- বইয়ের নামঃ প্রিয়
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ভালবাসা থাকলে সত্যি সব হয়
প্রিয় – উপন্যাস – ইমদাদুল হক মিলন
ভালবাসা থাকলে সত্যি সব হয়!
এই যে সকালবেলা সেতুদের বাড়ির পেছন দিককার বাগানে আতাগাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় বসে শিস দিচ্ছে দোয়েল, ভালবাসা না থাকলে দোয়েল পাখিরা কি এরকম শিস দেয়, না দিতে পারে!
আতাগাছের মাথার ওপরকার আকাশ আজ একটু বেশি নীল, বেশি স্বচ্ছ। রোদ্রছায়া আর তুলোর মতো মেঘে মেঘে আকাশ যেন আজ পুরনো আকাশ নয়। আকাশ যেন আজ এক নতুন আকাশ। আজকের আগে যেন কখনও ছিল না মানুষ কিংবা পৃথিবীর মাথার ওপর।
এও কি ভালবাসার জন্যে নয়!
যে হাওয়া এইমাত্র বইতে শুরু করেছে, শিশুর ত্বকের মতো নরম কোমল এবং আদুরে, ফুলের গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে আছে যে হাওয়া, ভালবাসা ছাড়া এরকম হাওয়া কি কখনও বয়!
বাগানে এত যে ফুল ফুটেছে, গাছের পাতারা হয়েছে গাঢ় সবুজ, ঘনঘাসের বনে মায়ামমতার মতো পড়ে আছে রোদ, কোথাও কোথাও পাতার ছায়া হাওয়ায় হাওয়ায়। দোলে, এই তো ভালবাসা! না কী!
আজ সকালে দোতলার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ভালবাসাকে এইভাবে আবিষ্কার করল সেতু। আসলে বাগানের দিকে তাকিয়ে সেতুর মনে পড়েছিল শুভর কথা। শুভর কথা মনে পড়লে চারদিকে ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না সে। অনেকদিন ধরেই এমন হচ্ছে।
সেতুর রুমের সঙ্গে চওড়া বারান্দা। বারান্দার পুবদক্ষিণে সুন্দর রেলিং। যে কোনও দিককার রেলিংয়ে দাঁড়ালে বাগানের সবখানি দেখা যায়।
কত রকমের যে গাছপালা বাগানে! ফুল ফল, পাতাবাহার লতাগুল্ম, মূল্যবান অর্কিড, মেহেদি এবং চওড়া পাতার মানকচু। ডুমুরঝোঁপ আছে, বাঁশঝাড় আছে, পাথরকুচি এবং লজ্জাবতি আছে।
দেড়বিঘার ওপর বাড়িটার দশবারো কাঠা জায়গা জুড়ে বাগান। সামনের দিকে পাঁচ সাতকাঠা জুড়ে লন, মাঝখানে পুরনো আমলের দোতলা বিল্ডিং।
গুলশান এলাকার প্রথম দিককার বাড়িগুলো এরকমই। আজকালকারগুলো অন্যরকম। বাগান লন তো দূরের কথা, একইঞ্চি জায়গাও কেউ বনেদিআনার জন্য খরচা করে না। এককাঠা জায়গার দাম পঁচিশ তিরিশ লাখ টাকা। যে কারণে বেশিরভাগ পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে। প্রতিটিই ছতলা।
এই এলাকায় ছতলার ওপর বাড়ি করা যায় না।
তবে পুরনো বাড়িগুলোর চেহারা বদলে যাওয়ার ফলে এলাকটাও বদলে গেছে। আগের সেই বনেদিভাবটা যেন নেই।
কিন্তু সেতুদের বাড়িটা যা ছিল তাই আছে। ভেঙেচুরে নতুন করা হয়নি। ছোটভাই একবার চেয়েছিলেন দেড়বিঘা জমি তিনভাগ করে তিনটি ছতলা বিল্ডিং করবেন।
গ্রাউন্ডফ্লোরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা, সিকিউরিটি রুম ইত্যাদি, বাকি পাঁচতলার একেকতলায় দুটো করে ফ্ল্যাট। তিনভাই বোনের প্রত্যেকের একটা করে বিল্ডিং। একটা বিল্ডিং মানে দশটা ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের সাইজ প্রায় তিনহাজার স্কোয়ার ফিট। এই এলাকায় পার স্কোয়ার ফিট আড়াই হাজার টাকা। তার মানে একেকটি ফ্ল্যাটের দাম হবে পঁচাত্তোর লাখ টাকা। প্রতিটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে থাকবে দুটো করে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। একেকটির জন্য আড়াই লাখ টাকা। এক্ষেত্রে পাওয়া যাবে আরও পাঁচলাখ। তাহলে ফ্ল্যাটের মোট দাম পড়ছে আশিলাখ। দশটি ফ্ল্যাট আটকোটি। অর্থাৎ এই বাড়িটাকে ব্যবহার করেই সেতুরা তিনভাই বোনের একেকজন হয়ে যেতে পারে আটকোটি টাকার মালিক।
বড়ভাই নিমরাজি ছিলেন, কিন্তু সেতু একেবারেই রাজি হয়নি। সব শুনে বুকের ভেতর হু হু করে ওঠেছিল। যে বাড়িতে জন্মে এতটা বড় হয়েছে সে, ঘুম ভেঙে যে বাড়ির সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়, ঘুরে ফিরে প্রতিদিনকার জীবন কাটে যে বাড়িতে সেই বাড়ি হঠাৎ করে অন্যরকম হয়ে যাবে একদিন, এই চেহারা, এই স্নিগ্ধতা বাড়ির থাকবে না এ কিছুতেই ভাবতে পারেনি সেতু। নিজের শরীর আচমকা একদিন বদলে গেলে, নতুন কিংবা অচেনা হয়ে গেলে যেমন লাগবে এও যেন তেমন এক ব্যাপার।
শুভকে ভালবাসার পর থেকে যে কোনও বিষয়ে ভাবতে শুরু করলে এক পর্যায়ে শুভর কথা সেতুর মনে পড়বেই। সেদিনও পড়েছিল। এই বাড়ির সঙ্গে কোথায় যেন শুভর খুব মিল।
শুভকে কি বদলে ফেলা যায়? শুভর জায়গায় কি দাঁড় করানো যায় নতুন প্রেমিক? ভালবাসা যায় তাকে?
তারপর সেতু একেবারে ছটফট করে উঠেছিল। না, না।
নিচতলার ড্রয়িংরুমে সেদিন সবাই ছিল। সেতুর দুভাই মামুন এবং স্বপন, দুভাবী শিলা এবং রেখা। বাড়ির বহুকালের পুরনো ঝি রানি বিকেলের চা দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতেই কথাটা তুলেছিল স্বপন। সেতুর ছটফটানি দেখে থতমত খেয়ে গেল। চায়ের কাপ হাতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সেতুর দিকে।
স্বামীর অবস্থা দেখে রেখা তার পক্ষ নিল।
রেখার গলা একটু বেশি সরু। তার ওপর মিষ্টতা বলে কিছু নেই গলায়। ফলে নরম স্বরে কথা বললেও শোনায় বেশ রুক্ষ্ম। তখনও শোনাল। তুমি এমন করছ কেন সেতু? তোমার ভাই তো ঠিকই বলেছে! এতবড় বাড়িটা অকারণে পড়ে আছে। এই বাড়ি ব্যবহার করে যদি একেকজন আটকোটি টাকার মালিক হয়…।
রেখার কথা শেষ হওয়ার আগে গম্ভীর গলায় মামুন বললেন, না হওয়া যাবে না। কারণ বিল্ডিং তৈরির খরচা আছে। সেসব খরচা বাদ দেয়ার পর বোঝা যাবে কতটাকা টিকলো। এই ধরনের প্রজেক্ট ব্যাংকলোন নিয়ে করতে হয়। ইন্টারেস্টসহ লোন শোধ করার পর আসল লাভটা বোঝা যাবে।