থাকো পিসি থাকো, গাঙ আছে কিন্তু ইস্টিমার নেই, গাঙ মজি গেছে, তবু থাক, বস পিসি বস।
রাধারানি নিজের বাপের বাড়ি ফিরলেন। বাড়ির পিছনে সেই পুকুর। কী টলটলে জল! ঘাটে বসে চোখের জল ফেলতে লাগলেন রাধারানি। আমি ছোটমামা শিব- প্রসাদকে ফোন করেছি সেখান থেকে। গলা জড়িয়ে গেছে ইন্ডিয়ার এবং বাংলাদেশের। কথা আটকে গেছে দুজনেরই। দূরে কপোতাক্ষ। গতিহারা। ম্লান মুখ। মাকে সেই শীর্ণ কপোতাক্ষ ফিরিয়ে দিয়ে আমি ফিরে এসেছি।
স্বাধীনতার জন্ম
আমাদের উত্তর পুবে করদ রাজ্য কোচবিহার ছিল ব্রিটিশ ভারতের বাইরে। কোচবিহার রাজ্য ছিল স্বাধীন রাজ্য, যদিও সামরিক ক্ষমতায় ব্রিটিশ ভারতের মুখাপেক্ষী। ভাল টাকা রাজস্ব দিতে হতো ব্রিটিশ সরকারকে। কোচবিহারের মহারাজার ১১১ গ্রাম ছিল ব্রিটিশ ভারত, রংপুর জেলার ভিতর, আর ব্রিটিশ ভারতের, রংপুর কালেক্টরের ৫১টি গ্রাম ছিল কোচবিহার রাজ্যের সীমানার ভিতরে। র্যাডক্লিফ সায়েবের বাউন্ডারি কমিশন এই নিয়ে মাথা ঘামায়নি ১৯৪৭-এ। কোচবিহার ভারতের অনুকূলে মত দেয় ১৯৪৯-এ এর সেপ্টেম্বরে, আর ১৯৫০-এর ১লা জানুয়ারি থেকে কোচবিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়, পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা। আইনত কোচবিহারের সমস্ত ভূসম্পত্তি ভারত হয়ে যায় সেই দিন থেকে। সেই থেকেই মনুষ্যত্বের অপমান পোক্ত হয়ে বসে এপার ওপারে। দেশের ভিতরে বিদেশ এই স্বত্তের জন্ম হলো। রংপুর পাকিস্তানে গেল, তাই এপারে কোচবিহার রাজ্যের সীমানার ভিতরে থাকা রংপুর কালেক্টরের ৫৩ মৌজা পাকিস্তান হলো। কোচবিহার ভারত হলো, তাই ওপারে কোচবিহার রাজার ১১১টি মৌজা ভারত হলো। এক দেশের ভিতরে আর এক দেশ। আসলে এই ছিটমহলবাসীর সত্যিকারের কোনো দেশই ছিল না। গত ১লা আগস্ট ২০১৫ ভারতের ভিতরের ৫১টি গ্রাম, বাংলাদেশের ভিতরে ১১১টি গ্রাম সত্যিকারের দেশ পেল। আর দুটি ছিটমহল,ভারতের ভিতরের দুটি গ্রাম, মেখলিগঞ্জ মহকুমার অঙ্গারপোতা, দহগ্রাম ১৯৯২-এ করিডোরে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সেই করিডোর তিনবিঘা যেমন ছিল তেমনই আছে। ১৯৭৪ সালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও সদ্যজাত রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান চুক্তি করেছিলেন ছিটগুলির বাস্তব সম্মত বিনিময়ের। সেই চুক্তি এতকাল বাদে বাস্তবায়িত হলো। ৩১শে জুলাই মধ্যরাতে, রাত বারোটায়। আমি সেই বিরল মুহূর্তের সাক্ষী হলাম।
আমার জন্ম ১৯৪৭-এর পর। আমি ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইটের কথা শুনেছি, দেখিনি। ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে দিল্লির লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলেছিলেন জওহরলাল নেহরু। আমার যৌবনকালে বাংলাদেশের জন্ম দেখে- ছিলাম। পাকিস্তান ভেঙে জন্ম হয়েছিল নতুন রাষ্ট্রের। সেও ছিল মুক্তি সংগ্রাম। স্বাধীনতার যুদ্ধ। বাংলাদেশ আমার পিতৃপুরুষের দেশ, তাই বাংলাদেশের জন্ম আমাকে উদ্বেলিত করেছিল সত্য। কিন্তু সে দেশ তো আমার দেশ নয়। আমার দেশ এই ভারত। ভারতের ভিতরে একট অংশ, সবর্মোট ৭০০০ একরের মতো টুকরো টুকরো ভূখণ্ড স্বাধীনতা পেল এই ২০১৫’র ৩১শে জুলাই মধ্যরাতে। সেই মহৎ ঘটনার দিন আমি মধ্য মশালডাঙা ছিটমহলে উপস্থিত ছিলাম। স্বাধীনতা কেমন, তা পরাধীন না থাকলে অনুভব করা যায় না। পরাধীনতা মানে মানে রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তির নাগরিকত্বর কোনো দাম নেই। রাষ্ট্র সেই ব্যক্তিকে ঘৃণার চোখে দ্যাখে। রাষ্ট্র তাকে ভিনদেশি বলে দাগিয়ে দিয়ে জেলখানায় ভরে দেয় কিংবা ঠেলে দেয় সীমান্তের ওপারে অচেনা বাংলাদেশে, পুশব্যাক যার আইনি নাম। ছিটমহলের বাসিন্দাদের সেই আতঙ্ক সেই ঘৃণাই সহ্য করতে হয়েছে এতকাল। সে কেমন ঘৃণা কেমন আতঙ্ক? মশালডাঙায় যে স্বাধীনতা উৎসব হলো ৩১শে জুলাই বিকেল থেকে, সেই উৎসবে সেই সব দিনগুলির কিছু কিছু ঘটনার কোলাজ প্রদর্শিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা বর্ণনার মধ্য দিয়ে। বলব তার কথা।
৩০শে জুলাই দুপুরে তিস্তা-তোরসা এক্সপ্রেস ট্রেনে রওনা দিয়েছিলাম আমি ও আমার তরুণ বন্ধু জয়জিৎ কোচবিহারের উদ্দেশে। কোচবিহার থেকে দিনহাটা। দিনহাটা একটি সীমান্তবর্তী মহকুমা শহর। এই মহকুমার ভিতরের ৫১টি ছিটের ১৯টি রয়েছে। আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি এখানে ছিটমহলের কৌতুহলেই। এক রাষ্ট্রের ভিতরে আর এক রাষ্ট্র কী ভাবে থাকে সেই কৌতুহলেই আসা বার বার। আসলে আরো স্পষ্ট করে বলতে হলে, এক রাষ্ট্রের ভিতরের কিছু মানুষ ভিনদেশি বলে পরিচিত হলে কী হয় তাদের, তা জেনে নিতেই বার বার আসা। স্বাধীনতা হলো সেই কিম্ভুত অবস্থার অবসান। সকালে দিনহাটা পৌঁছে ছিটমহল বিনিময় সমিতির দীপ্তিমান সেনগুপ্তকে ফোন করতে সে বলল, বিকেলে বের হতে হবে দাদা, ফিরতে রাত একটা হবে। আজ জাতীয় পতাকা তোলা হবে মশালডাঙায়। মশালডাঙাতেই কেন্দ্রীয় ভাবে স্বাধীনতা উদযাপন করা হচ্ছে। তা যে হচ্ছে সে আমি জানতাম, আমার ফেসবুকে মশালডাঙার জয়নাল আবেদিন মেসেজ করেছিল মশালডাঙাতে আসতে। উঠেছি মহকুমা শাসকের বাংলো অনন্যায়। পুরোন বন্ধু দমদমের শীতল বসু সেখানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ঘটনাচক্রে এবারই তা জানলাম। আগেও ছিলাম যখন, জানতাম না শীতল বসু সেখানে আছেন। অনন্যায় তরুণ সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অনুপ চন্দের সঙ্গে দেখা। অনমিত্র ছিটমহলের এপার ওপার জানেন। বাংলাদেশ জানেন। আমি যাঁদের চিনি তাঁদের চেনেন। সকালটা গেল ছিটমহল চর্চায়। কেন ওপারের মানুষ এপারে আসছে না। কেন এপারের মানুষ ওপারে যাচ্ছে না। ওপার থেকে যদিও হাজার জনের মতো আসছে এপারে, এপার থেকে একটি মানুষও ওপারে যাচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে ওপারের মানুষকে নাকি আসতে দেওয়া হচ্ছে না। কেন আসতে দেওয়া হবে না তা অবোধ্য। মানুষ চলে আসবে, জমি পড়ে থাকবে, তাহলে না আসতে দেওয়ার কারণ? এমনিতেই জমি দখলের জন্য মানুষকে জমি থেকে উৎখাত করাই যখন স্বাভাবিক প্রবণতা, তাহলে এই সুযোগে তো একটু ভয় দেখিয়েই বহু সংখ্যালঘুকে আইন সম্মত উপায়েই ওপার থেকে এপারে পাঠিয়ে দেওয়া যেত। তা হতে দেননি ওদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। আর মানুষও চায়নি ছিন্নমূল হতে। যে সমাজ আর আত্মীয়স্বজন নিয়ে বসবাস করছে তারা এতকাল ধরে তা ত্যাগ করে অজানা দেশ ভারতে আসতে চায়নি। ঠিক ওই কারণেই এপারের মানুষ, যাঁদের বড় অংশ সংখ্যালঘু তাঁরা কেউ এদেশ ছেড়ে না গিয়ে আগের নাগরিকতা ত্যাগ করে ভারতীয় হয়ে গেছেন। এই স্বাধীনতায় ছিটমহলের মানুষকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কে কোন দেশের নাগরিক হবে তা জানাতে। প্রথমে ১লা জুলাই থেকে ১৬-ই জুলাই পর্যন্ত, পরে তা ৩১শে জুলাই অবধি বর্ধিত হয়েছিল। এই রক্তপাতহীন স্বাধীনতা, ছিট বিনিময় হয়েছে অহিংস আন্দোলনে। মানুষের নীরব প্রতিবাদে। হ্যাঁ, এই পতাকা তো এই প্রথম ওঠেনি। এপারের বাংলাদেশি ছিটমহল মশালডাঙা বা অন্য ছিটমহলে ভারতের পতাকা উঠেছে এর আগেও। গত ২৬শে জানুয়ারি, আগের বছর ১৫-ই আগস্ট। এইসব ছিটের মানুষ বিনিময় চুক্তি অনুসারে ভারত হতে চাইছে যে তা জানাতেই ওই পতাকা উত্তোলন। আর গত ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে, যেদিন ছিল বাংলা দেশের বিজয় দিবস, সেদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ১১১টি ছিটমহলে ছিটের মানুষ বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে ছিট বিনিময়ের দাবিতে। স্লোগান দিয়েছিল, “ইন্দিরা মুজিব চুক্তি, ছিটবাসীর মুক্তি”। আমি সেদিন তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার (সাবেক রংপুর জেলার মহকুমা, এখন জেলা) ভুরুঙ্গামারী থানা সংলগ্ন দাশিয়ারছড়া মৌজায়। দেখেছিলাম,‘আমাদের একটি দেশ চাই’ এই আর্তিই ফুটে বের হচ্ছে সেই বাংলা দেশের ভিতরে ভারতের সেই গ্রামের মানুষের চোখে মুখে। স্ট্যাটাসে তখন সেই মস্ত গ্রাম বাংলাদেশের ভিতরে ভারত। তার থানা দিনহাটা।