হ্যাঁ, সাতক্ষীরের কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানের মধ্য থেকেই আমাকে তুলে নিয়েছেন প্রবীন শিক্ষক আনিসুর রহিম। ফিরদৌস জান্নাত নজৌলার মামা। ভাগ্নী খবর দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। তাঁরা আসলে বর্ধমানের লোক। ১৯৪৫-এ তাঁর বাবা চাকরিতে বদলি হয়ে সাতক্ষীরে আসেন। আর ফিরে যাননি। তিনি আমাকে প্রাণনাথ ইন্সটিটিউশনে নিয়ে গেলেন। বাবার ইস্কুল। ১৫০ বছর হয়ে গেছে। জমিদার প্রাণনাথ চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠা করা বিদ্যালয়। দুপুরে বৃষ্টির ভিতরেই আমাকে তিনি দেখালেন প্রাণসায়র। লম্বা সায়র। এই সায়রের ধারে হেমচন্দ্র ঘোষের বাড়ি ছিল। তিনি আমার ঠাকুমার ভাই। খুঁজলাম। পাত্তা করতে পারিনি। সে আমলের কাউকে যদি পাওয়া যেত! কোনো চিহ্ন পড়ে নেই। কাল স্রোতে ভেসে গেছে সব। অথচ কত লোকের সঙ্গে দেখা হলো যাঁদের আত্মীয় স্বজন এপারে, ধান্যকুড়িয়া, হাবড়া, সোলাদানা, টাকি। যাতায়াত আছে। তাঁরা কেউ বলতে পারলেন না হেমচন্দ্রের বাড়িটি কোথায় ছিল। কতকালের কথা এসব, আর কি খুঁজে পাওয়া যায়?
আমাদের ভিটেমাটি আর আত্মজনের খোঁজে যে যাত্রা, তার সঙ্গী তৃপ্তিমোহন। তুহিন ও শুভ্র আছে। অরিন্দম আছে। আছে কুমিল্লার পুত্র তরুণ কবি পিয়াস মজিদ আর তার বন্ধু বাবু। এই যাত্রা ছিল সেই মধ্যরাতের ডাক। আগের দুদিন ছিল অকাল বর্ষণে বিমর্ষ। আমরা ভোমরা সীমান্তে মেঘ মাথায় নিয়ে ঢুকেছিলাম। তারপর থেকে দুদিন বর্ষণে কেটেছে। ধূলিহর বা ধুরোল যাত্রা শুরু উজ্জ্বল দিনে। তৃপ্তিমোহনকে যখন বলেছি, ব্রহ্মরাজপুরে আমার মাসির বাড়ির কথা। না তারা কেউ থাকে না। প্রকাশ চলে গেছে ১৯৯১-এ। বি.এন.পি-র শাসনকালে। তাহলে পশুপতি ঘোষ আপনার? মেসো মশায়। তৃপ্তিমোহন খুব চেনেন। কাকে না চেনেন? মাসতুতো ভাই প্রকাশ ঘোষকে ভালই চিনতেন। সে কেন চলে গেল দেশ ছেড়ে? জমিজমা পড়ে আছে এখানে সব। তৃপ্তিমোহন জিজ্ঞেস করলেন, প্রকাশ খুব কষ্ট করেছে ওপারে গিয়ে, শুনেছি তাই।
হ্যাঁ তাই। সে ২০০১ না ০২ সালে দেশত্যাগ করে সুজন-বন্ধুদের না জানিয়ে। উপায় ছিল না। সেই সময়ের গভীরে ভয়ানক সাম্প্রদায়িকতা ছিল। ওদেশ ছেড়েছিল তখন অনেক হিন্দু।
তারাপদ মিত্রকে চিনতেন? আমি জিজ্ঞেস করেছি তৃপ্তিমোহনকে।
খুব চিনতাম। তৃপ্তিমোহন জিজ্ঞেস করলেন, তারা ডাক্তার কে হতেন আপনার?
তিনি আমার কাকা। চিকিৎসক ছিলেন। বিমর্ষ হলেন তৃপ্তিমোহন তিনি বেঁচে নেই শুনে। বেঁচে থাকলে নব্বই পেরিয়ে যেতেন ঠিক। সাতক্ষীরে পোস্ট অফিসের মোড় থেকে রাস্তা বাঁ দিকে ঘুরে গেছে ধূলিহরের পথে। পাকা রাস্তা। ২০০০ সাল আর ২০১৬-য় অনেক তফাৎ। পথের দুপাশে দোকানপাট। ইস্কুল। কলেজ। ট্রেনিং সেন্টার। সাতক্ষীরে চলল অনেকটা। তারপর সবুজ বনানী দুপাশে। ব্রহ্মরাজপুর ধূলিহর গায়ে গায়ে। ধূলিহরের ভিতরেই বুঝি ব্রহ্মরাজপুর ঢুকে আছে। পশুপতি ঘোষের বাড়ি জমিদারের অট্টালিকা। রাস্তা থেকে দেখা যায়। কেউ নেই। সব রেখে প্রকাশ ওপারে গিয়ে শ’মিলে কাজ নিয়েছিল। আমি তাকে গিয়ে যেন বলি একবার ঘুরে যেতে। তৃপ্তি মোহন, লেখক খায়রুল বাশার, সাংসদ লুৎফুল্লা মুস্তাফা সকলে আমাকে বলেছেন কদিন ধরে। সব ফেলে দিয়ে যে চলে গেছে, তার সব মায়া চলে গেছে যে তা বলতে পারি না। কিন্তু আর ফিরবে না সে। আমাকে প্রকাশ বলেছে, আর ফেরা যায় না।
ব্রহ্মরাজপুর বাজার বেশ বড়। জমজমাট। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। খাড়া হাতে অন্নদাচরণ। তৃপ্তিমোহন আমাকে সব দেখাবেনই। ঐ যে কাল- ভৈরবের মন্দির। টিনের চালা দেখলাম দূর থেকে। আমি বললাম সুপুরিঘাটা যাব। সুপুরিঘাটায় নৌকো থেকে যে নবদম্পতি নেমেছিল বিবাহের পর, তাঁরা আমার জনক জননী। মায়ের বাপের বাড়ি ছিল কপোতাক্ষ তীরে বাঁকা ভবানীপুর। সুপুরিঘাটার বেতনা নদী গিয়ে পড়েছে নদ কপোতাক্ষয়। মায়ের কাছে শোনা কথাই আমি বলছি। সুপুরিঘাটার আগে আমাদের বাস্তুভিটে। মাটির বাড়ি। এই অঞ্চলে পশুপতি ঘোষ ব্যতীত পাকা বাড়ি ছিল কোথায়? আগের বার, সেই ২০০০-এ সিদ্দিক ছিল না। মহম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিক মোড়ল। ১৯৬২ সালে সিদ্দিকের বাবা শুকুর আলি মসলন্দপুর থেকে এখানে আসেন। তাঁরা অন্নদাবাবুদের ভিটেয় আছেন। তবে সেই ভিটের কিছুটা আছে, সবটা নেই মনে হয়। আবছা যা মনে আছে তার কিছু আছে, দুটি পুকুর ছোট ডোবার চেয়ে একটু বড়। আমি কী বলব? ভিটের আর কী দেখার আছে? মাটির বাড়ি ভেঙে নতুন করে করা যায়। আমি সিদ্দিকের পরিবার দেখছিলাম। সিদ্দিকের কিছুই মনে নেই মসলন্দপুরের কথা। বাড়ির বাতাপি লেবু কেটে দিল। সিদ্দিকের বিবিকে আমার ছোটকাকির মতো মনে হচ্ছিল। তেমনি স্মিত হাসি, মাথায় ঘোমটা। আগেরবার বলেছিলেন, ভাত খেয়ে যান, আপনাদের ভিটেয় আছি, জমির ধান পাই, খেয়ে বাঁচি…মনে আছে সব। আমি ফোনে ধরলাম আমার মেজদা উদয়নকে। আমি ধুরোলে বাবুদা…। আমাদের জন্মভিটেয়। তাই। ফোনের ওপারে মেজদা কাঁদছেন। সিদ্দিক বলছিলেন, তাঁরা ভালো আছেন, সবই মাটির গুণ। সিদ্দিকের ৫৬-৫৭। অনেক সময় বসেছিলাম উঠনে। হাতনের পৈঠায়। এইখানে জন্মেছিল বড়দা মনোজ, মেজদা উদয়ন, বোন অপর্ণা। অকাল প্রয়াত দিদি ডিলডিল, সবার বড় ভাই সায়েব। মা ছিলেন সর্বংসহা। রাধারানীর চোখে জল আসে। তিনি যে আমার ভিতরে আছেন। পাশের বাড়ি আব্দুল জলিলের। শীর্ণকায় বৃদ্ধ। তিনি আমাদের আর এক শরিকের বাড়ি নিয়েছেন। বাবার জেঠতুতো ভাইদের বাড়ি। আব্দুল জলিল আমাকে বললেন, বেলেঘাটায় গিয়ে সাতদিন ছিলেন সন্তোষ মিত্রর বাড়ি। সেখেনেই দলিল হয় বিনিময়ের। কতকালের কথা সব। তিনি অনেক প্রবীণ। আমাকে নানাজনের নাম বলতে লাগলেন। তাঁরা সব তাঁদের প্রতিবেশী ছিলেন। ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। এই গ্রামেরই মানুষ সকলে। কেউ নেই। হরি মাস্টার ছিল অনেকদিন। তারপর চলে গেল কবে যেন। তর্জনী তুলে দেখিয়ে দিলেন দূরের একটা ভিটে। সিদ্দিকও পড়েছে হরি মাস্টারের কাছে। জলিল বললেন, কালি সেন, দোল মাস্টারকে আমি চিনি কি না? নাম শোনা, আমি চিনব কী করে? যিনি সকলকে চিনতেন, পূর্ববঙ্গ ধারণ করে রেখেছিলেন নিজের ভিতরে, আমার মা রাধারানির কাছেই তো সব জানা আমার।