আমার হাতের মধ্যে টেলিফোন;
আমার পায়ের কাছে খেলা করছে
সূর্যমণি মাছেরা।
পিচ-বাঁধানো সড়কের উপর দিয়ে
নৌকো চালিয়ে আমি
পৃথিবীর তিন-ভাগ জল থেকে এক-ভাগ ডাঙায় যাব।
সেই নৌকোর জন্যে আমি বসে আছি;
আর, পাঁচ মিনিট পরপর
ডায়াল ঘুরিয়ে চিৎকার করছি:
হ্যালো দমদম…হ্যালো দমদম…হ্যালো…
… … …
আমার জুঁইলতা এখন
পাঁচ ফুট জলের তলায় ফুল ফোটাচ্ছে।
১৯৭৮-এর বন্যায় শহর কলকাতার রাস্তায় কোমর সমান জল, সেই জলে পা হড়কে ডুবে মারা গেলেন একজন। জলের ভয়ানক চেহারা দেখেছি ১৯৭৮-সালের বন্যায়। প্লাবন। একের পর এক নদী, সুবর্ণরেখা, ডুলুং, কংসাবতী, শিলাবতী, কেলেঘাই, হলদি নদী, রূপনারায়ণ, দামোদর, উঠে আসছে স্থলভূমিতে। জল দখল করে নিয়েছিল সভ্যতা। দুর্গাপুর ব্যারেজে ধরেছিল ফাটল। আমি তখন মেদিনীপুরে। বন্যার পরে বাড়ি ফিরেছিলাম তিন মাস বাদে। ১৯৬৮ সালে তিস্তার জল প্রবেশ করেছিল জলপাইগুড়ি শহরে। সেই বন্যার কথা কত শুনেছি। তিস্তার বাঁধ সেই কারণে দেওয়া। নদীবাঁধ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যহত করে। তিস্তার জল নিয়ে বাংলা দেশের ক্ষোভ, ওদেশে এই নদী শুকিয়ে শুধুই বালুচর। দেখেছি তা। একই অভিযোগ ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে, চিন বাঁধ দিয়েছে তার উজানে। আমাদের এদিকে জল আসছে কম। গঙ্গার জল ক্যানেল কেটে চুরি করে তুলে নিচ্ছে উজানের মানুষ, আমরা জল পাচ্ছি কম। আবার ফারাক্কা ব্যারেজ নিয়ে বাংলাদেশের অভিযোগ কম নয়। শুখা সিজিনে জল চাই, বর্ষায় জল দিলে বন্যায় ভাসে দেশ। দামোদর ব্যারেজের ছাড়া জলে প্রতি বছর হুগলি হাওড়া ভাসে। অসম্পূর্ণ নির্মাণই তার কারণ। আর জল নিয়ে দাঙ্গাও দেখেছি। চাষের সিজিনে জমিতে জল পাঠান নিয়ে তা হয়। বড় বড় দিঘিতে জলের ভাগ নিয়ে লাঠালাঠিও দেখেছি কত। ভাগ কত, এক পয়সা, দু পয়সা, এক গণ্ডা দুই গণ্ডা, এক কড়া দুই কড়া… মোট ভাগ এক টাকা বা ষোল আনা হলে এই রকম হয় এক এক শরিকের অংশ।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলি জলাভাবে মরে যাচ্ছে। আমাদের বেতনা, কপোতাক্ষ নদ তো বালুচর মাত্র। তিস্তা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রের কথা তো বলেইছি। দক্ষিণ ২৪ পরগণার কত নদী যে মরে গেছে হিসেব নেই। আর আমরাও শেষ করছি যত জলের সূত্র। পুকুর, দিঘি বুঁজিয়ে জল মেরে দিয়ে অগ্নিকুন্ডের ভিতর বসিয়ে দিচ্ছি সভ্যতাকে। আমাদের জল আছে, তা শেষ করে দিচ্ছি। যাদের জল নেই, মরুদেশে, রাজস্থানে, দশ মাইল হেঁটে জল মাথায় করে ফেরে বাড়ির মেয়েরা। স্বাধীনতার ৭২ বছর বাদেও শুদ্ধ জলের ব্যবস্থা করে উঠতে পারিনি আমরা। নেতা মন্ত্রীদের তা জানা নেই। হ্যাঁ, জল নেই বটে, শীতল পানীয় আছে গঞ্জে গঞ্জে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের পশ্চিম প্রান্তে সুবর্ণরেখার কুলের এক গ্রামে তখন ছিল বাস। সেই ১৯৭৬ হবে। গ্রীষ্মের দিনে জল কই? কুয়োর জল তলানিতে। জঙ্গল থেকে একটি ঝোরা নেমে এসে চলে গিয়েছিল নদীর দিকে, সেই ঝোরার বালি খুঁড়ে যে জল উঠত তা ছেঁকে নিয়ে কলসে ভরা হতো। সেই জলই ছিল পানীয় জল। স্নানের জল সেই বালি খুঁড়ে তৈরি করা বড় বড় খোদল, চুইয়ে চুইয়ে যে জল জমত সেখানে তা দিয়েই অবগাহন। সেই জল হতো স্বচ্ছ, বিশুদ্ধ। গরমের দিনে খুব ঠান্ডা। বংশীধরপুরের কথা এখনো মনে পড়ে, জলের অভাব কি মিটেছে সেখানে? মানুষের চাওয়া কত সামান্য যে তা গ্রামদেশে না ঘুরলে বুঝব না। অন্ন, একখানি বস্ত্র, আর জল। বিশুদ্ধ জল। জঙ্গল মহল যে তিন জেলায়, সেই জেলার গ্রামদেশে জলের জন্য হাহাকার দেখেছি কম না। জলের সূত্র তো পাতাল। কুয়ো আর জঙ্গলের ঝোরা, ঝর্না, জোড়-এসব শুকোতে থাকে মাঘ মাস থেকে। ফাল্গুনের পর কুয়োর জল তলানিতে গিয়ে পৌঁছয়। একদিন বালতি নামল নিচে, ঠং করে আওয়াজ হলো। ভয় পেল বউটি। জল ফুরিয়ে এল! একদিন জলের সঙ্গে বালি, মানে জল শুকিয়ে এল। হায়! সামনে কী দিন অপেক্ষা করে আছে!
শালতোড়া ব্লক বাঁকুড়ার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে। পাহাড়ি জনপদ। কিছু গেরস্তর বাড়ির কুয়ো বাদ দিয়ে জনসাধারণের জন্য বড় একটিই কুয়ো চড়াই থেকে নেমে রাস্তার ঢালে। শেষ রাত থেকে সেখানে বালতির পর বালতির লাইন। তখন জল আছে। আর কদিন বাদে সারাদিন বালি ওঠে জলের সঙ্গে। ভোরে, কত ভোরে যেতে পারে মানুষ জল তুলতে তার প্রতিযোগিতা চলে যেন। সারারাত চুঁইয়ে চুঁইয়ে যে জল উঠে আসে কুয়োর তলদেশে তা থাকে স্বচ্ছ। সেই জলটুকুর জন্যই শেষ রাতে ছোটা। আমি টালার জলাধারের পাশে বড় হয়েছি, জলের কষ্ট পাইনি কখনো। বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের পশ্চিমভাগে দীর্ঘদিন বসবাসে বুঝেছি জলের জন্য হাহাকার কী? জলের কত দাম। জল ফুরিয়ে আসে, গঞ্জের হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ মেঘ আর বৃষ্টির জন্য আকাশে তাকিয়েই থাকে। ২৪ প্রহর হরিনাম আরম্ভ হয়। হরিনামে আকাশের দেবতা সন্তুষ্ট হবেন। জল নামবে আকাশ থেকে। খরা এবং বন্যা, দুই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গেই জলের সম্বন্ধ। বন্যা আসে জানান দিয়ে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি বন্যা নিয়ে আসে। আর খরা আসে একটু একটু করে। জানান দেয় না। নিঃশব্দ চরণে আসে সে। মানুষ একদিন টের পায় বহুদিন আকাশে মেঘ আসেনি, বৃষ্টি নেই বহুদিন। সব শুখা হয়ে যাচ্ছে। জলের অভাবে মানুষের মাথা বিগড়ে যায়। একটা লোকের সঙ্গে বেলিয়াতোড়ে দেখা হয়েছিল, বিকেলের দিকে আমাকে এসে বলে, ‘আকাশটা দেখুন, আগুনে তেতে বেঁকে গেছে কেমন, জল না নামলে আর উপায় নাই’। আমি বৈশাখ, জৈষ্ঠের আকাশ দেখি। হ্যাঁ, তাই। তালগাছের মতো লোকটা যা বলছে, তাই। জল না নামলে উপায় নাই। এস মেঘ এস।
বসন্তের নতুন রং
বসন্ত কোথায়? শীত এল কি এল না, শহরে গাঁয়ে গঞ্জে বসন্ত এসে গেছে বলে রব উঠতে উঠতে মিলিয়ে গেল। বসন্ত আসতে না আসতে গ্রীষ্মের হুহু আগুনে বাতাস বইতে শুরু করেছে। এতদিন জেনেছিলাম বসন্তের সময় জ্ঞান তীব্র প্রখর। প্রকৃতিতে না এলেও মনের ভিতরে সে গুণগুণ করে ঘোর শীতের ভিতরেও। এবছর চলছে ঋতু সংহার। শীত তো এল এল করে চলিয়া গেল অকালে প্রায়। বসন্ত মুখ লুকিয়েছে গ্রীষ্মের তেজময় বাতাসের ভিতরে। আমরা অবাক হয়ে আছি, জীবন থেকে একটি অম্লানকুসুম ম্লান হয়ে ঝরে গেল। বসন্ত মুখ দেখাতে না দেখাতে মিলিয়ে গেল।