ক্রিপসের মূলত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগসহ অন্যান্য দলের নেতৃবর্গের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ‘৪২-এর ২৪শে মার্চ তাঁর প্রস্তাব পেশ করেন। স্বাধীনতাকামী দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগকে তা অবহিত করেন।
(১) যুদ্ধের অবসানে ভারতকে কানাডার মতো অধিরাজ্যের মর্যাদা (Dominion Status) দেওয়া হবে, যা আসলে পূর্ণ স্বরাজ নয়। ব্রিটিশের অধীনেই এক দেশ হবে এই দেশ। মূল ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের কাছেই থাকবে।
(২) যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে এবং সেই সভাকে ভারতের নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হবে।
(৩) নতুন সংবিধান কোনো প্রদেশের পছন্দ না হলে সেই প্রদেশ ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সংবিধান রচনা করতে পারবে। ভারতের যে-কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য ইচ্ছে করলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও থাকতে পারবে।
(৪) সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ-ব্যবস্থা বহাল রাখা।
(৫) প্রদেশগুলোর প্রাদেশিক আইনসভা সংবিধান সভার সদস্যদের নির্বাচন করবে, অন্যদিকে দেশীয় রাজ্যের রাজারা তাঁদের সদস্যদের মনোনীত করবেন।
(৬) নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার নিজের হাতে রাখবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘ভিটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা বাতিল করার অধিকার বড়লাটের থাকবে।
ক্রিপসের প্রস্তাবগুলো ভারতের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ সহ ভারতের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই ক্রিপস-এর প্রস্তাব একযোগে প্রত্যাখ্যান করে।
কংগ্রেস মনে করে ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবিকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় অর্থাৎ ক্রিপস প্রস্তাবে দেশ বিভাগের পরোক্ষ ইঙ্গিত থাকায় কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। সবচেয়ে বড় কথা ভারতের প্রতিরক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে ব্রিটিশ সরকার রাজি ছিল না ক্রিপস প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারকে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার মতো সম-মর্যাদা ও ক্ষমতা দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না।
মুসলিম লিগ ক্রিপস প্রস্তাবে সরাসরি দেশ বিভাগ মেনে না নেওয়ায় তা বর্জন করে। ক্রিপস সায়েবের প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করে ১৯৪২এর ২৬শে এপ্রিল গান্ধীজী হরিজন পত্রিকায় ভারত ছাড়ো এই শিরোনামের প্রবন্ধে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান চান। ১৪ জুলাই কংগ্রেসের প্রস্তাবে ৯-ই আগস্ট স্থির হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনার দিন। ৯-ই আগস্ট গান্ধীজী গ্রেপ্তার হয়ে যান ভোরে। ভারতবর্ষ জেগেছিল তারপর থেকে কত রাত, কত ভোর। মহাত্মা গান্ধীর পর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, জে. বি. কৃপালনী সমেত বহু প্রথম সারির নেতা কারারুদ্ধ হন। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন রূপে ঘোষণা করে। সর্বত্র কংগ্রেস কর্মীদের গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হয়। হেমেন গুপ্ত মশায়ের বিয়াল্লিশ ছবিতে সেই সব সাধারণ মানুষের কথা আছে, তাদের আত্মত্যাগের কথা। প্রথম প্রথম এই আন্দোলন ছাত্র-শিক্ষক, যুবসম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ক্রমে তা দেশের শ্রমিক, কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে গণআন্দোলন হয়ে ওঠে। সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে দেশের আপামর জনসাধারণ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। দেশব্যাপী ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। এ সবের প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। নির্বিচার ধর-পাকড়, অত্যাচার শুরু হয়। ২৯শে সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারিত হয়েছিল সার্বিক অসহযোগের। অবরোধের। অহিংস মিছিলের। রেললাইন ধ্বংস, স্কুল-কলেজ বর্জন, বিভিন্ন অফিস-আদালত দখল, ট্রেন ও টেলিফোন সংযোগ বিছিন্নকরণ, থানা, ডাকঘর, রেজিস্ট্রি অফিস, রেলস্টেশন দখল ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ‘৪২ ছবিতে আছে সরকার সমস্ত রকম পরিবহন নিষিদ্ধ করছে। সাইকেল পর্যন্ত। যাতে আন্দোলনকারীরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল মহারাষ্ট্রের সাতারা, মেদিনী পুরের তমলুক, কাঁথি, দিনাজপুরের বালুরঘাট, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, আসামের নওগাঁ, ওড়িশার তালচের, বালাশোর ইত্যাদি। বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে সাতারার শ্রীনাথ লালা, নানা পাতিল, বালিয়ার চৈতু পাণ্ডে, সরযূ পাণ্ডে, তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা, সুশীল ধাড়া, পাঞ্জাবের গৃহবধু ভোগেশ্বরী ফকোননি, আসামের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দীপশিখা হয়ে উঠেছিলেন। এছাড়া অরুণা আসিফ আলি, সুচেতা কৃপালিনী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্র দেব, রামমনোহর লোহিয়া, যোগেশ চ্যাটার্জি, উষা মেহেতা, অচ্যুত পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি এই আন্দোলনে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এই আন্দোলনের গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল বেশি। তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন গান্ধিজীর অনুরাগিনী একজন গ্রাম্য বিধবা মহিলা। দেশ তাঁর কাছে ছিল জননী স্বরূপা। মহাত্মাজী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ ১৯৪২-এর সেই অসহযোগের দিন, ২৯ শে সেপ্টেম্বর নানাদিক থেকে এসে তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন। ‘৪২ ছবিতে রূপকাশ্রয়ে এই দিনটির কথা আছে। ৭৩ বছর বয়স্কা কৃষকবধু মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালত শীর্ষে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান। মাতঙ্গিনী হাজরার দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শ জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে। অজয় মুখার্জি, সুশীল কুমার ধাড়া ও সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে প্রশাসনের কেন্দ্র, মহকুমা অফিস দখল নেওয়া হয়। অজয় মুখার্জির উদ্যোগে ১৯৪২-এর ১৭ ডিসেম্বর তমলুক মহকুমায় ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ গঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকারি দমন নীতির প্রচন্ডতা ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। হেমেন গুপ্ত মহাশয়ের ‘৪২ ছবিতে মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মত্যাগের মতো বৃদ্ধা ঠাকুমার মৃত্যু আছে পুলিশের গুলিতে। পতাকা হাতে শিশু মৃত্যু আছে। আছে প্রধান চরিত্র, নায়কের স্ত্রী উন্মাদিনী ধর্ষিতা নারী বীনার চেতনা পুনরজ্জীবন। সে-ই পতাকা হাতে মিলিটারি ব্যারাকের ভিতরে যাত্রা করে। তার পিছনেই জনতা। ধর্ষিতা নারীকে সমুখে দেখে ধর্ষক পুলিশ কর্তা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। ‘৪২ এক আশ্চর্য ছবি। অন্তিম দৃশ্যে, স্বাধীনতা এলে যখন জনতা জয়ধ্বনি করে, তার ভিতরে গান্ধী টুপি পরিহিত সেই আড়তদার দালাল-গুপ্তচর ঢুকে পড়েছে। সে জয়ধ্বনি করছে গান্ধীজীর নামে। স্বাধীনতার পরে যা হয়েছিল তাই-ই দেখিয়েছেন পরিচালক। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে সেই সব দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষই ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যায় যে তা আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে। তারাই বেশি গান্ধীবাদী হয় এবং দরকারে দমন-পীড়ন হত্যা করে। কিন্তু আমাদের শেষ কথা, কিছুই ভুলি নাই। ১৯৪২- আমাদের স্মরণে আসুক আবার। ‘৪২-এর আন্দোলনে স্বাধীনতা এলে এই উপমহাদেশের চেহারা অন্য রকম হয়ে যেতে পারত।
একেই কি বলে সভ্যতা
ভালো আর মন্দ মানুষ নিয়েই তো সমাজ। নিজ দেশে ভালোমানুষ দেখেছি অনেক, কিন্তু সমাজটাকে দেশটাকে তাদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলাম কই? আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে সেই কৈশোর থেকে কত অভিযোগ শুনেছি। অভিযোগ তো মিথ্যে ছিল না, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ থেকে পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ চলছে অবিরত, সেখানে আমেরিকার ভূমিকা ছিল এবং রয়েছে প্রধান। যুদ্ধ আর অস্ত্র ব্যবসা তার অর্থনীতিতে এমন ভূমিকা নিয়েছে যে তা বন্ধ করা সম্ভবই নয় যেন। খোলাবাজারে অস্ত্র বেচা-কেনা হয় সে দেশে, ইস্কুলে গিয়ে রাইফেল হাতে অপরিণত মনস্ক কিশোর তার সহপাঠীদের মেরে ফেলে এই সত্যকে লুকোনো কঠিন। এই অস্ত্র ব্যবসা, যুদ্ধ থেকে সরে আসতে গিয়েই প্রেসিডেন্ট জন. এফ. কেনেডির নিহত হওয়া। তা নিয়ে ছবি হয় ওই দেশে (জে.এফ.কে), সেই ছবিতে দেখি হত্যাকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত এক অস্ত্র ব্যবসায়ী, এফ.বি.আই. এবং সি.আই.এ। এদের সঙ্গে অভিযুক্ত কেনেডি নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যিনি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে গিয়ে বসেন, সেই লিন্ডন বি জনসনও। আমাদের দেশে এমন ছবি হতে পারে না। হলে সরকার এবং রাজনৈতিক দল তা একযোগে বন্ধ করে দিত। আমি আমার কথা বলি, তুমি তোমার কথায় তা খণ্ডন করো, তা হবে না, তোমার কথা পছন্দ না হলে তোমাকে, তোমার পরিবারকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করব, দরকারে মেরেও দেব, যুক্তির বদলে বাহুবল আমাদের সম্বল। এক মাস কুড়ি দিন ধরে আমেরিকার নানা শহরে ঘুরেছি, উত্তরের মিশিগান থেকে পুবের শার্লট সিটি, আটলাণ্টা, পশ্চিমের লস এঞ্জেলস, সান দিয়েগো, থেকে পুবের নিউ ইয়র্ক সিটি, ওয়াশিংটন…। গিয়েছিলাম মিশিগান– অ্যান আরবর শহরে প্রবাসের বাঙালিদের এক সাহিত্যোৎসব কথামালায়। কথামালা তিনদিন। তারপর দেশটাকে ঘুরে দেখা। কলম্বাস ১৪৯২-এ পা দিয়েছিলেন আটলান্টিক পার হয়ে যে ভূখণ্ডে তার বয়স কত, ৫০০ পেরিয়ে আর ২৬ বছর হয়েছে মাত্র। এই ভারত দেশটির সভ্যতা কত হাজার বছরের। তুলনাই হয় না। সে তো এক নতুন দেশ। যারা তার এখনকার অধিবাসী তারা এসেছে সাগর পেরিয়ে, আর যারা ছিল সেই পাহাড় আর জঙ্গল অধ্যুষিত তিন দিক সাগরে ঘেরা সেই প্রাচীন ভূখন্ডে, সেই সব মানুষ, উপজাতি রেড ইন্ডিয়ানদের নিশ্চিহ্ন করেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পত্তন। কিন্তু নানা দেশের মানুষ, ইওরোপীয়, এশীয়, আফ্রিকার মানুষ, শ্বেতাঙ্গ, বাদামি চামড়ার মানুষ আর একদা শ্বেতাঙ্গদের দাস হয়ে আসা কালো মানুষে গড়া এই মস্ত দেশটি এমন আশ্চর্য সভ্যতার পত্তন করল কীভাবে তা দেখে বিস্ময় আর যায় না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আর সমাজকে যতটুকু আন্দাজ করা যায় ৫০ দিনে তার কথাই বলি। আমরা যখন হাজার হাজার বছরের সভ্যতা ত্যাগ করে ক্রমশ নানা অন্ধতার বিবরে প্রবেশ করছি, তখন দেখে এলাম মাত্র ৫০০ বছর পার করে আসা এক দেশ কীভাবে এক সভ্য সমাজ গড়ে তুলেছে সেই দেশে। এমন এক জীবনযাত্রার অভ্যাস গড়ে তুলেছে তা আমাদের ভাবনার অতীত। ছোট ছোট অভিজ্ঞতা এখন আমার কাছে মস্ত হয়ে উঠেছে। সেই কথাই বলি।