সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল সেতু। থমথমে গলায় বলল, আমি এখন চলে যাব। পরিবেশ ভুলে থাবা দিয়ে তার হাত ধরল শুভ। পাগল হয়েছ নাকি? আমি এত কষ্ট করে এলাম আর তুমি চলে যাবে? আমি কি ইচ্ছে করে লেট করছি? আজ পর্যন্ত কখনও এমন হয়েছে, বল? স্কুটার নষ্ট হয়ে গেলে আমি কী করব? বাড়ি থেকে বেরিয়েছি অনেক আগে। বারোটার দিকে। হেসে খেলে সোয়া বারোটা কিংবা বারোটা বিশে এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
এত কথা আমি শুনব না।
শুনতে হবে। কারণ আমি তোমার জন্য খুব কষ্ট করেছি। স্কুটার নষ্ট হওয়ার পর রিকশা টিকশা নিইনি। এই এতটা পথ পার্কের ভেতর দিয়ে দৌড়ে এলাম। তাও যেই। সেই দৌড়, একেবারে পাগলের মতো। ছেলেবেলার পর এমন দৌড় কখনও দৌড়াইনি। দেখছ না এখনও কেমন হাপাচ্ছি!
শুভর কথা শুনে মনটা একটু নরম হল সেতুর। তবু রাগি ভাবটা বজায় রাখল সে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় হাঁপাচ্ছ? তোমাকে একেবারে নরমাল মনে হচ্ছে।
শুভ তার নির্মল হাসিটা হাসল। মনে হওয়ার কারণ আছে। বস, বলছি।
যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল সেতু।
শুভ বলল, আসলে হয়েছে কী, দৌড়াতে দৌড়াতে রেস্টুরেন্টের সামনে এসেছি, এসে ভাবলাম এমন হাঁপাতে হাঁপাতে এই ধরনের রেস্টুরেন্টে ঢোকা ঠিক হবে না। এক দুমিনিট রেস্ট নিয়ে নিই।
কেন, রেস্ট নিতে হবে কেন? হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলে কী হতো?
লোকে কী ভাবত, বল! তার ওপর তুমি এভাবে একা বসে আছ! আমার জন্য ওয়েট করছ। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে, হাঁপাতে হাঁপাতে তোমার কাছে এলাম। দৃশ্যটা দেখতে কি ভাল লাগবে?
অন্যের কথা জানি না, আমার খুব ভাল লাগত।
কেন?
মনে হতো আমার জন্য পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে যে কোনওভাবে ছুটে আসতে পার তুমি। কোনও কিছুই কেয়ার কর না।
সেতুর চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় শুভ বলল, সত্যি আমি ছুটে এসেছি সেতু, সত্যি আমি কোনও কিছু কেয়ার করিনি! তোমার জন্য সব পারি আমি, সব।
বুক পকেট থেকে তারপর টকটকে লাল একটা গোলাপ বের করেছিল শুভ। সেতুর হাতে দিয়ে বলেছিল, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।
এই মুহূর্তে শুভর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন শুভর সেদিনকার কথা আবার শুনতে পেল সেতু। ভুলে গেল সে তাকিয়ে আছে শুভর ছবির দিকে। নিজের অজান্তেই পরিষ্কার উচ্চারণে সেতু বলল, আমিও তোমাকে ভালবাসি। আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি।
সঙ্গে সঙ্গে সেতুর পেছন থেকে পাখির মত মিষ্টি আদুরে গলায় কে যেন বলল, তা তো আমি জানিই।
এ হচ্ছে টুপলু। প্ল্যান মতো বাবলুর রুম থেকে সেতুর রুমে এসেছে সে। এসে দেখে সেতু মগ্ন হয়ে আছে এ্যালবামে। কোনওদিকে খেয়াল নেই। ফুপিকে চমকে দেয়ার জন্য পা টিপে টিপে তার একেবারে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তখনই ভালবাসার কথাটা বলেছে সেতু। টুপলু ভেবেছে তাকে দেখতে পেয়েও মজা করার জন্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকেই কথাটা বলেছে ফুপি। এজন্য সেও মুগ্ধ গলায় জবাব দিয়েছে।
কিন্তু টুপলুর গলা শুনে চমকে উঠল সেতু। ঝটপটে হাতে শুভর ছবি চালান করে দিল নিজের ছবির তলায়। এ্যালবাম বন্ধ করল। টুপলুকে দেখতে পেল। ও তুই? আমি ভয় পেয়ে গেছি।
টুপলু অবাক হল। কেন? ভয় পাবে কেন? আমি কি ভূত?
মুখের মিষ্টি একটা ভঙ্গি করে, অতি আদুরে ভঙ্গিতে দুহাতে টুপলুকে বুকের কাছে। টেনে আনল সেতু। তুই তো ভূতই। ছোট্টভূত।
তারপর কী ভেবে বলল, না না তুই হচ্ছিস পেত্নি। পেত্নি। মেয়েভূতগুলোকে বলে পেত্নি। তোকে এরকম পেত্নির সাজ কে সাজাল রে?
শুনে টুপলু একেবারে হা হা করে উঠল। না না পেত্নির সাজ না তো! নতুন বউর সাজ। দেখছ না লাল শাড়ি, গহনা।
দেখছি।
টুপলু খুশি হয়ে বলল, আমাকে কেমন লাগছে ফুপি?
গাল টিপে টুপলুকে একচোট আদর করল সেতু। খুব সুন্দর লাগছে, খুব সুন্দর। একদম নতুন বউর মতো। এই তোর বিয়ে কবে রে?
টুপলু কথা বলবার আগেই কডলেস ফোন হাতে রানি এসে ঢুকল। আফা, আপনের ফোন। দোলন আফায় ফোন করছে।
লাফ দিয়ে উঠে ফোনটা নিল সেতু। দৌড়ে বারান্দায় চলে গেল।
তারপর যেন টুপলুকে খেয়াল করল রানি। মুখের হা-টা একটু বড় রানির। হাসলে দুদিক থেকে মুখ চলে যায় প্রায় কানের কাছাকাছি। এই ধরনের হাসিকে বলে আকৰ্ণ হাসি। সেই আকর্ণ হাসি হেসে বলল, আরে, এতক্ষুণ দেখি নাই? এইডা কে? কার বউ?
রানিকে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না টুপলু। রানি যতই আদর করে তাকে সে ততই বিরক্ত হয়।
এখনও হলো। রানির মুখের দিকে ফিরেও তাকাল না। গম্ভীর গলায় বলল, তোর বউ।
তারপর গুটগুট করে হেঁটে সেতুর রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু টুপলুর কথায় রানি খুব মজা পেয়েছে। রুমে কেউ নেই দেখে প্রাণখুলে আকর্ণ হাসিটা হাসতে লাগল সে।
.
তোর আজ কোনও কাজ আছে?
আপনি কে যে এভাবে আমাকে তুই তোকারি করছেন? অভদ্র, ছোটলোক। ফোন তুলেই কেউ কাউকে তুই তোকারি করে? ভদ্রতা শেখেননি? বাড়িতে কি নতুন ফোন লেগেছে? আজকের আগে টেলিফোনে কখনও কথা বলেননি? টেলিফোনে কথা বলা শিখে তারপর আমাকে ফোন করবেন।
গলা অন্যরকম করে কথা বলতে শুরু করেছিল সেতু। ফলে দোলন একটু ভড়কে গেল। তবে মুহূর্তের জন্যই। তারপরই নিজেকে ম্যানেজ করল। থাপ্পড় মেরে দাঁত ভেঙে ফেলব।
সেতু আগের গলায় বলল, ছি ছি ছি, আপনি কী রকম মেয়ে? মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়ের দাঁত ভেঙে ফেলতে চাইছেন? সত্যি যদি দাঁত ভেঙে দিন মেয়েটির তাহলে কী ক্ষতি হবে আপনি জানেন?