জলিল জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কালী সেন, বিশ্বেশ্বর সেনরা কি বেঁচে আছেন? রামকৃষ্ণ ধরের “ফেমিলি” কেমন আছে? কত সব নাম উচ্চারণ করতে লাগলেন। শুনতে শুনতে রাধারানির চোখে জল। রাধারানি কাঁদছেন। আব্দুল জলিল এসে এঁদের পেয়েছিলেন প্রতিবেশী হিশেবে। তারপর সেই সব প্রতিবেশীরা একে একে গ্রাম ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। জলিলের খুব মনে পড়ে? আমার সেই সব জেঠাদের ‘ফেমিলি’ কেমন আছে? সুশীল মিত্তির, স্মরজিৎ মিত্তির, সন্তোষ মিত্তিরদের ছেলে মেয়েরা? কথা যেন ফুরোয় না জলিলের। হাঁ করে শুনছে সিদ্দিক। কেউ নেই। গ্রাম শূন্য করে চলে গেছে সবাই। আমরা চললাম সুপুরিঘাটার দিকে। বেতনার সেই ঘাটে নববধূ রাধারানি নেমেছিলেন প্রথম। ঘাটেই হিন্দু মুসলমান নারীরা, এজার শানা মোজার শানার মা দিদিরাও উলুধ্বনি দিয়েছিল। হেমনলিনীর ছেলে হাজুর বউ আসছে। হাজরা ঠাকুরের কৃপায় ছোটবেলায় বেঁচে গিয়েছিল অশোক। তাই তার নাম হাজু। সব জানে রাধারানি। মনে পড়ে যেতে রাধারানির চোখে জল। আমার পিঠে তুহিনের হাত। আমার হাত ধরেছে শুভ্র। এখন আর নদীঘাট নেই। পাকা ব্রিজ হয়ে গেছে। আমরা রওনা হলাম আমার মাতুলালয় বাঁকা ভবানীপুরের উদ্দেশে। আগে কপোতাক্ষতীরের সেইসব গ্রাম, বাঁকা, রাঢ়ুলি কাটিপাড়া, পাইকগাছা, কপিলমুনি, আমাদী থেকে নদীপথই ছিল পথ। স্টিমার-লঞ্চ ধরে বেরতে হতো গ্রামের বাইরে। এখন রাস্তায় রাস্তায় জুড়ে গেছে সব। পথের বাঁধা নদীর এপার ওপার সেতুতে সেতুতে জুড়েছে। মাঝে গাড়ি থামল বুধাহাটা বাজারে। চা খাওয়া হলো। বুধাহাটার নাম কত শুনেছি মায়ের কাছে। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আমি বুধাহাটা থেকে ফোনে ধরেছি ছোটমামাকে। মামা আমি বাঁকা যাচ্ছি। সে কী আবেগ শিবপ্রসাদ বসুর। কত কথা। তারপর বললেন, কেন যাচ্ছিস? কিছুই নেই। কেউ নেই। আবার রওনা হলাম। গাড়ি ছুটেছে চমৎকার রাস্তা দিয়ে। দুপাশে বিল জমি। মাছের ঘেরি। জল আর জল। আবার কোথাও বিস্তীর্ণ ক্ষেতে ধান পেকেছে। খেজুর গাছ কাটা হয়েছে। কলসি এখনো ঝোলেনি। রাধারানি চলেছে তার বাপের বাড়ি। বিষাদে ভরা মুখ। চশমার কাচের আড়ালে চোখ ছলছল। কার কাছে যাবে সে? আমি মাতুলালয় দেখিনি। মায়ের কাছেই যা শোনা সেই হারানো নদী হারানো গ্রামের গল্প। স্টিমারের ভোঁ বহুদিন থেমেছে। আমরা ঘন্টা দেড় বাদে বুঝি পৌছেছি বাঁকা বাজারে। কেন এলাম মা? মাতুলালয় শূন্য। কালী সেন বিশ্বশ্বর সেনদের মতো সবাই চলে গেছে ইন্ডিয়া। পড়ে আছে ভিটা কিন্তু অন্য মানুষ। পিয়াস মজিদ জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, কেউ আছে মামাবাড়িতে?
মাথা নেড়েছি। কে থাকবে? আমার মামারা মাসিরা সব ইন্ডিয়ায় গিয়ে খুব কষ্ট করে বেঁচেছে। দাঁড়িয়েছে। আবার এখনো দাঁড়াতে চাইছে। খুঁজছি সেই বোস বাড়ি। অবিনাশ বোস। জমিদার ছিলেন। মামাদের বড় শরিক। আমি কোনোদিন আসিনি এই গাঁয়ে, বাড়িটা দেখিয়ে দেবেন ভাই। অবিনাশ বোসকে কে না চেনে। তিনপুরুষ আগের মানুষ। তাঁদের দান ছিল গ্রামে। বিরাজ সাগরের জল যে এখনো খায় গ্রামের মানুষ। ওই পুকুরে মাছ নেই। শুধু তৃষ্ণার জল। এসব বলতে বলতে দোকানি মুকুল বললেন, রাতুল বোস তো থাকে এখানে। কে রাতুল বোস? আমাদের গাড়িতে কামাল হোসেন নামের যুবক উঠেছে বাড়ি দেখিয়ে দিতে। প্রাচীন হয়ে আসা দুতলা দুটি দালান সমুখে। ডানদিকে। বাঁয়ে কপোতাক্ষ আল বেঁধে মাছের ঘেরি। নদীকে এইভাবে হত্যা করা হয়েছে আমাদের দেশেও। ইছামতির এই হাল হয়েছে অনেক জায়গায়। আমি অবাক হয়ে দেখছি। সেই নদী? প্রমত্ত নদী। ভোরে প্রথম ইস্টিমার। আমার যে সব জানা। শুভ্র বলল, ড্রেজিং করে কপোতাক্ষকে আবার বাঁচানো হচ্ছে। কাজ চলছে। মাইকেলের নদী যে কপোতাক্ষ। প্রথম বাড়ি রেখে দ্বিতীয় বাড়ির বারান্দায় উঠেছি। দেওয়ালের প্লাস্টার খসা। জানালার খড়খড়ির সবুজ রঙ মলিন হয়ে গেছে। জানালায় এক প্রবীণার মুখ। আমি তাঁকে চিনি না। রাতুল হলো পিন্টু বোসের ছেলে। পিন্টু মামা মন্টু মামাদের দেখেছি ছোটবেলায়। মায়ের জ্যাঠতুতো ভাই। তাঁদের বাড়ি এপারে ছিল আমহারস্ট স্ট্রিট-ফকিরচাঁদ মিত্র স্ট্রিটে। মস্ত অট্টালিকা সেখানেও। কিন্তু তাঁরা তো ওপারেই আছেন। এপারে কী করে থাকবেন? কিন্তু আছেন। তাঁদের একজন আছেন এখানে? সত্যি! কেউ আছে? রাধারানি এই দ্যাখো পিন্টুমামার বউ, আমার মামি জানালায় দাঁড়িয়ে। উনি কি আমাকে চিনবেন। দুচোখে বিস্ময় আর চাপা ভয়ও। আমি বারান্দায় উঠতে উঠতে বলছি, মামি আমি রানিদির ছেলে, রানিদি গো, রাধারানি, বেলগেছিয়ার রানিদি। রানিদি! আমার বাবা অশোক মিত্র!
মনোজ মিত্তির আপনার বড় ভাই? রানিদিরে আমি দেখিনি কোনোদিন, বলতে বলতে তিনি জানালা থেকে সরে বাইরে এলেন। মোবাইলে ডাকতে লাগলেন রাতুলকে। সে বাজারেই আছে। রাধারানি বললেন, আমিও তোমারে দেখিনি বউ, তোমারে দেখতি এতদূর আসা। কেউ নেই ভেবে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ভোমরা সীমান্ত থেকে তা যে এইভাবে নাড়ু, চন্দ্রপুলি, তক্তি, সন্দেশ, দধিতে পুণ্য হবে কে জানত? রাতুল এল। লুঙ্গি আর শার্ট পরিহিত রাতুল আমাকে দেখাল আমার মামার বাড়ি। পেছনদিকে। শহর আলী গাজির পুত্ররা কিনেছিল অন্য দুই শরিকের অংশ। অবিনাশ বোসের অংশ, বড় অংশ পড়ে ছিল। রাতুল ওদেশে ফিরে গেছে ইন্ডিয়ায় এসে কিছু না করতে পেরে। নিজের দেশ তো। নিজের গ্রাম। রাধারানি বললেন, আমিও থাকি রাতুল?