অনেক বছর পরে আমি সেই গল্পটি লিখেছিলাম, ‘বাদশা ও মধুমতী’।
খুবই নিমগ্ন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর লেখা তাঁরই মতো। এখনো মনে হয় তাঁর কোনো পূর্বসুরী বাংলা সাহিত্যে ছিল না। আর তাঁর মতো আধুনিক লেখকও বাংলা সাহিত্যে বিরল। কবি জীবনানন্দের অসম্ভব অনুরাগী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গভীর নিমগ্ন-মর্বিড লেখার সঙ্গে পরে জীবনানন্দের অনুভূতিময় গদ্যের কোথাও বুঝি মিল আছে, কিন্তু সেইসব গদ্য খুঁজে বের করে ছাপা যখন শুরু হয়, তখন তিনি প্রয়াত। সেই গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকের শেষে ‘নদী ও নারী’ গল্প দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। ১৯৭৯-তে প্রয়াণের সময়ও অসম্ভব সক্রিয়। তাঁর গল্পের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতাম। মনে পড়ে কত গল্পের কথা।
রাইচরণের বাবরি ছিল খুব বাহারের। সে একটা দরজির দোকানের মালিক। একটা পা মেসিন, খুপরি ঘর, শিয়ালদার রাস্তা যেখানে বউবাজারের রাস্তায় বেঁকেছে, সে ভীড় জমজম জায়গায় বাবরি দুলিয়ে রাইচরণ সেলাই করে (হ্যাঁ, সেই রাস্তার বাঁক এখন অন্তর্হিত, দৈত্যাকার ফ্লাইওভারবিহীন সেই পুরোন কলকাতা আছে এই সব গল্পে)। বাবরি নিয়ে রাইচরণের খুব গর্ব। তার বাবরি দেখে পাড়া-প্রতিবেশী মুগ্ধ। পথ চলতি মানুষ মুগ্ধ। সেলাই মেসিনে পা চলছে খলিফার, তার মাথার কালো কুচকুচে থাক থাক বাবরি দুলছে। ব্যস্ত-সমস্ত পথচারীর চোখ পড়ে গেলে দাঁড়াবেই। তারপর আলাপ করবার উদ্দেশে ভিতরে প্রবেশ করে হয়তো সেলাইয়ের অর্ডার দেবে। তা হয় ও। বাবরি তাকে খরিদ্দার এনে দেয়। বাবরি নিয়ে এত গর্ব রাইচরণের, কিন্তু তার বউ দেখতে পারে না ওই চিতাবাঘের জঙ্গল। রেগে বলে,বটি দিয়ে চুলের গোড়া সুদ্ধ কেটে দেবে। একদিন সুযোগ পেলে, দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে পুড়িয়ে দেবে। রাইচরণ হাসে। সে বাবরিকে পরিচর্যা করে স্নানের আগে। বাঁ হাতের তেলোয় এতখানি তেল গবগব করে ঢেলে সামনে আরশি নিয়ে আধ ঘন্টা ধরে তেল মাখায় বাবরিকে। মানদা বলে, কী হবে ওই বাবরি দিয়ে, তেল খরচ করে, তার কতদিনের সাধ শশীর বউয়ের মতো একটা স্কার্ট পাড় শাড়ির, হলো কই? রাইচরণ চুপ করে থাকে। সত্যিই তো, তার যদি বাবরি নিয়ে এমন আহ্লাদ থাকে, মানদারই বা ঐ স্কার্ট পাড় শাড়ির শখ থাকবে না কেন? তাদের ছেলেমেয়ে নেই। রাইচরণ জানে তার বাবরি তার দোকানের হাল ফেরাবে। বাবরি তো খরিদ্দার আনে তার দোকানে। হ্যাঁ, তা হয়। একদিন সেই নিরিবিলি দোকানে একটি ফিটফাট বাবু এসে ঢুকল। বাবু অর্ডার দিল না, কিন্তু কথায় কথায় রাইচরণের ঠিকুজি জেনে নিয়ে বলে, এইসব দর্জির কাজ তাকে মানায় না, দোকানে বসে কল চালাতে হিমসিম খাচ্ছে রাইচরণ, অথচ ওই চুল দিয়ে সে দেশজোড়া নাম কিনতে পারে। থিয়েটার কোম্পানির ম্যানেজার লোকটি ১০০ টাকা মাস মাইনের প্রস্তাব দিল তাকে। শুনে রাইচরণ হতভম্ব, তার সাতপুরুষে কেউ যাত্রা থিয়েটার করেনি, সে পারবে না। কিন্তু ম্যানেজার নাছোড়বান্দা। পরেরদিন আসবে বলে গেল।
রাইচরণ যাবে না ঠিকই করেছিল, কিন্তু মানদাকে কথাটা বলেই সে ভুল করল। মানদা বলল, না গেলে রাইচরণ ঘুমোলে তার চুল নিকেশ করে দেবে সে। একশো টাকা কে দেয়? খলিফাগিরি করে কত হয় রাইচরণের? অগত্যা যেতে হয় ১০০ থেকে বেড়ে ১২৫ টাকা মাস মাইনেতে। দোকানে তালা ঝুলিয়ে রাইচরণ গেল। রাইচরণের বাবরির এত দাম তা সে কি জানত? সে থিয়েটার কোম্পানির নতুন এক পালায় এক ডাকাতের রোল পেয়েছে। রাইচরণ ধন্ধে পড়ে। সে তো ডাকাত হয়ে নামে মঞ্চে, কিন্তু সে তো সত্যিকারের ডাকাত নয়? ম্যানেজার বলল, তা হবে কেন, তাকে মঞ্চে উঠে বইয়ের কথা কটা বললেই হবে।
আসলে সব মিথ্যে। ডাকাতের সাজ-পোশাক, কথাবার্তা, লুঠতরাজ—সব। দর্শকও জানবে তাই। তারা শুধু সাময়িক ভাবে ধরে নেবে যেন সত্যি এক ডাকাত তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাইচরণ ছেড়ে এল কাজ। কেন না, তার সবটাই যখন মিথ্যে বলে ধরে নেবে দর্শক, যেখানে সাজ-পোশাক, হাব-ভাব, কথাবার্তা সব মিথ্যে বলে জানবে দশক, বাবরিটা আলাদা ভাববে কেন? ভাববে নিঘঘাত ওটা একটা পরচুলা। তাতে তার সাধের বাবরির মান যায়। বাবরি তার অতি যত্নের। তাকে সে অসম্মান হতে দেবে কেন? ১২৫ টাকা মাস মাইনের দামী কাজ ছেড়ে রাইচরণ ফিরে এল তার সেলাই মেসিনে। ওই টাকার চেয়ে তার বাবরির দাম তার কাছে অনেক বেশি। রাইচরণ কি শিল্পী? শিল্পী তো নিশ্চয়। সে তো রূপ-অরূপ চেনে। চেনে সৌন্দর্য। শিল্প। মনে মনে সে সত্যিকারের আর্টিস্ট। বাবরি তার যত্নে রাখা পরম ভালবাসার জিনিস। সৃষ্ট শিল্প যেন। তার অপমান সে সহ্য করে কী করে?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ছিলেন রূপ আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ এক লেখক। অন্তরের রূপ আর বহিরের রূপ, দুই-এর কথাই বার বার ফিরে এসেছে। আর সেই রূপের সাক্ষী যারা, তারা তো একেবারে ব্যর্থ, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে অসফল মানুষ। আবার গিরগিটি গল্পটির কথা মনে করি না কেন, বুড়োটা প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকে মায়া কখন আসবে কুয়োতলায়। বুড়োটা একেবারে ক্ষিন্ন জীবন যাপন করে, মায়াদের পাশের খোলার ঘরে থাকে। এ বাড়ির উঠোন যেমন ফাঁকা, কুয়োতলাটাও। মায়া চেয়েছিল এমনিই বোধহয়। কুয়োতলার চারদিক, এই উঠোনের এদিক ওদিক নানা গাছগাছালি। বর্ষা ঋতু বলে উঠোনের ডান পাশের নিম গাছটি পাতা ও ফলে ভরে গেছে। পাকা নিমফল একটি দুটি মাটিতে পড়ছে…। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ছিলেন প্রকৃতির রূপ মগ্নও। কুয়োতলায় একা একা স্নান করে মায়া। তার রূপ দেখে গাছগাছালি, পাখিরা, টিয়া বুলবুলিরা। তাতে কি হয়েছে, মায়া এই নির্জন কুয়োতলায় নিরাবরণ হতে পারে। আগে যেখানে ছিল ভাড়ায়, সেখানে পারত না। কুয়োতলায় মেয়েদের কি ভিড়। সেখানে একটি মেয়ের গা থেকে কাপড় সরে গেলে অন্য মেয়েরা সন্দেহভরা চোখে দেখত। মায়া এই নির্জন কুয়োতলায় নিরাবরণ হয়ে সুখে গায়ে জল ঢালার পর আচমকা টের পায় শুকনো পাতার উপর দিয়ে কে যেন হেঁটে আসে। একটা হাড়ি হাতে করে বুড়ো ভুবন সরকার অদূরে পেয়ারা গাছের গা ঘেসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পাঁকাটির মত সরু জিরজিরে হাত-পা, শুকনো খটখটে ক’খানা পাঁজর, শনের মত পাকা একমাথা লম্বা রুক্ষ চুল ও হলদে ফ্যাকাশে চোখ… এমন যার চেহারা, সে যদি কখনো মায়ার ধারে কাছে আসে, কি পাশ কাটিয়ে চলে যায়, পুরুষ বলেই মনে হয় না। মনে হয় মৃত নিষ্প্রাণ সহস্র ক্ষতচিহ্নযুক্ত মাদার গাছটি।