সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
উৎসর্গ
শ্রীমতি মনোলীনা চট্টোপাধ্যায়
শ্রীযুক্ত নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
পরম প্রীতিভাজনেষু
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
পার্টিশন আমি দেখিনি। ভাঙা বাংলায় আমার জন্ম। কিন্তু পার্টিশন আমাকে দগ্ধ করে। দেশভাগের যে বেদনা তা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করি। সেই অধিকারেই আমি পূর্ববঙ্গের কথা বারবার বলি। যেতে চাই। গিয়ে বিস্ময়ের ঘোরে থাকি। সেই বিস্ময়ের কথাই বলি একটু। আমরা পারটিশনের সময় খুলনা জেলার সাতক্ষীরে মহকুমার মানুষ। সাতক্ষীরে উত্তর ২৪ পরগণার বসিরহাট শহরের লাগোয়া। বসিরহাট গেলে আমি সাতক্ষীরের গন্ধ পাই। ইছামতী দেখলে আমি কপোতাক্ষ, বেতনা দুই নদীর স্রোতের শব্দ শুনতে পাই। মা আমাকে এইটুকু ভালবাসা দিয়ে গেছেন হারিয়ে যাওয়া গ্রাম আর নদীর জন্য। সতত আমি ফেলে আসা গ্রাম আর নদীকে স্মরণ করি। ভাবি।
সতত কার কথা ভাবি? কপোতাক্ষর কথা। তার তীরে কবি শ্রীমধুসূদন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মধুসূদনের মা জাহ্নবী দেবীর জন্ম। আমার মাতৃকুলও কপোতাক্ষর কুল। পিতৃকুল বেতনা নদীর কুল। আমি ২০০০ সালে আমাদের ফেলে আসা ছোট্ট শহর সাতক্ষীরে হয়ে ধূলিহর গ্রামে গিয়েছিলাম। আধঘন্টার জন্য। কিছুই দেখা হয়নি। শুধুই অশ্রুপাত হয়েছিল। তারপর আর যাওয়ার কথা ভাবিইনি। এক সন্ধ্যায় এক বন্ধু যখন সাহিত্য সভায় বললেন, তাঁর একটা গ্রাম আছে, তাঁর একটা নদী আছে তাই নিয়ে তিনি লেখেন। শুনতে শুনতে আমি নিজের নিঃস্বতা অনুভব করেছিলাম। আমার তো নেই। আমার গ্রাম আমার নদী ওপারে ফেলে এসেছি আমি। গুগুল সার্চ করে আমাদের গ্রাম দেখলাম একদিন। ছবিও। ফেসবুকে সাতক্ষীরের ক’জন বন্ধু হলো কোন অজানতে। এরপর একদিন ফেসবুকের ইনবক্সে সাতক্ষীরের বন্ধু তুহিন ম্যানগ্রোভ বলল, দাদা আসুন না কেন নিজেদের ফেলে যাওয়া গ্রামে। তুহিন বারবার ডাকতে লাগল, দাদা আসেন, সাতক্ষীরে আসেন, সাতক্ষীরে আপনার জন্য বসে আছে। এই তুহিন একদিন বিকেলে আমাকে ফেসবুকে মেসেজ দিল, দাদা আপনার বাবার নাম, ঠাকুদ্দার নাম? আমি জানাতে সে বলল, ধুরোলে (ধূলিহরে) আপনাদের ভিটেয় দাঁড়িয়ে আছি। সমস্ত গা শিহরিত হয়ে উঠল। আমাদের পিতৃপুরুষের ভিটেয় দাঁড়িয়ে তুহিন ডাক দিচ্ছে। এ কি সত্য হতে পারে? সত্তর বছর আগে যা হারিয়ে গেছে তাকে পাই কীভাবে? দু’দিন বাদে এক সন্ধেয় অস্ট্রেলিয়াবাসী সাতক্ষীরের কন্যা ফিরদৌস জান্নাত নজৌলা বারবার বলতে লাগল, দাদা আপনার জন্মভূমি দেখে আসুন। চেনা মানুষ খুঁজে পাবেন ঠিক। তাই সাতক্ষীরে যাওয়া। আর উস্কে দিয়েছিল তরুণ সাংবাদিক বন্ধু অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক আবেদ খান মশায়। সম্ভ্রান্ত খান পরিবারের বাড়ি সাতক্ষীরে। আমি যবন হরিদাসের জন্মভিটে কেড়াগাছি, ধূলিহর যেতে চাই শুনে ঢাকা থেকেই আবেদ খান মশায় যাদের যাদের বলার, বলে দিয়েছিলেন। আমাকে বারবার তাড়িত করছিলেন। আবেদ খান তো বলছিলেনই, বলছিলেন সাতক্ষীরের সাংসদ রবিভাই, উপজেলা কলারোয়া অঞ্চলের সাংসদ লুতফুল্লা ভাই। ফোনে ডাকছিল কবি মন্ময় মনির। ফোনে ডাকছিল তুহিন, শুভ্র আমেদ, আসুন আসুন। এস এস। ভোররাতে, ঘুমের ঘোরে তাদের ডাক শুনছিলাম। মধ্যরাতে আধো চেনা কারোর ডাক শুনছিলাম আচমকা ঘুম ভাঙা অন্ধকারে। এস এস। আয় আয়। তাঁরা আর কেউ নন, আমার পিতৃকুল মাতৃকুলের হারানো মানুষ, ধূলিহরের চন্ডীচরণ মিত্র, লক্ষীনারায়ন মিত্র, অন্নদাচরণ, হেমনলিনী। বাঁকা ভবানীপুরের প্রমাতামহ কৈলাশ বসু, মাতামহ ধীরেন্দ্রনাথ বসু … হারানো নদ কপোতাক্ষ, নদী বেতনা। নদীঘাট সুপুরিঘাটা, বড়দল। যুগীপোতার বিল জমি। রাজশাহী হয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম আগের মাসে। ঢাকা থেকে ফিরে আট দিনের মাথায় সাতক্ষীরে ভায়া বসিরহাট। এত কাছে! বাউন্ডারি কমিশনের, র্যাডক্লিফ সায়েব মানচিত্রে দাগিয়ে গোটা খুলনা জেলাকেই ভারতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনদিন বাদে ১৮-ই আগস্ট খুলনা ওপারে চলে যায়। সাতক্ষীরে তখন খুলনা জেলার একটি মহকুমা। এখন জেলা। থাক ওসব কথা। আমি যেন আমার আর জন্মের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। যাঁদের দেখিনি সেই প্রপিতামহ চন্ডীচরণ মিত্র, মাতামহ ধীরেন্দ্রনাথ বোস ডাক দিচ্ছিলেন। সব নিয়ে বসে আছি। আয়, একবার আয়। তোরে তো দেখিনি আয়। আয় রানি, ঠাকুরদাসের খবর নিয়ে আয়। শিবু, কেষ্টর খবর নিয়ে আয়। রানি আমার মা রাধারানি, শিবু কেষ্ট আমার দুই মামা। মধ্যরাতের সেই ডাকই আমাকে নিয়ে গেল। না গিয়ে পারিনি তাই গেছি। বসিরহাট থেকে এপারে ঘোজাডাঙা,ওপারে ভোমরা সীমান্ত, সঙ্গে তরুণ লেখক অরিন্দম বসু। স্থল-সীমান্ত দিয়ে সীমান্ত না পার হলে সীমান্তের মহিমা ধরা যায় না। এপারের কাস্টমস, সীমান্ত প্রহরীর ছাড়পত্র নিয়ে ট্রলি ব্যাগ টেনে টেনে বাংলাদেশে ঢুকে গেলাম। ওপারে তুহিন, শুভ্র, মন্ময়রা দাঁড়িয়ে। চন্ডীচরণ, অন্নদা মিত্তির হেমনলিনী আর ধীরেন বসুরা দাঁড়িয়ে। যাঁরা এপারে প্রয়াত হয়েছেন, বাবারা তিনভাই, বড় মামা, মামি, আমার মা রাধারানি সকলেই এপারে প্রয়াণের পর ওপারে ফিরে গেছেন, আমি দেখতে পাচ্ছি তাঁদের। হ্যাঁ, স্পষ্ট। অনুভব করতে পারছিলাম যেন। ওপারে গিয়েও এপারের মোবাইল সিম চালু থাকে প্রায় ২ কিলোমিটার অবধি। তারপর তা মুছে দেয় র্যাডক্লিফের ভূত। ফোনে গ্রামীন ফোনের সিম ভরে নিলেই সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, হাতিয়া, ময়নাদ্বীপ, ব্রাহ্মনবাড়িয়ার তিতাসের কুল, গোয়ালন্দ, ঈশ্বরদি, আরিচাঘাট, পোড়াবাড়ি, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিং জুড়ে যায়। ঢাকার ভূতের গলি থেকে ময়মনসিঙের ফুলবাড়িয়া গ্রামের শেফালী খাতুনের বাড়ি চলে যাওয়া যায় পড়ন্ত বেলায় নারিকেল গাছের ছায়ার অভিমুখ দেখে দেখে (শহীদুল জহিরের গল্প ‘কোথায় পাব তারে’)। এবারের সাতক্ষীরে ভ্রমণ সকল অলীকতার অবসান হয়তো। কিংবা নতুন অলীকতার জন্ম। সাতক্ষীরে, ধুরোল, বাঁকা, আমাদী, রাঢ়ুলী কাঠপাড়া, পাটকেলঘাটা সবই আমার কাছে ছিল হারিয়ে যাওয়া ভূখণ্ড। সীমান্তের ওপারে যা আছে তার একবিন্দুও আমার নয়। গ্রাম, নদী, নদীঘাট, কিছুই আমাদের নয়। সেখানে আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। বন্ধু সুজন আছে বটে, রক্তের কেউ নেই। নেই নেই কেউ নেই ওদেশে। ক’দিন আগে ঢাকাতেও তাই বলেছি গাজিপুর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশভাগ নিয়ে বলতে গিয়ে। ঢাকার খামখেয়ালীর সভায় তাই বলেছি। কনকর্ড মার্কেটে তরুণ লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে তাই বলেছি। কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে সাতক্ষীরের দিকে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল কেউ যেন আছে কোথাও! ঘ্রাণ আসছে। গায়ের গন্ধে স্বজন চেনা যায়। ছোটবেলায় মায়ের গায়ের গন্ধ চিনতাম, ঠাকুমার চিনতাম। তাঁদের মাথার চুলে ঘন নারকেল তেলের গন্ধ এখনো ভুলিনি। তা যেন বাতাসে ভেসে আছে ভোমরা সাতক্ষীরের পথে। কেউ যেন আছে। যার ডাকে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙেছিল, সে আছে। কিন্তু এ তো আমার কল্পনা। ইচ্ছা পূরণের কথা মাত্র। তা হয় নাকি? হয় না। সাতক্ষীরে কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল তৃপ্তিমোহন মল্লিকের সঙ্গে। তিনি পঁচাত্তর। থাকেন সাতক্ষীরের নিকটবর্তী গ্রাম নাটানা, আশাশুনি। আশাশুনির নাম কত শোনা। দেখে মনে হলো চেনা মানুষ। গান লেখেন। গানে সুর করেন। কত পরিবার চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। তিনি যাননি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তারাপদ মিত্র কে হন? চিনতেন আমার ছোটকাকাকে।