ওই যে গগনবাবু বসে আছেন তিন-রুম ফ্ল্যাটের বড় এক ব্যালকনিতে, একা, সম্পূর্ণ একা এক সত্তুরে ফিক্সড ডিপোজিটের সুদখোর বুড়ো, ছেলে বিলেতে থাকে, মিসেস চলে গেছেন আচমকা, সন্ধের উতলা বাতাস দিয়েছে তাঁরে ঘ্রাণ, বসন্ত এসে গেছে। সেই যে পেয়েছেন তিনি বাতাসে তাহারই ঘ্রাণ, নিজেই ফেসবুকের দরজা খুলে ডেকেছেন সেই কুসুমকে, বসন্ত এসে গেছে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের কুসুম আর ৩৬ নম্বরের অদিতি তো এক নয়। গগন কুণ্ডু আর জীবন মিত্রও তাই এক নয়। মোবাইল থেকে ছবি উগরে দেয় যেমন কুসুম, তেমনি তিনি উগরে দেন ওই ইন্টারনেট থেকে খুঁজে পেতে নিয়ে। কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস… গুনগুন করতে করতে গগন কুণ্ডু নেট সার্চ করে কত ছবি, ফাগুনের আগুন ডাউনলোড করে কুসুমকে উপহার দেন, এই দ্যাখো বসন্ত এসে গেছে। এই গান শুনেছ তুমি কুসুম? কোন গান গো? বনে বনে পাপিয়া বোওলে… কুঞ্জে কুঞ্জে গুঞ্জরে অলি কুসুমে, নীল নলিনী দোলে…। ওয়া, এই গান যে আমাদের উপরের ফ্ল্যাটের গগন দাদাই চালিয়েছিল সেদিন। তুমি জানলে কী করে?
বসন্ত এসে গেছে, তাই জেনেছি গো। বলে গগন বললেন, তোমার একটা ছবি দেবে?
এই বসন্ত নগরের। আর সেই বসন্ত গঞ্জে গঞ্জে, নপাহাড়ি, সাতপাহাড়ি, সাতশো পাহাড়ে সাতশো ফুলের দেশে। সেই গঞ্জ, সেই পাহাড়তলি, সেই প্রান্তর এখন পলাশের আগুনে জ্বলছে দাউ দাউ। এখনো রাতে শীত শীতে ভাব, দিনে মাটি থেকে গরম নিঃশ্বাস উঠছে। সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়ে গেছে, পাতা ঝরে গেছে বনে বনে। জঙ্গল অনেক ফাঁকা। এরই ভিতরে ফাল্গুণী পূর্ণিমা এল। দু-পক্ষ বাদে চৈত্র পূর্ণিমা। তখন বসন্ত পুড়ে জ্বলে খাঁক হয়ে যাবে। দূর উজ্জয়িনীতে চৈত্র পূর্ণিমায় কামদেবের পূজা। ফুলদোল ছিল একদিন। এখন নেই। ভার্চুয়াল জগতে তা আছে। যা কিছু মুছে যাবে তা থেকে যাবে অনস্তিত্বের এই আন্তর্জালের পৃথিবীতে।
গরুর রচনা
গরুর রচনা। গরুর চোনা নয়। তা ভাল না মন্দ এ নিয়ে কত কথা আছে। গরুর রচনার চেয়ে দেশপ্রেম কিংবা বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও লিখতে সুবিধে হতো। বড় হয়ে আমি “দেশপ্রেমিক” হব এই রচনা লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছিল আমার খুড়তুতো ভাইয়ের মাসতুতো ভাই মহেশ। মহেশ একটি গরুর নাম। আবার মহেশ মাসতুতো ভাইয়ের নাম। সুতরাং মহেশ নামের এই মানুষটি একটি গরু। গো মাতা নয় গো পিতা। বলদ। সেই বলদে দেশপ্রেম নিয়ে লিখে ২০-র ভিতরে কুড়িই পেয়েছিল শোনা যায়। আমার খুড়তুতো ভাই গণেশ বলে, বরং ২০-র চেয়ে বেশি পাওয়াও অসম্ভব ছিল না। এই কালে পরীক্ষায় যেমন মাইনাস নম্বর দেওয়া হয়, প্লাস দেওয়া চালু করলে কুড়িতে মহেশ পঁচিশই পেত। আমি লিখলে আমিও পেতাম। আমি কাত্তিক গরুর রচনার বদলে আমি দেশপ্রেম লিখতাম না হয়। দেশ অনেক বড়। দেশ আমার দেশ। গরুও অনেক বড়। গরু আমার গরু। গবাদি পশু খুবই মূল্যবান। পুরাকালে দেশ জয় করে সৈনিকরা সোনাদানা রমণী এবং গবাদিপশু লুন্ঠন করত। সেই লুন্ঠন বন্ধ করতে দেশপ্রেমিক হওয়া জরুরি। সুতরাং গরুর রচনা লিখতে গিয়ে যদি দেশপ্রেম নিয়ে লেখা হয়, তা ভুল তো হবে না, বরং তাইই সমীচিন হবে। দেশ লুন্ঠন এবং গবাদি পশু লুন্ঠন একই ঘটনার দুই রূপ। গো-রক্ষাই দেশ-রক্ষা। দেশ রক্ষাই গো রক্ষা। আসুন গরুর কথা বলি গরুর রচনার মাধ্যমে। গরু নিয়ে যেমন মহেশ গল্পের কথা জানি। গরু নিয়ে আর এক গল্প জানি, ‘হাজরা নস্করের যাত্রা সঙ্গী’ (শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়)। হাজরা চাষা মানুষ। গরু কিনে গো-হাট থেকে ফিরছে। রাতে গরুর সঙ্গে রুটি ভাগ করে খাচ্ছে। গরু আর মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করে একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারে। সুখ দুঃখও। গরু চিরকালই ভাল যাত্রাসঙ্গী। যাই হোক গরুর রচনা লিখতে গিয়ে অন্য কথা না বলে গরুর কথা বলি।
গরু এক অবোধ প্রাণী। মানুষের ভিতরেও অবোধ মানুষ আছে। তাঁকে আদর করে ‘গরু’ বলা হয়। যেমন মহেশ আর গণেশ। আমার খুড়তুতো ভাই এবং তার মাসতুতো ভাই। এবং আমি কাত্তিক। আমিও এক অবোধ মানুষ। সাতও জানি না, পাঁচও জানি না। গরুর চারটি পা। চতুষ্পদ প্রাণী। চতুষ্পদ নিয়ে গরু চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায়। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর আর পুবে বঙ্গোপসাগর… উত্তর পুবে আসাম নাগাল্যাণ্ড… ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আমাদের দেশ। এই আমাদের শুরু ও শেষ। যেমন এই আমাদের শাড়ি, এই আমাদের নারী। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা, মুম্বই থেকে গুয়াহাটি, এই ভারত আমার দেশ। গরু এই চারদিকে চতুষ্পদ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। গরু দুধ দেয়। দুধ আমাদের পুষ্টি দেয়। পুষ্টির কথা শুনলে আমার মনে পড়ে ফষ্টির কথা। ফষ্টির কথা শুনলে নষ্টির কথা। কী থেকে কিসে যাচ্ছি? যাচ্ছি তো যাচ্ছি। গরু ঘাস খায়। নদীতীরে সবুজ ঘাসের জমি। নদীর নাম মালিনী। মালিনী নদীর কূলে কন্বমুণির আশ্রম। সেই আশ্রমে উর্বশী মেনকা এবং বিশ্বামিত্রর গর্ভজাত কন্যা শকুন্তলা বড় হয়ে উঠছিল। বেতস লতার মতো তার দেহ বল্লরী। এই সময় দেশের রাজা দুষ্মন্ত শিকারে বেরিয়েছিলেন। একটি হরিণ শিশুর পিছু পিছু দৌড়ে তিনি এসে পৌঁছলেন কন্বমুণির আশ্রমে। যুবতী শকুন্তলাকে দেখে মোহিত হলেন। দেশের রাজা বলে কথা। আশ্রম কন্যাকে প্রলুব্ধ করে নির্জনে নিয়ে গিয়ে ভোগ করলেন। অভিজ্ঞান দিয়ে গেলেন। অভিজ্ঞান আংটি যেমন হতে পারে, অভিজ্ঞান হতে পারে অঙ্গে অঙ্গে নখের দাগ। দাঁত আর নখের দাগ অভিজ্ঞান নিয়ে গৃহে ফেরে বন কন্যা শকুন্তলা, এক আদিবাসী যুবতী। বনে গিয়েছিল পাতা কুড়োতে, ঝাঁটি কাঠ সংগ্রহে। বন তাদের পেটের ভাত দেয়। সালোয়া জুড়ুম, দেশপ্রেমিক গ্রাম-রক্ষী বাহিনীর লোক শকুন্তলাকে ভোগ করে অভিজ্ঞান দিয়ে চলে গেছে। মালিনী নদীর তীরের বনভূমিতে এমন হয়ে থাকে। দুষ্মন্তরা এখন এমন করে থাকেন।