ে যায় ট্রামের টিকিটে দুপয়সা বাঁচিয়ে তৃপ্ত বাবা। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের মনের অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারতেন নরেন্দ্রনাথ। ‘চোর’ গল্পটির কথা মনে করি, অমূল্য সামান্য এক দোকান কর্মচারী। ঘরে নতুন বউ রেনু। অমূল্যর হাত সাফাই-এর অভ্যাস। দোকান থেকে স্নো, পাউডার, চিরুনি নিয়ে আসে লুকিয়ে। বউ রেনু তা পছন্দ করে না। অমূল্য বিয়ের পর রেনুকে নিয়ে কলকাতা দেখাতে কিংবা সিনেমায় যেতে ট্রামের ভাড়া দেয় না ফার্স্ট ক্লাসে চেপে। ঘাড় কাত করে কিংবা আবোলতাবোল গল্পের অভিনয় করে ট্রামের টিকিট ফাঁকি দেয়। রেনুর ভয় করে। যদি ধরতে পারে কন্ডাক্টর? কী অপমানই না করবে। অমূল্য হেসেই উড়িয়ে দেয়। তা আবার হয় নাকি! ফার্স্ট ক্লাসে ওঠাই তো ভাড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য। সেই অমুল্যই তাদের ভাড়াটে বাড়ির দোতলা থেকে রেনুকে কাঁসার বাটি সরিয়ে আনতে উপদেশ দেয়। রেনু লজ্জায় ঘেন্নায় মরে যায়। ওপরের মাসিমার কাছে যায় সে। সেই ফ্ল্যাটের বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসে রেনু। সে কি পারে? অমূল্য যখন তাকে আদর করে, রেনুর গা ঘিনঘিন করে। ইস, অমূল্য কেন ভাল হয় না। এর ভিতরেই অমূল্যর চাকরি যায়। দোকানের বুড়ো ক্যাশিয়ার তার বউয়ের জন্য অমুল্যকে সাফাই করতে বলেছিল স্নো পাউডার, অমূল্য তা না করায় মালিকের কাছে সাতকাহন করে লাগিয়ে সে তার চাকরি খেয়েছে। কী হবে? এই গল্পে অভাবী রেনুই শেষ পযর্ন্ত অমূল্যর পথ অনুসরণ করে উপরতলা থেকে একটি ঘড়ি চুরি করে আনে। অমূল্য বলেছিল বটে, কিন্তু শেষ অবধি যে রেনু তাই করবে, তা সে ভাবেনি। প্রেমের মুহূর্তে রেনুর কঙ্কন-ক্কণিত মৃণালভুজ তার কাছে শ্রীহীন কলঙ্কিত হয়ে যায়। মনের বিচিত্র যে রূপ তা নরেন্দ্রনাথের গল্পে বারবার ঘুরে এসেছে। তিনি শুধুমাত্র কাহিনিকথক ছিলেন না, ছিলেন জীবনদর্শী।