শুনতে শুনতে ‘সামনে চামেলি’ গল্পের কথা, তা থেকে ‘রাইচরণের বাবরি’ গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, একটা কথা না বললে নয়, কলেজ স্ট্রিটে ৫০ বছরের পুরনো প্রকাশকের ঘরে যখন দেখি না বিক্রি হওয়া পুরনো বই-এর ধুলো, আচমকা তাঁর ‘ছাতা’ গল্পটি মনে পড়ে যায়। সেই ভাগীরথি প্রকাশনী, ঠিক দুপুরে খরিদ্দার নেই দোকানে, তখন ‘মেঘলা আকাশ’ বই-এর লেখকের আগমন। বই তার চলেই না। প্রকাশনীর কর্মচারীর পুরনো ছাতা নিয়ে এই অসামান্য গল্প…। আমি দেখতে পাই মন-গহনে বিচরণ করা সেই লেখককে। বাণিজ্যিকভাবে অসফল এক লেখকের কথা ছিল সেই গল্পে। কিন্তু গল্পটি তাঁর নয়, গল্পটি সেই ভাগীরথি প্রকাশনীর কর্মচারী গোলকের। গোলকের নয়, তার ছাতার। ছাতাটি বহুকালের পুরনো, কতবার যে রিপেয়ার হয়েছে, তার বাঁট, তার কাপড়, এটা ওটা কতবার যে বদলেছে গোলক তার কোনো ঠিক নেই। এই ভাবে বদলাতে বদলাতে আসল ছাতাটি আছে কিনা সন্দেহ। সেই ছাতা গোলকের প্রাণ। ছাতা নিয়েই বই পাড়ায় সে পরিচিত। বই-এর বিক্রিবাটা নেই, নিঝুম বসে আছে গোলক। তখন লেখক মুরারি মাইতি ধানবাদ থেকে এসেছেন আট বছর আগে ছাপা তাঁর মেঘলা আকাশ নামের বই-এর খোঁজ নিতে, কতটা বিক্রি হল, নতুন বই আবার ছাপবেন কিনা প্রকাশক। লেখক ভাল ব্যবহার পান না গোলকের কাছে, কত নামী দামী লেখকের বই বাজারে কাটছে না। শহর, বইপাড়া অশান্ত, মিটিং মিছিল লেগেই আছে। বোমা পড়ছে সবদিনই প্রায়। সেই সময়, ১৯৭০-৭১ এর কলেজ স্ট্রিট আর বইপাড়ার চেহারাটি রয়েছে গল্পে। লেখক বই-এর খোঁজ নিচ্ছেন, তখনই বাইরে ভীষণ শব্দ, বোমা পড়ল বোধহয়। কৌতুহলে ছুটে বেরিয়ে গেল গোলক, তেমন হলে তো ঝাঁপ বন্ধ করতে হবে। না, টায়ার ফাটার শব্দ। গোলক খবর নিয়ে ফিরে এসে দেখে লেখক নেই। বুকটা ধক করে উঠল। সে দেওয়ালে ঝোলানো তার শার্টের নীচে রাখা সেই পুরনো ছাতাটি দেখল আগে। আছে কিনা, না লোকটা নিয়ে গেল। ধুলিমলিন মেঘলা আকাশ, আর সব না কাটা বই-এর চেয়ে গোলকের কাছে বহুবার রিপেয়ার করা ওই ছাতাটির দাম বেশি।
পুস্তক প্রকাশনীতে যেতেন কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়। সেই সময় তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশ করেছিলেন কনকবাবু। তখন আমি সদ্য চাকরি পেয়ে দূর পশ্চিম সীমান্ত বাংলা – মেদিনীপুর, বিহার আর ওড়িশার সংযোগস্থলে গোপীবল্লভপুর থানার এক গ্রামে। কলকাতায় এলে আর ফিরতে ইচ্ছে হয় না। ফেরার দিন সন্ধেয় বঙ্গ বিহার ওড়িশার সংযোগস্থল জামশোলা ব্রিজে নেমে প্রবেশ করতে হত ভিতরে। আমি কলকাতায় বেড়ে ওঠা যুবক, আমার ওই যে যাওয়া আর সেই আদিবাসী অধ্যুষিত এই গল্প অগ্রজ আর বন্ধুদের কাছে করতাম ফিরে এসে। একদিন পুস্তক প্রকাশনীতে গিয়ে দেখি তিনি। কী আশ্চর্য! বসে আছেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। কনকদা পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রণাম করে তাঁর মুখোমুখি। তাঁর পুত্র তীর্থংকরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সদ্য। পরে হয়েছিলাম অভিন্ন হৃদয়। সেই তো প্রথম দেখা। সেই তো কথা বলা। তাঁর আনেক গল্প তখন পড়া হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেই ‘ছিদ্র’ গল্পটি নিয়ে খুব আলোড়ন হয়েছিল। অশ্লীল অশ্লীল বলে সাহিত্যের কিছু গার্জেনরা গোলযোগ শুরু করে দিয়েছিলেন। গিরগিটি গল্প নিয়েও তাই হয়েছিল। ক’দিন আগে পুজো সংখ্যায় পড়েছি ‘সামনে চামেলি’ নামের এক আশ্চর্য সুগন্ধে ভরা গল্প। সুগন্ধের কথা বললাম, তাঁর লেখার ভিতরে বর্ণ, স্পর্শ, গন্ধ – সব পাওয়া যায়। সামনে চামেলিও ছিল এক ব্যর্থ মানুষের গল্প। বিষাদময়। কিন্তু তার ভিতর থেকেও বুঝি এক সুগন্ধ বেরিয়ে আসে।
“সেই একটা রাস্তা। ভারি সুন্দর। আপনারা দেখেছেন কি! খুব নির্জন। হয়ত দেখেছেন, মনে নেই। তার মানে যতটা মন দিয়ে দেখার দরকার, ততটা মন ছিল না। যে জন্য রাস্তাটা ভুলে গেছেন। এই হয়। কেন না চলতে চলতে দেখা, আর দেখবার জন্য থমকে দাঁড়ান এক কথা নয়। (সামনে চামেলি)”
সে ছিল একটা নির্জন রাস্তা আর সেই রাস্তায় ক্রাচ বগলে সে হাঁটে। দুঃখী, বঞ্চিত আর ব্যর্থ মানুষের কল্পনা আর আকাঙ্খার গল্প। খুব বড় লেখক, আমার পিতৃতুল্য লেখক জিজ্ঞেস করতে লাগলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তখন তিনি শিশুর মতো। আমরা যারা ওই পুস্তক প্রকাশনীতে যেতাম, শচীন দাস, সমীর চট্টোপাধ্যায়, কখনো কবি তুষার চৌধুরী এবং পবিত্র মুখোপাধ্যায় – সকলেই তাঁকে পড়েছেন। তাঁর নানা লেখা নিয়ে আমাদের নানা কৌতুহল নিরসন করতেন হয়ত কখনো, কিন্তু বারবার প্রসঙ্গান্তরে চলে যেতেন। আমার মনে আছে আমি তাঁকে শুনিয়েছিলাম আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতার কথা। গ্রামীণ যাত্রাদল আসছে শীতের ধানকাটা মাঠ ভেঙে, সুবর্ণরেখা নদী পার হয়ে। হিরোইনের কোলে দুধের বাচ্চা। কোন ভোরে বেরিয়েছে ধ-ডাংরি যাত্রাদল। বেলা বারোটার পর এসে পৌঁছল। হিরোইনের মাথার চুলে খড়কুটো, বাচ্চা কাঁদছে। রাস্তার দুপারে দাঁড়িয়ে গাঁয়ের চাষাভুসো মানুষজন দেখছে তাকে। কে যেন হেঁকে উঠে ডাকল আমাকে, হিরোইন হিরোইন দেখুন স্যার… তিনি মগ্ন চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। আমি কুণ্ঠিত গলায় বললাম, আপনি এইটা নিয়ে লিখবেন?
হাসলেন তিনি, বললেন, ‘তুমি দেখেছ, অনুভব করেছ, তুমি লিখতে চেষ্টা করো, আমি তো এসব দেখিনি।’