- বইয়ের নামঃ প্রিয়
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ভালবাসা থাকলে সত্যি সব হয়
প্রিয় – উপন্যাস – ইমদাদুল হক মিলন
ভালবাসা থাকলে সত্যি সব হয়!
এই যে সকালবেলা সেতুদের বাড়ির পেছন দিককার বাগানে আতাগাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় বসে শিস দিচ্ছে দোয়েল, ভালবাসা না থাকলে দোয়েল পাখিরা কি এরকম শিস দেয়, না দিতে পারে!
আতাগাছের মাথার ওপরকার আকাশ আজ একটু বেশি নীল, বেশি স্বচ্ছ। রোদ্রছায়া আর তুলোর মতো মেঘে মেঘে আকাশ যেন আজ পুরনো আকাশ নয়। আকাশ যেন আজ এক নতুন আকাশ। আজকের আগে যেন কখনও ছিল না মানুষ কিংবা পৃথিবীর মাথার ওপর।
এও কি ভালবাসার জন্যে নয়!
যে হাওয়া এইমাত্র বইতে শুরু করেছে, শিশুর ত্বকের মতো নরম কোমল এবং আদুরে, ফুলের গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে আছে যে হাওয়া, ভালবাসা ছাড়া এরকম হাওয়া কি কখনও বয়!
বাগানে এত যে ফুল ফুটেছে, গাছের পাতারা হয়েছে গাঢ় সবুজ, ঘনঘাসের বনে মায়ামমতার মতো পড়ে আছে রোদ, কোথাও কোথাও পাতার ছায়া হাওয়ায় হাওয়ায়। দোলে, এই তো ভালবাসা! না কী!
আজ সকালে দোতলার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ভালবাসাকে এইভাবে আবিষ্কার করল সেতু। আসলে বাগানের দিকে তাকিয়ে সেতুর মনে পড়েছিল শুভর কথা। শুভর কথা মনে পড়লে চারদিকে ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না সে। অনেকদিন ধরেই এমন হচ্ছে।
সেতুর রুমের সঙ্গে চওড়া বারান্দা। বারান্দার পুবদক্ষিণে সুন্দর রেলিং। যে কোনও দিককার রেলিংয়ে দাঁড়ালে বাগানের সবখানি দেখা যায়।
কত রকমের যে গাছপালা বাগানে! ফুল ফল, পাতাবাহার লতাগুল্ম, মূল্যবান অর্কিড, মেহেদি এবং চওড়া পাতার মানকচু। ডুমুরঝোঁপ আছে, বাঁশঝাড় আছে, পাথরকুচি এবং লজ্জাবতি আছে।
দেড়বিঘার ওপর বাড়িটার দশবারো কাঠা জায়গা জুড়ে বাগান। সামনের দিকে পাঁচ সাতকাঠা জুড়ে লন, মাঝখানে পুরনো আমলের দোতলা বিল্ডিং।
গুলশান এলাকার প্রথম দিককার বাড়িগুলো এরকমই। আজকালকারগুলো অন্যরকম। বাগান লন তো দূরের কথা, একইঞ্চি জায়গাও কেউ বনেদিআনার জন্য খরচা করে না। এককাঠা জায়গার দাম পঁচিশ তিরিশ লাখ টাকা। যে কারণে বেশিরভাগ পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে। প্রতিটিই ছতলা।
এই এলাকায় ছতলার ওপর বাড়ি করা যায় না।
তবে পুরনো বাড়িগুলোর চেহারা বদলে যাওয়ার ফলে এলাকটাও বদলে গেছে। আগের সেই বনেদিভাবটা যেন নেই।
কিন্তু সেতুদের বাড়িটা যা ছিল তাই আছে। ভেঙেচুরে নতুন করা হয়নি। ছোটভাই একবার চেয়েছিলেন দেড়বিঘা জমি তিনভাগ করে তিনটি ছতলা বিল্ডিং করবেন।
গ্রাউন্ডফ্লোরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা, সিকিউরিটি রুম ইত্যাদি, বাকি পাঁচতলার একেকতলায় দুটো করে ফ্ল্যাট। তিনভাই বোনের প্রত্যেকের একটা করে বিল্ডিং। একটা বিল্ডিং মানে দশটা ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের সাইজ প্রায় তিনহাজার স্কোয়ার ফিট। এই এলাকায় পার স্কোয়ার ফিট আড়াই হাজার টাকা। তার মানে একেকটি ফ্ল্যাটের দাম হবে পঁচাত্তোর লাখ টাকা। প্রতিটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে থাকবে দুটো করে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। একেকটির জন্য আড়াই লাখ টাকা। এক্ষেত্রে পাওয়া যাবে আরও পাঁচলাখ। তাহলে ফ্ল্যাটের মোট দাম পড়ছে আশিলাখ। দশটি ফ্ল্যাট আটকোটি। অর্থাৎ এই বাড়িটাকে ব্যবহার করেই সেতুরা তিনভাই বোনের একেকজন হয়ে যেতে পারে আটকোটি টাকার মালিক।
বড়ভাই নিমরাজি ছিলেন, কিন্তু সেতু একেবারেই রাজি হয়নি। সব শুনে বুকের ভেতর হু হু করে ওঠেছিল। যে বাড়িতে জন্মে এতটা বড় হয়েছে সে, ঘুম ভেঙে যে বাড়ির সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়, ঘুরে ফিরে প্রতিদিনকার জীবন কাটে যে বাড়িতে সেই বাড়ি হঠাৎ করে অন্যরকম হয়ে যাবে একদিন, এই চেহারা, এই স্নিগ্ধতা বাড়ির থাকবে না এ কিছুতেই ভাবতে পারেনি সেতু। নিজের শরীর আচমকা একদিন বদলে গেলে, নতুন কিংবা অচেনা হয়ে গেলে যেমন লাগবে এও যেন তেমন এক ব্যাপার।
শুভকে ভালবাসার পর থেকে যে কোনও বিষয়ে ভাবতে শুরু করলে এক পর্যায়ে শুভর কথা সেতুর মনে পড়বেই। সেদিনও পড়েছিল। এই বাড়ির সঙ্গে কোথায় যেন শুভর খুব মিল।
শুভকে কি বদলে ফেলা যায়? শুভর জায়গায় কি দাঁড় করানো যায় নতুন প্রেমিক? ভালবাসা যায় তাকে?
তারপর সেতু একেবারে ছটফট করে উঠেছিল। না, না।
নিচতলার ড্রয়িংরুমে সেদিন সবাই ছিল। সেতুর দুভাই মামুন এবং স্বপন, দুভাবী শিলা এবং রেখা। বাড়ির বহুকালের পুরনো ঝি রানি বিকেলের চা দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতেই কথাটা তুলেছিল স্বপন। সেতুর ছটফটানি দেখে থতমত খেয়ে গেল। চায়ের কাপ হাতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সেতুর দিকে।
স্বামীর অবস্থা দেখে রেখা তার পক্ষ নিল।
রেখার গলা একটু বেশি সরু। তার ওপর মিষ্টতা বলে কিছু নেই গলায়। ফলে নরম স্বরে কথা বললেও শোনায় বেশ রুক্ষ্ম। তখনও শোনাল। তুমি এমন করছ কেন সেতু? তোমার ভাই তো ঠিকই বলেছে! এতবড় বাড়িটা অকারণে পড়ে আছে। এই বাড়ি ব্যবহার করে যদি একেকজন আটকোটি টাকার মালিক হয়…।
রেখার কথা শেষ হওয়ার আগে গম্ভীর গলায় মামুন বললেন, না হওয়া যাবে না। কারণ বিল্ডিং তৈরির খরচা আছে। সেসব খরচা বাদ দেয়ার পর বোঝা যাবে কতটাকা টিকলো। এই ধরনের প্রজেক্ট ব্যাংকলোন নিয়ে করতে হয়। ইন্টারেস্টসহ লোন শোধ করার পর আসল লাভটা বোঝা যাবে।
শিলা বললেন, তোমাদের কি টাকার অভাব আছে? ইচ্ছে করলে ব্যাংকলোন ছাড়াও এরকম তিনটা বিল্ডিং তোমরা করতে পার।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন মামুন। পারলেও করব না। অসুবিধা আছে। ইনকামট্যাক্সওয়ালারা খেয়ে ফেলবে।
স্বপন বলল, আর একটা কাজ করা যায়। সেটা সব চাইতে সহজ। আজকাল সেভাবেই অনেকে করছে। বাড়িটা আমরা ডেভলাপারকে দিয়ে দিলে পারি। ফ্ল্যাটের হিসেবটা হবে সিক্সটি ফোরটি। একেক বিল্ডিংয়ের ছটা ফ্ল্যাট ওদের, চারটা আমাদের। চারটা ফ্ল্যাটের সঙ্গে আটটা গ্যারেজ। তিনকোটি বিশলাখ টাকার প্রপার্টি। সঙ্গে আরও লাখ পঞ্চাশেক করে ক্যাশ টাকা। এছাড়া নিজেরা ফ্ল্যাট করে বিক্রি করলেও ভাল বিজনেস হবে।
মামুন মাথা নাড়লেন। তা হবে। এবং বিজনেস হিসেবে এটা এখন খুবই ভাল। এলাকার অনেকেই করছে। আসলে ব্যাপারটা হল এত দামী জায়গা আজকাল এভাবে কেউ ফেলে রাখে না।
অনেকক্ষণ ধরে সবার কথা শুনছিল সেতু। এবার সে বলল। কিন্তু আমরা ফেলে রাখব ভাইয়া। আমাদের অত টাকা পয়সার দরকার নেই। আমাদের যা আছে তাই যথেষ্ট। এতবড় বিজনেস তোমাদের, এই বাড়ি ছাড়াও আরও অনেক প্রপার্টি আছে। দিন দিন টাকা পয়সা, প্রপার্টি আরও বাড়বে। চাইলে ওরকম বিল্ডিং যে কোনও জায়গায় তোমরা করতে পারবে। এই বাড়িটা যেমন আছে তেমনই থাকুক।
তারপর মাথা নিচু করে বলল, মা মারা গেলেন এই বাড়িতে, বাবা গেলেন। দুজনের কত চিহ্ন ছড়ানো বাড়িতে, কত স্মৃতি। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন বাগান নিয়ে, গাছপালা নিয়ে। মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর হার্টএ্যাটাক করল বাবার। সিঙাপুর থেকে বাইপাস করিয়ে আনলে তোমরা। তারপর থেকে সারাক্ষণ নিজের রুমের সঙ্গের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে থাকতেন। এখনও হঠাৎ হঠাৎ বাবাকে যেন সেভাবে বসে থাকতে দেখি আমি। টাকার জন্য এসব স্মৃতি নষ্ট করে ফেলা কি ঠিক হবে? সবচে’ বড় কথা আমাদের কোনও অভাব নেই।
সেতুর কথা শুনে থমথমে হয়ে গিয়েছিল পরিবেশ। খানিক কেউ কোনও কথা বলেনি।
শেষ পর্যন্ত মামুন বললেন, ঠিক আছে, তোর কথাই থাকবে। তোর কথা শুনে আমার ভাল লেগেছে। এত সুন্দর করে কথাগুলো বললি তুই! তোকে তো সব সময়ই আমি খুব ছোট্ট মনে করি, আজ মনে হল তুই বেশ বড় হয়ে গেছিস।
শিলা বলল, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, বড় হবে না!
শিলার কথায় সেতু বেশ লজ্জা পেয়েছিল। আবার মনে পড়েছিল শুভর কথা। বড় তো সে হয়েছেই। বড় না হলে কি শুভকে সে এমন করে ভালবাসে! শুভকে পাওয়ার জন্য এমন করে পাগল হয়!
তারপর আরেকটি কথা মনে হয়েছিল সেতুর। বিয়ে হলে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে তাকে। শুভদের বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে। তখন? তখন এত মায়া জড়ানো প্রতিদিনকার বাড়িটির জন্য মন কেমন করবে না তার!
ঠিক এই কথাটাই দুদিন পর শিলা তাকে বলেছিল। এই বাড়ির জন্য এত যে মায়া তোমার, এই বাড়ি তুমি তাহলে ছেড়ে যাবে কী করে?
বুঝেও বেশ ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে শিলার কথার জবাব দিয়েছিল সেতু। ছেড়ে যাব মানে? কোথায় যাব?
শ্বশুরবাড়ি যাবে না?
সেতু হেসেছিল। না ওতো যেতে পারি।
তার মানে কী? তুমি বিয়ে করবে না?
নিশ্চয় করব।
তাহলে?
বিয়ে করলেই যে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে এমন কোনও কথা নেই। আমার ক্ষেত্রে উল্টোটাও হতে পারে।
বর নিয়ে আসবে এই বাড়িতে?
হতে পারে।
তাহলে তোমার ভাইদের বলি তোমার জন্য ঘরজামাই দেখতে।
সেতু ছটফট করে উঠেছিল। এই, না ভাবী! খবরদার! বিয়ে টিয়ের কথা এক্ষুনি বলবে না।
তারপর যা হয় আর কী, সঙ্গে সঙ্গে শুভর কথাও মনে পড়েছিল। শুভর সঙ্গে বিয়েতে ভাইভাবীরা কিছুতেই রাজি হবে না। শুভরা বেশ গরিব। ওরকম গরিব ফ্যামিলিতে সেতুকে কিছুতেই বিয়ে দেবে না ভাইরা। যত ভালই সেতুকে তারা বাসুক, কিন্তু এ কিছুতেই মেনে নেবে না। এ কারণেই শুভর কথা বাড়ির কাউকে বলেনি সেতু। জীবনের সবচে ভাললাগা মানুষটির কথা, সবচে ভালবাসার মানুষটির কথা বাড়ির সবার কাছে চেপে রেখেছে।
বারান্দার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে এখন এসব কথা মনে পড়ল সেতুর। মন খারাপ হয়ে গেল। শুভকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসা সম্ভব নয় তার, অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
কিন্তু শুভকে সে কেমন করে পাবে?
ঠিক তখুনি আতাগাছের দোয়েল পাখি শিস বন্ধ করল। খানিক চুপচাপ থেকে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে বাঁশঝাড়ের দিকে উড়াল দিল। ডুমুরঝোঁপের আবছা অন্ধকার থেকে ছটফটে ভঙ্গিতে উড়ে এল একজোড়া টুনটুনি। এসে মেহেদিঝোঁপের চারপাশে ওড়াউড়ি করতে লাগল, উত্তেজিত ভঙ্গিতে ডাকাডাকি করতে লাগল।
কী ব্যাপার? পাখি দুটো এমন করছে কেন?
তারপরই টুনটুনিদের উত্তেজনার কারণ বুঝতে পারল সেতু। কচুঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে একজোড়া বেজী। স্বভাব চঞ্চল ভঙ্গিতে বাগানের ইতিউতি চড়তে শুরু করেছে। এই দেখে ছোট্ট টুনটুনিরা ভয় পেয়েছে। কিন্তু বেজীরা নির্বিকার।
সেতু তারপর বেজী দেখতে লাগল। চঞ্চল ভঙ্গিতে একবার মানকচু ঝোঁপটার দিকে যায়, একবার ডুমুরঝোঁপের দিকে। বাঁশঝাড়ের ওদিকটা ঘুরে এল একবার। তারপর বাগানের মাঝামাঝি এসে মেহেদিঝোঁপের ছায়ায় অলস ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল একটি। আরেকটি খানিক দাঁড়াল শুয়ে পড়াটির সামনে, তারপর একবার এদিক যায় আরেকবার ওদিক, যেদিকেই যায় খানিক গিয়েই আবার ফিরে আসে। শুয়ে পড়াটির মুখের কাছে মুখ নেয়, মুখ তোলে।
আশ্চর্য এক ভালবাসার দৃশ্য।
এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আবার শুভর কথা মনে পড়ে সেতুর। সেই কথাটি মনে পড়ে। ভালবাসা থাকলে সব হয়। কথাটা যদি সত্য হয় শুভকে তাহলে সে নিশ্চয় পাবে। কেমন করে পাবে সেই পথ খুঁজে বের করতে হবে।
পথটা সেতু আজ থেকে খুঁজবে।
মামুনের রুম থেকে ঠিক তখুনি ভেসে এল, শিলা, শিলা। কোথায় গেলে তুমি?
বড়ভাই ডাকছেন ভাবীকে। তার অফিসে যাওয়ার সময় হল।
.
স্ত্রীর সঙ্গে মামুনের সম্পর্কে চিনির পরিমাণটা একটু বেশি।
অর্থাৎ খুবই মিষ্টি সম্পর্ক দুজনার। বাবলু ফাঁইয়ারে পড়ে, মুন্নি পড়ে ক্লাশ এইটে, হলে হবে কী, ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে কথাটা যেন মনেই থাকে না তাদের। দুজন সারাক্ষণই আছে ঠাট্টা মশকরার মধ্যে, হাসি মজার মধ্যে।
এই যেমন এখন।
স্বামীর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে বেডরুমে ঢুকেছে শিলা। মামুন ছিল ড্রেসিংরুমে। মাত্র টাই বাঁধা শেষ করেছে। শিলার সাড়া পেয়েই ড্রেসিংরুম থেকে গলা বাড়াল। মুখটা কার্টুনের মতো করে বলল, এসেছ?
শিলা গম্ভীর গলায় বলল, হ্যাঁ।
তোমাকে খানিক না দেখলে জানটা আমার বেরিয়ে যায়। এজন্য অমন ত্রাহি ডাক ছাড়ছিলাম।
বলতে বলতে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এল মামুন। শিলার একেবারে গা ঘেষে দাঁড়াল।
সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে সরে যেতে চাইল শিলা। হাতে পানির গ্লাস আছে বলে লাফটা সে দিতে পারল না। ছটফটে গলায় বলল, কাছে এস না, কাছে এস না।
প্রিয়তমা স্ত্রীর আচমকা এরকম কাছে এস না, কাছে এস না শুনে মামুন খুবই ভড়কে গেল। থতমত খেয়ে বলল, কেন? কী হয়েছে? আপন স্ত্রীর কাছে আসতে অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। ভীষণ অসুবিধা।
না বললে বুঝব কী করে?
সকালবেলা ওসব তোমাকে বলতে চাই না।
বললে কী হবে?
তেমন কিছুই হবে না। শুধু মনটা তোমার খারাপ হবে। অফিসে যাওয়ার সময় স্বামীর মন খারাপ করে দেয়া কোনও স্ত্রীর কর্তব্য হতে পারে না।
মামুন বিগলিত ভঙ্গিতে মুখটা হাসি হাসি করল। না না, তাতে কী? আমার মন যে খারাপ হবে তুমি তা কী করে বুঝলে?
আমি জানি, হবে।
হবে না, তুমি বল।
তারপর দূর থেকে হাত বাড়িয়ে শিলার গালটা ছুঁয়ে দিল মামুন। এই দুষ্টু, বল না!
মুখ নিচু করে খুবই লাজুক ভঙ্গিতে শিলা বলল, তুমি যে আমার চে অনেক বেটে, কাছে এসে দাঁড়ালে তা খুব বোঝা যায়। স্বামীর চে স্ত্রী মাত্র একবিঘত লম্বা এ কেমন কথা, বল। আমার বুঝি লজ্জা করে না?
সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ম্যানেজ করল মামুন। অযথা হে হে করে একটু হাসল। না, তাতে কী? বারোহাত কাকুড়ের তেরোহাত বিচি তো হতেই পারে! স্বামীর চে স্ত্রী লম্বা হলে ক্ষতি কী? আমি সব সময় হাতে একখানা জলচৌকি নিয়ে ঘুরব।
কেন?
চুমু খেতে হলে জলচৌকির ওপর দাঁড়িয়ে নেব।
শিলা খিলখিল করে হেসে উঠল।
মামুনও হাসছিল। হাসতে হাসতে গ্লাসের দিকে হাত বাড়াল। চুমু না, দাও এখন পানিটা খাই।
পানি খেয়ে গ্লাসটা শিলার হাতে ফিরিয়ে দিল মামুন। খুবই পরিতৃপ্ত গলায় বলল, অফিসে যাওয়ার সময় তোমার হাতের পানিটা খেয়ে গেলে মন এবং মাথা দুটোই বেশ ঠাণ্ডা থাকে। বিজনেসটা খুবই মন দিয়ে করতে পারি।
শিলা মুখ ঝামটে বলল, এসব ছাড়।
কেন ছাড়ব?
আমার সঙ্গে চালাকির দরকার নেই।
কোথায় চালাকি করছি?
এটাই তো চালাকি। আমার হাতের পানি নিয়ে যা বললে এটা তোমার পুরনো কায়দা। আমাকে পটাবার জন্য বলছ।
একুশ বছরের পুরনো স্ত্রীকে পটাবার কী আছে। সঙ্গে তো এই মুহূর্তে জলচৌকিও নেই!
শিলা আবার হাসল। ওহ্! তুমি পারও।
সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়াস হল মামুন। ঠিক আছে, আর ঠাট্টা নয়। রানিকে পাঠাও, স্বপন রেডি হয়েছে কি না দেখে আসুক।
পাঠাচ্ছি।
খালি গ্লাস হাতে বেরিয়ে গেল শিলা।
.
আজকালকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর ফিচার পাতায় মজার মজার সব লেখা ছাপা হয়। একদম চানাচুরের মতো। পাঠকরা এসব লেখা পড়ে না। খায়।
লেখা খাওয়ার কথাটা বলেছিল স্বপনের বন্ধু হাসান। সে একটি নতুন ধরনের দৈনিক পত্রিকার ফিচার এডিটর। তার পাতাগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। এইসব পাতার জন্য পত্রিকাটিও খুব জনপ্রিয় হয়েছে। পুরনো এবং জাদরেল বেশ কয়েকটি পত্রিকার বিক্রি কমে গেছে। কারণ তাদের পাঠক ভাগিয়ে নিয়ে গেছে হাসানদের পত্রিকা।
স্বপনের অফিসে আড্ডা দিতে এসে, চা খেতে খেতে হাসান একদিন বলল, আমাদের কাগজটা তুই পড়িস না?
স্বপন মাত্র সিগ্রেট ধরিয়েছে। টান দিয়ে বলল, না।
কেন?
আমি পড়ি ইত্তেফাঁক আর জনকণ্ঠ।
আমাদেরটাও পড়ে দেখ।
কেন, কী আছে তোদের কাগজে?
চানাচুরে ভর্তি।
মানে?
চা শেষ করে স্বপনের প্যাকেট থেকে সিগ্রেট নিয়ে ধরাল হাসান। মানে প্রচুর মজার মজার লেখা থাকে। বিশেষ করে আমি যে পাতাগুলো করি সেগুলো তো মজায় ভর্তি। ওসব পাতার লেখা পাঠকরা খুব খাচ্ছে। একবার হাতে নিলে তুইও খেতে থাকবি।
শুনে স্বপন একেবারে হতভম্ব। সিগ্রেটে টান দিতে ভুলে গেল। লেখা আবার খায় কী করে?
পড়লেই বুঝতে পারবি।
তারপর হাসতে হাসতে স্বপন বলল, কালচারাল মিডিয়াতে খাওয়া শব্দটা খুব চলছে আজকাল। বাজার কাটতি জিনিসগুলোকে জনপ্রিয় না বলে খাওয়া’ বলা হচ্ছে। যেমন ধর সিনেমার অমুক নায়িকা খুব জনপ্রিয়। যে ছবিতে সে আছে সেই ছবি হিট। আমাদের ভাষায় নায়িকাটিকে আমরা কিন্তু জনপ্রিয় বলব না। বলব অমুক নায়িকাকে লোকে আজকাল খুব খাচ্ছে।
শুনে হো হো করে হেসেছিল স্বপন। নায়িকাকে খাচ্ছে? সর্বনাশ!
তারপর থেকে বাড়িতে ইত্তেফাঁক এবং জনকণ্ঠের সঙ্গে হাসানের কাগজটাও সে রাখতে শুরু করেছে। সত্যি, পাতায় পাতায় নেশা ধরানো সব লেখা। পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না।
আজ সকালে তেমন একটি লেখা চোখে পড়ল স্বপনের। বাঁশের কী কী প্রতিভা আছে ওই নিয়ে লিখেছেন ইমদাদুল হক মিলন। সত্যি চানাচুর, খাঁটি চানাচুরের মতো লেখা। পড়তে শুরু করলে কুড়মুড় কুড়মুড় শব্দও হয়।
দিকপাশ ভুলে লেখাটির ওপর হামলে পড়ল স্বপন। নিবিষ্ট মনে খেতে লাগল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে সে। হাতের কাছে চায়ের কাপ, চাটা পুরো শেষ হয়নি, সেই চায়ের কথা ভুলে গেল। ঠোঁটে সিগ্রেট জ্বলছে, টান দিতে ভুলে গেল।
প্রতিভার দিক দিয়ে বাঁশের কোনও তুলনা হয় না।
বস্তুটির ভাল নাম বংশ। যার তিনটি সরল অর্থ বাঁশ বাঁশি এবং মেরুদণ্ড।
বাঁশের এক অর্থ মেরুদণ্ড জেনে আমি খুবই পুলকিত। আমার এক চীন ফেরত বন্ধুর মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। নানা রকম চিকিৎসার পরও প্রায়ই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে
সে। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। এই অবস্থায় তাকে একটু আনন্দ দানের জন্য আমি একদিন টেলিফোনে বললাম, বন্ধু, তোমার বাঁশটি কেমন আছে?
শুনে প্রথমে সে একটু হকচকিয়ে গেল, তারপর শব্দটির একটি কদর্য অর্থ করল। ভাবল পুরুষমানুষের শরীরের নিচের দিককার বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি আমি। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু এই ধরনের ঠাট্টা করতেই পারে।
বন্ধুটি বিবাহিত। সুতরাং সবিস্তারে সে ওই বিষয়ের দিকে ধাবিত হল। আমার তখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। কোনও রকমে বললাম, তুমি যা ভেবেছ তা নয়, বন্ধু। বাঁশ অর্থ মেরুদণ্ড।
শুনে সে খুবই হতাশ হল। তোমরা লেখকরা কত সহজ শব্দের কত বকা অর্থ কর। হাতে কলম আছে বলে যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছ। কর, আমরা নিরীহ মানুষরা পিঠের বাঁশে ব্যথা নিয়ে শুনে যাই।
তবে বাঁশের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক সত্যি খুব গভীর। বাগচী মহাশয়ের বাড়িতে যদি বাঁশঝাড় না থাকত তাহলে বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হত এক অসাধারণ কবিতা থেকে। ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ’। বাংলা গল্প উপন্যাস বঞ্চিত হত বাঁশঝাড়ের বর্ণনা থেকে। জীবনানন্দ দাশ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় খুবই ফাঁপড়ে পড়তেন। আর বাংলা সাহিত্যের গ্রামীণ ভূতগুলো তো সব বাঁশের ডগায়ই বসে থাকে। বাঁশ এবং তার ঝাড় না থাকলে ভূতগুলো যেত কোথায়? ভূতের গল্পের লেখকরা তাদেরকে কোত্থেকে জোগাড় করতেন?
এ তো গেল সাহিত্যে সংক্ষেপে বাঁশের ভূমিকা। এমনকি অংকশাস্ত্রেও একটি তৈলাক্ত বাঁশের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। একটি বানর দিনে কতবার তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে উঠবে এবং কতবার নামবে এই নিয়ে জটিল একখানা অংক তৈরি করে পাঠ্য বইতে বাঁশের মতো করেই প্রবিষ্ট করিয়ে রেখেছেন আমাদের পণ্ডিতরা।
বাঁশের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তো আরও গভীর। ভাবা যায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেম কাহিনীটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাঁশ। ওই যে বাঁশের দ্বিতীয় অর্থ, বাঁশি। কৃষ্ণের হাতে যদি বাঁশিটি না থাকত তাহলে রাধার সঙ্গে তার প্রেমই হত না। কৃষ্ণের বাঁশি শুনেই তো রাধা তার প্রেমে পাগল হয়েছিলেন! এবং একদা বাংলা গান বলতেই কানু বিনে গীত নাই। শচীনদেব বর্মন ‘সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’ বলে চিরকাল কেঁদে গেলেন। তারাশঙ্করের মতো মহান ঔপন্যাসিকও গান লিখলেন,
‘মধুর মধুর বংশি বাজে
কোথা কোন কদমতলীতে’।
গ্রামের প্রেমিক প্রেমিকারা এখনও রাতের আঁধারে কিংবা দিনের নির্জনতায় মিলিত হয় বাঁশঝাড় তলায়। দুষ্ট লোকেরা অবশ্য মলও ত্যাগ করে ওইসব জায়গায়। প্রেমের সঙ্গে মলেরও একটা সম্পর্ক আছে। গ্রাম্য ভিলেনরা প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকাকে মিলিত হতে দিতে চায় না বলে দল বেঁধে বাঁশঝাড় তলায় যে মল ত্যাগ করে আসে এরকম ঘটনা আমি নিজ কানে বহুবার শুনেছি।
এরকম অজস্র বিষয় জড়িত বাঁশের সঙ্গে। যে বাঁশে বাঁশি হয় সেই বাঁশে আবার লাঠিও হয়। লাঠির ব্যবহারবিধি আর নাই বা বললাম। সবাই জানে। এবং এও জানে বাঁশ দিয়ে দেয়া’ বলে একটা কথা আছে। সেটার অর্থও বিশদ বলবার দরকার নেই। জীবনে বহুবার বহুভাবে আমরা এ ওকে বাঁশ দিয়ে যাচ্ছি। যে দিচ্ছে সেও টের পাচ্ছে জিনিসটা কী, যে নিচ্ছে সে তো পাচ্ছেই।
বাঁশের সর্বশেষ প্রতিভা শুনে আমি প্রায় ভিড়মি খাচ্ছিলাম। যার বাঁশে ব্যথা আমার ওই বন্ধু চীনদেশ থেকে ফিরে বলল, প্রকাশনা জগতে চীন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কী রকম?
যন্ত্রের একদিক দিয়ে বাঁশ দিয়ে দিচ্ছে আরেক দিক দিয়ে চাররঙা দৈনিক পত্রিকা ছাপা হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বলে কী?
হ্যাঁ। যন্ত্রের ভেতর বাঁশ ঢুকবার পর সেই বাঁশ থেকে মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে কাগজ, সেই কাগজে ছাপা হয়ে যাচ্ছে দৈনিক পত্রিকা।
লেখা টেখা?
তাও নিয়ন্ত্রণ করছে বাঁশ।
কীভাবে?
লেখক টেখকদের পেছনে সক্রিয় একখানা বাঁশ তো সব সময়ই আছে। সেই বাঁশের গুতো না খেলে কি লেখা বেরয়!
এই বন্ধুই একবার ঈদের আগে আমাকে বলেছিল, আজকাল আকাশের চাঁদও নিয়ন্ত্রণ করছে বাঁশ। চাঁদ দেখা কমিটি না সমিতি কী যেন একখানা আছে, তার সদস্যরা। বাঁশ হাতে জনমানবহীন নির্জন স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম চাঁদগুলো উঠতে না চাইলেও বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে আগে ভাগেই তুলে দেয় তারা। ফলে সবেবরাত, ঈদ এইসব মহান দিবস কোনও কোনও সময় আগেভাগেই পালন করতে হচ্ছে আমাদের।’
রচনাটি খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর মাত্র তুলবে স্বপন তার আগেই রেখা এসে ঢুকল রুমে। স্বামীকে তখনও বিছানায় দেখে অবাক হল। ওমা, তুমি দেখি এখনও ওঠোইনি!
তেরো বছর একসঙ্গে থাকার ফলে স্ত্রীর গলার রুক্ষ্মতা বেশ সয়ে গেছে স্বপনের। কখন সত্যিকার রুক্ষ্ম হয় তার গলা কখন কোমল, ভালই বুঝতে পারে।
এখনও পারল। গলা স্বাভাবিকই আছে রেখার। হাসি হাসি মুখে তারপর স্ত্রীর দিকে তাকাল স্বপন। উঠিনি তো কী হয়েছে? এজন্য নিজের মাকে ডাকতে হবে নাকি?
কথাটা বুঝতে পারল না রেখা। বলল, কী বললে?
না মানে ‘মা’ বললে তো!
তাতে কী হয়েছে?
কিছুই হয়নি। যা বলছিলে বল।
তুমি বাথরুমে ঢুকবে কখন, কখন নাশতা করবে, কখন বেরুবে?
এত কখন কখন করো না। মজার একটা লেখা পড়লাম। মুডটা খুব ভাল। সেটা নষ্ট করো না।
তোমার মুড নষ্ট করার দরকার আমার নেই। ভাইয়া রেডি হয়ে বসে আছেন।
আমি আজ ভাইয়ার সঙ্গে বেরুব না। আমার লেট হবে।
কেন?
কোনও কারণ নেই। আমার ইচ্ছে। আমি কারও চাকরি করি না। পৈতৃক বিজনেস দুভাইয়ে মিলে দেখি। একদিন একভাই একটু লেটে গেলে কোনও অসুবিধা নেই।
সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে জব্দ করার চান্সটা নিল রেখা। ঠিক আছে, কথাগুলো তাহলে ভাইয়াকে গিয়ে বলে আসি।
শুনে ভয় পেয়ে গেল স্বপন। না না এভাবে বললো না। বলো আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। আমি ঘন্টাখানেক পরে যাব।
সকালবেলা মিথ্যে কথা আমি বলতে পারব না।
রেখার চোখের দিকে তাকিয়ে খুবই রোমান্টিক স্বরে স্বপন বলল, হাজব্যান্ডের জন্য মেয়েরা কত স্যাক্রিফাইস করে, আর তুমি এই সামান্য কাজটা করতে পারবে না?
রেখার বোধহয় একটু মায়া হল। স্বভাবসুলভ রক্ষ্ম গলা যতটা সম্ভব নরম করে বলল, ঠিক আছে, করছি।
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে রেখা, গলা আগের চেয়েও বেশি রোমান্টিক করে স্বপন বলল, শোন।
রেখা ঘুরে দাঁড়াল। কী?
কাছে এস।
আনমনা ভঙ্গিতে স্বামীর কাছে এসে দাঁড়াল রেখা। উঠে বসল স্বপন। হাত বাড়িয়ে স্ত্রীর চিবুকের কাছটা ধরল। তুমি কী ভাল! তোমার মতো ভাল বউ আমি জীবনে দেখিনি।
সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা মেরে স্বপনের হাত সরিয়ে দিল রেখা। সত্যিকার রুক্ষ্ম গলায় বলল, সকালবেলা এসব ঢং করো না। বিচ্ছিরি লাগে।
ব্যাপারটা একটু অপমানকর। কিন্তু এই অপমান গায়েই লাগল না স্বপনের। নির্বিকার গলায় সে বলল, আচ্ছা করলাম না। কিন্তু আমার যে একটা মেয়ে আছে, সাত আটবছর বয়স, নাম হচ্ছে টুপলু, সে কোথায়?
জানি না।
.
টুপলুর খুবই সাজগোজের শখ।
আটবছর বয়সে সে একটু বেশি লম্বা, বেশি রোগা। হলে হবে কী, মুখটা অসম্ভব মিষ্টি। কথা বলে একটু বেশি জোর দিয়ে। ফলে কথা বলার সময় গলার একপাশের রগ ফুলে ওঠে।
আর টুপলু হচ্ছে অসম্ভব আদুরে স্বভাবের। যে কোনও বিষয়ে তার অনেক অভিযোগ, অনেক কান্না। ছোটখাট বহু ব্যাপার তীক্ষ্ণচোখে খেয়াল করে।
ছোট খালামণির গায়ে হলুদ উপলক্ষে টুপলুকে তার মা আড়াই হাজার টাকা দামের লাল টুকটুকে একটা কাতান শাড়ি কিনে দিয়েছিল। সঙ্গে ব্লাউজ ছায়া, রুপোর গহনা, মল। বেইলি রোডের শাড়ির মার্কেটে শিশুদের এইসব জিনিসও পাওয়া যায়।
সেই লাল কাতান আর গহনা ইত্যাদি পরে খালামণির বিয়েতে টুপলু একেবারে ছবির মতো ফুটেছিল। কতজন কত যে ছবি তুলেছে তার! মা বাবার বেডরুমে একটা ছবি বড় করে বাঁধানোও আছে।
আজ সকালে টুপলুর ইচ্ছে হল ওরকম সাজ সাজার।
শাড়ি গহনা ইত্যাদি হাতের কাছেই থাকে, চেসটার ড্রয়ারে। ড্রয়ার খুলে জিনিসগুলো নিয়ে সে সোজা এসেছে মুন্নির রুমে। আপু, আমাকে বউ সাজিয়ে দাও।
মুন্নি একটু মোটাসোটা, গোলগাল ধরনের ফর্সা মেয়ে। ঘাড়টা সামান্য ছোট। কখনও কখনও তীক্ষ্ণচোখে খেয়াল করলে তাকে সামান্য কুঁজো দেখায়। তবে বেশ মেজাজি মেয়ে সে। মুড ভাল থাকলে টুপলুর জন্য সব করে আর খারাপ থাকলে ধমক দিয়ে বিদেয় করে দেয়।
ধমক খেয়ে কাঁদে টুপলু ঠিকই কিন্তু আবার যখন কোনও ব্যাপারে মুন্নির দরকার হয় সব ভুলে তার কাছে আসে। মুন্নির মুড ভাল কী খারাপ তোয়াক্কা না করে নিজের কথাটা বলে। ধমক খাবে কী খাবে না বুঝতে পারে না।
আজও পারেনি।
তবে ভাগ্য ভাল টুপলুর মুন্নির মুড আজ ভাল ছিল। নিজের বিছানায় শুয়ে কমিকস পড়ছিল সে। কমিকসটা বোধহয় ভাল লাগছিল না। এজন্য কথাটা টুপলু বলার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল। আয় সাজিয়ে দিচ্ছি। খুব মজা হবে।
তারপর থেকে টুপলুকে শাড়ি পরাচ্ছে মুন্নি। বউ সাজাচ্ছে। যে কোনও কাজ একটু সময় নিয়ে করার স্বভাব তার। আস্তেধীরে গুছিয়ে গাছিয়ে নিখুঁতভাবে করার স্বভাব। এখনও সেভাবেই করছে। হঠাৎ টুপলু বলল, আপু, আমাকে যেন একদম বউর মতো লাগে।
টুপলুর ছোট্ট কোমরে শাড়ি গুজতে গুজতে মুন্নি বলল, লাগবে। কিন্তু কথা বললে হবে না।
কেন?
নতুন বউরা কথা বলে না।
কথা বললে কী হয়?
এবার মুন্নি একটু রাগল। জানি না।
মুন্নির রাগ পাত্তা দিল না টুপলু। বলল, কেন জান না?
আমার ইচ্ছে আমি জানি না।
এমন ইচ্ছে কেন তোমার?
চুপ করলি?
এবার মুন্নির রাগ বুঝতে পারল টুপলু। সে চুপ করল।
শাড়ি পরানো শেষ করে টুপলুকে গহনা পরাতে লাগল মুন্নি। পরাতে পরাতে বলল, প্রথমে যাবি ভাইয়ার রুমে।
টুপলু অবাক। ভাইয়ার রুমে কেন?
তুই যে বউ সেজেছিস ভাইয়াকে দেখাবি না?
দেখাব তো!
তাহলে?
আচ্ছা যাব।
তারপর যাবি ফুপির রুমে। গিয়ে আড়াল থেকে নাম ধরে ডাকবি। তারপর হঠাৎ করে সামনে যাবি।
কেন এমন করব?
মজা করার জন্য। তোকে দেখে যেন চমকে যায়।
শুনে খুশি হয়ে গেল টুপলু। আচ্ছা।
পুরোপুরি বউ সাজার পর পা টিপে টিপে বাবলুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াল টুপলু। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতর উঁকি দিল।
পড়ার টেবিলে বসে আছে বাবলু। সামনে মোটা একটা বই খোলা পড়ে আছে। কিন্তু পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। কানে ওয়াকম্যানের হেডফোন লাগানো। তারপরও কোনওদিকে তাকাচ্ছে না।
পাখির মতো গলায় বাবলুকে ডাকল টুপলু। বাবলু ভাইয়া।
বাবলু শুনতে পেল না।
টুপলু আবার ডাকল। এবারও শুনতে পেল না বাবলু। খানিক দাঁড়িয়ে টুপলু ভাবল, কী করা যায়? তারপর পা টিপে টিপে বাবলুর পেছনে এসে দাঁড়াল। দুবার ডেকে সাড়া পায়নি বলে মেজাজ বোধহয় একটু খারাপ হয়েছিল। এবার ডাকলেও হয়তো শুনবে না ভেবে বাবলুর কোমরের কাছে একটা খোঁচা মারল সে। এই বাবলু ভাইয়া, এই, তুমি শোন না?
চমকে পেছন ফিরে তাকাল বাবলু। কান থেকে হেডফোন খুলল। কানে হেডফোন থাকলে বাইরের কথা তেমন শোনা যায় না। তাছাড়া ওয়াকম্যানে বাজছে রিকি মার্টিনের মারিয়া। অত ধুমধারাক্কা মিউজিক এবং চিৎকার চেঁচামেচির গান বাজলে কি অন্যকিছু শোনা যায়?
হেডফোন খুলে অবাক বিস্ময়ে টুপলুর দিকে তাকাল বাবলু। তুই কে রে?
টুপলু অবাক। আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?
না।
একদম চিনতে পারছ না?
একদম চিনতে পারছি না।
টুপলু হি হি করে হাসল। আমি টুপলু।
বাবলু খুবই মজার মুখভঙ্গি করল। ও তুই টুপলি?
তারপরই আচমকা রেগে গেল। যা ভাগ এখান থেকে।
বাবলুর বাঁজখাই গলা শুনে প্রথমে একটু ভড়কাল টুপলু। তারপর শাড়িটা সামান্য তুলে ধরে, মুখ ভেংচে দৌড় দিল।
শাড়ি পরা থাকলে দৌড়তে যে অসুবিধা এই বয়সেই টুপলু তা বুঝে গেছে।
.
এ্যালবামের মাঝামাঝি জায়গায় নিজের সুন্দর ছবির তলায় শুভর একটা ছবি রেখে দিয়েছে সেতু। যখনই ইচ্ছে হয় ছবিটা একবার বের করে দেখে। ছবির সঙ্গে মনে মনে কথা বলে।
আজ সকালে বারান্দা থেকে ফিরে এসে শুভর জন্য এতই কাতর হল সে, ছবিটা বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। মনে মনে কথা বলা শুরু করার আগে বেশ কিছুদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল। শুভ বলেছিল সাড়ে বারোটার দিকে রমনা রেস্টুরেন্টে সেতুর জন্য অপেক্ষা করবে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আসবে সেতু। আর সেতুর আগেই রেস্টুরেন্টের লেক সাইডের ঝুল বারান্দায় এসে বসে থাকবে শুভ। কোত্থেকে আসবে, বলেনি।
সেতুর নিয়ম হল শুভ যে সময় দেয় তারচে পাঁচ দশমিনিট দেরি করে পৌঁছানো। দেরিটা সে ইচ্ছে করেই করে। কারণ জায়গা মতো পৌঁছে শুভকে না পেলে তার মেজাজ খুবই খারাপ হয়। সময়ের পাঁচ দশমিনিট আগ থেকেই এসে বসে থাকে শুভ। সেতুর জন্য অপেক্ষা করে। এসব সেতু জানে। তবু সে আসে দেরি করে। যদি শুভর কখনও পাঁচ দশমিনিট দেরি হয়ও তবু সেতু এসে তাকে পাবে।
সেদিন হয়ে গেল ভয়ংকর কাণ্ড। পৌনে একটার দিকে পৌঁছে সেতু দেখে শুভ নেই। দেখে প্রথমে বিশ্বেস হয়নি শুভ সত্যি সত্যি পৌঁছয়নি। মনে হয়েছে নিশ্চয় পৌঁছে গেছে। হয়তো টয়লেট ফয়লেটে গেছে।
কিন্তু টয়লেটে যাওয়ার দরকার হলেও সেতু এসে পৌঁছবার আগেই শুভ তা সেরে রাখে। সেতুর আসার সময় হয়ে গেছে আর শুভ পৌঁছয়নি কিংবা টয়লেটে, এমন কখনও হয়নি।
সেতু বেশ বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল কিন্তু বিশ্বাস করল না যে শুভ পৌঁছয়নি। সে একটা টেবিলে বসে রইল।
পাঁচমিনিট দশমিনিট পনেরমিনিট চলে গেল শুভর দেখা নেই। ভেতরে ভেতরে মেজাজ খারাপ হতে লাগল সেতুর। সুন্দর মুখে এসে ভর করতে লাগল বিরক্তি।
এইসব রেস্টুরেন্টের ওয়েটারগুলো তালে থাকে কাস্টমার এসে টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গে কতক্ষণে অর্ডার নেবে, কতক্ষণে খাবার সার্ভ করবে।
সেতুর ক্ষেত্রেও তাই করল।
মেনু হাতে ওয়েটার এসে সামনে দাঁড়াল। কী খাবেন ম্যাডাম? চায়নিজ থাই। ইন্ডিয়ান না বাংলাদেশী খাবার?
সেতুর প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল, তোমার মুণ্ডু।
অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল সে। কোনও রকমে বলল, পরে অর্ডার দেব।
লোকটির বোধহয় বেশি কথা বলার স্বভাব। বলল, কত পরে?
জানি না।
জ্বী?
আমি একজনের জন্য ওয়েট করছি। সে আসুক, তারপর।
লোকটি বিগলিত হাসল। আমিও তাই ভেবেছি। আপনার মতো ম্যাডামরা একা এসে কখনও খায় না। স্যার আসবেন কখন?
বিরক্তি তখন চরমে সেতুর। তবু চেপে রাখতে হল। এই এক্ষুণি চলে আসবে।
শুভ এল একটা দশে। অর্থাৎ তার হিসেবে চল্লিশমিনিট লেট, আর সেতু আসার পর পঁচিশমিনিট। কিন্তু মুখটা খুবই করুণ তার এবং সামান্য হাঁপাচ্ছিল। দিশেহারা ভঙ্গিতে রেস্টুরেন্টের ঝুলবারান্দায় ছুটে এসেছিল সে, প্রায় হুড়মুড় করে সেতুর মুখোমুখি চেয়ারে বসেছিল। কখন এসেছ তুমি? নিশ্চয় অনেকক্ষণ! ইস আমার অনেক দেরি হয়ে। গেল। কী করব বল? আমাদের তো গাড়ি নেই! রিকশা স্কুটারে চলাফেরা করতে হয়। স্কুটার বেশ এক্সপেনসিভ। তারপরও তোমার জন্য আজ স্কুটারে চড়েছিলাম। কিন্তু। স্কুটারগুলোর যা নেচার। হয় প্লাকে ময়লা আসে, নয় স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। আমারটারও তাই হয়েছে আজ। পার্কের ওদিকটায় এসে একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছিল না।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল সেতু। থমথমে গলায় বলল, আমি এখন চলে যাব। পরিবেশ ভুলে থাবা দিয়ে তার হাত ধরল শুভ। পাগল হয়েছ নাকি? আমি এত কষ্ট করে এলাম আর তুমি চলে যাবে? আমি কি ইচ্ছে করে লেট করছি? আজ পর্যন্ত কখনও এমন হয়েছে, বল? স্কুটার নষ্ট হয়ে গেলে আমি কী করব? বাড়ি থেকে বেরিয়েছি অনেক আগে। বারোটার দিকে। হেসে খেলে সোয়া বারোটা কিংবা বারোটা বিশে এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
এত কথা আমি শুনব না।
শুনতে হবে। কারণ আমি তোমার জন্য খুব কষ্ট করেছি। স্কুটার নষ্ট হওয়ার পর রিকশা টিকশা নিইনি। এই এতটা পথ পার্কের ভেতর দিয়ে দৌড়ে এলাম। তাও যেই। সেই দৌড়, একেবারে পাগলের মতো। ছেলেবেলার পর এমন দৌড় কখনও দৌড়াইনি। দেখছ না এখনও কেমন হাপাচ্ছি!
শুভর কথা শুনে মনটা একটু নরম হল সেতুর। তবু রাগি ভাবটা বজায় রাখল সে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় হাঁপাচ্ছ? তোমাকে একেবারে নরমাল মনে হচ্ছে।
শুভ তার নির্মল হাসিটা হাসল। মনে হওয়ার কারণ আছে। বস, বলছি।
যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল সেতু।
শুভ বলল, আসলে হয়েছে কী, দৌড়াতে দৌড়াতে রেস্টুরেন্টের সামনে এসেছি, এসে ভাবলাম এমন হাঁপাতে হাঁপাতে এই ধরনের রেস্টুরেন্টে ঢোকা ঠিক হবে না। এক দুমিনিট রেস্ট নিয়ে নিই।
কেন, রেস্ট নিতে হবে কেন? হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলে কী হতো?
লোকে কী ভাবত, বল! তার ওপর তুমি এভাবে একা বসে আছ! আমার জন্য ওয়েট করছ। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে, হাঁপাতে হাঁপাতে তোমার কাছে এলাম। দৃশ্যটা দেখতে কি ভাল লাগবে?
অন্যের কথা জানি না, আমার খুব ভাল লাগত।
কেন?
মনে হতো আমার জন্য পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে যে কোনওভাবে ছুটে আসতে পার তুমি। কোনও কিছুই কেয়ার কর না।
সেতুর চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় শুভ বলল, সত্যি আমি ছুটে এসেছি সেতু, সত্যি আমি কোনও কিছু কেয়ার করিনি! তোমার জন্য সব পারি আমি, সব।
বুক পকেট থেকে তারপর টকটকে লাল একটা গোলাপ বের করেছিল শুভ। সেতুর হাতে দিয়ে বলেছিল, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।
এই মুহূর্তে শুভর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন শুভর সেদিনকার কথা আবার শুনতে পেল সেতু। ভুলে গেল সে তাকিয়ে আছে শুভর ছবির দিকে। নিজের অজান্তেই পরিষ্কার উচ্চারণে সেতু বলল, আমিও তোমাকে ভালবাসি। আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি।
সঙ্গে সঙ্গে সেতুর পেছন থেকে পাখির মত মিষ্টি আদুরে গলায় কে যেন বলল, তা তো আমি জানিই।
এ হচ্ছে টুপলু। প্ল্যান মতো বাবলুর রুম থেকে সেতুর রুমে এসেছে সে। এসে দেখে সেতু মগ্ন হয়ে আছে এ্যালবামে। কোনওদিকে খেয়াল নেই। ফুপিকে চমকে দেয়ার জন্য পা টিপে টিপে তার একেবারে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তখনই ভালবাসার কথাটা বলেছে সেতু। টুপলু ভেবেছে তাকে দেখতে পেয়েও মজা করার জন্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকেই কথাটা বলেছে ফুপি। এজন্য সেও মুগ্ধ গলায় জবাব দিয়েছে।
কিন্তু টুপলুর গলা শুনে চমকে উঠল সেতু। ঝটপটে হাতে শুভর ছবি চালান করে দিল নিজের ছবির তলায়। এ্যালবাম বন্ধ করল। টুপলুকে দেখতে পেল। ও তুই? আমি ভয় পেয়ে গেছি।
টুপলু অবাক হল। কেন? ভয় পাবে কেন? আমি কি ভূত?
মুখের মিষ্টি একটা ভঙ্গি করে, অতি আদুরে ভঙ্গিতে দুহাতে টুপলুকে বুকের কাছে। টেনে আনল সেতু। তুই তো ভূতই। ছোট্টভূত।
তারপর কী ভেবে বলল, না না তুই হচ্ছিস পেত্নি। পেত্নি। মেয়েভূতগুলোকে বলে পেত্নি। তোকে এরকম পেত্নির সাজ কে সাজাল রে?
শুনে টুপলু একেবারে হা হা করে উঠল। না না পেত্নির সাজ না তো! নতুন বউর সাজ। দেখছ না লাল শাড়ি, গহনা।
দেখছি।
টুপলু খুশি হয়ে বলল, আমাকে কেমন লাগছে ফুপি?
গাল টিপে টুপলুকে একচোট আদর করল সেতু। খুব সুন্দর লাগছে, খুব সুন্দর। একদম নতুন বউর মতো। এই তোর বিয়ে কবে রে?
টুপলু কথা বলবার আগেই কডলেস ফোন হাতে রানি এসে ঢুকল। আফা, আপনের ফোন। দোলন আফায় ফোন করছে।
লাফ দিয়ে উঠে ফোনটা নিল সেতু। দৌড়ে বারান্দায় চলে গেল।
তারপর যেন টুপলুকে খেয়াল করল রানি। মুখের হা-টা একটু বড় রানির। হাসলে দুদিক থেকে মুখ চলে যায় প্রায় কানের কাছাকাছি। এই ধরনের হাসিকে বলে আকৰ্ণ হাসি। সেই আকর্ণ হাসি হেসে বলল, আরে, এতক্ষুণ দেখি নাই? এইডা কে? কার বউ?
রানিকে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না টুপলু। রানি যতই আদর করে তাকে সে ততই বিরক্ত হয়।
এখনও হলো। রানির মুখের দিকে ফিরেও তাকাল না। গম্ভীর গলায় বলল, তোর বউ।
তারপর গুটগুট করে হেঁটে সেতুর রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু টুপলুর কথায় রানি খুব মজা পেয়েছে। রুমে কেউ নেই দেখে প্রাণখুলে আকর্ণ হাসিটা হাসতে লাগল সে।
.
তোর আজ কোনও কাজ আছে?
আপনি কে যে এভাবে আমাকে তুই তোকারি করছেন? অভদ্র, ছোটলোক। ফোন তুলেই কেউ কাউকে তুই তোকারি করে? ভদ্রতা শেখেননি? বাড়িতে কি নতুন ফোন লেগেছে? আজকের আগে টেলিফোনে কখনও কথা বলেননি? টেলিফোনে কথা বলা শিখে তারপর আমাকে ফোন করবেন।
গলা অন্যরকম করে কথা বলতে শুরু করেছিল সেতু। ফলে দোলন একটু ভড়কে গেল। তবে মুহূর্তের জন্যই। তারপরই নিজেকে ম্যানেজ করল। থাপ্পড় মেরে দাঁত ভেঙে ফেলব।
সেতু আগের গলায় বলল, ছি ছি ছি, আপনি কী রকম মেয়ে? মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়ের দাঁত ভেঙে ফেলতে চাইছেন? সত্যি যদি দাঁত ভেঙে দিন মেয়েটির তাহলে কী ক্ষতি হবে আপনি জানেন?
না জানি না। কী ক্ষতি হবে বল?
বোকরা দাঁত নিয়ে তার বিয়ে হবে কী করে?
‘বোকরা’ মানে?
মানে ফোকলা আর কী!
ফোকলা দাঁতে বিয়ে হলে কী হবে?
বর তাকে কিস করবে কেমন করে? কিস করার সময় ফোকলা দাঁতের ফোকড়ে শো শো করে শব্দ হবে না!
এ কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল দোলন। ইস তুই যা হয়েছিস না!
সেতুও হাসল। কী হয়েছি?
মহাপাজি।
তবে আমি যখন গম্ভীর গলায় কথা বলছিলাম তখন তোর চেহারাটা কেমন হয়েছিল, একজাক্টলি আমি তা দেখতে পাচ্ছিলাম।
কেমন বল তো?
সবকিছুর বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই। মাত্র একটা বিষয়ের বর্ণনা দিচ্ছি।
কোনও অসভ্য বিষয় না তো?
আরে না।
তাহলে বল।
তোর নাকটা আরও লম্বা হয়ে যাচ্ছিল। ঠোঁট ছাড়িয়ে ঝুলে পড়ছিল।
যা ভাগ।
সেতু চুপ করে রইল।
দোলন বলল, বললি না?
কী বলব? আজ কোনও কাজ আছে কি না?
না।
ইউনিভার্সিটি?
নেই। একটা সেমিস্টার গ্যাপ দিচ্ছি। তিনমাস ফ্রি।
গুড। আমাদের বাড়ি চলে আয়।
কেন? আমাদের কি বাড়িঘর নেই যে তোদের বাড়ি আসতে হবে!
আয় সারাদিন আড্ডা দেব।
আমি কি লেসবিয়ান যে তোর সঙ্গে আড্ডা দেব?
ছি। তোর মুখে দেখি কোনও কথাই আটকায় না।
কেন আটকাবে? আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে যা মনে আসে, মুখে আসে বলতে পারব না?
ঠিক আছে যত ইচ্ছে বলার বলিস, আগে আমাদের বাড়ি আয়।
তোর ইউনিভার্সিটি নেই?
আছে। যাব না।
কিন্তু তোর সঙ্গে আড্ডা দিতে যে আমার ভাল লাগবে না।
কার সঙ্গে লাগবে?
তুই জানিস।
অপজিট সেক্স?
এখন যে তুই সেক্স সেক্স করছিস তোর মুখে আটকাচ্ছে না?
এবার যেন একটু অধৈর্য হল দোলন। এত প্যাচাচ্ছিস কেন? বল না আসবি কি না! তোর যার সঙ্গে আড্ডা দিতে ভাল লাগবে তাকেও আসতে বলি।
সত্যি?
সত্যি।
চারদিক তাকিয়ে সাবধানি গলায় সেতু বলল, তুই তাহলে শুভকে ফোন কর। বল বারোটার মধ্যে যেন তাদের বাড়িতে চলে আসে। আমি তার আগেই চলে আসব।
এক্ষুনি করছি। তবে তুই বাড়িতে বলে আয় বিকেল পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকবি।
খাওয়া?
না খাইয়ে রাখব তোদেরকে। সিরিয়াসলি।
তারপর একটু থেমে বলল, খিচুড়ি আর ডিম ভাজা করা হবে। আয়।
তুই শুভকে ফোন কর।
করছি।
সেতুর লাইন কেটে শুভদের নাম্বারে ডায়াল করতে লাগল দোলন।
২. তোমাকে দেখছি
তোমাকে দেখছি।
আমাকে দেখার কিছু নেই।
আছে।
পাকামো করতে হবে না। যা গিয়ে পড়তে বস।
মুন্নি একটু অবাক হল। এখন পড়তে বসব কেন? হাফইয়ার্লি মাত্র শেষ হয়েছে। এখন আমাদের ছুটি।
ছুটির সময় পড়তে হয় না? ছুটির সময় পড়তে আমার ভাল লাগে না।
কিন্তু পড়া উচিত। ক্লাশ এইটের রেজাল্ট ভাল না হলে নাইনে তোকে ভাল সাবজেক্ট দেবে না। সায়েন্স কিংবা কমার্স তুই পাবি না। আমি ভিকারুননিসায় পড়েছি। ওই স্কুলের নিয়ম আমি জানি।
ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। ভাল সাবজেক্ট আমি পাব। দেখো সায়েন্সই পাব আমি।
তারপর একটু থামল মুন্নি। মুগ্ধ গলায় বলল, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ফুপি।
এবার মুন্নির দিকে ফিরল সেতু। সুন্দর করে হাসল। আমি সব সময়ই সুন্দর।
আজ একটু বেশি লাগছে। ইস্ আমি যদি তোমার মতো সুন্দর হতাম।
উঠে মুন্নির সামনে এল সেতু। দুহাতে মুন্নির মুখটা অতি আদুরে ভঙ্গিতে তুলে ধরল। আমার মতো হবি কেন? তুই আমর চেও সুন্দর।
.
শুভকে খুঁজতে তার রুমের দিকে যাচ্ছিল মালা।
হাতে মুখবন্ধ মোটাসোটা একটা এয়ারমেইল খাম আর পঞ্চাশ টাকার একটা নোট।
রুমে ঢোকার আগেই শুভর সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল।
শুভ বেশ ফিটফাট হয়ে বেরুচ্ছে। ফেডেড জিনসের সুন্দর প্যান্ট পরেছে, পায়ে কালো বুট, গায়ে বরফ সাদা টিশার্ট। খানিক আগে শেভ করেছে, মাথায় শ্যাম্পু করে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করেছে বলে খুবই ফ্রেস লাগছে তাকে। তার ওপর বেশ পুরুষালি, সুন্দর গন্ধের পারফিউম ইউজ করেছে। সেতুর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা থাকলে এরকম ফ্রেস হয়েই বেরয় সে।
তবু মালা তাকে বলল, তুই কি বেরুচ্ছিস?
দেখে বোঝা যাওয়ার পরও এরকম প্রশ্ন! শুভ খুবই ঠাট্টার ছলে নিল কথাটা। সিরিয়াস মুখ করে বলল, না, টয়লেটে যাচ্ছি।
মালা একটু থতমত খেল। কী?
হ্যাঁ। এরকম সাজগোজ করে, জিনস বুট পরে, টিশার্ট পরে, পারফিউম না লাগিয়ে আমি কখনও টয়লেটে যাই?
মালার স্বভাব হচ্ছে অতিশয় ন্যাকামো করা, অতিশয় আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলা। ভাইয়ের সঙ্গে একটা দুটো কথা বলার পরই সেই ভঙ্গিটা বেরিয়ে এল। দেখ তুই কিন্তু আমার সঙ্গে ফাজলামো করবি না। বল না, বেরুচ্ছিস?
শুভ একটু রুক্ষ্ম হল। শোন মালা…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখ বড় করল মালা। আপা না বলে হঠাৎ যে নাম ধরে ডাকছিস? বড় বোনকে কেউ নাম ধরে ডাকে?
তোর মাথায় ঘিলু আছে কী নেই পরীক্ষা করার জন্য ডাকলাম। সামান্য আছে। এজন্য নাম ধরে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে রিয়্যাক্ট করলি। তবে আর একটু ঘিলু তোর মাথায় থাকা খুব দরকার ছিল। তাহলে বুঝতি এইসব পোশাক পরে কেউ বসে থাকে না। দেখেই বোঝা যায় সে কোথাও বেরুচ্ছে। প্রশ্ন করার দরকার হয় না।
ছোট্ট শিশুর মতো আদুরে ভঙ্গিতে গাল ফোলাল মালা। হয়েছে, আর বলতে হবে না।
তারপর একটু থেমে বলল, বাইরে যখন বেরুচ্ছিসই, আমার কাজটা করে দিস সোনা।
কাজ মানে চিঠি পোস্ট করা।
হ্যাঁ। তুই তো জানিসই।
কিন্তু প্রত্যেক সপ্তাহে দুলাভাই ফোন করছেন, ফোন করলে আধঘণ্টার কম কথা বলেন না, বিদেশে থেকে বেচারা যা রোগজার করছেন সবই টেলিফোন বিলে চলে যাচ্ছে, তারপরও প্রতি সপ্তাহে তুই তাকে দেড় দুদিস্তা করে চিঠি লিখছিস! তোদের কথা কি ফুরোয় না?
না ফুরোয় না। সারাজীবন ধরে বললেও ফুরোবে না।
খামটা শুভর হাতে দিল মালা। যেখানেই যাস চিঠিটা পোস্ট করে তারপর যাবি।
ডানহাতে খাম ধরে বা হাতটা মালার দিকে বাড়াল শুভ। রিকশা ভাড়া দে।
পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিল মালা। চিঠি পোস্ট করতে বিশ টাকা আর দশটাকা তোর রিকশা ভাড়া। বাকি বিশ টাকা আমাকে ফেরত দিবি।
শুনে খ্যাক করে উঠল শুভ। তোর সাহস তো কম না। ছোটভাইর কাছে বিশটাকা ফেরত চাইছিস? আচ্ছা দেব কিন্তু তোর চিঠি আর কখনও পোস্ট করব না।
মালা মুম্বাই সিনেমার ভাইভক্ত বোনের ভঙ্গিতে বলল,এখন আমাকে তাহলে কী করতে হবে?
বল, বিশটাকা ফেরত দিতে হবে না, সোনা।
মালা মিষ্টি করে হাসল। আচ্ছা বললাম।
পুরো সেনটেনসটা বল।
বিশটাকা ফেরত দিতে হবে না, সোনা।
দ্যাটস গুড।
টাকাটা পকেটে খুঁজে বাড়ি থেকে বেরুল শুভ।
.
এক্সপোর্টফেয়ার থেকে কিছু ফুল কিনেছিল দোলন।
আসল ফুলের চেয়েও সুন্দর। বাড়িতে কারও আসার কথা থাকলে ড্রয়িংরুমের ফুলদানিগুলোতে সেই ফুল খুবই মন দিয়ে, পরিপাটি করে সাজায়।
কথাটা সেতু জানে।
এখন কি সেই ফুলই সাজাচ্ছে দোলন! না হলে সেতু যে ওদের বাড়িতে ঢুকল টের পেল না কেন! সেতুর আসার কথা থাকলে নীচতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে সে। অন্তত পাঁচ দশমিনিট আগ থেকে গেট বরাবর কোথাও না কোথাও সে থাকবেই যেখান থেকে সেতুকে ঢুকতে দেখা যাবে।
আজ কী হল?
নাকি সময়ের অনেক আগে চলে এসেছে সেতু!
সেতু ঘড়ি দেখল। না, ঠিক সময়েই এসেছে। বারোটা বাজতে দশমিনিট বাকি।
সেতু তারপর পা টিপে টিপে দোলনদের ড্রয়িংরুমের সামনে এসে দাঁড়াল।
হ্যাঁ যা ভেবেছিল তাই। ফুল সাজাচ্ছে দোলন। খুবই মগ্ন হয়ে সাজাচ্ছে। কোনওদিকে খেয়াল নেই।
নিঃশব্দে খানিক দাঁড়িয়ে দোলনকে দেখল সেতু, তারপর মৃদুশব্দে গলা খাকাড়ি দিল। দোলন একেবারে চমকে উঠল। দরজার দিকে তাকিয়ে সেতুকে দেখে হাসল। ও তুই? কখন এলি?
সেতু ভেতরে ঢুকল।
অনেকক্ষণ।
যাহ।
সত্যি। তুই টেরই পাচ্ছিলি না।
তারপরই যেন সেতুকে খেয়াল করে দেখল সে। দেখে খুবই মুগ্ধ হল। চোখ বড় করে বলল, কিন্তু তোকে দেখে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
কেন?
কী যে সুন্দর লাগছে!
ফুল রেখে সেতুর একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াল দোলন। এই, তুই এত সুন্দর কেন?
লম্বা সোফায় এককোণে বসল সেতু। বাস মালিকদের মতো কথা বলবি না।
মানে?
কোনও কোনও বাসের পেছনে লেখা দেখবি ‘পৃথিবী এত সুন্দর কেন? এই কেনর উত্তর কী?
ঠোঁটের মজাদার একটা ভঙ্গি করল দোলন। বাপরে, তুই দেখি মহাযুক্তিবাদি হয়ে গেছিস।
কিন্তু সে কোথায়?
নিশ্চয় রিকশায়। অস্থির হওয়ার কিছু নেই। বলেছে টাইমলি চলে আসবে। যে টাইমে আসার কথা সেই টাইমের আরও সাত মিনিট বাকি আছে।
আচমকা সেতু তারপর বলল, তোদের বাড়িতে কী হয়েছে?
দোলন অবাক হল। কই কিছু হয়নি তো।
তাহলে এমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছে কেন? অবশ্য তোদের বাড়িটা এমনিতেই ভুতুড়ে ধরনের।
আর তোদেরটা হচ্ছে জঙ্গল। দিনদুপুরে বেজী চড়ে বেড়ায়।
কথাটা পাত্তা দিল না সেতু। বলল, বল না বাড়িটা আজ এত ভুতুড়ে লাগছে কেন?
দোলন তার লম্বা নাকের ডগাটা একটু মুছল। বাড়িতে কেউ নেই। আমি আর দুটো কাজের বুয়া।
খালাম্মা খালুজান কোথায়?
দুজনেই যশোর গেছেন। ভাইয়ার ওখানে।
বাড়িতে শুধু তুই?
হ্যাঁ। অসুবিধা কী?
এই বয়সী মেয়েকে কাজের বুয়াদের কাছে রেখে…
দোলন হাসল। মা বাবা দুজনেই জানেন আমি খুবই বাঁজখাই টাইপের মেয়ে। আমার কাছে কেউ ভিড়বে না।
তোর জায়গায় আমি হলে এই চান্সটা যে কী নেয়া নিতাম না।
কী করতি?
ওকে রেখে দিতাম বাড়িতে।
শুনে চোখ বড় করল সেতু। কী?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
টাকা পয়সা দিয়ে কাজের বুয়া দুটোকে ম্যানেজ করে ফেলতাম। ওকে বলতাম বাড়ি থেকে ব্যাগট্যাগ নিয়ে চলে আস। বলবে ঢাকার বাইরে কোনও বন্ধুর ওখানে বেড়াতে যাচ্ছ।
তারপর?
মা বাবা যে কদিন না আসবে আমার সঙ্গে থাকবে সে।
রাতেও?
তবে!
বলিস কী? রাতে একসঙ্গে থাকা মানে…
মানে ফানে নিয়ে আমি ভাবছি না। যাকে ভালবাসি, যার জন্য মরে যেতেও পারি তাকে নিয়ে ওসব ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ভাব করব কেন? সে যেমন করে আমাকে চাইবে আমিও তেমন করে তাকে চাইব। দুজন দুজনকে চাইলে অসুবিধা কী?
ওরকম করে চাসনি এখনও?
না। চান্স পাইনি। জায়গা কোথায়?
আমি ব্যবস্থা করে দিই। তুই আমাদের বাড়িতে কয়েকদিন থাকবি বলে চলে আয়। শুভ ভাইকেও বল চলে আসতে।
সেতু খুবই উজ্জ্বল হল। অমন করতে পারলে বেশ হয়, না?
হ্যাঁ। করবি?
ধ্যাৎ!
লজ্জায় লাল হল সেতু। এসব ভাবতে ভাল লাগে কিন্তু করতে পারব না। বিয়ের আগে অমন করে শুভকে আমি পেতে চাই না। আমার মন ভরবে না।
ঠিক তখুনি কলিংবেল বাজল। দোলন লাফিয়ে উঠল। ওই এসে গেছে। তুই বোস, আমি গেট খুলে দিচ্ছি।
দোলন ছুটে বেরিয়ে গেল।
.
দুপুরবেলা অফিস ফেলে বাড়ি চলে এসেছে শাহিন এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি।
আজ কেন ফিরল?
বেডরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অবাক বিস্ময়ে স্বামীর দিকে তাকাল সুরমা। উতলা গলায় বলল, কী হয়েছে? এ সময় ফিরে এলে যে? অফিস করনি?
কাতর ভঙ্গিতে বিছানায় বসল শাহিন। ছুটি নিয়ে এসেছি। শরীর ভাল লাগছে না।
কোনও রকমে জুতোটা খুলল শাহিন, মোজা খুলতে পারল না। শুয়ে পড়ল।
ভারি শরীর নিয়েও দ্রুত বিছানার কাছে ছুটে এল সুরমা। ব্যস্ত ভঙ্গিতে শাহিনের কপালে হাত দিল। জ্বর এল না-কি? হ্যাঁ, শরীর বেশ গরম।
চোখ বন্ধ করে শাহিন বলল, মাথাটাও খুব ধরে আছে।
মাথায় পানি দিয়ে দেব?
দাও। একটা চাঁদরও গায়ে দিয়ে দাও। ঠাণ্ডা লাগছে।
ওয়ার্ডরোব থেকে চাঁদর বের করে শাহিনের গায়ে দিয়ে দিল সুরমা। তারপর বাথরুম থেকে প্লাস্টিকের বড় বালতি ভরে পানি আনল, মগ আনল, এনে অতিযত্নে। স্বামীর মাথায় পানি দিতে লাগল।
এ সময় হন্তদন্ত হয়ে মা এসে ঢুকলেন। শাহিন, কী হয়েছে বাবা?
তারপর ছেলের কপালে হাত দিলেন। ইস্ শরীর একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। কখন এরকম জ্বর এল? সকালবেলা আমাকে বলবি না! জ্বর নিয়ে অফিসে গেলি কেন?
শাহিন মুমুর্ষ গলায় বলল, তখন ছিল না। অফিসে যাওয়ার পর মাথা ব্যথা শুরু হল। শীত করতে লাগল। তারপর জ্বর এল।
পানি দেয়া বন্ধ করে উঠল সুরমা। তোয়ালে দিয়ে শাহিনের মাথা ভাল করে মুছে ঠিকঠাক মতো শুইয়ে দিল তাকে। তারপর কিচেনের দিকে চলে গেল। মা বসে রইলেন শাহিনের মাথার কাছে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এককাপ র চা আর একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নিয়ে এল সুরমা। শাহিনকে বলল, উঠে বস। গরম গরম র চায়ের সঙ্গে ট্যাবলেটটা খেয়ে নাও। এ এমন কিছু না। শর্দি জ্বর। তিনবেলা তিনটা ট্যাবলেট খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে মুখিয়ে উঠলেন মা। কে বলেছে তোমাকে এসব ছাইপাস খেলে ঠিক হয়ে যাবে! তুমি কি ডাক্তার যে নিজের ইচ্ছে মতো অমুদ খাওয়াচ্ছ?
শাশুড়ির এই ধরনের আচরণে সুরমা একেবারে বিব্রত হয়ে গেল। কোনও রকমে বলল, শর্দি জ্বরে এই ট্যাবলেটই দেয় মা।
মা আগের মতোই রুঢ় গলায় বললেন, কোন ট্যাবলেট দেয় না দেয় সেটা ডাক্তার বুঝবেন। জ্বর এসেছে, তোমার উচিত ছিল টেলিফোন করে ডাক্তার ডেকে আনা।
চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকাল শাহিন। এইটুকু জ্বরে ডাক্তার ডাকবার দরকার কী?
তুই চুপ কর। দরকার আছে কি নেই আমি বুঝব! একা এতবড় একটা সংসার টানতে টানতে শেষ হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা কিন্তু বাড়িতে তার কোনও যত্নআত্তি নেই। ঠিক আছে, আমিই ডাক্তারকে ফোন করছি।
রাগি ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন মা।
শাহিন তারপর উঠে বসল। চায়ের কাপ এবং ট্যাবলেটের জন্য সুরমার দিকে হাত বাড়াল। দাও।
গভীর অভিমানে হাত সরিয়ে দিল সুরমা। না থাক। কেন? এসব খাওয়ার দরকার নেই। ডাক্তার আসুক।
স্ত্রীর অভিমানটা বুঝল শাহিন। মায়াবি গলায় বলল, মন খারাপ করো না। মা সব সময়ই এমন।
এমন ছিলেন না, হয়ে গেছেন। বাচ্চাকাচ্চা হয় না বলে আমাকে তিনি পছন্দ করেন না।
চায়ের কাপ এবং ট্যাবলেট হাতে কিচেনের দিকে চলে গেল সুরমা। শাহিনের মনটা খারাপ হয়ে রইল।
.
দুহাতে সেতুর একটা হাত ধরে শুভ বলল, কী করা যায় বল তো!
চোখ তুলে শুভর দিকে তাকাল সেতু। কী হয়েছে?
উঠতে বসতে মা শুধু গালাগাল করছেন।
কেন?
চাকরির জন্য। আমার এখনও রেজাল্ট বেরয়নি। এ অবস্থায় কোথায় চাকরি পাব? কে আমাকে চাকরি দেবে?
সেতু মুখ গোমরা করে বলল, এসব শুনতে আমার ভাল লাগছে না।
ভাল না লাগার কী হল?
এলাম তোমার সঙ্গে প্রেম করতে, তুমি বলছ সমস্যার কথা।
সমস্যা থাকলে বলব না?
না বলবে না।
তাহলে কী করব?
আমাকে দেখবে।
দেখছি তো।
না দেখছ না। শাড়ি পরে, এত সুন্দর করে সেজে এলাম আর তুমি আমার দিকে তাকিয়েও দেখছ না।
হাত ছেড়ে এক হাতে সেতুকে বুকের কাছে টেনে আনল শুভ। মুখটা সেতুর মুখের কাছে নিয়ে বলল, কে বলেছে তাকাইনি? তাছাড়া তাকাতে হবেই বা কেন? আমার। চোখ জুড়ে সারাক্ষণই তুমি! মন জুড়ে তুমি! চোখ বুজে, চোখ খোলা রেখে সারাক্ষণই তোমাকে দেখছি আমি।
সেতুর গালে ঠোঁট ছোঁয়াল শুভ। তারপর দুহাতে তার মুখটা তুলে ধরল। সেতুর চোখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বলল, তোমার মতো এত সুন্দর মুখ আমি আর কারও দেখিনি।
একথার পর দুহাতে শুভর গলা জড়িয়ে ধরল সেতু। এভাবে বল বলেই আর কারও কথা ভাবতে পারি না আমি।
শুভ অবাক হল। আর কারও কথা মানে? কার কথা ভাবতে চাও?
ভাবতে চাই না। বাধ্য হতে পারি।
কথাটার অর্থ কী?
অর্থটা তুমি জান। তোমার সঙ্গে বিয়েতে ভাইয়ারা কিছুতেই রাজি হবে না।
আবার সেতুর চোখের দিকে তাকাল শুভ। সেতু যেভাবে কথাটা তাকে বলেছিল ঠিক সেইভাবে বলল, এলাম তোমার সঙ্গে প্রেম করতে আর তুমি বলছ সমস্যার কথা।
শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল সেতু। আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিলে?
দিলাম। কিন্তু ভাইয়ারা যদি বিয়েতে রাজি না হন তাহলে তুমি কী করবে?
জানি না।
ভাবনি?
না।
আজ থেকে ভাববে।
এসব ভাবার দায়িত্ব আমার না।
তাহলে কার?
তোমার।
আমি যা ভাবব, যা করব তুমি তা মেনে নেবে?
তোমার কী মনে হয়?
মনে হয় নেবে। তবে ওই ধরনের পরিস্থিতি হলে তোমাকে নিয়ে আমি পালিয়ে যাব।
তাই নাকি?
কেন তুমি বিশ্বাস করছ না?
না।
বল কী?
কেন বিশ্বাস করছি না জানো? যত সহজে বলছ আমি জানি এত সহজে কাজটা তুমি করবে না। চট করেই বড় বড় কথা যারা বলে আসল সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তারা সাধারণত পিছিয়ে থাকে।
তার মানে আমার ওপর তোমার ভরসা নেই?
সেতু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, এইসব প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দেব না। আমি শুধু জানি, আমি তোমাকে ভালবাসি, এই জীবন আমি তোমার সঙ্গে কাটাব। কেমন করে কাটাব তুমি না পারলে সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব।
কথাটা শুনে খুব ভাল লাগল শুভর। মুগ্ধ চোখে সেতুর দিকে তাকিয়ে রইল সে।
.
বিকেলবেলা নিজের রুমে বসে টিভি দেখছে শিলা, দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে রেখা এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। আসব ভাবী?
টিভিস্ক্রিন থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখার দিকে তাকাল শিলা। এসো।
তারপর রিমোট টিপে টিভি অফ করল।
রুমে ঢুকে একটা কাপ শিলার দিকে এগিয়ে দিল রেখা। চা খাও।
কাপটা নিল শিলা। হঠাৎ চা নিয়ে এলে?
চা খেতে খুব ইচ্ছে করছিল।
বিকেলের চা খাওনি?
খেয়েছি। কিন্তু চাটা তেমন ভাল ছিল না। রানি এত অখাদ্য চা করে, মুখে দেয়া যায় না। এজন্য নিজেই চা করলাম। চা করার সময় মনে হল তোমার জন্যও করি।
শিলা চায়ে চুমুক দিল।
রেখা বলল, ঘরে ভালও লাগছিল না। ভাবলাম চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গে গল্প করি।
রেখা তার চায়ের কাপে চুমুক দিল।
শিলা বলল, বাচ্চারা কোথায়?
কম্পিউটার গেম খেলছে।
তিনজনেই?
না। মেয়ে দুটো। বাবলুকে দেখলাম না।
বোধহয় বাইরে গেছে।
কথাটা যেন শুনতে পেল না রেখা। কী রকম আনমনা হয়ে গেল।
ব্যাপারটা খেয়াল করল শিলা। কী হয়েছে তোমার?
রেখা চমকাল। কই, কিছু হয়নি তো।
আনমনা হয়ে আছ কেন?
কদিন ধরে সবকিছু খুব একঘেয়ে লাগছে। বাচ্চাদের হাফইয়ার্লি শেষ হল, বেশ কয়েকদিন ছুটি। তার আগে গেল সামার ভেকেশান, কিন্তু এবার কোথাও যাওয়া হল না।
হ্যাঁ। সবাই মিলে কোথাও গিয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে এলে হতো। বাচ্চাগুলো এনজয় করত, আমাদেরও ভাল লাগত।
বাড়িতে একটা উৎসব আনন্দ হলেও ভাল হতো। একঘেয়েমিটা কাটত।
সেতুর বিয়ে ছাড়া সেই সম্ভাবনা নেই।
কথাটা শুনে রেখা যেন একটু উৎসাহিত হল। পর পর দুটো চুমুক দিল চায়ের কাপে। ভাইয়াকে বল সেতুর বিয়ে দিয়ে দিক। আমরা কয়েকদিন মজা করি।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল শিলা। এত আদরের বোনকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে সে বোধহয় রাজি হবে না। তবে আমি মনে করি ভালপাত্র পেলে উপযুক্ত মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভাল।
রেখাও তার কাপে শেষ চুমুক দিল। ঠিক তখুনি রিনরিন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন। উঠে গিয়ে ফোন ধরল শিলা। হ্যালো।
ওপাশ থেকে বেশ ভরাট, পুরুষালি গলায় ভেসে এল, আমি আপনার একজন ভক্ত। আপনি এত সুন্দর, এত ভাল, আমার ভাষাজ্ঞান কম বলে আপনাকে আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না যে আপনার জন্য দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা আমি কী রকম, কী বলব, বেচায়েন, মানে বেচায়েন হয়ে থাকি। আমার খবু ইচ্ছে করে আপনাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু আপনার স্বামীর ভয়ে এটেম্পটা নিতে পারছি না। লোকটা এমন করে পাহারা দিয়ে রাখছে আপনাকে। এত বড় বড় ছেলেমেয়ে থাকার পরও স্ত্রীকে এভাবে পাহারা দিয়ে রাখার কী দরকার বলুন তো। যদিও আপনাকে দেখে বোঝা যায় না যে আপনার ছেলেমেয়ে হয়েছে। মানে বিয়ে যে হয়েছে এটাই বোঝা যায় না।
এসব কথা শুনতে শুনতে ঠোঁটে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল শিলার। গলাটা সে প্রথমেই চিনে ফেলেছিল কিন্তু কিছু বলেনি। এখন আড়চোখে একবার রেখার দিকে তাকাল। রেখা আনমনা হয়ে আছে। শিলা যে টেলিফোন ধরে আছে রেখা যেন তা দেখতেই পাচ্ছে না।
চাপা গলায় শিলা বলল, ফাজলামো করো না। রেখা আমার রুমে। আমরা দুজনে মিলে এইমাত্র চা খেলাম। কখন আসবে?
ওপাশে থতমত খেল মামুন। যাহ বাবা, ধরা খেয়ে গেলাম! আসতে একটু দেরি হবে বলেই ভাবলাম তোমাকে একটু পটাই যাতে বাড়ি গিয়ে কোনও কৈফিয়ত না দিতে হয়। রেখাই সব মাটি করে দিল।
বুঝলাম।
কী বল, একটু দেরি করে এলে কোনও অসুবিধা আছে?
ছে। কী কারণে দেরি করবে?
কারণ আবার কী, বিজনেস।
এত বিজনেস করার দরকার নেই। চলে এস।
ঠিক আছে আসছি। এক্ষুনি আসছি, যে কাজে দেরি হওয়ার কথা সেটা না হয় আজ করব না। শোন।
বল।
একটা জলচৌকির অর্ডার দিয়েছি। সঙ্গে নিয়ে আসব?
কথা না বলে হেসে টেলিফোন নামিয়ে রাখল শিলা।
.
এসবের কয়েকদিন পর সেতুর বিয়ের একটা প্রস্তাব এল।
স্বপন সেদিন বাড়ি ফিরল একটু রাত করে। ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই রুমের একপাশে রাখা দুটো চেয়ারের একটায় গা এলিয়ে বসল। রেখা টিভি দেখছিল। বলল, টিভিটা অফ কর।
মুখ ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল রেখা। কেন?
কথা আছে।
খুব জরুরি?
মোটামোটি।
কিন্তু আমি খুব ভাল একটা প্রোগ্রাম দেখছি।
আচ্ছা দেখ।
উঠে ড্রেসিংরুমের দিকে যাবে স্বপন, রেখা বলল, ঠিক আছে বল।
তারপর টিভি অফ করল।
স্বপন আবার আগের জায়গায় বসল। তোমার মেয়ে ঘুমিয়েছে?
রেখা গ্রীবা বাঁকাল। স্বাভাবিক গলাই রুক্ষ্ম হয়ে গেল তার। আমার মেয়ে মানে?
স্বপন হাসল। তোমার গর্ভজাত।
গর্ভটা কি আমি অন্য কারও কাছে গিয়ে তৈরি করে এনেছিলাম! নাকি মেয়েটা অন্য কোথাও থেকে নিয়ে এসেছি?
অন্য সময় হলে এই নিয়ে কিছু মজা করত স্বপন। এখন করল না। মুহূর্তে সারেন্ডার করল স্ত্রীর কাছে। সরি। ভুল হয়ে গেছে।
বল আমাদের মেয়ে।
বলছি। কোথায় সে? ঘুমিয়েছে?
হ্যাঁ।
তাহলে কথাটা বলা যায়। কারণ টুপলু শুনলে মুহূর্তে রাষ্ট্র হয়ে যাবে। ছুটে গিয়ে প্রথমেই বলবে মুন্নিকে। মুন্নি এবং সে দুজনে মিলে বলবে বাবলুকে। এক ফাঁকে হয়তো রানিকেও বলবে। অর্থাৎ মিনিট চার পাঁচেকের মধ্যে সারাবাড়ি জেনে যাবে।
রেখা আবার গ্রীবা বাঁকাল। কী এমন কথা?
সেতুর বিয়ে।
কথাটা যেন বুঝতে পারল না রেখা। গলা আরেকটু তীক্ষ্ণ হল তার। কী?
স্বপন আবার বলল, সেতুর বিয়ে।
মানে?
বিয়ের আবার মানে কী? বিয়ে। তেরো বছর আগে তোমার আমার যা হয়েছে। ফলাফল হচ্ছে একটি কন্যা সন্তান। ডাকনাম টুপলু। ভাল নাম…
বাজে কথা না বলে আসল কথাটা বল। কোথায় বিয়ে, কী বৃত্তান্ত?
অসাধারণ একটা পাত্র পাওয়া গেছে। ডালাসের কোন এক ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছে। আমাদের কাছাকাছিই বাড়ি। বনানীতে। তিন ভাইয়ের মধ্যে এই ছেলে ছোট। বোন নেই। বাবা এবং বড় দুভাই বিজনেস করে। মতিঝিলে একটা অফিস আরেকটা চিটাগাংয়ে।
কীসের বিজনেস?
এক্সপোর্ট ইমপোর্টের বিশাল বিজনেস।
এবার মুখটা উজ্জ্বল হল রেখার। বল কী, এ তো দারুণ ব্যাপার।
স্বপন যেন আনন্দে একেবারে ফেটে পড়ল। সত্যি দারুণ ব্যাপার। ছেলেটির নাম আনিস। খুবই হ্যাঁন্ডসাম ছেলে। বোম্বের সারদ কাপুর না কী যেন একটা নায়ক আছে। অনেকটা ওরকম দেখতে।
যাহ।
সত্যি। বোনের বিয়ে নিয়ে আমি কি মিথ্যে বলব! তাছাড়া তোমরা তো সবাই দেখবেই। সেতুকে কোথায় যেন সে দেখেছে। ইউনিভার্সিটির ওদিকেই হবে। সেতুর ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি ওদের বাড়ি।
তাহলে ওদিকেই দেখেছে।
দেখেই খোঁজখবর নিয়েছে। জেনেছে আমার বোন।
প্রস্তাবটা আনল কে?
হাসান, আমার বন্ধু। সাংবাদিক। হাসানের সঙ্গে ছেলের বড়ভাইর বন্ধুত্ব। এসব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি! যোগাযোগের ডালপালা বেরিয়ে যায়।
রেখা মুগ্ধ গলায় বলল, সত্যি দারুণ ব্যাপার। মাত্র কদিন আগে ভাবী আর আমি সেতুর বিয়ে নিয়ে কথা বলছিলাম।
কী কথা?
মানে সেতুর বিয়ে হলে বাড়িতে একটা উৎসব আনন্দ হয়, এই আর কি! ভাবি অবশ্য বলছিলেন এত আদরের বোনকে এক্ষুনি বিয়ে দিতে রাজি হবেন না ভাইয়া। আচ্ছা শোন, তুমি কি ভাইয়াকে বলেছ?
না এখন গিয়ে বলব।
আগে তাঁকে বল। তিনি রাজি না হলে…!
রাজি না হওয়ার কোনও কারণ নেই।
কিন্তু সব শুনে মামুন কী রকম গম্ভীর হয়ে গেল। থমথমে গলায় বলল, বিয়ের পর সেতুকে কি আমেরিকায় নিয়ে যাবে?
স্বপন উৎসাহি গলায় বলল, না। ছেলে আমেরিকায় সেটেল করবে না, বাংলাদেশেই করবে। নিজেদের বিজনেস দেখবে। বিজনেস দেখার জন্যই আমেরিকা থেকে এমবিএ করে এসেছে সে?
ফলস এমবিএ না তো?
মানে?
আমেরিকায় ডিসওয়াসের কাজ করেও কিন্তু দেশে ফিরে অনেকে বলে অমুক ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, তমুক ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি।
পাগল হয়েছ! আমার সঙ্গে অমন কেউ করবে! হাসান আমার নেচার জানে না?
তবু মুখ উজ্জ্বল হল না মামুনের। আগের মতোই থমথমে গলায় বলল, আমাদের একমাত্র বোন, তাকে আমি বিদেশে থাকতে দেব না।
এসব ওরা জানে ভাইয়া।
কে বলেছে?
হাসান।
তোর সঙ্গে কথা বলার পর বলেছে?
না আগেই। কারণ ও এসব জানে।
এবার মুখে হাসি ফুটল মামুনের। তাহলে তো খুব ভাল কথা। এরচে’ ভাল পাত্র হয় না।
তুমি কী বল? কথাবার্তা বলব?
বলবি মানে? অবশ্যই বলবি। কালই বলবি।
ভেবে দেখ।
র কী ভাবব? আমার ভাবনা ফাইনাল।
কিন্তু সেতুর পড়াশুনো এখনও শেষ হয়নি।
তাতে কী হয়েছে। বিয়ের পরও পড়বে। আজকাল অনেকেই তা করছে। তুই কোনও গড়িমসি করিস না। ভাল করে খোঁজ খবর নিয়ে কথা ফাইনাল করে ফেল।
.
শুভর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে সেতুর মনে হল, আচ্ছা ওর নাকের ডগায় যদি মোটা একখানা গোঁফ থাকত তাহলে কেমন হতো!
গোঁফঅলা শুভকে দেখার জন্য তারপর মনটা ছটফট করে উঠল সেতুর। ছবিটা হাতে নিয়ে পড়ার টেবিলে এল সে। বলপয়েন্টে অতিযত্নে অতি নিখুঁত করে ছবির নাকের তলায় বেশ মোটা একখানা গোঁফ এঁকে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চেহারা একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেল শুভর। এই শুভকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল সেতু। আঁকা গোঁফে আঙুলের ডগা ছুঁইয়ে বলল, গুন্ডা।
সেতু যখন শুভর গোঁফ নিয়ে ব্যস্ত সে সময় পানির গ্লাস হাতে তাদের বেডরুমে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে শিলা। আসলেই মামুনের চে সে একটু বেশি লম্বা। এই বয়সেও ফিগার অত্যন্ত চমৎকার তার। গায়ের রং দুধের সরের মতো। সাজগোজের প্রতি খুবই ঝোঁক। বাড়িতেও বেশির ভাগ সময় সুন্দর শাড়ি পরে থাকে। বেশ কিছু গহনা পরে থাকে। সনু ওয়ালিয়ার মতো সামান্য লক্ষ্মীট্যারা সে। কাছ থেকে খেয়াল না করলে ব্যাপারটা একেবারেই ধরা যায় না। তবে শিলার সবচে বড় খুঁত তার পা। পা দুটো ময়ূরের পায়ের মতো।
শিলা যতটা ফিগার সচেতন মামুন ততোটাই উদাস। বয়স এখনও পঞ্চাশ হয়নি। তবু তার মধ্যে একটা বুড়োটে ভাব। মাথার চুল বেশ পেকেছে, শরীরটা মোটার দিকে। চোখে বহুদিন ধরে চশমা। কিন্তু মনের দিক দিয়ে সে বেশ সজীব। অন্তত শিলার কাছে। আর পোশাক পরে ভাল। দামী ব্র্যান্ডের শার্ট প্যান্ট, টাই জুতো। মাঝে মাঝে সুন্দর সানগ্লাস পরে। ভাল পারফিউম ইউজ করে, ভাল আফটারশেভ ইউজ করে।
আজ করেছে আজেরো।
আজেরোর গন্ধটা খুব প্রিয় শিলার। এজন্য স্বামী তারচে বেটে জেনেও তার পাশে সে এখন দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু পানিটা আজ খেল না মামুন। বলল, এখন থেকে কিছুদিন তোমার হাতের পানি না খেলেও চলবে।
শিলা অবাক হল। কেন?
বোনের বিয়ে। মন মাথা দুটোই ঠান্ডা হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেছি।
তোমার কীসের চিন্তা? বিয়ে তো তোমার না!
বাজে কথা বলো না।
ঠিক আছে চিন্তাটা কী, বল।
এত ভাল পাত্রের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিচ্ছ, আমার চিন্তা হচ্ছে নিজের মেয়ের জন্য এরকম পাত্র পাব কি না!
আমার ওইটুকু মেয়ের বিয়ে নিয়ে এখনই চিন্তা করছ তুমি?
ওইটুকু কই? ক্লাস এইটে পড়ছে। দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে। আগে এই বয়সী মেয়েদেরই বিয়ে হয়ে যেত। আমার দাদীর হয়েছিল দশবছর বয়সে।
তার মায়ের বিয়ে হয়েছিল নিশ্চয় আটবছর বয়সে। তার মায়ের তিনচার, আর তার মায়ের মায়ের পেটে থাকা অবস্থায়ই, তাই না।
শিলা হাসল। সব সময় ফাজলামো করো না।
ফাজলামো করছি না। আগের দিনে অল্প বয়সেই বিয়ে হতো মেয়েদের। এখন হয় না। শোন, তোমাকে একটু জ্ঞান দিই। ফ্যামিলি ট্রেডিসান জিনিসটা হচ্ছে বড়গুলো একধাপ গেলে ছোটগুলো যায় দুই ধাপ। অর্থাৎ…।
বুঝেছি।
পুরোটা মনে হয় বোঝনি। অর্থ হচ্ছে বোনের চে মেয়ের বিয়ে আরও ভাল পাত্রে হবে। যেমন আমার চে স্বপনের বিয়ে আরও ভাল পাত্রিতে হয়েছে, আরও ভাল ফ্যামিলিতে হয়েছে।
একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চেহারা বদলে গেল শিলার। শিলা আর শিলা রইল না। মা কালীর রূপ ধারণ করল। কী, আমার চে রেখা ভাল? আমাদের চে রেখাদের ফ্যামিলি ভাল? এতবড় অপমান তুমি আমাকে করলে?
হাতের গ্লাস ঠাস করে দেয়ালে ছুঁড়ে মারল শিলা। পানি এবং কাঁচের টুকরোয় বেডরুমের মেঝে ছেয়ে গেল। কিছুই খেয়াল করল না সে, দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
ততোক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেছে মামুন। কপালে হাত দিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বিছানায় বসে পড়ল। নিজেকে নিজে কোনও রকমে শুধু বলল, সর্বনাশ করে ফেলেছি। একদম সর্বনাশ করে ফেলেছি।
.
সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরেছে স্বপন।
ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কেমন লাগছে আমাকে?
রেখা মুগ্ধ চোখে স্বামীর দিকে তাকাল। কিন্তু সে কথা বলার আগেই টুপলু নির্বিকার। গলায় বলল, পচা।
টুপলু যে রুমের এককোণে বসে পুতুল খেলছে খেয়ালই করেনি স্বপন। পচা শব্দটা শুনে করল। কপট রাগের গলায় বলল, এই তোকে জিজ্ঞেস করেছি? তুই যা এখান থেকে।
বাপকে মোটেই পাত্তা দিল না মেয়ে। বলল, না যাব না। দেখছ না খেলছি!
টুপলুর দিকে আর তাকাল না স্বপন। রেখাকে বলল, বোনের বিয়ে উপলক্ষে নতুন পাঞ্জাবিটা পরলাম। হাসানরা আজ আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে। এজন্য খুব মুডে আছি।
রেখা বলল, এখনও বিয়ের কিছুই হয়নি, এখনই এত মুডের কী হল?
আজ সব ফাইনাল হবে।
তারপর বেশ স্বস্তির গলায় বলল, সেতুর বিয়েটা হয়ে গেলে আপাতত আমাদের আর কোনও প্রেসার থাকে না। বাবলু, মুন্নি ওদের বিয়ের বহু দেরি।
এই প্রথম ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল টুপলুর। পুতুল ফেলে লাফিয়ে উঠল সে। মা বাবার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। উত্তেজিত গলায় বলল, ফুপির বিয়ে? কবে?
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে ধমক দিল রেখা। চুপ কর। সব কথায় নাক গলানো!
ব্যাপারটা পছন্দ করল না স্বপন। মেয়েকে কাছে টেনে রেখাকে বলল, এটা ঠিক হল না। খানিক আগে দমক দিয়েছি আমি, এখন দিলে তুমি। দুজনেই যদি এমন করি মেয়েটি তাহলে কার কাছে যাবে?
টুপলু গাল ফুলাল। আমি ফুপির কাছে চলে যাব।
রেখা আগের মতোই রাগি গলায় বলল, যা এক্ষুনি যা।
টুপলুকে কোলের কাছে টেনে চেয়ারে বসল স্বপন। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল, শোন মা, ফুপির বিয়ের কথা এখন কাউকে বলো না, কেমন! বড়দের কথা ছোটদের কখনও বলতে হয় না।
খুবই সুবোধ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল টুপলু। আচ্ছা।
তারপর অতি নিরীহ ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল।
স্বপনও উঠল। কিন্তু দরজার দিকে যাওয়ার আগেই রেখা তাকে ডাকল। এই যে ভদ্রলোক, শুনুন।
স্বপন থমকে দাঁড়াল। ডাকের ভঙ্গিটা মারাত্মক। নিশ্চয় ভয়ংকর কোনও কথা আছে। বুকটা ছ্যাত করে উঠল স্বপনের। স্ত্রীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলল, জ্বী বলুন।
বোনের বিয়ে উপলক্ষে মাঝারি ধরনের একট প্রেসার আছে আপনার।
তা আমি কিছুটা বুঝেছি।
যেটুকু বুঝেছেন বলুন, শুনে কৃতার্থ হই।
বোধহয় গোটা তিন চারেক শাড়ি কিনে দিতে হবে আপনাকে।
তাতে দিতে হবেই। কিন্তু শাড়ি আমি ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি।
তাহলে?
কিঞ্চিত গহনাও দিতে হবে।
স্বপন একটা ঢোক গিলল। কী পরিমাণ?
খুব বেশি না। মাত্র একসেট।
সেটের সাইজ? মানে ওজন?
এক্ষেত্রে একটু সমস্যা আছে। সামান্য ওজনদার।
ভরির হিসেবে কতটা হতে পারে?
আপনি আরেকটু বসুন, বলছি।
কপট ভয়ের ভঙ্গি করে স্বপন বলল, বসতে হবে কেন?
শুনে অকস্মাৎ ভিড়মি খেতে পারেন। ভিড়মি খেয়ে পপাতধরণীতল হলে ব্রেন হেমারেজ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। স্বামীর ব্রেন হেমারেজ ঘটাতে মন চাইছে না।
অতটা বোধহয় হব না। আপনি নিঃসংকোচে বলুন। কত ভরি?
এই ধরুন বিশ বাইশ ভরি। মজুরিসহ লাখ দেড়েক টাকার ব্যাপার।
ভুরু কুঁচকে রেখার দিকে তাকাল স্বপন। গলার স্বর এবং ভাষা দুটোই স্বাভাবিক করল। চান্সটা একটু বেশি নিয়ে ফেললে না?
রেখা হাসল। কোনও কোনও সময় বেশি করেই চান্স নিতে হয়। ঝোঁপ বুঝেই তো কোপ মারে লোকে। আমাদের একটা মাত্র ননদ আর তোমরা এত বড়লোক। আর কিছু কি বলবার দরকার আছে?
না দরকার নেই। গ্রানটেড। কাটায় কাটায় বাইশ ভরি পেয়ে যাবে।
খুবই উজ্জ্বল ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল স্বপন।
৩. কোনও কোনও টেলিফোনের শব্দে
কোনও কোনও টেলিফোনের শব্দে শুভর মনে হয় এই ফোনটা আমার।
যখন এরকম মনে হয়, বাড়ির যেখানেই থাক ডাইনিংস্পেসের দিকে ছুটে আসে শুভ। কারণ ফোনটা ডাইনিংস্পেস এবং ড্রয়িংরুমের মাঝামাঝি একটা জায়গায় থাকে। এরকম টেলিফোনের সময় কাছে পিঠে কেউ থাকলেও শুভ খেয়াল করে না।
এখনও করল না।
টেলিফোনের শব্দ শুনে যখন মনে হয়েছে ফোনটা আমার, নিজের রুম থেকে। পাগলের মতো ছুটে এসেছে সে। প্রায় হামলে পড়ে ফোনটা ধরেছে। হ্যালো।
ওপাশ থেকে দোলন বলল, আমি সেতু।
সেতু নামটা শুনে হৃদয়ের শব্দ বদলে যাচ্ছিল শুভর। মুহূর্তের জন্যে মাত্র। তারপরই দোলনের চালাকিটা সে ধরে ফেলল। হাসিমুখে বলল, তাই নাকি?
কেন বুঝতে পারছ না?
পারছি। বলো দোলন।
দোলন খিলখিল করে হেসে উঠল। যাহ ধরা পড়ে গেলাম!
তারপর সেতুর সঙ্গে কী প্রোগ্রাম হয়েছে ঝটপট বলে ফেলল সে। শুনে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল শুভর মুখ। ঠিক আছে, কোনও অসুবিধা নেই। আমি আসছি।
সেতুর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা শুনলে মুহূর্তেই সেতুর পাশে নিজেকে দেখতে শুরু করে শুভ। বিভিন্ন এঙ্গেলে দেখতে শুরু করে এবং শুভর বেশ একটা ঘোর লেগে যায়।
এখনও লাগল। ঘোরের মধ্যে টেলিফোন নামিয়ে রাখল সে। রেখেই চমকে উঠল। মা দাঁড়িয়ে আছেন শুভর একেবারে পাশেই। মাকে দেখে অকারণে হে হে করে একটু হাসল শুভ। সেই হাসি একেবারেই পাত্তা দিলেন না মা। স্বভাবসুলভ কঠিন স্বরে বললেন, কোথায় যেতে হবে এখন?
শুভ সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যে বলতে শুরু করল। এই তো, আমার এক বন্ধুর ওখানে।
বন্ধুর নাম কী?
দোদুল।
কী? আমি যে শুনলাম দোলন।
হ্যাঁ হ্যাঁ দোলন। তবে দোদুল নামেও আমার এক বন্ধু আছে।
দোলন কি কোনও ছেলের নাম হয়?
হবে না কেন? মাহাবুবুল হক দোলন নামে একজন ছাত্রনেতা ছিলেন না? তুমি তার নাম শোননি?
না। আমি জানি দোলন শুধু মেয়েদেরই নাম হয়।
না। অনেক ছেলের নাম দোলন। যে ছেলেরা ছোটবেলায় খুব দোলনা চড়তো তাদের অনেকেরই নাম দোলন। শব্দটা এসেছে দোলনা থেকে।
বাজে কথা বলিস না। তারপর গলা আরও কঠিন করলেন মা। কী কাজে যাচ্ছিস?
না তেমন কোনও কাজ নেই। পরীক্ষা টরিক্ষা শেষ হয়ে গেছে, লেখাপড়া নেই, বন্ধুবান্ধব মিলে আড্ডা দেব।
আড্ডা শব্দটা বলেই ভুলটা করল শুভ। মা একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কি, আড্ডা দিবি? তোর মতো ছেলে আড্ডা দেয় কী করে? যাদের সংসার ঠিক মতো চলে না তাদের আবার আজ্ঞা কীসের? বড়ভাই ছোট একটা চাকরি করে এতবড়
সংসারটা চালায়…।
এবার শুভও একটু কঠিন হল। কেমন একটা তর্ক করার মনোভাব হল তার। ভাই একা চালাবে কেন? বাড়ি ভাড়ার টাকা আছে না?
কথাটা পাত্তাই দিলেন না মা। তা আর কটাকা? সাত হাজার টাকা কোনও টাকা হল? বোনটা এখনও তোদের ঘাড়ের ওপর। হাজারবার বললাম বিদেশে থাকা ছেলের কাছে বিয়ে দেয়ার দরকার নেই। তখন আমার কথা কেউ শুনলি না। না শাহিন শুনল
তুই। চারবছর হয়ে গেল মেয়েটা এখনও স্বামীর কাছে যেতে পারল না।
এক কথা থেকে আরেক কথায় যাওয়ার স্বভাব মা’র। কথা বলার ভঙ্গিটা রাগি ধরনের। মুখে হাসি বলতে গেলে দেখাই যায় না। গার্লসস্কুলের অংকের টিচারদের মতো।
মাকে মোটামুটি পছন্দই করে শুভ। তবে যখন এককথা থেকে চট করে আরেক কথায় চলে যান তখন শুভ যায় রেগে।
এখনও রাগল। খেকুড়ে গলায় বলল, আপা এখনও যেতে পারেনি তো কী হয়েছে? পারবে।
কবে পারবে?
দুলাভাই চেষ্টা করছেন।
চারবছর ধরেই শুনছি চেষ্টা করছে। এই হল বলে। হতে তো দেখি না।
না হলেই বা কী? আপা তো তোমাদেরটা খাচ্ছে না। মাঝে মাঝে খরচের টাকা। পাঠাচ্ছেন দুলাভাই। সেই টাকা সংসারেই দিচ্ছে আপা। রেজাল্ট বেরুবার পর আমিও বসে থাকব না। চাকরি নিয়ে নেব। তুমি এত অস্থির হয়ে গেছ কেন?
বেকার ছেলেমেয়ে আমি দেখতে পারি না। এখুনি কিছু একটা করা উচিত তোর।
ঠিক আছে করব। এখন দয়া করে লেকচারটা বন্ধ কর। মাফ করে দাও আমাকে।
মা তবু থামলেন না। আগের মতোই রাগি গলায় বললেন, কাজের কথা বললেই লেকচার, না?
নিজের রুম থেকে দেবর এবং শাশুড়ির কথা শুনতে পাচ্ছিল সুরমা। এগারো বছর বিয়ে হয়েছে কিন্তু ছেলেপুলে হয়নি তার। শরীর বেশ ভারির দিকে। ফলে হাঁটাচলায় ইদানিং বেশ ধীর সে। শুভর জন্য টানটা একটু বেশি। এজন্যই এখন রুম থেকে বেরুল। আস্তেধীরে মা এবং ছেলের অদূরে এসে দাঁড়াল। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে নিরীহ গলায় বলল, ওকে বকছেন কেন?
শুনে গরম তেলে নতুন করে যেন বেগুন পড়ল। শুভকে ছেড়ে সুরমাকে নিয়ে পড়লেন মা। বকতে আর পারি কোথায়? তোমার জন্য তো ওর সঙ্গে কথাই বলতে পারি না। কথা শুরু করলেই ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়। মায়ের চে মাসির দরদ বেশি।
সুরমা তার স্বভাব সুলভ নিরীহ গলায় বলল, কথাটা আপনি ঠিক বললেন না। বড়ভাবী মায়ের মতোই। নিজের ছেলে থাকলে তাকে আমি শুভর চে বেশি আদর করতাম না।
আদর করা আর লাই দেয়া এক না।
সুরমার আগে এবার কথা বলল শুভ। ভাবী আমাকে কোনও লাই দেয়নি। ভাবীর জন্য এখনও এই বাড়িতে থাকতে পারছি আমি। নয়তো তোমার কারণে অনেক আগেই বাড়ি ছাড়তে হতো।
সুরমাকে ছেড়ে আবার শুভকে ধরতে যাবেন মা, তার আগেই শুভকে ছোটখাট একটা ধমক দিল সুরমা। এত কথা বলিস না। যা এখান থেকে।
শুভ আর কথা বলল না। মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে চলে গেল।
.
চান্স পেলেই সেতুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মুন্নি।
সেতু যখন সাজতে বসে, কোথাও বেরুবে, মুহূর্তে কেমন করে যেন সেই খবর পৌঁছে যায় মুন্নির কাছে। যেখানেই থাক ছুটে এসে সেতুর রুমে ঢোকে মুন্নি কিংবা দরজার সামনে দাঁড়ায়।
এখন এসে আর রুমে ঢোকেনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে।
নীল রংয়ের সুন্দর শাড়ি পরেছে সেতু। গায়ের রং সামান্য হলদে হয়ে আসা মাখনের মতো বলে যে কোনও রংয়েই তাকে খুব মানায়। নীল শাড়িতেও মানিয়েছে। সাজগোজ শেষ করে এখন ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে নিজেকে দেখেছেন। এই অবস্থায় আয়নার ভেতর মুন্নিকে দেখতে পেল সে। কিন্তু পেছন ফিরে তাকাল না। বলল, কী?
মুন্নি হাসল। কিছু না।
কিছু না মানে?
.
ডাইনিংস্পেসের সামনে রানিকে পেল মামুন।
একগাদা জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। উৎকণ্ঠিত মুখে তার সামনে এসে দাঁড়াল সে। কিন্তু বাড়ির এতদিনকার পুরনো ঝিয়ের নামটা কিছুতেই মনে করতে পারল না। এবং মেয়েটি তাকে কী বলে ডাকে, তাও না।
তবে রানির নামটা মামুন জিজ্ঞেস করল না, করল অন্যকথা। এই, তুই যেন আমাকে কী বলে ডাকিস?
আচমকা এরকম প্রশ্নে রানি প্রথমে একটু ভড়কাল তারপর ফিক করে হাসল। খালু, খালু বলে ডাকি। কখনও কখনও খালুজানও বলি।
অত আল্লাদের দরকার নেই। তোর খালা কোথায় দেখেছিস?
না।
কেন দেখিসনি? ছিলি কোথায়?
মামুনের চড়া গলা শুনে ভড়কাল রানি। নির্দ্বিধায় একটা মিথ্যে কথা বলল। আমি বাথরুমে ছিলাম।
বাথরুম শব্দটা শুনে মামুন একেবারে খেঁকিয়ে উঠল। এত বাথরুম কীসের? সারাক্ষণ কী করিস বাথরুমে?
তারপর হন হন করে মুন্নির রুমের দিকে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে যেন বেয়াইয়ের সঙ্গে মসকরা করছে এমন ভঙ্গিতে রানি বলল, বাথরুমে আর কী করুম? ঘুমাই, খালুজান।
মামুন ততোক্ষণে মুন্নির রুমে গিয়ে ঢুকেছে।
মেঝেতে বসে ছবি আঁকছে মুন্নি। চারদিকে রং তুলি কাগজ ইত্যাদি ছড়ানো। মামুন এসব ভ্রুক্ষেপ করল না। বলল, মুন্নি, তোর মাকে দেখেছিস?
বাবার দিকে তাকাল না মুন্নি। নদীতে পালতোলা নৌকো এঁকেছে সে। মাঝি হাল ধরে বসে আছে। মাঝির মাথায় মাথলা। মাথলাটা পুরো আঁকা হয়নি। সামান্য বাকি আছে। সেটুকু আঁকতে আঁকতে বলল, না।
শুনে তেড়িয়া হয়ে উঠল মামুন। কেন দেখিসনি?
বাবার এরকম গলা আশাই করেনি মুন্নি। মাঝির মাথার মাথলা আঁকতে ভুলে গেল। চিন্তিত চোখে বাবার দিকে তাকাল। তুমি কি আম্মুর সঙ্গে ঝগড়া করেছ?
সঙ্গে সঙ্গে বাজখাই গলায় মেয়েকে ধমক দিল মামুন। চোপ।
তারপর এসে ঢুকল বাবলুর রুমে।
স্বামীর সঙ্গে রাগ করে ছেলের রুমে এসে বসে নেই তো শিলা! থাকতে পারে। তার পক্ষে এখন সবই সম্ভব।
কিন্তু না, এই রুমে সে নেই। বাবলু আপন মনে কম্পিউটার গেম খেলছে।
একবার কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে খুবই খেচড়া মেজাজে মামুন বলল, শিলার সঙ্গে, মানে তোর মা’র সঙ্গে তোর কখন দেখা হয়েছে?
বিরক্ত হয়ে বাবার দিকে তাকাল বাবলু। কী? মানে লাস্ট কখন দেখা হয়েছে? তোমার কথার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।
একথায় যাচ্ছেতাই রকমের রাগ হল মামুনের। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, কী করে বুঝবি? সারাক্ষণ তো আছিস কম্পিউটার নিয়ে। ঘোড়ার ডিমের কম্পিউটার। দেব একদিন আছাড় মেরে ভেঙে!
ছেলের রুমে আর দাঁড়াল না মামুন। ডাইনিংস্পেসের দিকে চলে এল।
কিন্তু বাবার আচরণে খুবই চিন্তিত হয়ে গেল বাবলু। নিজের কাছে বলার মতো করে বলল, বাবা একটু ক্রাক হয়ে গেছে।
এদিকে ডাইনিংস্পেসে এসে হতাশ ভঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসেছে মামুন। যে কেলেংকারি শিলার সঙ্গে হয়ে গেছে এখুনি সেটা মিটাতে না পারলে সমূহ বিপদ। এই অবস্থায় অফিসে গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। বাড়ি ছেড়ে নিশ্চয় বড়বোনের বাসায় চলে যাবে শিলা। পরে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। এদিকে সেতুর বিয়ের কথা আজ পাকা করবে স্বপন। সবমিলে শিলাকে এখুনি ম্যানেজ রকতে না পারলে সেতুর বিয়ে ফিয়ে সবই হসফস হয়ে যাবে। ইস কেন যে ওরকম বেফাঁস কথাটা বলতে গেল সে? নিজের মাথার চুল নিজেরই এখন ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে মামুনের।
কিন্তু বাড়িতে থেকেই বা কোথায় উধাও হয়ে গেল শিলা?
নাকি বেডরুম থেকে বেরিয়েই সোজা চলে গেছে বাড়ির বাইরে। রিকশা কিংবা স্কুটার ডেকে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে বোনের বাসায়।
ওখানে কি একটা ফোন করে দেখবে?
এসময় নিজেরচে বড় একটা সাদা ভল্লুক কোলে নিয়ে মামুনের সামনে এসে দাঁড়াল টুপলু। বড়চাচা, বড়চাচা।
নিজের ছেলেমেয়ের তুলনায় ভাইয়ের ওইটুকু মেয়ের ওপর বেশি রাগল মামুন। প্রসঙ্গ ভুলে সম্পূর্ণ অন্য একটা কথা তুলল। এই, তুই আমাকে বড়চাচা বলিস কেন? এ্যা? আমি তোর একমাত্র চাচা। শুধু চাচা বললেই হয়।
আশ্চর্য ব্যাপার মামুনের রাগটা পাত্তাই দিল না টুপলু। কোলের ভল্লুক আদর করতে করতে বলল, আচ্ছা বলব।
তারপর আগের ভুলটাই করল। তুমি কি চাচীকে খুঁজছ বড়চাচা?
শুনে লটারি পাওয়ার মতো অবস্থা হল মামুনের। টুপলু যে আবার বড়চাচা বলেছে তাকে সে কথা যেন শুনতেই পেল না। উফুল্ল গলায় বলল, হ্যাঁ মা। তুমি দেখেছ?
দেখেছি।
কোথায়?
ছাদে চলে গেছে।
সত্যি?
সত্যি। তুমি গিয়ে দেখ।
আর কোনওদিকে তাকাল না মামুন। যতদূর সম্ভব স্পিডে ছাদের সিঁড়ির দিকে দৌড়াল।
সত্যি সত্যি ছাদে চলে এসেছে শিলা। পানির ট্যাংকের ছায়ায় দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। বসে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে আর শাড়ির আঁচলে চোখ মুচেছে।
স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে খুবই মায়া হল মামুনের, আবার ভালও লাগল। যাক বাড়িতে যেহেতু আছে ম্যানেজ করা যাবেই। দরকার হলে দুহাতে যে-কোনও একটা পা চেপে ধরবে। ছাদে তো আর কেউ নেই। কেউ তো দেখছে না। আড়ালে আপন স্ত্রীর পা ধরতে অসুবিধা কী?
পা ধরার প্রস্তুতি নিয়েই শিলার সামনে এসে দাঁড়াল মামুন। প্রথমেই সাস্টাঙ্গে প্রণাম করার মতো করে স্ত্রীর পায়ে কি পড়া যায়! যায় না, ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়। সেই ক্ষেত্র তৈরির জন্য আচমকা বলল, তুমি দেখি আজকাল ঠাট্টাও বোঝ না। আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছি, ঠাট্টা। পিওর ফান। আরে তোমাদের ফ্যামিলির কোনও তুলনা হয় নাকি! কতবড় ফ্যামিলি, কত নামডাক! টাকা পয়সার কোনও অভাব নেই। তোমাদের ফ্যামিলির সামনে রেখাদের ফ্যামিলি কোনও ফ্যামিলিই না। এমন কি আমাদের ফ্যামিলিও কোনও ফ্যামিলি না। তোমার বাবা যে তোমাকে আমার কাছে বিয়ে দিয়েছেন এ আমাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর ভাগ্য আর আমার সৌভাগ্য।
চোখের চে নাকের জল বেশি ঝরছিল শিলার। ফোঁস করে নাক টানল সে। ভাঙাচোরা তেজাল গলায় বলল, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো না। একদম কথা বলো না।
শুধুমাত্র এইটুকু কথায় মামুন বুঝে গেল পাটা শিলার ধরতে হবে না। সে এসে সামনে দাঁড়াবার পরই বরফ গলতে শুরু করেছে।
হে হে করে কোন একখানা হাসি হাসল মামুন। যাহ্, তা হয় নাকি, বল! তোমার সঙ্গে কথা না বলে আমি পারি? আপন বউর প্রশংসা আমি না করে পারি না। তুমি কত ভাল, কত সুন্দর। কোথায় তুমি আর কোথায় রেখা! একুশ বছর হল তোমার বিয়ে হয়েছে, ছেলে আইএ পড়ে, বোঝাই যায় না। এখনও আনমেরেড মনে হয় তোমাকে। ইচ্ছে করলে আনমেরেড মানে আগে একটাও বিয়ে করেনি এমন ছেলের কাছে ইজিলি তোমাকে বিয়ে দেয়া যায়।
চোখ পাকিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল শিলা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, চুপ করলে!
কিন্তু চুপ মামুন করল না। আগের মতোই হে হে করা ভঙ্গিতে বলল, তোমার সামনে চুপ করে থাকতে আমি পারি না। গলার ভেতরটা চুলকায়, হিন্দিতে যাকে বলে খুজলি, খুজলি হতে থাকে, কথা না বললে খুজলিটা কমে না। বাংলায় কিন্তু খুজলি বলতে খোসপাঁচড়াও বোঝায়। সেই জিনিসটার সঙ্গেও চুলকানোর খুব মিল। ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে অর্থটা একই। এবং বিক্রমপুরের ভাষার সঙ্গে হিন্দিভাষার খুব মিল। বিক্রমপুরে কাককে বলে কাউয়া, হিন্দিতেও কাককে বলে কাউয়া। স্যাটেলাইটে ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলো দেখে শিখেছি। ঝুট বলে কাউয়া কাটে’ নামে একটা সিনেমাও হয়েছে। কাহিনীটা লিখেছেন বিমল কর। এই লেখকের কয়েকটা বই আমি এক সময় পড়েছি। একটা বইয়ের নাম ছিল ‘বালিকা বধূ’। নায়িকার নাম চিনি। খুবই সুইট মেয়ে। একদম। তোমার মতো। তুমি হচ্ছো আমার চিনি। এখনও বালিকা বধূ। কথায় কথায় অভিমান, কথায় কথায় কান্না।
তারপরই থাবা দিয়ে শিলার একটা হাত ধরল মামুন। চল, ওঠো। তোমাকে ম্যানেজ না করে বাড়ি থেকে বেরুতে পারছি না। ম্যানেজ করার জন্য যা মুখে আসে বলে গেলাম। কাউয়া থেকে চিনি পর্যন্ত। প্রসঙ্গের সঙ্গে মিলল কি মিলল না বুঝতে পারলাম না।
এত আবোল তাবোল বকে যাওয়ার পরও কিন্তু ঝটকা মেরে মামুনের হাতটা ছাড়িয়ে দিল না শিলা। নাক চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। আদুরে অভিমানি শিশুর গলায় বলল, ছোটভাইর বউর কাছে নিজের বউকে কেউ ছোট করে?
মামুন সঙ্গে সঙ্গে বলল, না না করে না, করে না। যে করে সে একটা মূর্খ, মূর্তিমান অশিক্ষা। লক্ষ্মীসোনা, এসব তুমি মনে রেখ না। বল মনে রাখবে না! বল।
আচ্ছা মনে রাখব না। তবে একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
এই অবস্থায়ও অতি রোমান্টিক চোখে স্বামীর চোখের দিকে তাকাল শিলা। আধো আধো বোল সখা টাইপের গলায় বলল, তুমি বোঝনি?
শুনে ভেতরে ভেতরে খবর হয়ে গেল মামুনের। তবু মুখের হাসিটা বজায় রাখল সে। হে হে বুঝেছি, বুঝেছি। এতদিনকার স্ত্রীর এসব ইঙ্গিত কেউ না বোঝে নাকি! আরে ওটা কোনও ব্যাপারই না।
তাহলে আজই গিয়ে অর্ডার দিয়ে আসি।
নিশ্চয়, নিশ্চয়।
কিন্তু এবার আর মুখে হাসি ফুটল না মামুনের। হাসতে চেষ্টা করল, পারল না। কোনও রকমে বলল, কত ভরি?
শিলা অতি উৎসাহে বলল, দাঁড়াও হিসাব দিচ্ছি। বারোটা চুড়ি বারো ভরি, একটা সীতা হাড় পাঁচভরি, দুল তিন ভরি…
দুলটা একটু কমাও। না না টাকার জন্য না। দেড়ভরি ওজনের দুল তোমার কান বইতে পারবে না। কান ছিঁড়ে যাবে। তোমার কানের লতি অনেক নরম। আমি বহুদিন টিপে দেখেছি।
ঠিক আছে তাহলে দুটো দুল দুই ভরিতে করব। একটা টিকলি করব একটু বেশি সোনার। আর দুটো আংটি। সব মিলে পঁচিশ ভরির বেশি না।
মামুন গোপনে একটা ঢোক গিলল।
স্বামীর সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক বলেই কিনা কে জানে ঢোকের শব্দটা যেন টের পেল শিলা। আড়চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বেশি হয়ে গেলে থাক।
শিলার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই তারপর অন্য মানুষ হয়ে গেল মামুন। স্বাভাবিক মানুষ। বলল, তোমাকে স্বাভাবিক করার জন্য অনেক ফাজলামো করলাম। এখন আমি সিরিয়াস। আমার একমাত্র বোনের বিয়ে। না চাইলেও তোমাকে একসেট গহনা আমি দেব। শাড়ি, কসমেটিকস যা লাগে কিনবে। এগুলো কোনও ব্যাপারই না। চল নীচে চল।
যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে মামুনের পিছু পিছু নিচে চলে এল শিলা।
তোমাকে চাই, আমি তোমাকে চাই
রাত ভোর হলে আমি তোমাকে চাই
সুমন চট্টোপাধ্যায়ের এইগান শোনার সময় এতটাই মগ্ন থাকে সেতু, এতটাই ডুবে থাকে শুভর চিন্তায়, চোখ খোলা রেখেও কোনও কিছুই দেখতে পায় না।
টুপলুকেও দেখতে পেল না।
টুপলু এসে যে তার রুমে ঢুকেছে, বিছানার অদূরে দাঁড়িয়ে আছে, দেখেও দেখতে পেল না সেতু।
ব্যাপারটা টুপলু বুঝল কিনা কে জানে, খানিক অপেক্ষা করে নিজেই মিউজিক সিস্টেমটা অফ করে দিল।
এবার সেতু একেবারে ছটফট করে উঠল। যেন হঠাৎ করে বিষপিঁপড়ে কামড় দিয়েছে। চোখ পাকিয়ে টুপলুর দিকে তাকাল সে। অফ করলি কেন?
টুপলু নির্বিকার গলায় বলল, তোমাকে একটা কথা বলব।
সব কিছুতে পাকামো।
না পাকামো না তো। শোন, খুব মজার কথা।
না আমি শুনব না। আমি কিছুতেই তোর কথা শুনব না।
রাগ করছ কেন?
তুই যা এখান থেকে।
তবু দমল না টুপলু। বলল, বাবা বলেছে কথাটা যেন আমি কাউকে না বলি।
এবার আরও রাগল সেতু। মানা করে থাকলে সে কথা বলতে এসেছিস কেন?
বারে, তোমার বিয়ের কথা তোমাকে বলব না!
শুনে বুকটা ধ্বক করে উঠল সেতুর। মুহূর্তের জন্য দমটা যেন বন্ধ হয়ে গেল। মুখটা গেল ফ্যাকাশে হয়ে। সে একটা ঢোক গিলল। কী, আমার বিয়ে?
হ্যাঁ, তোমার বিয়ে।
কার সঙ্গে? কবে?
ওসব আমি জানি না। মা জানে।
দিশেহারা ভঙ্গিতে বিছানা থেকে নামল সেতু। সাদার ওপর নীল বুটিদার সালোয়ার কামিজ পরা। ওড়নাটা এলোমেলো হয়েছিল। ওড়না ঠিক করার কথা মনেই হল না, সোজা ছুটে এল রেখার রুমে।
বিছানার চাঁদর, বালিশের ওয়্যার সব নামিয়ে মেঝেতে রাখছিল রেখা, সেতুকে দেখে হাসল। সেতু কথা বলবার আগেই বলল, নিশ্চয় আমাদের কূটনিটা তোমাকে সব বলেছে।
সেতু উত্তেজিত গলায় বলল, যেই বলুক, কথাটা ঠিক কিনা।
একদম ঠিক। আজ এনগেজমেন্টের ডেট হবে।
কী বলছ?
হ্যাঁ। আমরা ডিসাইড করেছিলাম সব ঠিক হওয়ার পর তোমাকে জানাব। তোমাকে সারপ্রাইজ দেব। কিন্তু কূটনিটার জন্য পারা গেল না। তোমার ভাই খুব একসাইটেড ছিলেন, এজন্য ওর সামনে বলে ফেলেছে। আমি তখনই বুঝেছিলাম সারপ্রাইজটা মাঠে মারা গেল। তবে তোমার ভাগ্য বলতে হবে, পাত্র সত্যি সত্যি রাজপুত্র।
ফ্যাল ফ্যাল করে রেখার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল সেতু। তারপর কোনও কথা না বলে শিলার রুমে এসে ঢুকল।
বিছানায় শুয়ে মাত্র টিভি অন করবে শিলা, সেতুকে দেখে করল না। বিছানায় উঠে বসল। স্বামীর সঙ্গে মধুর ঝগড়ার পর বিপুল পরিমাণে গহনার প্রতিশ্রুতি, মনটা খুবই প্রফুল্ল হয়ে আছে তার। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে আছে মুখ। সেই উজ্জ্বল মুখে বলল, কিছু বলবে?
সেতু কোনও ভনিতা করল না। থমথমে গলায় বলল, বলা কি উচিত নয়?
শিলা একটু অবাক হল। মানে?
আমাকে জিজ্ঞেস না করেই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছ?
স্বামীর সঙ্গের শিলা আর এখনকার শিলা মুহূর্তে দুজন হয়ে গেল। বেশ রাশভারি এবং ব্যক্তিত্বের ভঙ্গিতে প্রথমে সে সেতুর চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমাদের দেশের গার্জিয়ানরা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, মতামত নিয়ে তার বিয়ে ঠিক করে না। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর মেয়েরা জেনে যায়।
এসব পুরনো দিনের নিয়ম, এসব আজকাল চলে না। আজকাল আগেই মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে হয়।
তোমার কথার অর্থ আমি বুঝেছি। তোমাকে কি জিজ্ঞেস করতে হবে?
শিলার কথা বলার ভঙ্গিতে নিজের কথার খেই হারিয়ে ফেলল সেতু। নার্ভাস হয়ে গেল। না মানে…
শিলা তার ব্যক্তিত্ব বজায় রাখল। জিজ্ঞেস করতে হলে বল তোমার ভাইদেরকে বলি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে। আর নয়তো তাদের পক্ষ হয়ে আমি এবং রেখা তোমাকে জিজ্ঞেস করি।
সেতু খুবই অসহায় বোধ করল। কাতর গলায় বলল, আমার এখনও পড়াশুনো শেষ হয়নি আর তোমরা আমার বিয়ে নিয়ে পাগল হয়ে গেলে?
একথায় শিলা কেমন হাঁপ ছাড়ল। ওই এই কথা! আমি ভেবেছিলাম কী না কী!
তারপর একটু থেমে বলল, ইচ্ছে থাকলে বিয়ের পরও পড়াশুনা শেষ করা যায়। অনেক মেয়েই করে। আমার বড়বোন তো দুটো বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর শেষ করল। এখন একটা কলেজের টিচার। তুমি কোনও চিন্তা করো না। আনিসকে আমরা বলব, সে তোমার পড়াশুনোর ব্যবস্থা করবে।
আনিস নামটা যেন শুনতেই পেল না সেতু। মনে মনে শুভকে ডাকতে লাগল সে। শুভ শুভ শুভ। আমি এখন কী করব তুমি বলে দাও।
.
পাঁচদিনের জ্বরে শাহিন বেশ কাবু হয়েছে।
চেহারা একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে তার। শেভ না করার ফলে মুখময় গজিয়ে উঠেছে দাড়ি গোফ। দাড়ি গোঁফ যে ফাঁকে ফাঁকে এত পেকেছে সুরমা কিংবা অন্য কেউ। তো দূরের কথা শাহিন নিজেও তা জানত না। এবারের জ্বরে জানতে পারল।
।কিন্তু স্বামীর এই মুখের দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছে না সুরমা। তাকালেই মনে হচ্ছে এই মুখটা তার স্বামীর নয়। অন্য কারও।
এই যে এখন পেয়ালায় করে স্বামীকে সে মুরগির স্যুপ খাওয়াচ্ছে, খাওয়াচ্ছে মুখের দিকে তাকিয়েই তবুও যেন মুখটা সে দেখছে না।
শাহিন এসব খেয়াল করছিল না। জ্বরে মুখের ভেতরটা একেবারে সেদ্ধ হয়ে আছে। কিছুই খেতে ভাল লাগে না। কোনও রকমে স্যুপ কিছুটা খেয়েছে কিন্তু শেষ করতে পারছে না।
এক সময় সুরমার হাত ঠেলে দিয়ে বলল, আর খেতে পারছি না। ভাল লাগছে না।
সুরমা বলল, জ্বরের মুখে খেতে ভাল লাগে না। জোর করে খেতে হয়।
আমি জোর করে খেতে পারি না। বমি আসে।
কাত হয়ে শুয়ে পড়ল শাহিন। জ্বরটা ছেড়ে গেছে, কিন্তু শরীর খুব দুর্বল।
সুরমা বলল, দুচার দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
যত তাড়াতাড়ি ঠিক হয় ততো ভাল। বাড়ি বসে থাকতে বোর লাগছে। মনে হচ্ছে। বহুদিন অফিস করি না।
এ সময় টেলিফোন বাজল। শাহিন বলল, যাও টেলিফোন ধর।
স্যুপের পেয়ালা চামচ হাতে বেরিয়ে গেল সুরমা।
কিন্তু সুরমার আগেই মা এসে ফোন ধরলেন। হ্যালো, হ্যালো। কে?
ওপাশ থেকে কেউ কথা বলল না। খুট করে লাইন কেটে দিল। বিরক্ত হয়ে ফোন নামিয়ে রাখলেন মা। সুরমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভুতুড়ে টেলিফোন। কথা বলে না। নাকি আমার গলা শুনেই রেখে দেয় কে জানে!
এ কথায় মুখ নিচু করে হাসল সুরমা। হাসিটা মা দেখে ফেললেন। রুক্ষ্ম গলায় বললেন, হাসছ কেন?
সুরমা বিব্রত হল। না হাসছি নাতো!
তারপর ম্যানেজ করার চেষ্টা করল। এরকম টেলিফোন অনেক সময় আসে। আমি ধরলেও কথা বলে না।
এ সময় আবার বাজল টেলিফোন।
মা ভ্রু কুঁচকে বললেন, তুমি ধর। দেখ কথা বলে কিনা।
সুরমা ফোন ধরল।
ওপাশ থেকে ভীতু ভীতু গলায় সেতু বলল, হ্যালো! কে ভাবী?
ব্যাপারটা বুঝে গেল সুরমা। আড়চোখে একবার মায়ের দিকে তাকাল সে। তারপর চটপটে গলায় বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ বল। চিনেছি, চিনেছি।
কিছুক্ষণ আগে আমিই ফোন করেছিরাম। ভয়ে ছেড়ে দিয়েছি। ভাবী, ওকে একটু দেয়া যাবে?
বাড়ি নেই তো!
এলে যেন দোলনদের বাড়িতে একটু ফোন করে। খুব জরুরি।
আচ্ছা।
টেলিফোন নামিয়ে রাখল সুরমা।
মা তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়েছিলেন সুরমার দিকে। সন্দেহের গলায় বললেন, কে ফোন করল?
নির্জলা মিথ্যে বলল সুরমা। ইয়ে, শুভর এক বন্ধু।
কী নাম?
নাহিদ, নাহিদ।
ওকি আমাকে চেনে না? আমার সঙ্গে কথা বলতে কী অসুবিধা ছিল?
না না অসুবিধা ছিল না। বলল লাইনটা কেটে গিয়েছিল। গ্রাম থেকে ফোন করেছে।
মায়ের সামনে থাকলে আরও মিথ্যে বলতে হবে, কোন কথা বলতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবে, এসব ভেবে যতদূর সম্ভব দ্রুত কিচেনের দিকে চলে গেল সুরমা।
.
শিলা বলল, সেতু যে ভঙ্গিতে এসে আমার সামনে দাঁড়াল, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
রেখা হাসল। আমাকে গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করল, আমিও ভয় পেয়েছিলাম।
ওরা দুজন কথা বলছিল রেখার রুমের সামনের বারান্দায় বসে। এখানটায় তিনটে সুন্দর বেতের চেয়ার রাখা আছে। ছোট্ট একটা টেবিল রাখা আছে। বিকেল কিংবা গভীর রাতে রেখা এবং স্বপন কখনও কখনও এখানটায় বসে টুকটাক গল্প করে। সকালবেলা এখানে বসে কখনও কখনও খবরের কাগজও পড়ে স্বপন।
এখন বসে আছে শিলা এবং রেখা। সেতুকে নিয়ে কথা বলছে তারা।
শিলা বলল, সেতুর কথা শুনে তোমার সন্দেহ হয়নি? আমার কিন্তু হয়েছে।
রেখা চোখ তুলে তাকাল। কী সন্দেহ?
ওর বোধহয় কোথাও প্রেম ট্রেম আছে। এত বড় ঘরের, এত সুন্দর মেয়ে, এরকম মেয়ের প্রেম থাকতেই পারে।
এরকম কেন, প্রেম যে কোনও মেয়েরই থাকতে পারে।
তবে সুন্দরি মেয়েগুলোর বেশি থাকে।
তা থাকে। প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম যে সেতুর ওসব আছে। পরে আর ভাবিনি।
কেন?
প্রেম থাকলে আমরা নিশ্চয়ই টের পেতাম।
ও না বললে কী করে পেতাম?
মুখের দিকে তাকালেই ধরা যায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম, প্রেম এবং ক্যান্সার নাকি চেপে রাখা যায় না।
কিছুদিন হয়তো যায়। শেষ পর্যন্ত সব একদিন বেরিয়ে পড়ে। গর্তে লুকানো সাপের মতো। সাপের গর্তে গরম পানি ঢেলে দিলে সাপটা সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে।
রেখা আর কোনও কথা বলল না। সাপের কথা শুনে গাটা কেমন কাঁটা দিল।
.
সুরমা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল।
পৌনে বারোটা। এতরাত হল এখনও ফিরছে না কেন শুভ? কোথায় গেল? সে না আসা পর্যন্ত ঘুমোতে যেতে পারছে না সুরমা। কিন্তু খুব ঘুম পাচ্ছে তার। আঠার মতো জড়িয়ে আসছে চোখ। ডাইনিংটেবিলে বসে প্রায়ই ঢলে পড়ছে।
একবার ইচ্ছে হল যখন ইচ্ছে ফিরুক শুভ, তার কী! সে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
তারপরই মনে হলো, না তাহলে খুবই বিপদে পড়বে শুভ। চোরের মতো এসে দরজায় টুকটুক করবে, ঘুমিয়ে পড়া মানুষজন অতকম শব্দ শুনতে পাবে না। তখন বাধ্য হয়ে কলিংবেল বাজাবে। সেই শব্দে নিশ্চয় জেগে উঠবেন মা। তারপর ধুন্দমার কাণ্ড বেঁধে যাবে। খেতে তো শুভ পাবেই না, গালাগাল খেয়ে মরে যাবে। সুরমা থাকতে ওরকম বিপদে শুভ কী করে পড়ে! তাছাড়া সেতুর টেলিফোনের কথাও তো বলতে হবে!
এসব ভেবে ডাইনিংটেবিল ছাড়ল না সুরমা। বসে ঢুলতে লাগল।
বারোটা বিশে টুকটুক করে শব্দ হলো দরজায়। ধরফর করে উঠল সুরমা। প্রথমে সাবধানী চোখে চারদিক তাকাল তারপর প্রায় নিঃশব্দে দরজা খুলল। ভুবন ভোলানো হাসিমুখে, পা টিপে টিপে শুভ ঢুকল। মা নিশ্চয় গভীর ঘুমে! এজন্য কলিংবেল বাজাইনি। জানি তুমি জেগে আছ।
শুভকে দেখেই কেমন যেন রেগে গেল সুরমা। থমথমে গলায় বলল, কটা বাজে?
হাসিমুখে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল শুভ। বারোটা তেইশ।
তা আমিও জানি। ছিলি কোথায়?
বেড়াতে গিয়েছিলাম।
কোথায়?
বিক্রমপুরের মাওয়াঘাটে। ভাবি, কী বলব তোমাকে, পদ্মার তীরটা একদম সীবিচের মতো। একদম কক্সবাজার। গেলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। আসতেই ইচ্ছে করে না।
তাহলে এলি কেন?
শুধু তোমার টানে। আর…!
আমার জন্যে কতটা টান তা আমি বুঝি। আর একজন যার কথা বলতে চাইলি সে আজ ফোন করেছিল।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। গলা শুনে কেমন যেন নার্ভাস মনে হল। বোধহয় কোনও ঝামেলা হয়েছে।
ঝামেলা শব্দটা শুনে মুখ শুকিয়ে গেল শুভর। কী ঝামেলা?
তা আমাকে বলেনি। কাল যোগাযোগ করিস।
নিশ্চয় করব। তুমি না বললেও করব।
একথায় মনটা একটু খারাপ হল সুরমার। স্নান গলায় বলল, আমার দায়িত্ব ছিল তোকে জানানো, জানালাম। কী করবি না করবি তোর ব্যাপার।
বেডরুমের দিকে পা বাড়িয়েই থমকে দাঁড়াল সুরমা। টেবিলে খাবার রাখা আছে, খেয়ে নিস।
কথাটা যেন শুনতেই পেল না শুভ। তার কেবল সেতুর কথা মনে পড়ছে।
.
হঠাৎ এভাবে বিয়ে ঠিক করে ফেলল, মানে কী?
খুবই বিরক্ত হয়ে দোলনের দিকে তাকাল সেতু। মানে আবার কী? ভাল পাত্র পেয়েছে, ঠিক করেছে।
সেতুর বিরক্তিটা খেয়াল করল না দোলন। দুশ্চিন্তায় লম্বা নাকটা যেন আরেকটু লম্বা হয়ে গেল তার। এখন কী করবি?
কিছুই বুঝতে পারছি না।
আগে শুভ ভাইর সঙ্গে কথা বল।
ওকে আমি টেলিফোনে পাইনি। ভাবীকে বলেছিলাম…
সেতুর কথা শেষ হওয়ার আগেই দোলন বলল, ঘণ্টাখানেক আগে শুভ ভাই ফোন করেছিলেন। বললাম তুই আসবি, শুনে বললেন, আমিও আসছি। এক্ষুনি হয়তো চলে আসবেন।
তাহলে ভালই হয়।
শুভ এল মিনিট দশেকের মধ্যে। তাকে দেখেই উঠল দোলন। আপনারা প্রেম করেন, আমি যাচ্ছি। চা পাঠিয়ে কি ডিস্টার্ব করব?
শুভ হাসল। দরকার নেই। আমি চা খাব না। সেতু, তুমি খাবে?
না।
দোলন বলল, ও যে খাবে না, তা আমি জানি। এই অবস্থায় চা খাওয়া যায় না।
শুভ অবাক হল। এই অবস্থা মানে?
ওর কাছ থেকেই শুনুন।
দোলন বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেতুর পাশে বসল শুভ। কী হয়েছে?
অন্যদিকে তাকিয়ে সেতু বলল, বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
কার বিয়ে?
খরচোখে শুভর দিকে তাকাল সেতু। অন্যের বিয়ের খবর তোমাকে আমি দেব?
শুভ একেবারে হকচকিয়ে গেল। না না তা দেবে কেন! কিন্তু তোমার বিয়ে! বল কী? কবে ঠিক হল? কোথায়?
ব্যাপারটা শুভকে খুলে বলল সেতু। শুনে শুভ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। বল কী!
হ্যাঁ, এভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে, কল্পনাই করিনি।
আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
দুহাতে শুভর একটা হাত ধরল সেতু। এখন আমি কী করব?
শুভ দিশেহারা গলায় বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না।
তোমাদের বাড়িতে আর কেউ না জানুক তোমার ভাবী জানেন। একজন মানুষ অন্তত তোমার পক্ষে আছেন। আমার পক্ষে কেউ নেই।
কী করে থাকবে? তুমি তো কাউকে জানাওনি।
কেন জানাইনি তুমি জানো না? আমার ভাইদের আমি চিনি। এসব জানলে আরও অনেক আগেই জোর করে আমার বিয়ে দিয়ে দিত। আমার মুখ তুমি আর কখনও দেখতে পেতে না।
বুঝলাম, কিন্তু এখন তো না জানিয়ে উপায় নেই।
শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে সেতু বলল, এখনও জানাব না।
শুভ অবাক। তাহলে?
আগে বিয়ে করে ফেলব তারপর জানাব।
শুনে বুকটা ধ্বক করে উঠল শুভর। না না তা ঠিক হবে না। কেলেংকারি হয়ে যাবে। তুমি তোমার ভাবীদেরকে আমার কথা বল। ভাবীরা বলুক ভাইদেরকে। এভাবে সব ম্যানেজ কর।
সেতু গম্ভীর হল। তুমি বেশ ভাল করেই জানো আমার ভাইরা কিছুতেই রাজি হবে না।
না হলে তখন দেখা যাবে।
কী দেখা যাবে তখন? আমার ভাইরা যেমন ভাল তেমন খারাপ। রেগে গেলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। যদি আমাকে তারা বাড়ি থেকে বেরুতে না দেয়, যদি ঘরে আটকে রেখে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়?
শুভ বিরক্ত হল। সিনেমা নাকি! এসব এত সোজা না। একটা মেয়ে যদি বিয়ে করতে না চায়, জোর করে তাকে বিয়ে দেয়া যায় না।
এবার বেশ রাগল সেতু। কে বলেছে যায় না? গার্জিয়ানদের চাপে পড়ে মতের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বাংলাদেশে।
ওসব হয় অশিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে।
শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যেও প্রচুর হয়। তুমি জানো না।
সত্যি আমি জানি না।
জেনে তর্ক করছ কেন?
সরি।
সেতু একটু নরম হল। স্বাভাবিক গলায় বলল, এই রিসকটা আমি নেব না। আমি বিয়ে করে ফেলব। বিয়ে হয়ে গেলে শক্তিটা আমার থাকে। বাড়িতে সবার সঙ্গে ফাঁইট করতে পারব। জোর গলায় বলব, আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার নেই।
সেতুর কথা শুনে হতাশায় একেবারে ডুবে গেল শুভ। এভাবে বিয়ে করব?
শুনে খুবই অভিমান হল সেতুর। তোমার ইচ্ছে না হলে করো না। আমি আমার ভাইদের পছন্দ মেনে নিই।
সেতুর চোখের দিকে তাকাল শুভ। পারবে?
সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে শুভর গলা জড়িয়ে ধরল সেতু। পারব না বলেই তো এভাবে ভাবছি। মরে যেতে হলে যাব কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না। আর কারও সঙ্গে সংসার করব না।
কিন্তু শুভর বুকটা তখন চিব ঢিব করছে।
.
রাতেরবেলা নিচতলার ড্রয়িংরুমে এসে বসছে মামুন এবং শিলা।
কিছুক্ষণ পরে এল রেখা এবং স্বপন। কোনও বিষয়ে বড় রকমের সিদ্ধান্তের সময় এই রুমে এসে একত্রিত হয় সবাই।
স্বপনের মুখের দিকে তাকিয়ে মামুন বলল, কবে এনগেজমেন্ট করতে চায় ওরা?
স্বপন বলল, আমরা যেদিন করব। ওদের কোনও অসুবিধা নেই। ওরা বলছে এনগেজমেন্টেরই দরকার নেই। মানে এনগেজমেন্টের জন্য কোনও অনুষ্ঠানের দরকার নেই। সরাসরি বিয়ে।
না তা করব না। আমাদের একমাত্র বোন। যত রকমের অনুষ্ঠান ইত্যাদি আছে সবই করব।
তাহলে এনগেজমেন্টের ডেটটা ফিক্সড কর।
শিলা বলল, ডেট ফিক্সড করার আগে সেতুর সঙ্গে একটু কথা বলা উচিত না।
মুখ ঘুরিয়ে ভাবীর দিকে তাকাল স্বপন। কী কথা?
শিলা জবাব দেয়ার আগে রেখা বলল, না মানে ওর মতামত!
মামুন গম্ভীর গলায় বলল, ওর আবার মতামত কী? আমরা সবাই যেখানে রাজি সেখানে ওর অমত হবে কেন?
শিলা বলল, আমার মনে হয় অমত ওর নেই। লেখাপড়া শেষ হয়নি এসব নিয়ে একটু গাইগুই করছিল।
বাড়ির অন্যান্যদের সামনে মামুন অত্যন্ত গম্ভীর এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। একান্তে স্ত্রীর সঙ্গে যে তার ওরকম মজার সম্পর্ক এই মামুনকে দেখে কেউ তা কল্পনাও করতে পারবে না।
এখন শিলার কথা শুনে সে বলল, বিয়ের কথা শুনলে সব মেয়েই অমন করে। ওসব ভেবে লাভ নেই। স্বপন, দিনদশেকের মধ্যে এনগেজমেন্টের ডেট কর। এনগেজমেন্টের দিন বিয়ের ডেট হবে। তবে মাসখানেকের মধ্যেই বিয়ে।
স্বপন গভীর উৎসাহে বলল, ঠিক আছে।
.
মানুষ যদি সত্যি সত্যি কখনও হাতে চাঁদ পায় যে রকম খুশি হবে নাহিদকে দেখে ঠিক সেরকম খুশি হল শুভ।
কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে শুয়েছিল সে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। একদম টাইমলি এসে পড়েছিস দোস্ত। তোকে এমন ফিল করছিলাম। তোর মতো বন্ধু তো আর কেউ নেই, কার সঙ্গে পরামর্শ করে ডিসিসান নেব বুঝতে পারছিলাম না।
নাহিদ কোনও কথা বলল না। নির্জীব ভঙ্গিতে বিছানার এককোণে বসল। বসে উদাস হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল।
নাহিদ অত্যন্ত প্রিয়দর্শন যুবক। খুব বেশি লম্বা কিংবা স্বাস্থ্যবান নয়। মাঝারি ধরনের হাইট। শরীরটা রোগার দিকে। গায়ের রং শবরি কলার মতো। গোঁফ দাড়ি ওঠার পর কখনও সেভ করেনি। ফলে মুখময় ঘন কালো দাড়ি গোঁফ। খাড়া নাকের ওপর গোল কাঁচের ছোট্ট ধরনের চশমা। চশমার ভেতর উজ্জ্বল দুটো চোখ সারাক্ষণ যেন হাসছে। মুখের দাড়ি গোঁফের মতো মাথার চুলও খুব ঘন নাহিদের। স্টাইলটা অনিল কাপুরের মতো। মুখে মিষ্টি একখানা হাসি সব সময় লেগে থাকে।
এই ধরনের মানুষকে কেউ পছন্দ না করে পারে না। এই ধরনের মানুষের কোনও শত্রু থাকে না।
পোশাক আশাকে নাহিদ একেবারেই কেয়ারলেস টাইপের। সব সময় জিনস পরে। জিনসের প্যান্ট, শার্ট। কখনও কখনও টিশার্ট। পায়ে বুট। কিন্তু একই পোশাকে নাহিদ হয়তো বেশ কয়েকদিন থাকে। এসব নাহিদকে খুব মানায়। অন্যদের চে আলাদা করে রাখে। এবং নাহিদ অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠের মানুষ। ধীর শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলে। কথা বলার সময় হাসিটা ঠোঁটে লেগেই থাকে। উচ্চারণ চমৎকার। আশ্চর্য রকমের এক রোমান্টিক ভঙ্গি আছে কথা বলার।
কিন্তু কী হয়েছে নাহিদের? এতদিন পর প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে এমন উদাস হয়ে আছে কেন? কথা বলছে না কেন?
এগিয়ে এসে নাহিদের কাঁধে হাত দিল শুভ। নাহিদ, কী হয়েছে?
তারপরই নাহিদের কান্নাটা দেখতে পেল। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। চশমার ফাঁক দিয়ে নেমেছে অশ্রুধারা।
শুভ একেবারেই দিশেহারা হয়ে গেল। তুই কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে? বাদলের শরীর কেমন?
একহাতে চোখ মুছল নাহিদ। বাদল মারা গেছে।
কী?
চব্বিশ তারিখে। বিকেল চারটা দশ।
কী বলছিস তুই?
নাহিদ মাথা নাড়ল। বাদল মারা গেছে এখন বর্ষাও মরতে বসেছে। যমজ ভাই বোনের একজন মারা গেল আরেকজন একেবারেই শেষ হয়ে যায়। সবমিলে আমাদের খুব দুঃসময় যাচ্ছে। এসব কারণেই তোকে কিছু জানাতে পারিনি।
বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ল শুভর। ভাঙাচোরা গলায় বলল, তোকে দেখে এত ভাল লাগল, মনে হচ্ছিল গভীর অন্ধকারে ডুবে আছি, তুই এসে আলোটা জ্বেলে দিলি। কিন্তু…।
শুভ মাথা নিচু করল। এই ধরনের খবর শোনার পর কেমন করে তোকে আমি আমার সমস্যার কথা বলি! কিন্তু তোকে না বলেও আমার উপায় নেই।
চশমা খুলে ভাল করে চোখ মুছল নাহিদ।
শুভ বলল, বাদলের অসুখের কথা জানতাম। ওর মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে বুক ফেটে যাবে আমার। সবকথা বলতে তোরও খুব কষ্ট হবে। ওসব এখন আমি জানতে চাইব না। খুবই স্বার্থপরের মতো আমার কথাগুলো তোকে বলব।
শার্টের খুটে চশমা মুছে পরল নাহিদ। শুভর দিকে তাকাল। সেতুকে নিয়ে কোনও সমস্যা হয়েছে?
হ্যাঁ। বড় রকমের সমস্যা।
কী হয়েছে আমাকে বল।
শুভ আবার মাথা নিচু করল। দুএকদিনের মধ্যে বিয়ে করতে হবে।
একথা শুনে যতটা চমকাবার কথা নাহিদের ততটা চমকাল না সে। অবশ্য তার। স্বভাবই এমন, উত্তেজিত হয় কম। হলেও এমনভাবে চেপে রাখে, কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
তবে শুভর কথা শুনে অপলক চোখে কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল নাহিদ। তারপর কিছুই জানতে না চেয়ে বলল, কর। আমি আছি।
এই অবস্থায়ও বন্ধুর পাশে এভাবে দাঁড়াতে পারে মানুষ!
নাহিদের কথা ভেবে আশ্চর্য রকমের এক অনুভূতি হল শুভর। বুকটা তোলপাড় করতে লাগল। দুহাতে নাহিদের একটা হাত ধরল সে। মাথা নিচু করে বলল, আমার খুব কান্না পাচ্ছে দোস্ত, খুব কান্না পাচ্ছে।
কথা বলতে বলতে গলা জড়িয়ে এল শুভর। নিজের অজান্তে চোখ ভেসে গেল।
.
সেতুর বিছানার ওপর মাঝারি সাইজের সুন্দর একটা ব্যাগ।
সেই ব্যাগে বেগুনি রংয়ের একটা কাতান শাড়ি নিয়েছে সেতু, ছায়া ব্লাউজ নিয়েছে। সামান্য কিছু কসমেটিক, সামান্য কিছু গহনা নিয়েছে। শুভর খুব পছন্দ এমন। একটা পারফিউম নিয়েছে। এসব নিয়ে এখন দোলনদের বাড়ি যাবে সে। সেখান থেকে বউ সেজে যাবে শাহিনবাগ কাজি অফিসে। শুভ আর তার বন্ধু নাহিদ আগে থেকেই
অপেক্ষা করবে। সেতু এবং দোলন গিয়ে পৌঁছুবার পর বিয়ে। শুভর পক্ষ থেকে স্বাক্ষী। হবে নাহিদ, সেতুর পক্ষ থেকে দোলন। বিয়ে শেষ হওয়ার পর আবার দোলনদের বাড়ি যাবে সেতু। এবার সঙ্গে থাকবে শুভ।
প্ল্যান শুনে দোলন বলেছিল, বাসররাতটা দিনের বেলাতেই আমাদের বাড়িতে করে ফেলতে পারিস তোরা। বুয়াদের ম্যানেজ করে আমার রুম তোদেরকে ছেড়ে দেব।
শুনে লজ্জায় মরে গিয়েছিল সেতু। যাহ।
কেন, অসুবিধা কী?
ওসব এখন না। সব ঠিকঠাক হওয়ার পর আবার যখন আমাদের বিয়ে হবে, মানে আয়োজন করে যখন বিয়ে হবে তখন।
তাহলে আজ আর আমাদের বাড়িতে আসার দরকার কী?
তোদের বাড়িতে এসে, সাজগোজ বদলে স্বাভাবিক হয়ে তারপর বাড়ি ফিরব যাতে ঘুণাক্ষরেও কেউ টের না পায়।
বুঝলাম, এ কাজের জন্য শুভ ভাইকে সঙ্গে আনার দরকার কী?
বাহ বিয়ের পর ওকে একটু একা পেতে ইচ্ছে করবে না আমার! ওর সঙ্গে কথা, বলতে ইচ্ছে করবে না!
সবই যখন ইচ্ছে করবে তখন আর ওইটুকু বাদ রাখছিস কেন?
না বাবা, প্রথম দিনেই যদি কনসিপ করি।
তাহলে তো আরও সুবিধা। ঝামেলা লাগলে বাড়িতে বলবি, আমি প্রগন্যান্ট। দেখবি সঙ্গে সঙ্গে সবাই মেনে নিয়েছে।
ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বেরুবার সময় এসব কথা মনে পড়ল সেতুর। আজ যদি সত্যি সত্যি ওসব হয়? সত্যি যদি সে কনসিপ করে!
শরীরের ভেতর তারপর আশ্চর্য এক অনুভূতি হল সেতুর। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। একেবারেই নতুন ধরনের এক লজ্জায় রাঙা হল মুখ।
এই আবেশের মধ্যে ছিল বলেই বোধহয় শিলাকে দেখতে পায়নি সেতু। বেরুতে গিয়ে আচমকা দেখতে পেল তার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে শিলা।
সেতু একটু থতমত খেল। ভাবী, তুমি এ সময় আমার রুমে?
শিলা সরল গলায় বলল, খুবই অবাক হলে মনে হয়?
না মানে আমি বেরুচ্ছি তো?
তাতে কী হয়েছে? বেরুবার সময় তোমার রুমে আমি আসতে পারি না?
তা পারবে না কেন?
তাহলে অমন থতমত খেলে কেন?
শিলা একটু থামল। সেতুর হাতের ব্যাগ দেখে কী রকম সন্দেহ হল তার। কোথায় যাচ্ছ?
সেতু একটু ভড়কাল, কিন্তু শিলাকে তা বুঝতে দিল না। চটপটে গলায় বলল, ইয়ে মানে দোলনদের বাড়ি। দোলন ফোন করেছিল।
ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছ কেন? ব্যাগে কী?
তেমন কিছু না। দুএকটা ড্রেস নিয়ে যাচ্ছি। সারাদিন থাকব তো? এক ড্রেসে থাকতে ভাল লাগবে না। আমাদের আরও দুতিনজন বান্ধবী আসবে। সবাই মিলে হৈ চৈ করব, আড্ডা দেব। পিকনিক মতো হবে, ছবি তোলা হবে।
এখন এসব করা ঠিক না।
কেন? অসুবিধা কী?
তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কদিন পর এনগেজমেন্ট। মেয়েরা এ সময় ঘরে থাকে। সৌন্দর্যচর্চা করে। হৈ চৈ চিৎকার চেঁচামেচি এ সময় করা ঠিক না। ওসব করলে শরীর চেহারা নষ্ট হয়।
শুনে গম্ভীর হলো সেতু। তার মানে এখন থেকেই আমার ভাললাগা ব্যাপারগুলো তোমরা শেষ করে দিচ্ছ! স্বাধীনতা বলতে কিছুই আমার থাকছে না।
সেতুর কথায় শিলা যেন একটু বিরক্ত হল। এভাবে বলো না। কোনও ব্যাপারেই তোমাকে আমরা কখনও বাধা দিইনি। তুমি যখন যা চেয়েছ, যেভাবে চেয়েছ সেভাবেই সব হয়েছে। তোমার মতো স্বাধীনতা খুব কম মেয়ের ভাগ্যেই জোটে। বিয়ে ঠিক না হলে আজকের এই কথাগুলো তোমাকে বলার কোনও দরকার আমার হতো না।
শিলা যেন ক্ষুণ্ণ হয়েই চলে গেল।
৪. সুন্দর একটা পাঞ্জাবি
সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরেছে শুভ।
ঘি রংয়ের চমৎকার কাজ করা। সকালবেলা সেভ করে, গোসল করেছে, চুলে শ্যাম্পু করেছে। ফ্যানের হাওয়ায় সেই চুল এখন ফুরফুর করে উড়ছে। বেশ পুরুষালি একটা পারফিউমের গন্ধ আসছে শরীর থেকে। সব মিলিয়ে বেশ ভাল লাগছে শুভকে। কিন্তু চোখেমুখে গোপন একটা উৎকণ্ঠা যেন ছায়া ফেলেছে।
নাহিদ আছে সঙ্গে। ক্যামেরায় রিল ভরছিল। শুভ হঠাৎ করে বলল, কত টাকা লাগতে পারে?
বন্ধুর দিকে তাকাল না নাহিদ। নিজের কাজ করতে করতে বলল, কোন ব্যাপারে কত টাকা লাগার কথা বলছিস?
গলা নিচু করে শুভ বলল, তুই বুঝতে পারিসনি? বিয়ে করতে কত টাকা লাগবে?
রিল ভরা শেষ করে শুভর দিকে তাকাল নাহিদ। কী করে বলব? এই ধরনের বিয়েতে আমি কখনও এটেন্ড করিনি।
আমিও তো করিনি।
কিন্তু খোঁজখবর নেয়া উচিত ছিল।
তা কিছুটা নিয়েছি। বেশি টাকার কাবিন হলে নাকি ফি বেড়ে যায়। ভাবছি খুব কম টাকার কাবিন করব। আজকাল নাকি মাত্র এক টাকার কাবিন করে কেউ কেউ।
যার যা ইচ্ছে করুক। তুই এখন এসব নিয়ে ভাবছিস কেন? বুঝতে পারিসনি কেন ভাবছি?
না।
টাকা পয়সা তেমন নেই আমার কাছে। তিনচার জায়গা থেকে অতিকষ্টে হাজার পাঁচেক টাকা জোগাড় করেছি। পুরোটাই ধার। এতে না হলে মার্ডার হয়ে যাব। সেতুর সামনে প্রেস্টিজ থাকবে না।
নাহিদ যেন একটু বিরক্ত হল। ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, এভাবে টাকা পয়সা ধার করতে যাওয়া ঠিক হয়নি।
শুভ অসহায় গলায় বলল, তাহলে কীভাবে করব? সেতুকে বলব বিয়ের টাকা নিয়ে এস, আমার কাছে টাকা নেই।
না তা আমি বলিনি। তুই আসলে ভুলে গেছিস যে আমি তোর সঙ্গে আছি।
শুভর কাঁধে হাত দিল নাহিদ। আমি সঙ্গে থাকলে কোনও ব্যাপারেই তুই কখনও ভাববি না। আমার কাছে টাকা আছে, টাকা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।
এ কথায় গভীর আবেগে বুক ভরে গেল শুভর। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তুই যখন এভাবে কথা বলিস, ক্রাইসিসের সময় আমার পাশে দাঁড়াস, ভরসা দিস, আমি ঠিক বুঝতে পারি না তখন আমার কী করা উচিত! কী বলা উচিত তোকে!
নাহিদ মৃদু হাসল। কিছু বলার দরকার নেই।
আসলে আমি কিছু বলতে পারি না। আমার শুধু কান্না পায়।
অন্যদিকে মুখ ঘোরাল শুভ। এখনও পাচ্ছে।
আবার শুভর কাঁধে হাত দিল নাহিদ। এত ইমোশনাল হওয়ার কিছু নেই। চল।
মাকে ভাবীকে একটু সালাম করে আসব? এতবড় একটা কাজ করতে যাচ্ছি!
না যাওয়াই ভাল। ঝামেলা হতে পারে। পাঞ্জাবি টাঞ্জাবি পরে হঠাৎ করে মুরব্বিদেরকে সালাম করছিস, খালাম্মা নানা রকমের প্রশ্ন করতে পারেন।
ঠিকই বলেছিস। চল।
.
শুভর বুকে, গলার কাছে হাত বুলাতে বুলাতে সেতু বলল, কাজি অফিসে নাহিদ ভাই যখন তোমার আমার ছবি তুলছিল, আমার যে কী ভাল লাগছিল!
শুভ কথা বলল না।
বিয়ে শেষ করে খানিক আগে দোলনদের বাড়িতে ফিরেছে ওরা। কাজি অফিস থেকে বেরিয়েই চলে গিয়েছিল নাহিদ। উত্তরায় কী যেন কাজ আছে। নতুন বউ নিয়ে তারপর স্কুটারে চড়ে দোলনদের বাড়ি এসেছে শুভ। সঙ্গে অবশ্য দোলনও ছিল। বাড়ি এসেই দোলন চলে গেছে তার রুমে। সেতু শুভকে রেখে গেছে ড্রয়িংরুমে। সেই রুমের লম্বা সোফায় সেতুর কোলে মাথা দিয়ে এখন শুয়ে আছে শুভ।
কিন্তু আনমনা হয়ে আছে কেন? সেতু কথা বলল সে কোনও সাড়াই দিল না।
সেতু বলল, কী ভাবছ তুমি?
শুভ বলল, কিছু না।
তাহলে আনমনা হয়ে আছ কেন?
এভাবে বিয়ে করে ফেললাম, কেমন যেন লাগছে।
কথাটা শুনে মন খারাপ হলো সেতুর। তুমি শুধু তোমার দিকটা ভাবছ!
না শুধু আমার দিকটা ভাবব কেন? তোমার দিকটাও ভাবছি।
কথা বলতে বলতে উঠে বসল শুভ। আমি জানি আমার চে তোমার সমস্যা হবে অনেক বেশি, অনেক কিছু ফেস করতে হবে তোমাকে।
তারপরও সামলানো যে কী কঠিন হবে, আমি ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না।
তোমার ভাইরা খুব দুঃখ পাবেন। আমার মা ভাই এবং বোনটিও দুঃখ পাবে। খুশি হবেন শুধু ভাবী।
সেতুর একটা হাত ধরল শুভ। আমাদের ফ্যামিলির দুঃখ পাওয়ার কারণ কিন্তু তুমি না। তোমাকে সবাই খুব পছন্দ করবে, গোপনে বিয়ে করাটা পছন্দ করবে না।
সেতু ম্লান হাসল। তা কেউ করেও না। ছেলেমেয়ে কিংবা ভাইবোনের সুন্দর, স্বাভাবিক বিয়েই পছন্দ করে সবাই।
এজন্য প্রেম করাটাই ঠিক না। আর করলেও দুপক্ষ যাতে মেনে নেয় সেভাবে করা উচিত।
একথায় বিরক্ত হল সেতু। তোমার এই ধরনের কথা শুনলে আমার খুব রাগ হয়। এতকিছু ভেবে প্রেম করতে পারে কেউ? নাকি সব বুঝে শুনে অংক কষে প্রেম করে লোকে!
তারপর উদাস এবং দুঃখি হল। জানি সামনে অনেক সমস্যা, এই সুন্দর সময়টা সেই সমস্যার কথা ভেবে নষ্ট করছি আমরা। অথচ বিয়ের দিনটা সবচে আনন্দের দিন প্রেমিক প্রেমিকার।
কথা বলতে বলতে গলা ধরে এল সেতুর। চোখ ভরে এল জলে। মনে হয় তোমার জন্য অনেক কাঁদতে হবে আমাকে।
সঙ্গে সঙ্গে শুভ কী রকম বদলে গেল। গভীর মমতায় দুহাতে তুলে ধরল সেতুর মুখখানি। এভাবে বলো না। আমি তোমাকে কখনও কাঁদতে দেব না, কখনও দুঃখ দেব না। তুমি যা বলবে তাই শুনব। তোমার জন্য দরকার হলে জীবন দিয়ে দেব।
চোখ মুছে সেতু বলল, না তা তুমি করবে না। যাকে পাওয়ার জন্য সমগ্র পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি আমি, বেঁচে থাকতে তাকে আমি কখনও হারাব না।
সেতুর কথা শুনে এত ভাল লাগল শুভর, পাগলের মতো কাছে টানল সেতুকে, দুহাতে চেপে ধরল বুকে।
শুভর বুকে মুখ রেখে খানিক স্থির হয়ে রইল সেতু। তারপর মুখ তুলে শুভর গলার কাছে চুমু খেতে খেতে বলল, আদর কর, আমাকে তুমি খুব আদর কর। যত পার আদর আমাকে তুমি কর।
.
আজ সকাল থেকে মালা খুব ব্যস্ত।
সে একটু আয়েশি ধরনের মেয়ে। স্বামীকে চিঠি লেখা এবং স্বামীর ফোন পেলে পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ফোন ধরা ছাড়া অন্য যে কোনও কাজে অপরিসীম আলস্য তার।
আজ সেই আলস্য একদমই দেখা যাচ্ছে না।
সাড়ে আটটা নটার আগে মালা কখনও ঘুম থেকে ওঠে না। আজ উঠেছে পৌনে সাতটার দিকে। উঠেই ছুটোছুটি শুরু করেছে।
এই বাড়িতে সবার আগে ঘুম ভাঙে মায়ের। ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে। ঘুম ভাঙার পর এক মিনিটও বিছানায় থাকেন না তিনি। উঠে অজু করে নামাজ পড়েন। তারপর সংসারের কাজ শুরু করেন। শরীরে আলস্য বলে কিছুই যেন নেই তাঁর। তাঁকে কেউ কখনও বসে থাকতে দেখে না। সারাক্ষণই এটা করছেন, ওটা করছেন। মায়ের জন্য বাধা কাজের বুয়া রাখা যায় না বাড়িতে। একজন ছুটা বুয়া আছে। সকালবেলা এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে সে। তারপর চলে যায়। মধ্যবয়সী বুয়াটির কাজ হচ্ছে সব রকমের ধোয়া মোছা এবং মশলা বাটা। মেশিনে গুঁড়ো করা মশলা একেবারেই পছন্দ করেন না মা। গুড়ো মশলায় রান্না করা তরকারি মুখে দিতে পারেন না।
আর বুয়াদের হাতের রান্না?
প্রশ্নই ওঠে না। মরে গেলেও ওসব রান্না মুখে দেবেন না তিনি।
সারাক্ষণ কাজের মধ্যে আছেন বলেই বোধহয় এখনও ভাল আছেন তিনি। শরীরে মেদ জমেনি, অসুখ বিসুখে ধরেনি। বয়স হল চৌষট্টি, পয়ষট্টি। এগারো বছর আগে বিধবা হয়েছেন, তবু যেন কোনও রকমের মালিন্য স্পর্শ করেনি তাঁকে। গায়ের রং টকটকে ফর্সা, তীক্ষ্ণ নাক, বয়সের তুলনায় সামান্যই পেকেছে চুল, চোখে চশমা আছে কিন্তু বয়সের তুলনায় পাওয়ার তেমন নয় চশমার। মুখটা রাগি ধরনের, এই রাগি মুখ নিয়ে এখনও বেশ সুন্দর তিনি। কম বয়সে তিনি যে বেশ রূপবতি ছিলেন বোঝা যায়।
আজ অত সকালে মালাকে উঠতে দেখে, ব্যস্ত হতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেছেন তিনি কিন্তু ওই নিয়ে কোনও কথা বলেননি।
বললেন এখন।
ডাইনিং টেবিলে অনেকগুলো প্লেট গ্লাস, কাপ পিরিচ পেয়ালা জগ। মালা নিজ হাতে গরম পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়েছে। এখন মা মেয়ে দুজনে মিলে সেগুলো গুছিয়ে রাখছে। কাজটা করতে করতে থমথমে গলায় মা বললেন, তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের এভাবে আসার দরকারটা কী?
শ্বশুরবাড়ি শব্দটা শুনলেই লাজুক একটা ভঙ্গি করে মালা। সেই ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বলল, আমাকে নাকি অনেকদিন দেখে না। বলল, দেখতে আসবে।
শুনে মা বেশ রাগলেন। এতই যখন আল্লাদ, তোকে তাদের বাড়িতে নিয়ে রাখে না কেন? ছেলে বিদেশে আছে তো কী হয়েছে?
মালা গাল ফুলাল। সব সময় এমন করে বলো না মা, ভাল লাগে না।
উচিত কথা কারওই ভাল লাগে না। এতগুলো মানুষ আসবে তাদের পেছনে একটা খরচা আছে না! টাকাটা আসে কোত্থেকে?
যত খরচ হয়, হিসেব করে টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নিও।
চুপ কর, বড় কথা বলবি না।
এ সময় শুভ এসে বাড়ি ঢুকল। কোথায় ছিল কে জানে। মুখটা বিষণ্ণ হয়ে আছে, চোখে উদাসীনতা। কোনওদিকে না তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে, মা শুভর দিকে তাকালেন। আজ আর বাড়ি থেকে বেরুবি না। গেস্ট আসবে।
চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল শুভ। কোনও কথা বলল না, নিজের রুমের দিকে চলে গেল। শুভর এই আচরণে মা যেন খুবই বিরক্ত হলেন। নিজেকে নিজে বলার মতো করে বললেন, পাগলা গারদের মধ্যে আছি। একেকটা হয়েছে একেক রকম।
.
অফিস থেকে সরাসরি বাড়ির কিচেনে আজকের আগে কখনও আসেনি শাহিন।
সুরমা ব্যস্ত রান্নাবান্না নিয়ে। গরমে ঘামে একসা অবস্থা তার। বোধহয় এই কারণেই স্বামীর এভাবে রান্নাঘরে আসাটা খুব একটা গুরুত্ব দিল না সে।
কিন্তু স্ত্রীর কাহিল অবস্থাটা গুরুত্ব দিল শাহিন। চিন্তিত গলায় বলল, রান্নাবান্না করতে পারে এমন একটা কাজের বুয়া রাখা দরকার।
কথাটা শুনে সুরমা যেন অবাক হল। কেন, বুয়া তো আছেই।
শাহিনও অবাক হল। কোথায় বুয়া?
এই যে!
নিজেকে দেখাল সুরমা।
শাহিন লজ্জা পেল। এভাবে বলল না। আমাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? সংসারে একেকজন মানুষ একেকরকম হয়। আমার মা একটু অন্যরকম, একটু মেজাজি…!
শাহিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাসল সুরমা। এত কাতর হওয়ার কিছু নেই। আমি এভাবেই বলেছি। তুমি এখান থেকে যাও। মা দেখলে বিপদ হবে।
কীসের বিপদ?
বলবেন, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসে, কিচেনে দাঁড়িয়ে বউর সঙ্গে গল্প করছে।
কিন্তু আমি তো এসেছি মালার শ্বশুরবাড়ি থেকে গেস্ট আসবে বলে! রান্নাবান্না কী হচ্ছে সেসবের খোঁজখবর নিচ্ছি। ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি।
কিচেন থেকে বেরিয়ে শুভর রুমে এল শাহিন। কী করছিস?
সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিল শুভ। শাহিনকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে বসল। ভাইয়া, তুমি আমার রুমে?
শাহিন হাসল। এমনভাবে বললি, যেন জীবনে কোনওদিন তোর রুমে আসিনি?
তবে এসে খুব ভাল করেছ। তোমার সঙ্গে জরুরী আলাপ আছে।
শুভর পড়ার চেয়ারটায় বসল শাহিন। আমাকে দেখে আলাপের কথা মনে হল?
আরে না! অনেকদিন ধরেই ভাবছি আলাপটা করব।
করিসনি কেন?
সময় পাইনি।
শাহিন ঠাট্টার সুরে বলল, হ্যাঁ তুই তো খুবই ব্যস্ত। আপন বড়ভাই জ্বরে বেহুশ হয়ে থাকে, এক বাড়িতে থেকেও তুই তাকে দেখতে যাওয়ার সময় পাস না।
শুভ লজ্জা পেল। এটা সত্যি আমার খুব অন্যায় হয়েছে।
তারপর বিছানায় বসেই ডানদিককার কান শাহিনের দিকে এগিয়ে দিল। তুমি আমার কানটা মুচড়ে দাও ভাইয়া।
শুভর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিল শাহিন। আরে যাহ পাগলা!
তারপর বলল, কিন্তু কী নিয়ে ব্যস্ত তুই?
ব্যস্ত মানে নানা রকমের ঝামেলা যাচ্ছে আর কী! যেটা তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইলাম ভাইয়া, আমাকে একটা চাকরি বাকরির ব্যবস্থা করে দাও। চাকরির খুব দরকার।
তীক্ষ্ণচোখে শুভর মুখের দিকে তাকাল শাহিন। তোর তো এখনও রেজাল্ট বেরয়নি, এখুনি কীসের চাকরি!
একপলক শাহিনের দিকে তাকিয়ে কথা ঘোরাল শুভ। বেকার ছেলে মা একদম দেখতে পারে না। প্রায়ই কথা শোনায়। তাছাড়া নিজের একটা হাত খরচের ব্যাপার। আছে। তোমাদের কাছ থেকে কত নেব?
শাহিন উদাস গলায় বলল, ঠিক আছে, দেখি।
এই বিষয়টা রাতেরবেলা সুরমাকে বলল শাহিন।
মালার শ্বশুরবাড়ির লোকজন চলে যাওয়ার পর, সবকিছু গোছগাছ করে, রাত এগারোটার দিকে নিজের রুমের ড্রেসিংটেবিলে বসেছে সুরমা। ঘুমোবার আগে অনেকক্ষণ ধরে মাথা আঁচড়াবার অভ্যেস তার। এখন সেই কাজটা করছে। বিছানায়। আধশোয়া হয়েছিল শাহিন। শুভর কথা মাত্র বলতে যাবে তার আগেই সুরমা বলল, মালার শ্বশুরবাড়ির লোকজনগুলো যেন কেমন?
শুনে শুভর প্রসঙ্গ ভুলে গেল শাহিন। মানে?
আমাদের বাড়িতে এসে মালাকে নিয়ে আদিখ্যেতার সীমা পরিসীমা নেই, কিন্তু একবারও বলল না তুমি গিয়ে আমাদের বাড়িতে কদিন থেকে এসো। ছেলে বিদেশে থাকলে ছেলের বউকে বাড়িতে নিয়ে রাখে না লোকে, নাকি সবসময় বাপের বাড়িতেই ফেলে রাখে!
এসব নিয়ে ভেব না। মালার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের ব্যাপারে আমার তেমন কোনও আগ্রহ নেই। ওর বরটা ভাল তাতেই আমি খুশি।
তারপর শুভর কথা মনে পড়ল শাহিনের। বিছানায় উঠে বসল সে। শোন, অন্য একটা বিষয়ে কথা বলি। শুভর ব্যাপারটা কী?
সুরমা চমকাল। কেন, কী হয়েছে?
খুবই চিন্তিত মনে হল। চাকরি বাকরি করতে চাইছে।
তাই নাকি! হঠাৎ এমন সুমতি?
সুমতি না অন্যকিছু সেটাই ভাবছি।
অন্যকিছু মানে?
এই মানেটাই বের করতে চাইছি। আচ্ছা, শুভর কি কোনও মেয়ের সঙ্গে ভাবটাব আছে? ব্যাপারটা এমন নয়তো যে সেই মেয়েটি বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করতে হবে এজন্য চাকরি বাকরি দরকার।
ভেতরে ভেতরে ব্ৰিত হল সুরমা কিন্তু শাহিনকে বুঝতে দিল না কিছুই। মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে নির্বিকার গলায় বলল, আমি কী করে বলব?
তোমার কাছে সে কিছু লুকায় না।
কিন্তু এসব কখনও বলেনি।
জানার একটু চেষ্টা করো তো?
পরদিন সকালেই জানার চেষ্টাটা করল সুরমা।
এককাপ চা হাতে শুভর রুমে এসে ঢুকল সে। শুভ বেরুচ্ছিল সেতুর সঙ্গে দেখা করতে। সুরমাকে দেখে নয়, তার হাতে চায়ের কাপ দেখে উৎফুল্ল হল। কাপটা নিয়ে ফুরুক করে চুমুক দিয়ে বলল, তোমার নামের মধ্যে ‘মা’ শব্দটা আছে, সুরমা, তোমাকে আমার মা বলেই ডাকা উচিত। তুমি আমার জন্য যা কর, যেভাবে ফিল কর আমাকে, মা ছাড়া এভাবে কেউ কাউকে ফিল করে না।
মুখের সুন্দর একটা ভঙ্গি করে সুরমা বলল, হঠাৎ এমন আল্লাদের কারণ কী? মানে এত আল্লাদী কথা কেন বলছিস?
এই যে তুমি আমার জন্য চা নিয়ে এলে এজন্য। তুমি ছাড়া কারোরই বোঝার কথা নয় যে এই মুহূর্তে আমার এককাপ চায়ের দরকার।
সেতুর বোঝার কথা।
শুভ একটু থতমত খেল। হ্যাঁ সেও হয়তো বুঝবে।
তারপর উদাস হল।
ব্যাপারটা খেয়াল করে সুরমা বলল, সেতুর কথা বলতেই যেন চিন্তিত হয়ে গেলি?
নিজেকে সামলাল শুভ। না মানে, ভাবী, আমি আসলে ভেতরে ভেতরে খুবই অস্থির হয়ে আছি। এমন একটা ব্যাপার, কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। কিন্তু ব্যাপারটা। কারও সঙ্গে শেয়ার করা উচিত।
কী হয়েছে?
তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল। কেন যে বলা হয়নি!
এত ভনিতা করছিস কেন? বলতে হলে এখনও বলা যায়।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের ওপর রাখল শুভ। মাথা নিচু করে বলল, সেতুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
শুনে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সুরমা। কী?
আমাদের কোনও উপায় ছিল না।
দুহাতে সুরমার একটা হাত ধরল শুভ। তোমাকে না বললে অন্যায় হতো। ভাবী, আপাতত তুমি ছাড়া কথাটা যেন আর কেউ না জানে!
শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় সুরমা বলল, এটা কি ঠিক হল?
আমি এভাবে চাইনি। সেতুর কারণে বাধ্য হয়েছি।
কিন্তু সামলাবি কীভাবে?
জানি না। তবে তিনটি ভরসা আছে আমার। তুমি নাহিদ আর সেতু।
.
সব শুনে সেতু বলল, তুমি অন্তত একজনকে বলে ফেলেছ, আমি তো পারছি না।
অবাক হয়ে সেতুর মুখের দিকে তাকাল শুভ। এখনও কাউকে বলনি?
না। ভয় করছে, খুব ভয় করছে। বলার সঙ্গে সঙ্গে যে কী হবে বাড়িতে কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাই ভাবীরা কে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে, তাদের রিয়্যাকসানে আমি কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
কিন্তু জানানো দরকার। এনগেজম্যান্টের ডেট এসে গেল, এখনও যদি না জানাও পরে কিন্তু অন্য ধরনের কেলেংকারি হয়ে যাবে।
আর একটা ব্যাপারেও খুব ভয় পাচ্ছি।
কী?
জানাজানি হওয়ার পর যদি বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ হয়ে যায়, মানে বাড়ি থেকে যদি আমাকে আর বেরুতে না দেয়, তোমার সঙ্গে যদি দেখা করতে না পারি!
হ্যাঁ, এমনও হতে পারে। তবে এখন যে কোনও পরিস্থিতি ফেস করার জন্য রেডি থাকতে হবে।
কিন্তু আমার খুব ভয় করছে।
সেতুকে বুকের কাছে টেনে আনল শুভ। ভয় পাবে না, একদম ভয় পাবে না। আমি আছি। এখন তুমি আমার বউ, বিয়ে করা বউ। আমি বেঁচে থাকতে আমার কাছ থেকে কেউ তোমাকে সরিয়ে রাখতে পারবে না। তোমার জন্য পৃথিবীর যে কোনও দেয়াল আমি ভেঙে ফেলব।
শুভর গলার কাছে আদুরে ভঙ্গিতে মুখ ঘষে সেতু বলল, তুমি এভাবে বললে খুব ভাল লাগে আমার, খুব সাহস পাই আমি।
শুভ কোনও কথা বলল না। আনমনা হয়ে গেল।
শুভর বুক থেকে মুখ তুলে সেতু বলল, কী হয়েছে? আমার সামনে বসে কার কথা ভাবছ তুমি?
শুভ ম্লান হাসল। তোমার কথা।
আমার কথা ভাববে যখন আমি তোমার সামনে না থাকব তখন, যখন সামনে থাকব তখন তুমি শুধু আমাকে দেখবে, আমার সঙ্গে কথা বলবে আর আমাকে আদর করবে।
সেতুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল শুভ। আসলে আমার মনটা খারাপ।
কেন গো?
তোমার জন্য।
কী করেছি আমি?
আমাকে বিয়ে করে খুব বড় ভুল করেছ। আমি এক হতদরিদ্র যুবক, সুখ শান্তি প্রাচুর্য কিছুই তোমাকে আমি দিতে পারব না।
শুভর একগালে হাত বুলিয়ে দিল সেতু আর একগালে চুমু খেল। কীসে আমার সুখ, কীসে আমার শান্তি তা তুমি জান না। কোনও প্রাচুর্য তোমার কাছে আমি চাই না, আমি শুধু একটা জিনিস চাই তোমার কাছে, বল, সারাজীবন ধরে সেই জিনিসটা আমাকে তুমি দেবে?
সাধ্য থাকলে অবশ্যই দেব।
সাধ্য তোমার আছে।
তাহলে বল, বল কী চাও তুমি?
ভালবাসা চাই, সারাজীবন ধরে আমি শুধু তোমার ভালবাসা চাই।
সেতুকে আরও নিবিড় করে আঁকড়ে ধরল শুভ। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালবাসা ছাড়া তোমাকে দেয়ার মতো আর কিছু নেই আমার। সারাজীবন ধরে আমার সবটুকু ভালবাসা আমি শুধু তোমাকেই দেব।
তারপর একটু থেমে বলল, এই, তুমি আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবে?
সেতু ঘোরলাগা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে যে কোনও জায়গায় যেতে রাজি আমি, এমনকি দোযখেও।
দোযখে তোমাকে আমি নেব কেন?
তাহলে কোথায় নেবে?
কক্সবাজার।
হঠাৎ কক্সবাজার কেন?
হানিমুনে। আমরা নবদম্পতি, হানিমুনে যাব না?
ওরকম হানিমুন কি আমাদের কখনও হবে?
কেন হবে না?
যেভাবে বিয়ে হল, আমার ভাইরা এ বিয়ে মেনে নেবে কি না…
সেতুকে থামিয়ে দিল শুভ। থাক, এসব এখন আর বলো না, মন খারাপ হয়ে যাবে। তারচে’ অন্যকথা বল।
শুভর বুকে আঙুল বোলাতে বোলাতে সেতু বলল, আমার এক সময় স্বপ্ন ছিল আমি হানিমুনে যাব কাশ্মিরে। শ্রীনগরের ডাললেকে সিকারায় থাকব অনেকগুলো দিন।
সিকারা মানে?
এক ধরনের নৌকো। নবদম্পতি কিংবা প্রেমিক প্রেমিকারা থাকে।
শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাধ্য থাকলে এক্ষুণি তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতাম।
তারপর একেবারেই অন্যমানুষ হয়ে গেল শুভ। চটপটে গলায় বলল, চল, শ্রীনগরে নিয়ে যাই তোমাকে, এক্ষুণি নিয়ে যাই। ডাললেকের সিকারায় বসে একজন ধরে রাখি আরেকজনের হাত, একজন তাকিয়ে থাকি আরেকজনের চোখে মুখে কোনও কথা থাকবে না আমাদের, সব কথা হবে চুমোয় চুমোয়, নিঃশব্দে।
সেতু হাসল। কিন্তু তুমি আমাকে নেবে কীভাবে?
শুভ একমুহূর্তও দেরি করল না। বলল, কল্পনায়, কল্পনায় নিয়ে যাব। আমার বুকে মুখ রেখে চোখ বুজে তুমি কল্পনা কর, দেখবে দোলনদের ড্রয়িংরুমটাই ডালকের ভাসমান সিকারা হয়ে গেছে। ভালবাসা থাকলে সব হয়।
.
মামুন বাড়ি ফিরল সন্ধের পর।
অফিস থেকে ফিরে সে সাধারণত ড্রেসিংরুমে ঢোকে। বাইরের পোশাক বদলে বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে তারপর আসে বেডরুমে।
আজ ড্রেসিংরুমে ঢুকল না। বেডরুমে শিলা আছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে টাই আলগা করতে করতে বলল, এনগেজম্যান্টের অনুষ্ঠান শেরাটনে করব। স্বপনকে। পাঠিয়েছি বুকড করতে।
শিলা বলল, এটা কিন্তু একটা বাড়তি খরচ। এসব না করে একবারে বিয়ে দিলেই পারতে। সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠান করতে আর নয়ত সেনাকুঞ্জে।
খরচ নিয়ে তুমি ভাবছ কেন? আমাদের একমাত্র বোন।
একমাত্র বোন বলে অকারণে সব করতে হবে নাকি?
কোন ফাঁকে দক্ষিণের দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সুন্দর এবং অতি আরামদায়ক চেয়ারটায় বসে পড়েছে মামুন। শিলার কথা শুনে একটু নড়েচড়ে উঠল। আক্রমণের গন্ধ পাচ্ছি। তুমি কি কোনও কারণে রেগে আছ? ঝগড়া লাগাবে নাকি?
শিলা কঠিন গলায় বলল, যদি লাগাই?
না না, লাগিয়ো না। আমি আগেই সারেন্ডার করছি। আমি তোমাকে খুবই ভয় পাই। সেদিনের পর থেকে মারাত্মক রকমের সাবধানতা অবলম্বন করে আছি, যাতে কোনওভাবেই বিগড়ে যাওয়ার চান্স না পাও তুমি। ইয়ে, গহনা বানাবে বলেছিলে, কালই যাও, অর্ডার দিয়ে এস।
অর্ডার দেয়া হয়ে গেছে। দুএকদিনের মধ্যেই নিয়ে আসব। টাকাটা দিয়ে দিও।
কত, কত টাকা? ক্যাশ না চেক?
বিলটা আমার কাছে আছে। একলাখ বাহাত্তোর হাজার। তবে ক্যাশ টাকা নিয়ে আমি মুভ করব না। চারদিকে যা ছিনতাই ফিনতাই হচ্ছে!
খুবই সরল মুখ করে মামুন বলল, ফিনতাইটা কী?
মামুনের মুখভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল শিলা। ফাজলামো করো না।
মামুন বিগলিত হল। করার আর দরকার হবে না। এই যে তুমি একবার হাসলে, মামার কাজ শেষ। শোন, আমাদের প্রপার্টির এক অংশ সেতুরও। সব মিলে দুআড়াই কোটি টাকা সে পাবে। দরকার হলে ওর টাকা থেকে ওর বিয়ের খরচা করব।
গ্রীবা বাঁকিয়ে মামুনের দিকে তাকাল শিলা। কথাটা কি তুমি আমাকে খুশি করার জন্য বললে?
মামুন বিব্রত হল। না, তা কেন বলব!
ভাবতে পার, আমি তোমার স্ত্রী, বোনের বিয়েতে তোমার টাকা থেকে বিশাল একটা এমাউন্ট খরচা হয়ে যাবে ভেবে রেগে আছি আমি কিংবা রেগে যেতে পারি এজন্য আমাকে ম্যানেজ করছ এ ধরনের কথা বলে! যদি এরকম ভেবে থাক, ভাবনাটা তোমার ঠিক না। এভারেজ বাঙালি বউদের মতো লোভি মহিলা আমি নই। যা বললে তা কক্ষনো করবে না। তোমাদের কি কোনও অভাব আছে নাকি যে সেতুর প্রাপ্য থেকে ওর বিয়ের খরচা করবে? তোমাদের দুভাইয়ের দায়িত্ব হচ্ছে ছোটবোনকে ভাল পাত্রে বিয়ে দেয়া। বাপ না থাকলে বড়ভাই বাবার মতো। মেয়ে বিয়ে দিয়ে বাবা কখনও বলে না যে তোর প্রাপ্য থেকে তোকে বিয়ে দিলাম।
শিলার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল মামুন। চেয়ার ছেড়ে উঠে এল সে, শিলার সামনে দাঁড়াল। খুব ভাল লাগল তোমার কথা শুনে। তুমি যাতে এই কথাগুলোই বল, শোনার জন্য চালাকি করে সেতুর প্রাপ্য টাকার প্রসঙ্গটা তুলোম। সত্যিকার অর্থে কখনও আমি তা করব না। স্বপনকেও করতে দেব না। আমাদের টাকায়ই বিয়ে দেব সেতুকে। তারপর ও যখন ওর প্রাপ্য চাইবে হিসেব করে পাই টু পাই ওরটা ওকে দিয়ে দেব।
তারপর স্ত্রীর কাঁধে হাত দিল মামুন। তুমি একটু নিচু হও।
শিলা অবাক হল। কেন?
দেখছ না সঙ্গে জলচৌকিটা নেই।
স্বামীর হাত সরিয়ে ছিটকে গেল শিলা। এই, খবরদার! ফাজলামো করো না।
মামুন হো হো করে হাসতে লাগল।
.
রেখা টিভি দেখছে।
বেডরুমে ঢুকে রেখার দিকে না তাকিয়ে টিভির দিকে তাকাল স্বপন। টিভিটা অফ
রিমোট টিপে টিভি অফ করল রেখা। ভাইয়া কী বললেন?
খুশি হলেন। চট করে শেরাটন ম্যানেজ করে ফেলব, ভাবেননি।
মন খারাপ করা ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে পড়ল স্বপন।
ব্যাপারটা খেয়াল করে রেখা বলল, তোমাকে কী রকম যেন দেখাচ্ছে। মন খারাপ?
স্বপন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেতুর এনগেজম্যান্টের দিন ঘনিয়ে আসছে আর মন খারাপ হচ্ছে আমার।
ছোটবোনের বিয়ের সময় এমনই লাগে। বিশেষ করে মা বাবা না থাকলে। আমার বিয়ের দিন দেখনি ভাইয়ারা কী রকম কান্নাকাটি করল!
বোন যখন বাড়ি থেকে চলে যায় তখন কান্না পাবেই। আমার তো এখনই পাচ্ছে।
রেখা আচমকা বলল, একটু কাঁদ না!
স্বপন অবাক হল। কী?
তোমাকে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি। নিজের স্বামীকে কাঁদতে দেখলে কেমন লাগে, এই অভিজ্ঞতাটা থাকা দরকার।
স্বপন হাসল। ফাজলামো করো না।
রেখাও হাসল। তোমার মন ভাল করার জন্য করলাম।
তা আমি বুঝেছি।
তবে অভিজ্ঞতাটা আমার সত্যি থাকা দরকার।
সেতুর বিয়ের দিন হয়ে যাবে।
স্বপন এবং রেখা যখন এসব কথা বলছে তখন বাবলুর রুমে এসে ঢুকেছে মুন্নি। সোফায় শুয়ে সকালবেলার কাগজ রাতেরবেলা পড়ছে বাবলু আর তার রুমের মেঝেতে বসে পাঁচ সাতটা পুতুল নিয়ে মগ্ন হয়ে খেলছে টুপলু।
বিন্দুমাত্র ভনিতা না করে মুন্নি বলল, গেটধরা বোঝ, ভাইয়া?
খবরের কাগজের আড়াল থেকে মুখ বের করল বাবলু। না তো! গেটরা কী?
বিয়ের দিন যখন বর আসে তখন বাড়ির ছেলেমেয়েরা গেট আগলে দাঁড়ায়। বরপক্ষ টাকা না দিলে ঢুকতে দেয়া হয় না, এটাকে বলে গেটধরা।
বুঝেছি, এখন যা, আমি খেলার খবর পড়ছি।
পুতুলকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে টুপলু বলল, আমিও ব্যস্ত। খেলছি।
কিন্তু মুন্নি দমল না। বলল, একেকজন দশহাজার টাকা করে পাব।
বাবলু উৎসাহি হল। কীভাবে?
ফুপির বিয়ের দিন আমরা তিনজনে মিলে গেট ধরব। পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইব। যা চাইব তাতো আর দেবে না, কমাবার চেষ্টা করবে। তবে তিরিশ হাজারের কমে কিছুতেই আমরা ছাড়ব না। ওই তিরিশ হাজার তিনজনে ভাগ করব। একেকজনের ভাগে দশহাজার করে।
ভেরিগুড। আমি আছি তোর সঙ্গে। গেট ধরব।
টুপলু বলল, আমিও ধরব কিন্তু টাকা নেব না। টাকা নিলে আম্মু আমাকে বকবে। আমার ভাগের টাকাটাও তোমরা দুজনে নিয়ে নিও।
মুন্নি খুশি হয়ে বলল, তাহলে আমাদের ভাগে পনের হাজার করে পড়বে।
.
তুই কি ঢাকায় নাকি?
নাহিদ বিষণ্ণ গলায় বলল, ছিলাম না, বর্ষাকে নিয়ে কাল এসেছি। বাবা মাও এসেছেন। আজ ওকে একজন ডাক্তার দেখাব তারপর কাল সবাই মিলে আবার ফিরে যাব।
কোথায় উঠেছিস তোরা?
মাঝারি ধরনের একটা হোটেলে।
শুভ অবাক হল। হোটেলে উঠেছিস কেন?
নাহিদ আবার বিষণ্ণ হল। তাহলে কোথায় উঠব! তুই তো জানিসই ঢাকায় আমাদের কোনও আত্মীয়স্বজন নেই।
আত্মীয়স্বজন না থাক, আমি তো আছি, আমাকে জানালি না কেন?
জানালে কী হত?
আমাদের বাড়িতে ওঠার ব্যবস্থা করতাম।
এতগুলো মানুষ নিয়ে একটা বাড়িতে এসে ওঠা যায় না।
বুক পকেট থেকে ছবির খাম বের করল নাহিদ। তোদের বিয়ের ছবিগুলো।
ছবির কথা শুনে যতটা আগ্রহি হওয়ার কথা শুভর তার কিছুই হল না। খামটা সে খুললও না। বিছানার ওপর ফেলে রেখে বলল, কোন হোটেলে উঠেছিস বল, আমি গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসব।
দরকার নেই। আমরা কখন কোথায় থাকব বলতে পারছি না। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আমি আবার ঢাকায় আসব। এসে তোর সঙ্গে দেখা করব।
নাহিদ চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে ছবিগুলো দেখল শুভ। প্রত্যেকটি ছবির দুটো করে প্রিন্ট। বেশ বুদ্ধি করেই দুসেট ছবি করিয়েছে নাহিদ। একটা সেট শুভর কাছে থাকবে আরেকটা সেতুর কাছে।
সেতুর সেটটা তো তাহলে আজই পৌঁছে দিতে হয়। এক্ষুণি যেতে হয় দোলনদের বাড়ি।
এই ভেবে তক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরুল শুভ। দোলনদের বাড়ি পৌঁছবার আগে টকটকে লাল, তরতাজা কতগুলো গোলাপ কিনল। ফুলগুলো ব্যান্ড দিয়ে সুন্দর করে বেঁধে দিল দোকানের একজন কর্মচারি। ছবির সঙ্গে এই ফুল পেলে মুগ্ধ হয়ে যাবে সেতু। সেতুর মুগ্ধতার চে মূল্যবান আর কিছুই নেই শুভর কাছে।
কিন্তু ফুল দেখে দোলন একটু ভুল বুঝল। আমার জন্য ফুল এনেছেন?
শুভ হাসল। না।
তাই তো বলি, আপনার তো এত উদার হওয়ার কথা না।
বউর বান্ধবীর সঙ্গে উদার হওয়ার কোনও দরকার আমার নেই। আমি এলাম তোমাকে একটু জ্বালাতে।
ওসব বলে আর লাভ কী! দুজনে মিলে তো অনেকদিন ধরেই জ্বালাচ্ছেন।
এভাবে বললে সারাজীবন জ্বালাব।
না বললেও যে জ্বালাবেন, জানি। অসুবিধা নেই, কী করতে হবে বলুন।
এই খামে আমাদের বিয়ের ছবিগুলো আছে, ছবির সঙ্গে এই ফুল, এসব ওকে একটু পৌঁছে দেবে।
ছবির খাম এবং ফুল হাতে নিল দোলন। ঠিক আছে, এক্ষুনি যাচ্ছি। আর কিছু বলতে হবে?
হ্যাঁ।
কী?
বলবে, আমি ওকে খুব ভালবাসি।
দোলন মিষ্টি করে হাসল। আপনি খুব রোমান্টিক।
কিন্তু দোলনের হাতে ফুল দেখে সেতু খুব অবাক। চোখ ছানাবড়া করে বলল, তুই হঠাৎ ফুল নিয়ে!
দোলন উজ্জ্বল গলায় বলল, বান্ধবীর এনগেজম্যান্ট হচ্ছে, খালি হাতে তার সঙ্গে দেখা করতে আসি কী করে?
সেতু গম্ভীর হল। আমি টেনশানে মরছি আর তুই ফাজলামো করছিস?
টেনশান করে লাভ নেই। আমি চলে যাওয়ার পর পরই বাড়িতে আজ জানিয়ে দিবি।
ফুলগুলো সেতুর হাতে দিয়ে ব্যাগ থেকে ছবির খামটা বের করল দোলন, সেতুর হাতে দিল। তোদের বিয়ের ছবি। কেউ যদি তোর কথা বিশ্বেস না করে তাহলে ছবি দেখিয়ে দিবি। ছবির সঙ্গে ফুলগুলোও তোর বর পাঠিয়েছে, বলেছে, সে তোকে খুব। ভালবাসে।
ভালবাসা শব্দটা শুনে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল সেতুর।
তারপরও ভাবীদের কাউকে বিয়ের কথাটা জানাতে পারল না সেতু। সারাটা দুপুর ছটফট করল। বিয়ের ছবিগুলো দেখতে দেখতে নানারকমভাবে ভাবল কেমন করে কথাটা ভাবীদেরকে বলা যায়। কোন ভাবিকে বলবে, শিলা না রেখাকে!
রেখা একটু নরম ধরনের। রেখাকে বলতে সুবিধে হবে ভেবে বিকেলের মুখে মুখে রেখার বেডরুমের সামনে এসে দাঁড়াল সেতু। যেমন করেই হোক আজকেই জানাতে হবে। এনগেজমেন্টের চারদিন বাকি। আজ না জানালে অন্য ধরনের সমস্যা হবে। পাত্রপক্ষকে মানা করার ব্যাপার আছে। একেবারেই শেষ সময়ে জানালে কিংবা এনগেজম্যান্টের দিন জানালে সিনেমার মতো ব্যাপার হবে। স্বাভাবিক অবস্থার চে বেশি বিব্রত হবে ভাইয়ারা, স্বাভাবিক অবস্থার চে বেশি রাগবে সেতুর ওপর।
কিন্তু রেখার বেডরুমের কাছে এসেও ভেতরে ঢুকতে পারল না সেতু, নিজের অজান্তেই যেন বসে পড়ল রেখার রুমের সঙ্গের বারান্দায় ফেলে রাখা বেতের চেয়ারগুলোর একটায়। বসে আনমনা হয়ে রইল। বিয়ের তিন চারটে ছবি হাতে ধরা, মূল খাম রেখে অন্য একটা খামে ভরে ছবি কটি নিয়ে এসেছে। একবার ভেবেছিল সবগুলো ছবিই, মানে পুরো খামটা দোলন যেভাবে দিয়ে গেছে ঠিক সেভাবেই দিয়ে আসবে ভাবীদের একজনকে। তারপর ভেবেছে, যদি ছবিগুলো আর ফেরত না পায়! যদি ছিঁড়েটিরে ফেলে দেয় ভাইয়ারা! তারপর যদি শুভর সঙ্গে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে দেয়, তাহলে একা ঘরে হাজার ইচ্ছে হলেও তো বিয়ের ছবিগুলো দেখতে পাবে না সে!
তুমি এভাবে এখানে বসে আছ?
সেতু চমকে তাকাল। কখন রেখা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে! সেতুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল। সেতু তার দিকে তাকাতে মুখে দুঃশ্চিন্তার ছায়াটাও দেখতে পেল। বলল, কী হয়েছে?
সেতু বিষণ্ণ গলায় বলল, কিছু না।
তোমাকে কী রকম যেন দেখাচ্ছে! শরীর খারাপ, নাকি কিছু ভাবছ?
এই সুযোগটা ইচ্ছে করলেই নিতে পারে সেতু! রেখার কথার রেশ ধরে গড়গড় করে বলে যেতে পারে সব কথা। হাতের খামটা এগিয়ে দিতে পারে রেখার দিকে।
কিন্তু এসবের কিছুই করল না সে। আগের মতোই বিষণ্ণ গলায় বলল, শরীরও খারাপ না, কিছু ভাবছিও না, এমনিতেই বসে আছি।
সঙ্গে সঙ্গে সেতুর মুখোমুখি চেয়ারে বসল রেখা। চা খাবে?
একথায় বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই কিন্তু সেতু খুব বিরক্ত হল। রুক্ষ্ম গলায় বলল, এ সময় চা খাব কেন? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বাইরের লোক, তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি!
রেখা থতমত খেল। ফ্যাল ফ্যাল করে সেতুর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আবারও বলছি, কী হয়েছে তোমার?
গলা আগের চেয়েও রুক্ষ্ম হল সেতুর। আমিও আবার বলছি, কিছুই হয়নি আমার।
কদিন পর এত ভালপাত্রের সঙ্গে যে মেয়ের এনগেজম্যান্ট তার মনমেজাজ এ সময় এত তিরিক্ষি হওয়ার কথা নয়।
তাহলে কেমন হওয়ার কথা?
এ সময় সে থাকবে গভীর আনন্দে। মজা করবে, হাসবে।
নাচবে না? ভারতনাট্যম কিংবা কথক?
উঠে হন হন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেল সেতু।
রেখা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সেতুর এই ধরনের আচরণ কখনও দেখেনি সে।
.
মামুন অফিসে চলে যাওয়ার পর সুন্দর একটা শাড়ি পরল শিলা।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে সাজগোজ করতে লাগল। এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরুবে সে। গহনা আনতে যাবে। এক লাখ বাহাত্তোর হাজার টাকার চেক দিয়ে গেছে মামুন।
জুয়েলারিওয়ালারা এডভান্স ছাড়া অর্ডার নেয় না, শুধু এই বাড়িরটা নেয়। ক্যাটালগ দেখে অর্ডার দিয়ে এলেই হয়। গহনা আনার দিন পুরো পেমেন্ট।
কাল বিকেলে টেলিফোনে খবর নিয়েছে শিলা। গহনা রেডি। আজ আনতে যাবে, এজন্য বেশ আনন্দে আছে সে। গুনগুন করে গানও গাইছিল। সেতুকে দেখে থামল।
হাতের খামটা নাড়তে নাড়তে সেতু বলল, তুমি কি বেরুচ্ছ ভাবি?
শিলা হাসল। হ্যাঁ।
কোথায় যাচ্ছ?
মার্কেটে। ননদের বিয়ে, কত কেনাকাটা করতে হয়! এখন যাচ্ছি গয়না আনতে।
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বল।
ভাইয়াদেরকে জানিয়ে দাও, বিয়েটা হবে না।
কথাটা যেন বুঝতে পারল না শিলা। থতমত খেয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়না থেকে মুখ ফেরাল। কী?
গলা একটুও কাঁপল না সেতুর, একটুও নার্ভাস হল না সে, একেবারেই নির্বিকার গলায় বলল, আমার বিয়ে হয়ে গেছে। শুভ নামের একজনের সঙ্গে বহুদিনের এফেয়ার আমার। তাকে আমি বিয়ে করেছি। এই খামে আমাদের বিয়ের ছবি আছে।
খামটা শিলার হাতে দিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে নিজের রুমের দিকে চলে গেল সেতু।
এদিকে শিলার তখন সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। খামটা ধরে মৃতের মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। মার্কেটে যাওয়ার কথা ভুলে গেল, গহনার কথা ভুলে গেল। তারপর একসময় পাগলের মতো ছুটে এল রেখার রুমে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, শুনেছ, শুনেছ কী কাণ্ড হয়েছে?
সব শুনে ধপ করে নিজের বিছানায় বসে পড়ল রেখা। বল কী! সর্বনাশ হয়ে গেছে তো!
আমি কল্পনাই করতে পারিনি। ছবি না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। এই যে ছবি, তুমিও দেখ।
ছবি দেখতে দেখতে চোখ প্রায় ঠিকরে বেরুল রেখার। ও যে ভেতরে ভেতরে এমন, মুখ দেখে একদম বোঝা যায় না। কাল বিকেলে এই খামটা ওর হাতে আমি দেখেছি। বোধহয় তখন থেকেই এসব বলার প্রিপারেশান নিচ্ছিল। আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহারও করেছে।
রেখার কথা যেন শুনতেই পেল না শিলা। বলল, আমার যখন বিয়ে হয় তখন ওর দুআড়াই বছর বয়স। দুই ভাইয়ের সঙ্গেই বয়সের বিরাট ব্যবধান। যে বয়সে সন্তান হওয়ার কথা কল্পনা করে না লোকে সেই বয়সে কেমন করে যেন কনসিপ করেছিলেন। আমার শাশুড়ি। এই বাড়িতে এসে আমি যখন ওকে কোলে নিতাম কিংবা মামুন যখন কোলে নিত মনে হতো ও আমাদেরই সন্তান। কোথাও বেড়াতে গেলে ওকে আমরা সঙ্গে নিতাম না, কারণ কেউ বিশ্বাস করত না যে ও আমার ননদ। তারপর আমার চোখের সামনে বড় হল। প্রথমে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল ওকে। তিন বছর পড়ার পর শ্বশুর বললেন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে যখন সেভেন এইটে উঠবে তখনই বখে যাবে মেয়ে। স্কুল বদলাও। আমি এবং মামুন অনেক বোঝালাম। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে ছেলেমেয়েরা বখে যায় এসব কথা কে বলেছে! যারা বখার তারা যে কোনও পরিস্থিতিতেই বখতে পারে। তিনি কোনও কথাই শুনলেন না। স্কুল বদলে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করা হল ওকে। দুটো বছর নষ্ট হল। বয়স অনুযায়ী ওর তো এখন অনার্স কমপ্লিট হওয়ার কথা।
একটু থামল শিলা। তবে বখে সেতু কখনও যায়নি। আমার চোখের সামনে বড় হল। কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হল, খারাপ কিছু ওর মধ্যে কখনও আমি দেখিনি। সেই মেয়ে গোপনে গোপনে এমন কাজ করল! কথা নেই বার্তা নেই আচমকা পুরো ফ্যামিলির মাথায় বাড়ি মেরে বসল!
রেখা অধৈর্যের গলায় বলল, কিন্তু এখন কী হবে? তিনদিন পর এনগেজম্যান্ট, সব রেডি!
আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না, কিছু ভাবতে পারছি না আমি।
একথা শোনার পর সেতুর ভাইদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। টুপলুর বাবা এমনিতে খুব ভাল, কিন্তু ভীষণ বদরাগি, কী যেন কী করে বসে!
মামুন সাহেবও কম রাগি নয়। দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব রাগি। এসব শোনার পর তার মাথার ঠিক থাকবে না। সেতু তার জান, তারপরও কিছুতেই এসব সে মেনে নেবে না।
আমার কথা হচ্ছে এতবড় একটা ব্যাপার এতদিন ও কীভাবে চেপে রাখল?
উত্তেজনায় রেখার গলা আরও রুক্ষ্ম এবং কর্কশ হয়ে গেছ। শিলার লক্ষ্মীট্যারা চোখটা গেছে ভাল রকমের ট্যারা হয়ে। সেই চোখ ঘুরিয়ে সে বলল, তুমি না বলেছিলে প্রেম এবং ক্যান্সার চেপে রাখা যায় না, সেতু তো ঠিকই চেপে রেখেছিল!
কোথায় আর চেপে রাখল! বলে তো দিলই! কথা হচ্ছে, প্রেম এবং ক্যান্সার কোনও না কোনও সময় বেরিয়ে আসবেই। বহুদিন চেপে রাখার পর সেতুরটা যেমন বেরিয়ে এল। সব বলে দিল সে।
এই বলাটা আরও কিছুদিন আগে বললে আমাদের খুব উপকার হতো।
কিন্তু এখন কী হবে?
শিলা রেগে গেল। তীক্ষ্ম গলায় বলল, বার বার এক কথা বলো না। কী হবে তার আমি কী জানি?
শিলার একটা হাত ধরল রেখা। কাতর গলায় বলল, রাগ করো না ভাবী। আমার খুব ভয় করছে।
শিলা নরম হল। ভয় আমারও করছে। সংসারে বিরাট ঝামেলা লেগে যাবে। চল, ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি।
রেখা উঠল। চল।
ওরা দুজন তারপর সেতুর রুমে এসে ঢুকল।
চিন্তিত মুখে হাতপা গুটিয়ে নিজের বিছানায় বসে আছে সেতু। শিলা এবং রেখাকে দেখে চোখ তুলে তাকাল। তারপর ওরা কিছু বলার আগে নিজেই বেশ অপরাধী গলায় বলল, আমার আর কিছু বলার নেই। যদি কাবিননামা দেখতে চাও, দেখাব।
চাপা ক্রোধের গলায় শিলা বলল, কিন্তু এটা তুমি কেন করলে? তোমার যদি কারও সঙ্গে এফেয়ার থাকে প্রথমে আমাদের দুজনকে তুমি তা বলবে, আমরা তোমার। ভাইদেরকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করব। না পারলে তুমি তোমার ডিসিসান নেবে। এরকমই নিয়ম। তুমি কোনও নিয়মের ধার ধারলে না? আগেই বিয়ে করে ফেললে? তাও এমন সময় যখন অন্য জায়গায় তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এ তুমি কি করলে? এসব জানার পর তোমার ভাইরা কী দুঃখটা পাবে, তুমি ভেবেছ? যে ভাইয়েরা এত ভালবাসে তোমাকে, তুমি যাদের জান, তাদেরকে একরম দুঃখ দেয়ার আগে তুমি একটু ভাবলে না?
রেখা বলল, আমি মনে করি দুঃখের চে’ অপমানটা তাঁদের বেশি। যেখানে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সেই লোকগুলোকে তারা এখন কী বলবে? কীভাবে মুখ দেখাবে তাদেরকে! কীভাবে সব ম্যানেজ করবে! সবকিছু জানাজানি হলে লোকে আমাদেরকে বলবে কী?
দাঁতে দাঁত চেপে শিলা বলল, আমার নিজের মেয়ে হলে থাপড়ে তোমার দাঁতগুলো আমি ভেঙে ফেলতাম। তারপর,তারপর ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। তোমার মতো মেয়ের মুখ আমি জীবনে দেখতাম না।
রাগি ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার জন্য পা বড়িয়েছে শিলা, থাবা দিয়ে তার একটা হাত ধরল সেতু। চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে তার। কাঁদতে কাঁদতে বলল, অন্যায় আমি করে ফেলেছি, নিশ্চয় অনেক বড় অন্যায় আমি করে ফেলেছি। আমার ওপর যদি খুব রাগ হয় তোমার, আমাকে তুমি গালাগাল করো, যত ইচ্ছা গালাগাল করো, দরকার হলে মারো, তারপরও ভাইয়াকে তুমি ম্যানেজ করো।
ঝটকা মেরে সেতুর হাত ছাড়িয়ে দিল শিলা। আমি পারব না। ম্যানেজ করা তো দূরের কথা, তোমাকে নিয়ে তার সঙ্গে আমি কোনও কথাই বলব না। তুমি একটা বাজে মেয়ে।
প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল শিলা। তার পিছু পিছু গেল রেখা।
চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেতু তখন ভাবছে এখন সে কি করবে! কেমন করে ম্যানেজ করবে ভাবীদেরকে।
যে কোনও অসহায় মুহূর্তে সেতুর যা হয়, শেষ পর্যন্ত শুভকে ডাকতে লাগল সে। মনে মনে কথা বলতে লাগল শুভর সঙ্গে। শুভ, তুমি বলে দাও আমি এখন কী করব।
আশ্চর্য ব্যাপার, শুভই যেন পথটা তাকে বাতলে দিল। কিছুক্ষণ পর নিজের অজান্তেই যেন রেখার রুমে এসে ঢুকল সে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে রেখা। সেতুকে দেখে মোটেই অবাক হল না, বিরক্ত হল। কপালে কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
অপমানটা গায়ে মাখল না সেতু। বলল, তোমরা দুজনেই যদি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি কার কাছে যাব? তোমরা ছাড়া আমার আর আছে কে?
নরম করে বলতে চাওয়ার পরও গলাটা রেখার নরম হল না। কর্কশ গলায় বলল, আমাদের জায়গায় তুমি হলে কী করতে?
তোমাদের কোনও প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। তবে সবদিক ভেবেই কাজটা আমি করেছি। এছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না। আমি চাই তোমরা দুজন আমার পাশে দাঁড়াও, আমাকে হেলপ কর।
একথায় রেখা কেমন ব্ৰিত হল। আমি কীভাবে তোমাকে হেলপ করব? না না আমার কিছু করার নেই।
আছে। তুমি ছোটভাইকে বোঝাও।
সে আমার কথা শুনবে না। প্রচন্ড রেগে যাবে, তার রাগ সামলাবার ক্ষমতা আমার নেই। তারচে’ তুমি বরং ভাবির কাছে যাও। ভাইয়া যদি সব মেনে নেন তাহলে কারও কিছু বলার থাকবে না।
কিন্তু শিলা বলল, আমার রুমে আসা তোমার ঠিক হয়নি, যা বলার আমি তোমাকে বলে দিয়েছি।
শিলার সঙ্গে সেতুর সম্পর্কটা মা মেয়ের মতো। রেখার কথা তেমন গায়ে লাগে না তার, কিন্তু শিলা রাগ করে কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে কান্না পায়।
এখনও পেল। কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, তুমি যে আমার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করবে এ আমি কখনও ভাবীনি।
শিলা শুয়েছিল, উঠে বসল। তুমি নিজে যা করেছ তারচে খারাপ আর কিছু হতে পারে! আমার খারাপ ব্যবহারটা দেখছ, নিজেরটা দেখছ না?
ভাঙাচোরা, কাতর গলায় সেতু বলল, আগের কথাটাই তোমাকে আবার বলি, ভাইয়াকে তুমি ম্যানেজ কর। তোমার কথা ভাইয়া ফেলবে না। আমাকে তুমি বাঁচাও ভাবী, প্লিজ, আমাকে তুমি বাঁচাও।
শিলা কঠিন গলায় বলল, এককথা আমি দুবার বলি না। এতবড় কাজটাই যখন করে ফেলতে পেরেছ, তখন ভাইদের সামনেও দাঁড়াতে পারবে। তুমি নিজেই তাদের সামনে দাঁড়াও, তাদেরকে ম্যানেজ কর। আমি পারব না।
বিছানা থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল শিলা। তারপরও সেতু খানিক দাঁড়িয়ে রইল। চোখের জলে দুগাল ভাসছিল তার।
৫. নিজের রুম থেকে বেরিয়ে
নিজের রুম থেকে বেরিয়ে শিলা চলে এল ড্রয়িংরুমে।
দূর থেকে রেখা তাকে দেখতে পেয়েছিল। সেও এল। এসে কোনও ভনিতা ছাড়া বলল, সেতুর ওপর যত রাগই আমাদের হোক, সে যে ভুল করেছে সেই ভুল কিন্তু আমাদের করা ঠিক হবে না।
শিলা ভ্রু কোঁচকাল। তোমার কথা আমি বুঝতে পারিনি।
বলছিলাম কী, আমরা যেহেতু ব্যাপারটা জেনেছি, আমাদের উচিত আজই সেতুর ভাইদেরকে জানিয়ে দেয়া।
ঠিকই বলেছ, তা না হলে তারা আমাদেরকে দোষারোপ করবে। বলবে জেনেও আমরা কেন তাদেরকে জানাইনি।
অন্য ঝামেলাও আছে। এক্ষুনি এনগেজম্যান্ট না ভাঙলে কেলেংকারি হয়ে যাবে।
রানি খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে ড্রয়িংরুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, দোতলার ড্রয়িংরুমটি একটু খোলামেলা ধরনের, দুইজাকে নিভৃতে কথা বলতে দেখে ফেলল সে। সকাল থেকেই বাড়ির দুইবউ এবং সেতুর আচরণে কী রকম যেন অস্বাভাবিকতার গন্ধ পেয়েছে সে। কী যেন একটা হয়েছে বাড়িতে। ব্যাপারটা কী জানার জন্য ড্রয়িংরুমের বাইরে এমন একটা জায়গায় দাঁড়াল রানি, যেখান থেকে রুমের ভেতরকার কেউ তাকে দেখতে পাবে না কিন্তু সে শুনতে পাবে তাদের সব কথা।
রানির একা একা কথা বলার স্বভাব আছে। শিলা এবং রেখার কথা শুনতে দাঁড়িয়ে সে ফিসফিস করে বলল, বাড়িতে হইছে কী? এত গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর কীসের?
রানিকে এই অবস্থায় দেখে ফেলল টুপলু। সে যাচ্ছিল মুন্নির রুমের দিকে। রানিকে দেখে কিছু একটা সন্দেহ হল, পা টিপে টিপে নিঃশব্দে এসে রানির পেছনে দাঁড়াল সে। আচমকা বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?
টুপলুর যেহেতু জোরে কথা বলার অভ্যেস, রানি একেবারে আঁতকে উঠল। ও মাগো, ডরাইয়া গেছি।
তারপর থুথু করে নিজের বুকে থুতু দিল।
টুপলু আবার বলল, কথা বলছ না কেন? এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?
সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যে বলতে শুরু করল রানি। না, দাঁড়াই নাই তো! আমি তো যাইতাছিলাম।
মিথ্যে কথা বলো না। আমি আম্মুকে বলে দেব।
কী, কী বলবা?
তা তোমাকে বলব না।
মুন্নির রুমের দিকে চলে গেল টুপলু। রানি ভাবল নিশ্চয় তাদের কথা শিলা এবং রেখা শুনতে পেয়েছে, এখুনি ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে ধরবে তাকে, ভয়ে সেই প্রায় দৌড়ে কিচেনের দিকে চলে গেল।
.
আম্মু, তুমি আর চাচি যখন কথা বলছিলে…
সন্ধের পর রেখাকে মাত্র কথাটা বলতে শুরু করেছে টুপলু, স্বপন এসে ঢুকল। স্বপনকে দেখে সব ভুলে লাফিয়ে উঠল টুপলু। এই তো বাবা এসে পড়েছে।
তারপর ছুটে এসে স্বপনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিল। কোলে নাও।
রেখা কর্কশ গলায় বলল, এখন কোলে উঠতে হবে না, যাও।
কিন্তু মেয়েকে কোলে নিল স্বপন। উঠুক না, তোমার অসুবিধা কী!
রেখা কথা বলল না। চিন্তিত চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েকে আদর করতে লাগল স্বপন, রেখার চিন্তিত হওয়া চোখেই পড়ল না তার।
কিন্তু নিজের রুমে ঢুকেই শিলার থমথমে মুখ দেখতে পেল মামুন। মুন্নির মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে শিলা, মামুন যে অফিস থেকে ফিরল, মা মেয়ের একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল শিলা যেন তা দেখতেই পেল না।
ব্যাপার কী? নিজের অজান্তে কি আবার কোনও ভুল করে ফেলেছে মামুন!
অনেক ভেবেও ভুলটা বের করতে পারল না মামুন। ড্রেসিংরুমে না ঢুকে বলল, ব্যাপার কী, সারাদিন পর বাড়ি ফিরলাম আর তুমি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছ না!
শিলা কথা বলল না।
মুন্নি বলল, আম্মু বোধহয় রেগে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে ধমক দিল শিলা। চুপ কর, তোকে বলেছি, রেগে আছি!
মেয়েকে ধমকাচ্ছ কেন? মুন্নি, যা তো মা, রানিকে বল চা দিতে।
আচ্ছা।
বারান্দায় রাখা টেলিফোনটা বাজল এ সময়। পাশাপাশি দুটো সেট। একটা কডলেস। বাবলু আসছিল মা বাবার বেডরুমের দিকে, শব্দ পেয়ে কডলেস ফোনটা ধরল। হ্যালো।
ওপাশ থেকে অত্যন্ত বিনয়ি গলায় কে একজন বলল, সেতুকে দেয়া যাবে?
সিওর। একটু ধরুন।
ফোন নিয়ে সেতুর রুমে এল বাবলু। ফুপি, তোমার ফোন।
টেলিফোন সেট হাতে নিল সেতু। কে করেছে?
এক ভদ্রলোক, আমি নাম জিজ্ঞেস করিনি।
বাবলু চলে গেল।
সেতু বলল, হ্যালো।
ওপাশ থেকে অত্যন্ত রোমান্টিক গলায় ভেসে এল, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।
সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা কেটে গেল সেতুর। গভীর আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। বুকের অনেক ভেতর থেকে সে বলল, আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি।
তারপর একটু থেমে বলল, কিন্তু খুব টেনশানে আছি। ভাবীরা জেনেছে, আজ রাতের মধ্যেই ভাইয়ারা জেনে যাবে।
শুনে শুভ যেন ভয় পেল। তোমার কথা শুনে আমারও বুক কাঁপতে শুরু করেছে। ইস্ কী যে হবে!
সেতুর মন একটু খারাপ হল। কিছু একটা বলতে যাবে সে তার আগেই শুভ বলল, আমি তোমার সঙ্গে ফান করলাম। শোন, একদম নার্ভাস হবে না তুমি, একটুও ভয় পাবে না। আমি আছি।
ভয় আমি পাচ্ছি না। যদি কেউ কোনও বাড়াবাড়ি করে, সোজা তোমার কাছে চলে আসব।
ঠিক এ সময় সেতুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াল মামুন। অফিসের পোশাক ছেড়ে বাড়ির পোশাক পরেছে সে। সেতুর টেলিফোনে কথা বলাটা খেয়াল করল না। বলল, সেতু, কী করছিস?
তারপর রুমে ঢুকল। সেতু থতমত খেয়ে ফোন অফ করল। দেখে মামুন বলল, রাখার দরকার নেই, কথা শেষ কর, আমি নাহয় পরে আসব।
বুকটা কাঁপছে সেতুর, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কোনও রকমে সে বলল, না, ঠিক আছে।
তখন আবার ফোন বাজল। হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরল মামুন। সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেল লাইন। মামুন বিরক্ত হল। আমি ধরলাম আর ফোনটা ছেড়ে দিল। কে ফোন করেছিল?
সেতুর গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল, সে একটা ঢোক গিলল। তুমি যখন ধরলে তখন কে করল জানি না, আগে করল দোলন।
আমি যখন ধরলাম তখন দোলন করেনি, দোলন হলে আমার সঙ্গে কথা বলতো!
তারপরই প্রসঙ্গটা ভুলে গেল সে। উচ্ছল গলায় বলল, শোন, তোর কিছু চাওয়ার থাকলে আমার কাছে চেয়ে ফেল। খুব মুডে আছি, যা চাইবি, পেয়ে যাবি।
সেতু একটু উদাস হল। এজন্যই আমার রুমে এসেছ?
হ্যাঁ। আসলে মনটা খারাপ। তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তুই যে বাড়িতে থাকবি না সেই বাড়িতে আমি কেমন করে থাকব!
কথা বলার ফাঁকে জলে চোখ ভরে এল মামুনের। সেতুর মুখের দিকে সে আর তাকাতে পারল না।
সেতু ভাবল এই সুযোগটা নেবে কি না। কোনও না কোনওভাবে শুভর সঙ্গে তার বিয়ের কথাটা বলে দেবে কি না?
কিন্তু বড়ভাইকে নিজের বিয়ের কথা কেমন করে বলা যায়?
ভেতরে ভেতরে লজ্জা পেল সেতু। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
মামুন বলল, ঠিক আছে, আমি তোর সঙ্গে পরে কথা বলব। এখন মন খুব খারাপ হয়ে গেছে।
চোখ মুছতে মুছতে সেতুর রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।
.
স্বপন বলল, সেতুর বিয়ের ব্যাপারে ভাইয়ার সঙ্গে আমার মতের খুব মিল হচ্ছে।
কথাটা যেন শুনতে পেল না রেখা। আনমনা হয়ে আছে সে। চিন্তিত হয়ে আছে।
ব্যাপারটা খেয়াল করল স্বপন। বিরক্ত হল। তুমি আমার কথা শুনছ না?
স্বপনের চোখের দিকে তাকিয়ে রেখা বলল, শুনতে চাচ্ছি না।
কেন?
বিয়ের ব্যাপারটা…
কথা শেষ না করে মাথা নিচু করল রেখা।
স্বপন গম্ভীর গলায় বলল, কথা শেষ কর।
এবার রেখাও একটু বিরক্ত হল। তোমার সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল। শুরুর আগেই রেগে যাও।
কথার ধরনে মনে হচ্ছে তুমি খুব খারাপ কিছু বলবে।
স্বপনের একটা হাত ধরল রেখা। আগেই রেগে যেও না, কথাটা আগে শোন।
স্বপন ভুরু কোঁচকাল। তুমিই বা এত ভনিতা করছ কেন? কী হয়েছে পরিস্কার বললেই পার।
সেতুর বিয়ের চিন্তাভাবনা আপাতত বাদ দিতে হবে!
কী?
পাত্রপক্ষকে মানা করে দাও।
অপলক চোখে রেখার মুখের দিকে তাকাল স্বপন। শীতল গলায় বলল, তুমি বুঝতে পারছ তুমি কী বলছ? পরশু এনগেজম্যান্ট। সব রেডি। এই সময়ে কোনও রকমের ঠাট্টা মশকরা করার চেষ্টা করো না।
তা আমি করছিও না। এনগেজম্যান্ট হবে না। যেমন করেই হোক ওটা বন্ধ করতে হবে কারণ শুভ নামের একটি ছেলের সঙ্গে সেতুর বিয়ে হয়ে গেছে।
সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছে নিজে একেবারেই অচেনা হয়ে গেল স্বপন। কখন উঠে দাঁড়াল বুঝতে পারল না, কখন ঠাস করে রেখার গালে চড় মারল বুঝতে পারল না।
.
জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেতু।
টের পায়নি কখন কাঁদতে শুরু করেছে, কখন চোখের জলে গাল ভাসতে শুরু করেছে। বাড়িতে কী হচ্ছে কিছুই এখনও বুঝতে পারছে না সে। বড়ভাই যে এখনও শোনেনি বুঝতে পেরেছে, ছোটভাই শুনেছে কী না বুঝতে পারছে না। কাউকে জিজ্ঞেস করারও উপায় নেই।
এ সময় টুপলু এসে ঢুকল সেতুর রুমে। ফুপি, ফুপি, আম্মু বলেছে তোমার বিয়েতে আমাকে খুব সুন্দর একটা ড্রেস কিনে দেবে। দুধের মতো সাদা। পরলে আমাকে একদম। পরির মতো দেখাবে।
সেতু কথা বলল না, চোখও মুছল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
ফুপিকে কথা বলতে না দেখে টুপলু তার হাত ধরল। কী হল ফুপি, তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন?
এবার ওড়না দিয়ে চোখ মুছল সেতু। টুপলুর দিকে তাকাল।
টুপলু অবাক। তুমি কাঁদছ? কেন, কাঁদছ কেন? তোমাকে কেউ বকেছে ফুপি?
টুপলুকে কোলের কাছে টেনে সেতু বলল, না মা, কেউ বকেনি।
তাহলে কাঁদছ কেন?
এমনি।
তারপর নিজেকে সামলাল সেতু। চটপটে গলায় বলল, আম্মু তোমাকে সাদা ড্রেসের কথা কবে বলেছে?
দুতিনদিন আগে।
সেতু মনে মনে বলল, তাই তো! সব জানার পর তো বলার কথা নয়।
মুখে বলল, শোন, যদি আম্মু তোমাকে সাদা ড্রেস কিনে না দেয় তাহলে আমি তোমাকে কিনে দেব। পরলে সবাই তোমাকে বলবে ছোট্টপরি টুপলু। এখন যাও, মা।
আচ্ছা।
টুপলু প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।
.
মামুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভেবেছিলাম সেতু কিছু চাইবে। ডায়মন্ডের গহনা বা এই ধরনের কিছু। খুব মুড নিয়ে কথা শুরু করলাম, কিন্তু সব কথা বলতে পারলাম না, মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওকে যে আমি কী ভালবাসি, কী রকম টান যে ওর জন্য আমার, আমি কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। একটা কথা আজ বলি। তুমি মন খারাপ করো না, রেগে যেও না। নিজের মেয়ের চেয়েও সেতুকে আমি অনেক বেশি ভালবাসি।
পিঠের কাছে দুটো বালিশ দিয়ে বিছানায় বসে আছে শিলা। মুখটা থমথম করছে। মামুনের কথা শুনে গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক হয়নি।
কথাটা বুঝতে পারল না মামুন। কী ঠিক হয়নি?
এত ভালবাসা।
তাই বল।
অতিরিক্ত আল্লাদ ভাল না। কিছু মানুষ থাকে বানরের মতো। বানরকে লাই দিলে মাথায় ওঠে।
আমার বোনকে তুমি বানর বলছ?
পারলে বানরের চেয়েও খারাপ কিছু বলতাম।
মামুন টের পেল কোথায় যেন একটা প্যাঁচ লাগতে যাচ্ছে। সেদিনের পর থেকে শিলার ব্যাপারে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে আছে সে। শিলার সঙ্গে খোঁচাখোচি লাগতে পারে এমন প্রসঙ্গ যত্নে এড়িয়ে চলছে। শিলা বাঁকা করে কথা বলতে চাইলেই নিজে হয়ে যাচ্ছে অতিরিক্ত সরল।
এখনও হল। হাসিমুখে, আদুরে গলায় বলল, এই, কী হয়েছে তোমার?
কিছুই হয়নি।
তাহলে এমন করছ কেন?
কী করছি?
আমি অবশ্য বুঝেছি।
কী বুঝেছ, বল!
বোনের ব্যাপারে মন খারাপ করে আছি দেখে ঠাট্টা করে আমার মন ভাল করার। চেষ্টা করছ।
শিলা চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাল।
মামুন বলল, দরকার নেই। তুমি সামনে থাকলে আমার মন এমনিতেই ভাল থাকে।
শিলা গম্ভীর গলায় বলল, তোমার মন নিয়ে আমি ভাবছি না, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা মশকরাও করছি না। স্বপনকে বল আজ রাতেই পাত্রপক্ষকে ফোন করতে।
কেন?
এনগেজম্যান্ট হবে না।
কথাটা একদম পাত্তা দিল না মামুন। ধুৎ, ঠাট্টা করো না।
আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় শিলা বলল, একবার বলেছি, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি না। তোমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
কী?
এই যে বিয়ের ছবি।
বলেই পিঠের দিককার বালিশের তলা থেকে সেতুর দেয়া ছবির খামটা বের করল শিলা। মামুনের হাতে দিল।
মামুন ততোক্ষণে পাথর হয়ে গেছে।
.
গেট খুলেই খিলখিল করে হাসতে লাগল দোলন।
শুভ অবাক হল। কী হল, হাসছ কেন?
এ কথায় দোলনের হাসি আরও বাড়ল। হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল সে।
শুভ কিছুই বুঝতে পারল না। বলল, আরে! কী হয়েছে?
দোলন হাসতে হাসতে বলল, এ সময় ভিক্ষুকরা এসে কলিংবেল বাজায়।
বুঝলাম, তাতে হাসার কী আছে?
আমি আপনাকে তাই ভেবেছি।
মানে ভিক্ষুক?
হ্যাঁ।
এবার শুভও হাসল। খারাপ ভাবনি। আমার অবস্থা ভিক্ষুকের মতোই।
দোলন হাসি থামাল। যাহ্, বাজে কথা বলবেন না। ভেতরে আসুন।
না, এখানেই বলি।
অবশ্য মা বাবা এসে পড়েছেন। তবু ভেতরে আপনি আসতে পারেন। অসুবিধা হবে না।
দরকার নেই ঝামেলার। শোন, কথাটা সেতু ওদের বাড়িতে বলে দিয়েছে। কী ধরনের রিয়্যাকশান হয়েছে, জানি না। অনেকবার ফোন করেছি, সেতু ফোন ধরছে না। আর আগে কখনও যা হয়নি আজ তাই হচ্ছে, সেতুকে চাইলেই নামধাম সব জিজ্ঞেস করছে বাড়ি থেকে। মিথ্যে বলতে বাঁধো বাধো লাগছে বলে ফোন ছেড়ে দিচ্ছি আমি।
ভাল করেছেন। তাছাড়া প্যারালাল লাইনে আপনাদের কথা শুনেও ফেলতে পারে কেউ।
হ্যাঁ। এসব কারণে আমার খুব নার্ভাস লাগছে।
বুঝেছি। আমি কী করতে পারি বলুন?
তুমি একটু ওদের বাড়িতে যাও। অবস্থাটা বুঝে এস। আমি বিকেলে এসে খবর নেব।
ঠিক আছে।
তারপর মাথা নিচু করে শুভ বলল, যখন তখন এসে তোমাকে খবু বিরক্ত করি, আমাদের জন্য অনেক করছ তুমি, তোমার কাছে খুব ঋণী হয়ে গেলাম।
সব ঠিক হয়ে গেলে ঋণ শোধ করে দেবেন।
শুভ হেসে বলল, বিল করে রেখ।
কিন্তু সেতুদের বাড়ি ঢুকেই স্বপনের মুখোমুখি পড়ে গেল দোলন।
মামুন এবং স্বপন কেউ আজ অফিসে যায়নি। কপালে হাত দিয়ে নিজের রুমে শুয়ে আছে মামুন আর বাড়ির সামনের দিককার বারান্দায় বেতের চেয়ারে রাগি মুখ করে বসে আছে স্বপন। হাতে হাসানের পত্রিকা। হাসিঠাট্টা বিষয়ক পাতাটা বেরিয়েছে আজ। সকাল থেকে বহু চেষ্টা করে একটি লাইনও পড়তে পারেনি স্বপন।
এ সময় দোলন এসে ঢুকল।
দোলনের স্বভাব হচ্ছে অতি দ্রুত হাঁটার। স্বপনকে দেখেও দ্রুত হেঁটে দোতলার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল সে। স্বপন তাকে ডাকল। দোলন, শোন।
দোলন এসে তার সামনে দাঁড়াল। জ্বী?
তুমি কেন এসেছ আমি জানি।
কী করে জানলেন?
তা তোমাকে বলব না। এও জেনেছি যে ব্যাপারটার সঙ্গে তুমি জড়িত।
দোলন বুঝে গেল কেলেংকারি যা হওয়ারা এই বাড়িতে হয়ে গেছে। ব্যাপারটির সঙ্গে তাকেও জড়ানো হয়েছে। হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। সে যা করেছে জেনে বুঝেই করেছে। সেতু তার বন্ধু, বন্ধুর জন্য বন্ধু করবে না!
কিন্তু স্বপনের কথা বলার ধরনটা বিশ্রি। এই ভঙ্গিতে কথা বলা একদমই সহ্য করতে পারে না দোলন। গা একেবারে জ্বলে গেল তার। তবু নিজেকে সংযত রাখল সে। যেন কিছুই জানে না এমন গলায় বলল, কোন ব্যাপারটার সঙ্গে আমি জড়িত?
দাঁতে দাঁত চেপে স্বপন বলল, আমাকে দিয়ে বেশি কথা বলিও না।
এবার দোলনও গম্ভীর হল। আপনি আমার সঙ্গে অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করছেন?
আরও বাজে ব্যবহার তোমার সঙ্গে আমার করা উচিত।
কেন?
বলতে চাই না, আমার মেজাজ আরও খারাপ হবে। সেতুর সঙ্গে আমার দেখা হবে না। তুমি এসো।
স্বপনের চোখের দিকে তাকিয়ে দোলন বলল, নিজেদের বাড়িতে এতটা অপমান আমাকে না করলেও পারতেন। অপমানটা একদিন আপনার কাছে ফিরে আসতে পারে।
যে গতিতে হেঁটে সেতুদের বাড়ি ঢুকেছিল দোলন তারচেও দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
স্বপনের এই আচরণের কথা সেতুকে জানাল মুন্নি। কী কাজে নিচে এসেছিল সে, স্বপন এবং দোলনের শেষদিককার কথাগুলো শুনতে পেয়েছিল। দোলন বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল সেতুর রুমে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তুমি কিছু শুনেছ, ফুপি?
সেতু শুয়ে ছিল। উঠে বসল। না তো! কী হয়েছে?
দোলন ফুপি এসেছিল তুমি জানো?
না। কোথায় সে?
চলে গেছে।
আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেল?
এজন্যেই তো বললাম, তুমি কিছু শুনেছ কি না? দোলন ফুপিকে চাচা খুব বকেছে।
কী?
হ্যাঁ, দুজনে খুব তর্কাতর্কি হয়েছে। দোলন ফুপি তারপর তোমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেছে।
রাগে ক্রোধে মুখ লাল হয়ে গেল সেতুর। আমি বুঝেছি কেন দোলনের সঙ্গে সে অমন ব্যবহার করেছে?
তারপর বিছানা থেকে নামল সেতু। এটা সে ঠিক করেনি। অন্যায় করে থাকলে আমি করেছি, বকতে হলে আমাকে বকবে, দোলনকে কেন?
সেতু তারপর স্বপনের রুমে এসে ঢুকল।
স্বপন এবং রেখা দুজনেই আছে রুমে। রেখার দিকে তাকাল না সেতু, স্বপনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, দোলনকে তুমি অপমান করেছ কেন? আমার বন্ধুকে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে দাওনি কেন?
সেতুর দিকে তাকাল না স্বপন, যেমন বসেছিল তেমনি বসে থেকে কঠিন গলায় বলল, আমি তোর সঙ্গে কোনও কথা বলব না, তুই আমার সামনে থেকে যা।
সেতু দৃঢ় গলায় বলল, না আমি যাব না। পরিস্কার ভাষায় তোমাকে বলতে হবে দোলনের সঙ্গে বাজে বিহেভ তুমি কেন করেছ?
যা করেছি তা তেমন কোনও বাজে বিহেভ নয়, আমার উচিত ছিল ওর দুগালে দুটো চড় মারা। ওর ভাগ্য ভাল যে ও মেয়ে। ছেলে হলে শুধু চড় মারাই নয়, ওর দাঁতগুলো আমি ভেঙে ফেলতাম।
আমার অবাক লাগছে, তুমি আমার ভাই! কোনও শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের মানুষ ছোটবোনের বন্ধুর সঙ্গে অশোভন ব্যবহার করে, দেখা তো দূরের কথা, কেউ কখনও বোধহয় শোনেওনি।
সেতুর কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে স্বপনের। রেখার দিকে তাকিয়ে সে বলল, রেখা, ওকে এখান থেকে যেতে বল। নিজেকে আমি আর কন্ট্রোল করতে পারছি না, এক্ষুনি আমি ওকে মারব।
একথা শুনে মাথা যেন খারাপ হয়ে গেল সেতুর। কয়েক পা এগিয়ে স্বপনের একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। মারো, মারো আমাকে! দেখি কত মারতে পার!
একেবারে সিনেমার কায়দায় উঠে দাঁড়াল স্বপন। সেতুকে মারার জন্য হাত তুলল। চট করে সেই হাত ধরে ফেলল রেখা। তীক্ষ্ণস্বরে বলল, খবরদার বোনের গায়ে হাত তুলবে না। চুপ, একদম চুপ করে বস। সেতু ঠিকই বলেছে, দোলনকে কেন তুমি অপমান করবে? সে কোনও অন্যায় করেনি। তোমার বন্ধুর ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিস্থিতি হলে তুমিও নিশ্চয় বন্ধুকে সাহায্য করতে।
তারপর সেতুকে ঠেলে বের করে দিতে চাইল রেখা। তুমি যাও, তুমি এখান থেকে যাও।
সেতু নড়ল না, রেখার দিকে ফিরেও তাকাল না। আগের মতোই স্বপনের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, আমি যা করেছি আমার নিজের ইচ্ছেয়, নিজের ভাললাগার কারণে করেছি। কেউ সাহায্য না করলেও এ আমি করতামই। এই পৃথিবীতে আমার সবচে প্রিয় যে মানুষ তার সঙ্গে সারাজীবন কাটাব বলেই তাকে আমি বিয়ে করেছি। তোমাদের যার যা ইচ্ছে করতে পার, চাইলে আমাকে মেরেও ফেলতে পার, কিন্তু আমি যা করেছি, যার হাত সারাজীবনের জন্য ধরেছি, সেই হাত আমি কখনও ছাড়ব না।
এসব বলতে বলতে ভালবাসার গভীর অহংকারে সুন্দর হয়ে গেল সেতুর মুখ। আস্তে ধীরে হেঁটে নিজের রুমের দিকে চলে গেল সে।
.
আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। খুব।
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সেতুর ছবির দিকে তাকিয়ে কথাটা যখন বলেছে শুভ, নাহিদ এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। শুভ তাকে দেখতে পেলো না। খানিক দাঁড়িয়ে শুভকে দেখল নাহিদ তারপর মৃদু শব্দে গলা খাকারি দিলো। চমকে দরজার দিকে। তাকাল শুভ। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে সেতুর ছবি বালিশের তলায় লুকোতে গিয়েই হেসে ফেলল। ও তুই? আমি ভেবেছিলাম কে না কে?
তারপরও ছবিটা বালিশের তলায় রাখল সে। তোরা যাসনি?
নাহিদ এসে শুভর সামনে দাঁড়াল। না, যে ডাক্তারকে দেখালাম তিনি আরেকজন ডাক্তারের কাছে রেফার করলেন। অনেক কষ্টে সেই ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েনম্যান্ট করেছি। কাল সন্ধ্যায় দেখবেন।
চিন্তিত চোখে নাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শুভ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজেকে আমার খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে। আমার জীবনের সবচে’ বড় ডিসিশানটার সময় তুই আমাকে সাহায্য করেছিস। আর তোর এরকম বিপদের সময় আমি তোর পাশে দাঁড়াতে পারছি না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।
বিছানা থেকে নেমে আলনার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শুভ। শার্ট নিয়ে পরতে লাগল।
নাহিদ বলল, শার্ট পরছিস কেন?
শুভ গম্ভীর গলায় বলল, এই মুহূর্ত থেকে আমি তোর সঙ্গে আছি। যদিও সেতুদের বাড়িতে খুব ঝামেলা যাচ্ছে, আমি খুব টেনশানে আছি, তারপরও আমি তোর সঙ্গে থাকতে চাই।
দরকার নেই। আমি সব সামলাতে পারছি।
তোর কোনও কথাই আমি আর শুনব না। চল আমার সঙ্গে, দেখি কোন ডাক্তার দেখাতে হয় বর্ষাকে।
নাহিদের হাত ধরে নিজের রুম থেকে বেরুল শুভ।
.
এই হোটেলটি পুরনো আমলের।
সামনে বিশাল বাগান, প্রচুর ফুল পাতাবাহারের ঝোঁপ। বিকেলবেলা বাগানে এসে ঢুকেছে বর্ষা। এখন একটা ঝোঁপের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলের ডগায় আলতো করে ফুল এবং পাতা নাড়ছে। নাড়ছে ঠিকই কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না কী নাড়ছে সে। কারণ তার চোখ এখানে, মন অন্যকোথাও।
আস্তেধীরে হেঁটে নাহিদ এবং শুভ এসে তার পেছনে দাঁড়াল। পায়ের শব্দ পেয়েও পেছনে ফিরে তাকাল না বর্ষা। আগের মতোই আনমনা ভঙ্গিতে ফুল এবং পাতা নাড়তে লাগল।
নাহিদ বলল, বর্ষা, দেখ কে এসেছে?
আলতো করে মুখ ফেরালো বর্ষা। নির্বিকার গলায় বলল, কোথায় কে এসেছে?
শুভকে দেখাল নাহিদ, এই যে।
উদাস চোখে শুভর মুখের দিকে তাকাল বর্ষা, তারপর তাকাল নাহিদের দিকে। কে?
চিনতে পারছিস না?
শুভ হাসিমুখে বলল, কী করে চিনবে! বর্ষা তো আমাকে কখনও দেখেনি!
কিন্তু আমার মুখে তোর কথা অনেক শুনেছে।
তারপর বর্ষার দিকে তাকাল নাহিদ। ভেবে দেখ তো কার কথা আমার মুখে সবচে’ বেশি শুনেছিস তুই?
বর্ষা আগের মতোই উদাস গলায় বলল, আমার কিছু মনে পড়ে না।
বর্ষার গলায় গভীর অসহায়ত্ব। শুভর মনটা অন্যরকম হলো। নাহিদকে বলল, অযথা ওর মনের ওপর প্রেসার দেয়ার দরকার নেই। তারচে’ আমিই আমার পরিচয় দিয়ে ফেলি।
হাসি হাসি মুখ করে বর্ষার দিকে তাকাল শুভ। বর্ষা, আমি শুভ।
বর্ষা তবু চিনতে পারল না।
শুভ বলল, নাম বলার পরও বোধহয় আমাকে তুমি চিনতে পারনি। আমি নাহিদের বন্ধু।
এবার সামান্য চঞ্চল হলো বর্ষা, ও। জানেন বাদল, বাদল মারা গেছে।
তারপর আর কোনওদিকে তাকাল না, একটিও কথা বলল না, আস্তেধীরে হেঁটে হোটেল বিল্ডিংয়ের দিকে চলে গেল।
বর্ষা চলে যাওয়ার পর শুভ আর নাহিদ এলো রিসিপসানে।
রিসিপসানের অদূরে গেস্টদের বসার জন্য সুন্দর কয়েকটি সোফা রাখা আছে। দুটো সোফায় মুখোমুখি বসল ওরা। বর্ষার সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই বেশ চিন্তিত শুভ। এখন নাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বর্ষাকে দেখে, বর্ষার কথা শুনে মনে হলো সে কিছুটা এবনরমাল হয়ে গেছে।
নাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুটা না, অনেকটা।
যমজ ভাই বোনদের ব্যাপারটা আমি জানি। আমার সঙ্গে স্কুলে দুটো যমজ ভাই পড়ত। একজন টিচার ছিলেন, ইসলাম স্যার, কথায় কথায় বেত দিয়ে মারতেন আমাদেরকে। যমজ ভাই দুটোর নাম ছিলো কিসলু আর খসরু। তাদের একজনকে মারলে অন্যজনও কেঁদে ফেলতো।
বাদল-বর্ষার ক্ষেত্রে এটা কোনও ব্যাপারই ছিল না। ওদের একজনের জ্বর হলে প্রায় সাথে সাথে আরেকজনের হতো। বড় হওয়ার পর এসব একটু একটু করে কমতে শুরু করেছিল।
এই অবস্থায় একজন আরেকজনকে ছেড়ে গেলে সেই শোক সামলানো প্রায় অসম্ভব। বর্ষাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি মন খারাপ করতে পারছি না। আমাকে ভাবতে হচ্ছে তিনজন মানুষের কথা। মা বাবা বর্ষা। বাদল মারা গেল, আমার ভাই, অসুখের সময় দিনরাত আগলে রাখার চেষ্টা করেছি তাকে…
কথা শেষ করতে পারল না নাহিদ। কেঁদে ফেলল। চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বলল, ওর কথা ভাববার এখন সময়ও নেই আমার।
শুভ উঠে এসে নাহিদের পাশে বসল। তার কাঁধে হাত দিল। তুই এমন করিস না নাহিদ। আমার খুব অসহায় লাগছে। কী করব কিছু বুঝতে পারছি না। আমি বরং যাই।
চোখ মুছে নাহিদ বলল, মা বাবার সঙ্গে দেখা করে যা।
দেখা করে কী হবে? তাঁদের মুখ দেখে, কষ্টের কথা শুনে মন আরও খারাপ হবে। ওদিকে সেতুদের বাড়িতে কী হচ্ছে কিছুই জানি না। আমার ভাল লাগছে না।
জীবন এরকমই। সব দুঃখ কষ্টকেই সামাল দিতে হবে। আয় আমার সঙ্গে।
ওরা দুজন উঠল।
.
সোফায় বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন হাদি সাহেব।
চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে তাঁর। মিনু দাঁড়িয়ে আছেন স্বামীর সামনে। স্বামীকে এভাবে কাঁদতে দেখে খুবই অসহায়বোধ করলেন তিনি। তবু তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। তুমিও যদি এমন ভেঙে পড়, আমার ওইটুকু ছেলে কী করে এতগুলো লোককে সামলাবে?
দুহাতে চোখ মুছলেন হাদি। ভাঙাচোরা গলায় বললেন, তিনটি ছেলে মেয়ের একটি নেই, এ আমি ভাবতেই পারি না। আমার বুক ফেটে যায়।
এবার স্বামীর কাঁধে হাত দিলেন মিনু। তুমি এমন করলে আরেকটিকেও হারাতে হবে। একটু শক্ত হও। যে গেছে তার কথা না ভেবে যারা আছে তাদের কথা ভাব।
কথা বলতে বলতে নিজেও কেঁদে ফেললেন তিনি। আমাকে দেখছ না তুমি! আমি কী রকম পাষাণ হয়ে গেছি, দেখছ না!
টুক টুক করে দরজায় শব্দ হলো এসময়।
সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছলেন হাদি। এই শব্দটা তিনি চেনেন। নাহিদের। দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, আয়।
দরজা ঠেলে নাহিদ এবং শুভ ঢুকল।
হাদির দিকে তাকিয়ে নাহিদ বলল, বাবা, এই হচ্ছে শুভ।
তারপর মিনুর দিকে তাকাল সে। মা, শুভর কথা তো তুমি জানই।
বলেই মা এবং বাবার ভেজাচোখ দেখে ফেলল নাহিদ। একটু যেন বিরক্ত হল। নিশ্চয় তোমরা আবার কান্নাকাটি করেছ! আচ্ছা তোমরা এরকম করলে আমি কী করি বল তো?
তারপর যেন চমকাল নাহিদ, বর্ষা কই?
মিনু বললেন, ওই রুমে।
ওকে একা রেখে তোমরা দুজন এই রুমে বসে আছ কেন?
তোর বাবা কাঁদছিলেন, এজন্য আমি..
মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই শুভর দিকে তাকিয়ে নাহিদ বলল, তুই এখানে বস। আমি বর্ষার রুমে আছি।
শুভ কিছু বলার আগেই বেরিয়ে গেল নাহিদ।
সঙ্গে সঙ্গে শুভর দিকে তাকালেন হাদি। কাতর গলায় বললেন, আমাদের ফ্যামিলির কারও কখনও ডায়াবেটিস ছিল না। এত কম বয়সে বাদলের যে কেমন করে হল?
স্বামীর পাশে বসে মিনু বললেন, ছোটবেলা থেকেই ও একটু রোগা ছিল। হজমে গণ্ডগোল হতো, ঘনঘন জ্বর হতো। দুবার জন্ডিস হল। বছরখানেক আগে স্পাইনাল কর্ডে টিবি হল। একটানা মাস চার চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হল ছেলেটার।
তারপরই বললেন, সারাজীবন শুয়ে থেকেও যদি বেঁচে থাকত…!
কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। কেঁদে ফেললেন।
শুভ খুবই বিব্রত হল। আপনাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার উপযুক্ত আমি নই, তবু দুএকটি কথা বলি। বর্ষার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ওর যা অবস্থা, আপনারা দয়া করে ওকে নিয়ে ভাবুন। যে চলে গেছে তার কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
মিনু বললেন, ভুলে যেতে চাই বাবা, সত্যি ভুলে যেতে চাই। পারি না। কিছুতেই পারি না।
তবু পারতে হবে। মন শক্ত করতে হবে। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
উঠে দাঁড়াল শুভ। আমার একটু কাজ আছে। আপনারা তো আরও তিন চারদিন। আছেন, এর মধ্যে আমি আবার আসব।
.
নাহিদ বলল, আমি ভেবেছিলাম শুভর সাথে তুই অনেক কথা বলবি। তুই কিছুই বললি না। কেন বললি না? ও কী ভাবল বল তো?
এসব কথা যেন শুনতেই পেল না বর্ষা। জানালার সামনে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করেই বলল, ভাইজান, বাদল কি এতদিনে কঙ্কাল হয়ে গেছে? কবরের অন্ধকারে একা একা কেমন করে আছে সে? অন্ধকারে বাদল খুব ভয় পেত। এখন ওর ভয় করে না?
হাত ধরে বর্ষাকে চেয়ারে বসাল নাহিদ। এসব বললে আমি খুব কষ্ট পাই। তুই কি ইচ্ছে করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস?
নাহিদের কথা কিছুই শুনল না বর্ষা। বলল, মৃত্যুর পরও নাকি মানুষের মাথার চুল, নখ বড় হয়! ভাইজান, বাদলের চুলগুলো কি অনেক বড় হয়ে গেছে? ঘাড় ছাড়িয়ে নেমেছে? আর নখগুলো কি ওর বড় হয়ে গেছে? ওতো নিজ হাতে নখ কাটতে পারত না। আমি কেটে দিতাম। ভাইজান, কবরে ওর নখ কেটে দেবে কে?
নাহিদ অসহায় গলায় বলল, তোকে আমি কতবার বলব এসব বলিস না। চল, ঐ রুমে যাই। সবাই মিলে চা খাই।
বর্ষা নড়ল না। আগের মতো করেই বলল, বাদল কি এখন বিকেলের চা খায়? কে করে দেয় ওর চা?
দুহাতে বর্ষার দুটো হাত ধরল নাহিদ। আমি তোকে কিছু কথা বলি…
নাহিদের কথা শেষ হওয়ার আগেই বর্ষা বলল, বাদলের কথা বল ভাইজান, শুধু বাদলের কথা বল। অন্য কারও কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না।
এবার আশ্চর্য রকমের এক অভিমান হল নাহিদের।
কেন শুধু বাদলের কথা বলব? বাদল ছাড়া আর কেউ নেই তোর? আমি নেই? আমি তোর ভাই নই? তুই যখন শুধুই বাদলের কথা বলিস আমার খুব কষ্ট হয়। বাদল নেই সেই কষ্ট কিন্তু নয়। অন্য রকমের কষ্ট। মনে হয় আমি তোর ভাই নই, শুধু বাদলই তোর ভাই। আমি মরে গেলেও তুই কোনও কষ্ট পাবি না।
শুনে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল বর্ষা। না না, না। মৃত্যুর কথা বল না, তুমি আর মৃত্যুর কথা বল না ভাইজান। আমি সহ্য করতে পারি না। আমার বুক ফেটে যায়। মৃত্যুর সময় যে রকম কষ্ট পেয়েছে বাদল ঠিক সেরকম কষ্ট পেতে থাকি আমি। মনে হয় আমি নিজেই যেন মরে যাচ্ছি।
একটা কথা তোর বোঝা উচিত, বাদলের জন্য যে রকম কষ্ট পাচ্ছিস তুই, তারচে অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছি মা, বাবা আর আমি, আমরা তিনজন। আমাদের কষ্টটা শুধু বাদলকে নিয়ে নয়, তোকে নিয়েও। বাদল চলে গিয়ে যে কষ্ট আমাদেরকে দিয়েছে, বেঁচে থেকে তুই তারচে কম কষ্ট আমাদেরকে দিচ্ছিস না। আমরা কেউ বুঝতে পারছি না, কী করলে তুই ভাল থাকবি।
কিছু করতে হবে না, কিছু করতে হবে না আমার জন্য। বাদলকে এনে দাও, তোমরা শুধু বাদলকে আমার কাছে এনে দাও। আমি আর কিছু চাই না।
বর্ষা হুহু করে কাঁদতে লাগল। বাদল কেন মরে গেল? কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেল?
.
জীবনে এত অপমান আমি কখনও হইনি। এতটা অপমান কেউ আমাকে কখনও করেনি।
রাগে ক্রোধে থমথম করছিল দোলনের গলা। বিরক্তিতে বিশ্রী দেখা যাচ্ছে সুন্দর মুখ। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল শুভ। তার জন্য, শুধু তার জন্য এমন হয়েছে। কেন সে সেতুদের বাড়িতে দোলনকে শুভ পাঠিয়েছিল?
কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। যে অপমান দোলনকে করা হয়েছে, কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে তা মুছে দেওয়া যায় তার মন থেকে!
শুভ কাতর গলায় বলল, পরিস্থিতিটা এরকম হবে আমি কল্পনাই করিনি। তাহলে কিছুতেই তোমাকে পাঠাতাম না।
দোলন রুক্ষ গলায় বলল, আপনি পাঠাতেন কি, এরকম অপমান হতে হবে জানলে আমি নিজেই যেতাম না।
একটু থেমে তীব্র ঘৃণায় মুখ বিকৃত করল দোলন। ছি ছি ছি! ছোট বোনের বান্ধবীর সাথে কেউ এরকম ব্যবহার করে? তাও ওরকম সফিসটিকেটেড ফ্যামিলির ছেলে!
ছোট বোনের লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলাটা মেনে নিতে পারছে না।
কেন পারবে না? একটি সৎ চরিত্রের মেয়ে তার পছন্দে বিয়ে করে ফেলেছে তাতে কী হয়েছে?
আমার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি সেতুদের বাড়ি যাই। গিয়ে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করি, দোলনের সাথে এই ব্যবহারটা আপনি কেন করেছেন? কিছু বলার থাকলে আমাকে। বলুন।
তাতে লাভ কী? আমার অপমানটা তো আর কেটে যাবে না।
দোলনের কথা বলার ভঙ্গিতে শুভ নিজেও খুব অপমানবোধ করছিল। যদিও বুঝতে পারছিল এটাই স্বাভাবিক। যার জন্য অপমান হয়েছে তাকে তো মনের ঝাল কিছুটা ঝাড়বেই দোলন। তবু মনটা শুভর খারাপ হচ্ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। আমি খুব দুঃখিত।
দোলন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আপনি দুঃখিত হয়ে কী করবেন? আপনার কি কিছু করার আছে?
না মানে আমার জন্য এরকম অপমান হলে তুমি!
এই অপমানের শোধ আপনি নিতে পারবেন না।
তা হয়ত পারব না, তবে অন্য একটা কাজ করতে পারব। চেষ্টা করব এসবের মধ্যে যেন তোমাকে আর না জড়াতে হয়।
দরজার দিকে পা বাড়াল শুভ।
দোলন বলল, শুনুন।
শুভ ঘুরে দাঁড়াল।
ছোট ভাইর আচরণে আমি বুঝেছি, ব্যাপারটা কিছুতেই ওরা মেনে নেবে না। যতো রকমের ঝামেলা করতে হয় করবে।
শুভ শান্ত গলায় বলল, তা আমিও বুঝেছি। দেখা যাক।
.
দাঁতে দাঁত চেপে স্বপন বলল, না তুমি কিছু বোঝনি! এখন থেকে আমি আর কারও কথা শুনব না। নিজে যা ভাল বুঝব তাই করব।
স্বামীকে শান্ত করার জন্য রেখা বলল, তুমি আমার কথা শোন।
কী কথা শুনব তোমার?
এসব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে কোনও লাভ হয় না।
লাভ লোকসানের কথা আমি ভাবছি না।
ভাবতে হবে। এটা তোমাদের ফ্যামিলির প্রেস্ট্রিজ। এজন্য ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে কাজ করতে হবে।
চিন্তা আমি করতে পারছি না। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
এবার স্বপনের একটা হাত ধরল রেখা। তুমি একটু স্থির হও, স্থির হয়ে বস। আমি তোমার মাথা মেসেজ করে দিই।
ঝটকা মেরে রেখার হাত ছাড়িয়ে দিল স্বপন। রাখ তোমার মাথা মেসেজ! যত্তসব ফালতু চিন্তা। জান, কী অপমানটা আমি হয়েছি। পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলছিলাম আমি।
তা তো আমি জানিই।
কিন্তু অপমানটা বোধহয় তুমি ফিল করতে পারছ না। এই মুখে একবার যা হা করেছি, তাই আমাকে আবার না করতে হয়েছে। এনগেজম্যান্টের যাবতীয় ব্যবস্থা। করেছিলাম, সেসব ভেঙে দিতে হয়েছে। লোকে এখন নানা রকমের কথা বলছে, এই অপমানটা শুধু আমার। আর কারও না।
রেখা সরল গলায় বলল, সেতুর ভুলটা হল এসব সে আমাদেরকে আগেই জানিয়ে দিলে পারত। সব ঠিকঠাক হওয়ার পর…!
রেখার কথা শেষ হওয়ার আগেই বেশ জোরে তাকে ধমক দিল স্বপন। চুপ কর।
তারপর গটগট করে বেরিয়ে সেতুর রুমে এসে ঢুকল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বিছানায়। বসে আছে সেতু। মায়ের চোখের সামনে দাঁড়াবার পরও চোখ তুলে তাকাল না।
ক্রোধে ফেটে পড়া গলায় স্বপন বলল, ইচ্ছে করছে এখন মারি তোকে, মেরে দাঁতগুলো ভেঙে ফেলি তোর, হাড়গুলো ভেঙে ফেলি। হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে পা দুটো ভেঙে দিই তোর, যাতে কোনদিন বাড়ি থেকে বেরুতে না পারিস। হাত দুটো ভেঙে দিই, যাতে কোনদিন টেলিফোন ধরতে না পারিস। তোর জিভটাও কেটে দেয়া উচিত যাতে মানুষের সঙ্গে আর কথা বলতে না পারিস।
সেতু একটিও কথা বলল না। চোখের জলে ভাসতে লাগল।
.
সন্ধ্যারাতে নিজের বেডরুমে মন খারাপ করে শুয়ে আছেন মামুন।
শিলা গিয়েছিলেন মুন্নির রুমে। ফিরে এসে স্বামীকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে স্বামীর পা মোছালেন তিনি। তার বাহুর কাছটায় হাত রাখলেন। তুমি একটু বেশি ভেঙে পড়েছ।
মামুন হতাশ গলায় বললেন, বেশি মানে কী? আমার মনে হচ্ছে আমি একেবারেই শেষ হয়ে গেছি।
এভাবে বল না।
সত্যি। বাবা মার মৃত্যুতেও এতো কষ্ট আমি পাইনি।
তা আসলে ঠিক নয়। মানুষ যখন সে দুঃখটা পায় সেটাকেই বড় করে দেখে।
এরকম কাজ সেতু কেমন করে পারল?
শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলেই এরকম কাজ মানুষ করতে পারে। একবারও আমাদের কথা ওর মনে হল না?
মনে হলে কী আর এরকম কাজ করে? মানুষের নিয়মই এই, যে সংসারে বড় হয়, যাদের আদরে ভালবাসায় বড় হয়, একদিন তাদের দিকেই আর ফিরে তাকায় না। নিজের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখে।
এটা কেমন স্বার্থ দেখা?
নিজের পছন্দে বিয়ে করা মানেই তো নিজের স্বার্থ দেখা।
কিন্তু ওই ছোকরাটার খবর আমি নিয়েছি। অতি বাজে পরিবার, হতদরিদ্র। ওইটুকু একটা বাড়ি ছাড়া কিছু নেই। কেরানিগিরি করে জীবন চালাতে হবে। আমার বোন হবে কেরানির বউ।
এ কথায় স্বামীর মন খারাপের কথা ভুলে গেলেন শিলা। স্বামীর ঠাট্টা প্রবণতার কথা মনে পড়ল। ফলে নিজের অজান্তেই যেন গলায় এসে তার ভর করল ঠাট্টার সুর। হবে না, হয়ে গেছে।
স্ত্রীর এই ভঙ্গিটা পছন্দ করলেন না মামুন। বিরক্ত হলেন। কথাটা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন শিলা। মাথা নিচু করে বললেন, সরি।
মামুন বললেন, নিজের স্বার্থটাও সেতু বোঝেনি। বুঝলে এরকম জায়গায় নিজেকে জড়াত না। মানুষ সব সময় নিজের ভাল চায়। সেতু কী চাইল?
কেউ কাউকে ভালবাসলে এত নিজের করে বাসে না।
মামুন খর চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। চুপ কর। ভালবাসা শব্দটার ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
বাইরে থেকে রানী এক সময় বলল, ছোট সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে আছে।
মামুন উঠলেন। শিলাকে কিছু না বলে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকলেন।
স্বপন গম্ভীর মুখে বসে আছে।
মামুন তার মুখোমুখি বসলেন। কী হয়েছে?
স্বপন থমথমে গলায় বলল, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার। ওকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
রাগারাগি করে লাভ নেই।
তাহলে কী করব? হুজুর হুজুর করব ওকে?
মামুন কথা বললেন না।
স্বপন বলল, ভাইয়া, আজ তোমাকে কিছু কথা আমি না বলে পারছি না। তোমার অতিরিক্ত আদরে এতোটা বখে যাওয়ার সাহস পেয়েছে সেতু। বোনকে আদরেরও একটা সীমা থাকে, যেই সীমাটা তোমার ছিল না। তীক্ষ্ণ চোখে স্বপনের দিকে তাকালেন মামুন, তোর ছিল? তুই কি সেতুকে কম আদর করেছিস?
তোমার মতো করিনি।
সেতুর কথা একা বলছিস কেন? তোকেই কি কম আদর করেছি আমি! বড় ভাই পিতার মতো। তোদের দুজনকে পিতার স্নেহে বড় করেছি আমি।
তা অস্বীকার করছি না।
তাহলে আমার অপরাধটা কোথায়? আমার দায়িত্ব ছিল তোদেরকে ভালবেসে বড় করা। আমি তা করেছি। বড় হয়ে তুই যদি আমার বুকে ছুরি মেরে দিস তাহলে আমার কী করার থাকে!
এসব ইমোশনাল কথা বলে লাভ নেই। এখন কী করবে, কীভাবে এটা সামাল দেবে তাই বল।
এখন কিছুই করতে চাইছি না।
মানে?
তোর চেয়ে রাগ আমারও খুব কম নয়। কিন্তু রাগের মাথায় আমি কিছু করব না। তাহলে ভুল হবে। কয়েকটা দিন যাক, রাগটা একটু কমে আসুক। তারপর যা করার করব।
তার মানে এখন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব?
এছাড়া কিছু করার নেই।
একটু থেমে মামুন বললেন, কিছু করার নেই কথাটা ঠিক নয়। আছে।
কী আছে বল।
আমি তোর ভাবীকে বলে দেব, তুইও রেখাকে বলবি সেতুর দিকে খেয়াল রাখতে, আরও কিছু কী করতে হবে, তোর ভাবী সেসব করবে।
ঘণ্টাখানেক পর শিলা এসে ঢুকলেন সেতুর রুমে।
সেতু শুয়েছিল। শিলাকে দেখে উঠে বসল।
শিলা কোনও ভণিতা করলেন না। রুক্ষ গলায় বললেন, তোমাকে কিছু বলতে এসেছি। কথাগুলো আমার নয়, তোমার ভাইদের। মন দিয়ে শুনবে। নাম্বার ওয়ান, এখন থেকে বাড়ির বাইরে তুমি যেতে পারবে না। নিষেধ। টু, টেলিফোন ধরতে পারবে না। নিষেধ। থ্রি, কোনও রকমের চালাকি কিংবা অন্য কিছু করলে আমাদের সাথে তোমার কোনও সম্পর্ক থাকবে না। ফিরে এলেও আমরা তোমাকে আর চিনব না।
সিনেমার রাগী মহিলাদের ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন শিলা। সেতু অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে তার।
.
ভাই-ভাবীর বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে শুভ বলল, ভাবী, আসব?
রুমে সুরমা একা! শুভর গলা শুনে বলল, আয়।
শুভ ভেতরে ঢুকল।
এক পলক দেবরের দিকে তাকিয়ে সুরমা বলল, বস!
শুভ বসল না। চিন্তিত গলায় বলল, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।
তীক্ষ্ণ চোখে শুভর মুখের দিকে তাকাল সুরমা। কী হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে। কেন? সেতুকে নিয়ে কোনও ঝামেলা হয়েছে?
শুভ মাথা নাড়ল।
সুরমা উতলা গলায় বলল, কী হয়েছে?
ওকে বাড়ি থেকে বেরুতে দিচ্ছে না, ফোন ধরতে দিচ্ছে না।
আর?
দোলনকেও ঐ বাড়িতে যেতে মানা করা হয়েছে।
এবার উল্কণ্ঠা যেন একটু কমলো সুরমার। বলল, প্রথম প্রথম এরকমই হয়। ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু আমার খুব নার্ভাস লাগছে।
নার্ভাস লাগার কিছু নেই।
সেতুর ছোট ভাইটা খুব রাগী।
তাতে কী? সেতু নিজে যদি ঠিক থাকে তাহলে কেউ কিছু করতে পারবে না।
কিন্তু এভাবে কতদিন?
কিছুদিন তো যাবেই।
সেতুর সাথে দেখা হবে না, কথা হবে না।
আপাতত না হোক।
কিন্তু কতদিন ওর সাথে কথা না বলে থাকব আমি, কতদিন দেখা না করে থাকব?
মনে হয় না বেশিদিন।
ভাবী, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
সুরমা সুন্দর করে হাসল। ভালবাসার জন্য এই কষ্ট করতেই হবে। হাত ধরে নিজের পাশে শুভকে বসাল সুরমা। শোন, তুই চাকরি বাকরির কথা বলেছিস, শুনে তোর ভাই কিন্তু চিন্তিত হয়ে গেছেন। তুই একটু সাবধানে থাকিস।
শুভ অবাক হল। সাবধানে থাকব কেন?
যে রকম মন খারাপ করে ঘুরছিস, যে কেউ দেখে তোকে নিয়ে চিন্তিত হবে।
শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ব্যাপারটা ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত মন আমার ভাল হবে না।
.
মালা ছুটে এসে বলল, তিনটি চিঠির জবাব আসেনি, জানিস, দুসপ্তাহ ধরে ফোনও করে না।
শুভ কোনও কথা বলল না। নিজের বিছানায় যেমন শুয়েছিল শুয়ে রইল।
মালা বলল, একটা ফ্যাক্স নাম্বারও আছে, এই ফুলস্কেপের পৃষ্ঠা আমেরিকায় ফ্যাক্স করতে কতো লাগে রে?
শুভ নির্বিকার গলায় বলল, জানি না, তুই এখন যা।
‘তুই’ শব্দটা শুনে আঁতকে উঠল মালা। চোখ কপালে তুলল মালা, তুই আমাকে তুই করে বলছিস কেন?
এবার বিরক্ত হল শুভ। আমার ইচ্ছে হয়েছে বলেছি। যা ভাগ!
সাথে সাথে ঠোঁট উল্টাল মালা। ইস্ ঢং! দাঁড়া এক্ষুণি গিয়ে মাকে বলছি।
যা বল গিয়ে। যা।
কিন্তু মায়ের কাছে আসার আগে চোখটা একটু ভিজিয়ে নিলো মালা। কাঁদতে কাঁদতে এল।
ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পেয়ালা প্লেট গোছাচ্ছিলেন মা। মালাকে দেখে। অবাক হলেন। কাঁদছিস না কি? কী হয়েছে?
মালা নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়ে বলল, তোমার ছোট ছেলে…
কথা শেষ হওয়ার আগেই গম্ভীর গলায় মা বললেন, কথা ঠিক মতো বল। আমার ছোট ছেলে মানে? আমার ছোট ছেলে তোর কী হয়?
আঁচলে চোখ মুছল মালা। হয়ত ভাইই, ছোট ভাই কিন্তু ব্যবহার করে পরের মতো।
ভণিতার দরকার নেই। কী হয়েছে তাই বল।
একটা কথা বলতে গেছি, তুই তোকারি শুরু করল। বড় বোনের সাথে কেউ এমন করে?
তুই বা যখন তখন ওর কাছে যাস কেন? কথায় কথায় যখন এত কান্না পায় তখন…
একথা শুনে কান্না ভুলে মালা একেবারে তেড়িয়া হয়ে উঠল। তুমি কেমন মা? তোমার কাছে এলাম বিচার দিতে আর তুমি উল্টো আমাকেই বকছ? আমি আজই আমেরিকায় ফোন করব। এই বাড়িতে আমি আর থাকব না।
শুনে মাও রাগলেন। না থাকলে তো বেঁচেই যাই। তুই যে রুমটা দখল করে আছিস ওটা ভাড়া দিলে কমপক্ষে দেড় হাজার টাকা পাব।
মালা ঠোঁট উল্টাল। ইস, দেড় হাজার টাকা।
তারপর নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল।
মা বললেন, শোন।
মালা দাঁড়াল।
আমেরিকায় ফোন করতে হলে কার্ডফোন থেকে করবি। খবরদার এই বাড়ি থেকে ফোন করবি না।
মালা মুখ ঝাঁপটে বলল, কার্ডফোন থেকেই করব। তোমাদের ফোন থেকে করব না।
মালা চলে যাওয়ার পর হাতের কাজ ফেলে রেখেই শুভর রুমে এসে ঢুকলেন মা। কী, ব্যাপার কী?
শুভ যেন কিছুই জানে না এমন ভঙ্গিতে বলল, কী?
মালার সঙ্গে ঝগড়া করেছিস কেন?
কে বলল ঝগড়া করেছি?
যেই বলুক, কেন করেছিস?
ঝগড়া করিনি, তুই করে বলেছি।
কেন?
সব সময় চিঠিপত্র নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি ভাল লাগে না।
মুখ সামলে কথা বল। কীসের ঘ্যানঘ্যানানি? বড় বোনের কথাকে কেউ ঘ্যানঘ্যানানি বলে?
আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে মা। যত কথা বলবে মেজাজ তত খারাপ হবে। তারচে’ তুমি এখন যাও। যা বলার পরে বল।
এ কথায় খুবই রেগে গেলেন মা। কী, আমাকেও চলে যেতে বলছিস? এত বড় সাহস তোর? এই, কোন লাটবাহাদুর হয়ে গেছিস তুই? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! এক থাপ্পড় মারব।
এবার আস্তেধীরে বিছানা থেকে নামল শুভ। আলনা থেকে শার্ট নিয়ে পরল। ঠিক আছে, তুমি থাক, আমিই বরং বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই।
দরজার দিকে এগিয়ে গেল শুভ।
মা বললেন, পারলে চিরতরে চলে যা। তোর মুখ যেন আমার আর দেখতে না হয়। শুভ আর কথা না বলে বেরিয়ে গেল।
৬. উদাস চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে
উদাস চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে বর্ষা।
মিনু এসে তার রুমে ঢুকলেন বর্ষা খেয়ালই করল না, যেমন তাকিয়ে ছিল তেমনি তাকিয়ে রইল।
কয়েক পলক তাকিয়ে বর্ষাকে দেখলেন মিনু, তারপর তার পাশে বসলেন। এ সময় শুয়ে আছিস কেন?
বর্ষা কথা বলল না, ফিরেও তাকাল না।
মিনু বললেন, ওঠ। ঐ রুমে চল। বিকেলের নাস্তা দিয়েছে। তোর বাবা বসে আছেন, তুই গেলে নাস্তা খাবেন।
এবারও মায়ের দিকে তাকাল না বর্ষা। ধীর গলায় বলল, আমি খাব না।
কেন?
খেতে ইচ্ছে করে না আমার।
ইচ্ছে না করলেও খেতে হয় মা। না খেলে শরীর খারাপ হয়।
হোক।
বর্ষার মাথায় হাত দিলেন মা, এমন করে না। চল সামান্য কিছু হলেও মুখে দে।
বর্ষা এবার মায়ের দিকে তাকাল, অসহায় গলায় বলল, খেতে আমার ভাল লাগে। না। শুধু বাদলের কথা মনে হয়। তারপর কেমন যেন দুঃখি হয়ে গেল বর্ষা। মা, তোমার মনে আছে শেষ দিকে খিদে খুব বেড়ে গিয়েছিল বাদলের। বারবার শুধু খেতে চাইত।
বর্ষার কথা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল মিনুর। তবু নিজেকে সংযত করলেন তিনি। শান্ত গলায় বললেন, ডায়াবেটিক রোগীদের এমন হয়।
আগের মতো করেই বর্ষা বলল, তুমি বাবা ভাইজান, তোমরা সবাই ওর ওপর খুব রেগে যেতে। তোমরা রেগে গেলে মুখটা এমন অসহায় দেখাত ওর, আমার যে তখন কী কষ্ট হতো! কিছুতেই কিছু খেতে পারতাম না আমি। আমার খুব কান্না পেত, মনে হতো ইচ্ছে করে বাদলকে তোমরা খেতে দিচ্ছ না।
মিনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। না, এটা তোর ভুল ধারণা। সন্তানকে ইচ্ছে করে না খাইয়ে রাখতে পারে না কোনও মা বাবা।
তোমরা তো রাখতে।
ইচ্ছা করে রাখতাম না মা। ওর ভালর জন্য খাবারটা কন্ট্রোল করতাম।
তারপর একটু থেমে বললেন, আমি, তোর বাবা, আমরা কি কম ভালবাসতাম বাদলকে? বল।
এই কথাটা যেন শুনতেই পেল না বর্ষা। বলল, আমি কিন্তু চুপি চুপি খেতে দিয়ে আসতাম বাদলকে।
সত্যি?
হ্যাঁ, তোমরা কেউ যাতে দেখতে না পাও, পা টিপে টিপে খুব সাবধানে ওর ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতাম। যেসব খাবার নিষিদ্ধ ছিল সেসব খাবারের দুএকটি পেলে মুখটা যে কী উজ্জ্বল হতো ওর!
বর্ষার কথা শুনতে শুনতে জলে চোখ ভরে এল মায়ের। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, এভাবে বলিস না মা, এভাবে বলিস না। আমি সহ্য করতে পারি না। আমার বুক ফেটে যায়।
কিন্তু মায়ের কথা যেন শুনতেই পেল না বর্ষা। উদাস গলায় বলল, আমাদের ছেড়ে কোথায় চলে গেল বাদল? কেন চলে গেল?
.
বাড়ি থেকে বেরিয়েই শুভর মনে পড়েছিল নাহিদের কথা। নাহিদ কি এখন হোটেলে আছে? তাহলে নাহিদের ওখানে যাওয়াই ভাল। নাহিদের মা, বাবা, বর্ষা, সবাই মিলে অন্যরকম একটা পরিবেশ। ওদের কাছে ভালই লাগবে শুভর। যদিও বর্ষা একটু অন্য রকম, তাকে নিয়ে নানা রকমের জটিলতায় আছে তিনজন মানুষ, তবু তাদের কাছে। যেতে ভাল লাগে শুভর।
কিন্তু হোটেলের লনে এসেই ভাল রকমের একটা হোঁচট খেল শুভ।
রিকশা বিদায় করে রিসিপশানের দিকে যাচ্ছে শুভ, বর্ষা বেরিয়ে এল। এসে শুভর পাশ দিয়ে অচেনা মানুষের ভঙ্গিতে হেঁটে লনের দিকে চলে গেল। শুভকে সে চিনতেই পারল না।
শুভ বেশ অবাক হল। তারপর বর্ষার পিছু কয়েক পা এসে ডাকল। শোন।
বর্ষা থমকে দাঁড়াল। অচেনা মানুষের ভঙ্গিতে তাকাল শুভর মুখের দিকে। খানিক তাকিয়ে তাকে চেনার চেষ্টা করল, আপনি যেন কে?
শুভ মৃদু হাসল, আমি বুঝেছিলাম।
কী বুঝেছিলেন?
তুমি আমাকে চিনতে পারনি।
হ্যাঁ।
আমি শুভ।
ও।
নাহিদ আছে?
না।
আগের মতোই নির্বিকার ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল বর্ষা।
শুভ বলল, কোথায় যাচ্ছ?
বর্ষা আবার দাঁড়াল। কাল সকালে বাড়ি চলে যাব।
শুভ হাসল। কাল সকালের কথা বলছি না। এখন কোথায় যাচ্ছ?
কোথাও না।
রিসিপশানের সোফা দেখাল শুভ। তাহলে চল ওখানে বসি।
কেন?
কথা বলি তোমার সঙ্গে। গল্প করি।
সঙ্গে সঙ্গে মুখ উজ্জ্বল হল বর্ষার। বাদলের গল্প! চলুন। দ্রুত হেঁটে সোফার সামনে এল বর্ষা। নিজে একটি সোফায় বসে মুখোমুখি সোফাটি দেখাল শুভকে। বসুন।
শুভ বসল।
বর্ষা দূরাগত গলায় বলল, স্পাইনাল কর্ডে যখন টিবি হল, চার মাস ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বাদল। অত শুয়ে থাকলে কি ঘুম আসে মানুষের? বাদলেরও ঘুম আসত না। আমি থাকতাম পাশের রুমে। গভীর রাতে আস্তে আস্তে বাদল আমাকে ডাকত। বর্ষা বর্ষা। জোরে ডাকত না, জানেন! একটুও জোরে ডাকত না। জোরে ডাকলে যদি অন্যদের ঘুম ভেঙে যায়! জানেন, একবার ডাকলেই আমি টের পেতাম। মাত্র একবার ডাকলেই। আসলে বাদলের জন্য আমি যেন সারারাতই জেগে আছি।
বর্ষার কথা বলার ভঙ্গিতে মন খারাপ হলো শুভর। অবস্থাটা বদলাবার জন্য বলল, বাদলের কথা নয়, তুমি তোমার কথা বল।
অপলক চোখে শুভর দিকে তাকাল বর্ষা। আমার কী কথা? আমার তো কোনও কথা। নেই। আমি আর বাদল, আমরা দুজন এক সঙ্গে পৃথিবীতে এসেছিলাম। এক সঙ্গে বড় হয়েছিলাম, এক সঙ্গে এসে, এক সঙ্গে থেকে একজন কী করে আরেকজনের আগে চলে। যায়? বাদলকে ছেড়ে আমি কেমন করে থাকি বলুন তো, একটু থামল বর্ষা। তারপর বলল, বাদল আমাকে বলত, আমার মনে মনে বলা কথাও সে শুনতে পায়। এই যে এখন আমি ওর কথা বলছি, ও কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছে? বলুন না, শুনতে পাচ্ছে?
শুভ বলল, না মৃত্যুর পর আর কিছুই থাকে না।
কেন থাকে না? মৃত্যু এমন কেন? বলুন না মৃত্যু এমন কেন? বাদল কেন মরে গেল?
বর্ষা হুহু করে কাঁদতে লাগল।
.
নিজের রুমে বসে সেতু যখন কাঁদছে, ড্রয়িংরুমে বসে সেতুর দুভাই তখন তাকে নিয়ে নানা রকমের চিন্তাভাবনা করছে। ভেতরে ভেতরে রাগে গজরাচ্ছিল স্বপন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ওকে যখন কাঁদতে দেখি, আমার ইচ্ছে করে ওর গলা টিপে ধরি।
মামুন বললেন, রিল্যাক্স। যতোই কান্নাকাটি করুক কোনও লাভ হবে না। শোন তোকে নিয়ে আমি একটু ঐ ছোকরার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
কোন ছোকরা?
আরে ঐ যে, শুভ না কী যেন নাম!
শুনে চোখ কপালে উঠে গেল স্বপনের। বল কী তুমি? ওর সঙ্গে আমরা কেন দেখা। করব?
মামুন গম্ভীর গলায় বললেন, কারণ আছে।
কী কারণ?
যাওয়ার আগে সব বলব। তুই কি ওদের বাড়ি চিনিস?
চিনি।
তাহলে এখুনি চল।
তারপরই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে দুভাই। শুভদের বাড়ি এসেছে। কলিংবেল বাজাবার পর শুভই দরজা খুলে দিয়েছে। খুলে হতভম্ব হয়ে গেছে। আপনারা? আসুন, আসুন।
শুভর পিছু পিছু ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকেছে মামুন এবং স্বপন।
বসুন।
স্বপন বলল, তুমি কি আমাদেরকে চিনেছ?
জ্বি। একটু বসুন, ভাবীকে ডেকে আনি।
দরকার নেই।
চা, চা খাবেন তো?
এবার কথা বললেন মামুন। আমরা চা খেতে আসিনি, অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতেও আসিনি। বরং অন্য কারও না থাকাই ভাল, আমরা তোমার সঙ্গে দুএকটা কথা বলব।
শুভ একটা সোফায় বসল।
সেতুর দুভাইকে দেখার পর থেকেই বুকটা ধুকধুক করছিল। গলাটা শুকিয়ে আসছিল। খুবই নার্ভাস লাগছিল তার। কোন ফাঁকে যেন সেই ভাবটা কেটে গেছে।
সোফায় বসে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মামুন এবং স্বপনের দিকে তাকাল শুভ। ধীর শান্ত গলায় বলল, জ্বি বলুন। স্বপন বলল, ব্যাপারটা আমরা জেনেছি।
সঙ্গে সঙ্গে আরও বললেন, খুবই দুঃখ এবং লজ্জাজনক ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের জন্য। আমার বোন এরকম একটা কাজ করবে এ আমরা কল্পনাও করিনি।
স্বপন বলল, এবং এমন সময় ব্যাপারটা আমরা জেনেছি…। হাত তুলে স্বপনকে থামালেন মামুন। আমি বলছি। তারপর শুভর দিকে তাকালেন তিনি। যা হোক, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। যা করতে হবে তাই নিয়ে ভাবা উচিত। একটু থামলেন তিনি। তারপর বললেন, আমরা চাই ব্যাপারটা তোমার দিক থেকে শেষ হয়ে যাক।
শুভ চমকালো। মানে?
স্বপন বলল, মানে জানতে চাওয়ার দরকার নেই। মানেটা খুব পরিষ্কার। যা লাগে আমরা দিয়ে দেবো। কাজটা যেভাবে করেছ সেভাবেই গোপনে শেষ করে দেবে।
মামুন বললেন, অত কিছুর দরকার নেই। আমাদের ল ইয়ার পেপারস রেডি করে নিয়ে আসবে, তুমি শুধু সই করে দেবে।
ফ্যালফ্যাল করে মামুন এবং স্বপনের মুখের দিকে তাকাল শুভ। আপনাদের কথা আমি বুঝতে পারছি না। কীসের পেপারস? কীসের সই?
স্বপন বলল, ডিভোর্সের।
জ্বি?
হ্যাঁ, সেতুকে তোমার ডিভোর্স করতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল শুভ। দৃঢ় গলায় বলল, একথা বলার জন্য আমাদের বাড়িতে আসা আপনাদের ঠিক হয়নি। মরে গেলেও সেতুকে আমি কখনও ডিভোর্স করব না।
.
মা বললেন, কারা এসেছিল তোর কাছে?
শুভ একটু থতমত খেল। তুমি চিনবে না।
চিনিনি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি। কারা?
আমার পরিচিত।
কেমন পরিচিত?
বিশেষ পরিচিত।
মা ভুরু কুঁচকালেন, বিশেষ পরিচিত?
হ্যাঁ।
কিন্তু তাদেরকে তো চা খাওয়াতে দেখলাম না।
শুভ কথা বলল না।
মা তীক্ষ্ণ চোখে শুভর দিকে তাকালেন। কেন এসেছিল?
ওই একটা কাজ আর কি! তুমি বুঝবে না।
তোর মতো মানুষের কাছে কী এমন কাজে গাড়ি নিয়ে সুট-টাই পরা লোকজনরা আসবে যা আমি বুঝব না?
শুভ একটু বিরক্ত হল। তুমি আমাকে যা ভাব আমি তা নই মা। আমি বড় হয়েছি, আমার একটা সার্কেল তৈরি হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যে দেখবে ভাল একটা চাকরিও পেয়ে গেছি। তখন আর যখন তখন আমাকে গালাগাল করতে পারবে না।
মা কথা বললেন না। কী রকম সন্দেহের চোখে শুভর দিকে একবার তাকিয়ে শাহিন-সুরমার বেডরুমে এসে ঢুকলেন।
সুরমা রুমেই ছিল। শাশুড়িকে দেখে চোখ তুলে তাকাল।
মা বললেন, বউমা, তুমি আমাকে সত্য একটা কথা বলবে?
সুরমা মৃদু হাসল। আমি আপনার সঙ্গে কখনও মিথ্যে বলি না।
মা যেন একটু বিরক্ত হলেন। সব কথায় প্যাঁচ ধরো না। শুভর কাছে যারা এসেছিল তাদেরকে তুমি চেন?
না। কারা এসেছিল?
সে কথাই তো জিজ্ঞেস করছি। আমি মা, কিন্তু শুভ আমাকে সব কথা বলে না। তোমাকে বলে। কারা এসেছিল তোমাকে বলেনি?
না। আমি কিছু জানিই না। বাড়িতে যে কেউ এসেছিল একথা এইমাত্র আপনার মুখে শুনলাম।
আমার কী রকম যেন সন্দেহ হচ্ছে।
কীসের সন্দেহ?
আজকালকার এই বয়েসি ছেলেরা নানারকমভাবে বখে যায়। শুভর ব্যাপারটা কি তুমি একটু জানার চেষ্টা করবে?
অবশ্যই করব। শুভর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাব।
ঠিক আছে।
মা বেরিয়ে গেলেন।
সামান্য সময় কী ভাবল সুরমা তারপর শুভর রুমে এসে ঢুকল। কপালে আড়াআড়ি করে ডান হাত ফেলে শুয়ে আছে শুভ। সুরমার সাড়া পেয়ে কপাল থেকে হাত সরাল তারপর বিছানায় উঠে বসল। আমি জানি তুমি কেন এসেছ?
শুভর খাটে বসল সুরমা। কেন বলতো?
মা গিয়েছিলেন তোমার কাছে?
হ্যাঁ। কারা এসেছিল তোর কাছে?
সেতুর দুভাই।
সুরমা চমকাল, কী?
হ্যাঁ।
হঠাৎ?
আমি কল্পনাই করিনি ওঁরা এভাবে আমাদের বাড়িতে আসবেন।
কিন্তু এসেছিলেন কেন?
আশ্চর্য এক আবদার নিয়ে। আমি যেন সেতুকে ডিভোর্স করি।
কী?
হ্যাঁ।
সুরমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শুভর দিকে।
শুভ বলল, এভাবে এসে ওঁরা যে আমাকে ডিভোর্সের জন্য চাপ দেবেন আমি ভাবতেই পারিনি ভাবী।
সুরমা একটু নড়েচড়ে উঠল। কিন্তু ওদের পলিসিটা আমি একদম বুঝতে পারছি। এসব ক্ষেত্রে নিজেদের মেয়েটিকেই সাধারণত প্রেসার দেয় সবাই। তা না করে, ওঁরা তোর কাছে এলেন কেন?
সেতুকে যে প্রেসার দেয়নি তাই বা কী করে বলছ? হয়ত তাকে ম্যানেজ করতে পেরেই আমার কাছে এসেছে।
হতে পারে। সেতুর ব্যাপারে তুই কতটা সিরিয়াস তা হয়ত ওঁরা দেখতে চাইলেন।
শুভ কথা বলল না।
সুরমা বলল, কিন্তু এদিকে কী করবি?
চোখ তুলে সুরমার দিকে তাকাল শুভ। এদিকে মানে?
সেতুর ভাইদেরকে দেখার পর থেকে মা কী রকম যেন সন্দেহ করছেন। তাঁকে ম্যানেজ করবি কী করে?
কথাটা আমিও ভেবেছি। ভাবী, বিয়ের ব্যাপারটা কি আমাদের বাড়িতে জানিয়ে দেবে? দুদিন আগে পরে জানাতে তো হবেই।
সুরমা কাতর গলায় বলল, আমার খুব ভয় করছে। মা যে রকম মেজাজি মানুষ! তুলকালাম করে ফেলবেন।
শুভ শান্ত গলায় বলল, সেই ভয়ে কি বসে থাকা যাবে? তুমি একটা কাজ কর, ভাইয়াকে বল। ভাইয়া বলবে মাকে।
তারপরই সুরমার একটা হাত ধরল শুভ। ভাবী, তুমি ছাড়া আমার পাশে এখন। কেউ নেই। জানি তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল যাবে। তবু তোমাকে সব সামলাতে হবে।
সুরমা চিন্তিত চোখে শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছে শাহিন।
সুরমা এসে ঢুকল কিন্তু শাহিন তার দিকে ফিরেও তাকাল না। কয়েক পলক স্বামীকে দেখে রিমোট টিপে টিভি অফ করল সুরমা। এতে শাহিন তেমন বিরক্ত হল না। হাসিমুখে স্ত্রীর দিকে তাকাল। অফ করলে কেন?
সুরমা সঙ্গে সঙ্গে বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কী এমন কথা যে জন্য টিভি অফ করতে হবে?
তারপরই তীক্ষ্ণ চোখে সুরমার মুখের দিকে তাকাল শাহিন। এ
ত গম্ভীর হয়ে আছ কেন? মা কিছু বলেছেন?
না।
তাহলে?
একেবারেই অন্যরকম ব্যাপার।
বলে ফেল।
কথাটা তুমি কীভাবে নেবে বুঝতে পারছি না।
আমাকে কিছু বলতে এত দ্বিধা করার মানে নেই। সরাসরি বলে ফেল।
শুভ চাকরি বাকরির কথা বলায় তুমি সেদিন যেমন চিন্তিত হয়েছিলে, আজ আমি বুঝেছি কেন সে ওসব কথা বলেছিল।
কেন?
আগে আমাকে তোমার একটা কথা দিতে হবে। উত্তেজিত হবে না, রেগে যাবে না।
শাহিন গম্ভীর গলায় বলল, কী হয়েছে?
আগে কথা দাও।
এত ভণিতা করো না। ভাল লাগছে না। কী হয়েছে বল।
সুরমা পরিষ্কার গলায় বলল, সেতু নামের খুব বড়লোক বাড়ির একটি মেয়ের সঙ্গে শুভর অ্যাফেয়ার।
শাহিন বেশ একটা ধাক্কা খেল। তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কই, তুমি তো আমাকে কখনও বলনি?
ছোটভাই একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে সে কথা বড়ভাইকে বলার কী আছে?
তাহলে এখন বলছ কেন?
বলতে চাইনি। বাধ্য হচ্ছি।
কীসের বাধ্য?
সেতুর সঙ্গে শুভর বিয়ে হয়ে গেছে।
কথাটি যেন বুঝতে পারল না শাহিন। কী বলছ তুমি?
সুরমা গম্ভীর গলায় বলল, হ্যাঁ।
কবে? কোথায়? কীভাবে হল?
ব্যাপারটা খুলে বলল সুরমা।
শুনে শাহিন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।
সুরমা বলল, এখন আসল কাজটা তোমাকে করতে হবে।
আসল কাজ কোনটা?
মাকে ম্যানেজ করতে হবে।
মানে?
ব্যাপারটা মাকে বলে তাঁকে তুমি ম্যানেজ করবে।
কিন্তু কাজটা কি শুভ ভাল করেছে?
এছাড়া ওদের কোনও উপায় ছিল না।
তা বুঝলাম কিন্তু মাকে ম্যানেজ করা খুব কঠিন হবে। শুনেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করবে, রাগারাগি শুরু করবে।
তাকে তুমি বোঝাবে সেতু খুব বড়ঘরের মেয়ে। শিক্ষিতা, সুন্দরী।
যত যাই হোক, আমাদের দেশের মা বাবারা এই ধরনের খবর শুনলেই রেগে যান। ছেলেমেয়েদেরকে এই ধরনের স্বাধীনতা তাঁরা দিতেই চান না। তার ওপর মা যদি শোনে। সেতুর ভাইরা এসে ডিভোর্সের জন্য প্রেসার দিয়ে গেছে তাহলে একেবারে কেলেঙ্কারি করে ফেলবে।
এই কথাটা মাকে বল না।
কিন্তু আমি অন্য রকমের একটা ভয় পাচ্ছি।
সেতুর ভাইয়েরা কোনও ঝামেলা করে কি না?
হ্যাঁ।
আমিও সেই ভয়টা পাচ্ছি। এত টাকা পয়সা ওদের। টাকা দিয়ে সব হয় আজকাল।
তা ঠিক।
একটু চুপ করে থেকে শাহিন বলল, এমনিতেই শুভর ওপর সবসময় রেগে আছে। মা, এসব শোনার পর যে কী হবে ভাবতেই পারছি না।
স্বামীর কাঁধে হাত দিল সুরমা। মা তোমাকে খুব ভালবাসেন। আমার বিশ্বাস, তুমি তাঁকে ম্যানেজ করতে পারবে। যেমন করে হোক শুভকে তুমি সেভ কর।
শাহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাতো করতেই হবে। তবে আপাতত মাকে কিছুই জানাবার দরকার নেই।
মানে?
আর কিছুদিন যাক, এরপর জানাব।
শাহিন থামল। হাসিমুখে সুরমার দিকে তাকাল। সেতুর একটা ছবি আমাকে দেখিও তো। দেখব মেয়েটা কেমন।
সুরমা মুগ্ধ গলায় বলল, খুব সুন্দর মেয়ে।
.
টেলিফোন সেটটা খুবই যত্নে মুচছে মালা।
এই একটি ব্যাপারে অপরিসীম যত্নবান সে। আর কাজটি করার সময় অন্যদিকে মনোযোগ প্রায় দেয়ই না।
কিন্তু এখন একটু দিল।
শুভ এসে অদূরে দাঁড়িয়েছে আড়চোখে তা দেখল মালা। দেখেই মুখটা গম্ভীর, শক্ত ধরনের করে ফেলল।
অপরাধী ভঙ্গিতে শুভ এসে দাঁড়াল মালার পাশে। নরম গলায় বলল, আপা।
অভিমানে গলা ভারি হল মালার, আমাকে আপা বলার দরকার কী?
তাহলে কী বলব?
নাম ধরে বল, তুই করে বল।
শুভ মাথা নিচু করল, আমার মনটা সেদিন ভাল ছিল না।
কেন?
খুব টেনশন যাচ্ছে।
মালা অবাক হল। কীসের টেনশন? কী হয়েছে তোর?
এমন একটা ব্যাপার, কাউকে বলতেও পারছি না।
শুভর কথা বলার ধরনে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল মালার, টেলিফোন রেখে শুভর মুখোমুখি দাঁড়াল। তোর কথা শুনে আমার ভয় লাগছে। কোথাও কোনও বিপদ হয়নি তো? মা বলল, কারা নাকি এসেছিল তোর কাছে?
শুভ বলল, ভয় পাওয়ার মতো কিছু না। একেবারেই অন্যরকম একটা ব্যাপার।
সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের কথা ভুলে গেল মালা। যাবতীয় অভিমান ভুলে গেল। গভীর মমতায় ছোটভাইর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, কী হয়েছে আমাকে বল।
বলতে পারি, কিন্তু প্রমিজ কর এখুনি কাউকে বলবে না।
অন্য হাত শুভর গালে চুঁইয়ে মালা বলল, প্রমিজ করলাম।
তাহলে আমার রুমে এস, বলছি।
শুভর পিছু পিছু তার রুমে এসে ঢুকল মালা। অনেকক্ষণ ধরে সেতুর ব্যাপারটা মালাকে বলল শুভ। শেষ পর্যন্ত সেতুর একটা ছবি বের করে দিল মালার হাতে।
সেতুর ছবি দেখে মালা একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। ওমা, কী সুন্দর মেয়ে! জীবনে এত সুন্দর মেয়ে আমি দেখিনি।
তারপরই শুভর দিকে তাকাল মালা। এই গাধা, তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন?
শুভ ম্লান গলায় বলল, তোমাদের কাউকে ভয় পাচ্ছি না। ভয় পাচ্ছি শুধু মাকে।
সেতুকে দেখে আমার চেয়েও বেশি মুগ্ধ হবে মা।
কিন্তু আমাকে তো মা দেখতে পারে না।
তোকে দেখতে পারে না ঠিকই কিন্তু সেতুকে খুব আদর করবে দেখিস।
ওসব তো বাড়ির বউ হয়ে আসার পর। আগে সব ঠিকঠাক করতে হবে না?
আমাদের বাড়ি নিয়ে তুই ভাবিস না। ভাইয়া দেখবি ঠিকই মাকে ম্যানেজ করে ফেলেছে। দরকার হলে ভাইয়ার সঙ্গে আমিও থাকব।
তুই কিছু বলতে গেলে মা আরও রেগে যাবে।
মালা ঠোঁট উল্টাল। ইস রেগে যাবে! আমরা তিনভাইবোন আর ভাবী যদি একদিকে থাকি, আমাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই করতে পারবে না মা।
শুভ কথা বলল না।
.
কোনও কোনও রাতে দুধভাত খাওয়ার খুব শখ হয় টুপলুর। সন্ধেবেলাই মাকে বলে, আম্মু আমি আজ দুধভাত খাব।
আজও বলেছে।
তারপরই প্লেটে দুধভাত নিয়ে চামচে করে মেয়েকে খাওয়াতে বসেছে রেখা। প্রথম প্রথম আস্তেধীরেই খাওয়াচ্ছিল। এখন খাওয়াবার গতি একটু দ্রুত হয়েছে। ব্যাপারটা খেয়াল করে টুপলু বলল, এত তাড়াতাড়ি খাওয়াচ্ছ কেন আম্মু?
রেখা বলল, এমনি।
আমি এত তাড়াতাড়ি খেতে পারি না।
খাওয়া দাওয়ার জন্য বেশি সময় নষ্ট করতে হয় না।
কেন?
খেতে বসে বেশি সময় নষ্ট করলে পড়বে কখন?
এখন আমার পড়া নেই। টিচার চলে গেছে।
আমি এখনকার কথা বলিনি।
তাহলে কখনকার কথা বলেছ?
রেখা একটু রাগল। চুপ কর। তুমি খুব বেশি কথা বল।
ঠিক তখুনি রুমে এসে ঢুকল স্বপন। কী যেন কী কারণে মেজাজ খিঁচড়ে আছে তার। রেখা টুপলুকে খাওয়াচ্ছে এই দৃশ্য দেখে খিচড়ানো মেজাজ আরও খিঁচড়ে গেল। খেকুড়ে গলায় টুপলুকে বলল, তুমি এখানে বসে খাচ্ছ কেন? এটা কি খাওয়ার জায়গা? যাও ডাইনিং টেবিলে যাও।
বাবার এরকম আচরণে টুপলু নার্ভাস হয়ে গেল। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার। ব্যাপারটা খেয়াল করে স্বামীর দিকে তাকাল রেখা। বাড়ি এসেই মেয়েটাকে ধমকাচ্ছ কেন?
আগের ভঙ্গিতেই স্বপন বলল, এখানে বসে খাচ্ছে কেন?
খেতে চায়নি, আমি নিয়ে এসেছি।
এক চামচ দুধভাত টুপলুর মুখে দেয়ার চেষ্টা করল রেখা। টুপলু মুখ সরিয়ে নিল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি আর খাব না আম্মু।
সঙ্গে সঙ্গে প্লেট সরিয়ে নিল রেখা। তুমি তাহলে মুন্নি আপুর রুমে যাও। টিভি দেখ গিয়ে।
আচ্ছা।
টুপলু বেরিয়ে গেল।
তারপর স্বামীর দিকে তাকাল রেখা। গম্ভীর গলায় বলল, তোমার আচরণ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
আগের মতই রাগী ভঙ্গিতে স্বপন বলল, কী রকম?
ভেবে দেখ। বউ বাচ্চার সঙ্গে এই ধরনের আচরণ কোন ভদ্রলোক করে না।
বিছানার এক পাশে বসল স্বপন। সেতুর ব্যাপারে আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
তাতে আমাদের কী?
মানে?
যার জন্য মেজাজ খারাপ, রাগটা গিয়ে তাকে দেখাও। আমাদেরকে দেখাবে না। তোমার জন্য আমার মেয়েটি এখন খেতে পারল না। তোমার আল্লাদি বোনের জন্য আমাকে তুমি চড় মেরেছ। অন্যায়টা তো আমরা করিনি। করেছে তোমার বোন। তার জন্য আমরা কেন সাফার করব?
একটু থামল রেখা। তারপর বলল, আর একদিন যদি দেখি তুমি আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছ, তাহলে টুপলুকে নিয়ে আমি আমাদের বাড়িতে চলে যাব। গিয়ে সবাইকে বলব তোমার বোন এই এই করেছে, তার রাগ তুমি আমাদের ওপর ঝাড়ছ, পায়ে ধরলেও এই বাড়িতে আমি আর ফিরব না।
টুপলুর আধখাওয়া দুধভাতের প্লেট হাতে রাগী ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল রেখা। স্বপনের এখন খুবই অসহায় লাগছে। কাতর মুখে নিজের বিছানায় বসে রইল সে।
.
ঠিক স্বপনের মতো করেই নিজের বেডরুমে নিজের বিছানায় বসে আছে মামুন। তার সামনে দাঁড়িয়ে শিলা বলল, আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম শুভর কাছে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। যে ছেলে এভাবে বিয়ে করতে পারে তার বুকের পাটা বেশ চওড়া। তোমাদের কথায় বউ সে ছেড়ে দেবে না।
মামুন বলল, এটা যে আমিও না বুঝেছি তা নয়। তবু গেলাম। চেষ্টা একটু করে দেখলাম। ছোকরাটিকে আমার একটু বোঝার দরকার ছিল, বুঝলাম।
কী বুঝলে?
লোভে পড়ে কাজটা করেছে।
তা আমারও মনে হয়েছে।
লোভ হচ্ছে তিনটি। প্রথমত, সেতু আমাদের একমাত্র বোন। এত বড় ফ্যামিলির একমাত্র মেয়ে, তাকে যে বিয়ে করবে প্রচুর জায়গা সম্পত্তির মালিক হবে সে।
সেতু দেখতে খুব সুন্দর এটাও একটা কারণ।
এটা হচ্ছে তৃতীয় কারণ।
দ্বিতীয় কারণটা কী?
দ্বিতীয় কারণটি হল, ছোকরাটি খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সেতুকে পাওয়া মানে, জাতে উঠে গেল সে।
শিলা ঠোঁট উল্টে বলল, আমার মনে হয় না এতকিছু ভেবে কাজটা সে করেছে।
মামুন বলল, আমার মনে হয় ভেবেই করেছে।
কিন্তু এখন কী করবে?
দেখি কী করা যায়!
.
বিষণ্ণ মুখে শুয়ে আছে সেতু।
খুবই নরম ভঙ্গিতে তার রুমে এসে ঢুকল মুন্নি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেতুকে কয়েক পলক দেখল। তারপর তার পাশে এসে বসল। ফুপি, তোমার কি শরীর খারাপ?
সেতু শান্ত গলায় বলল, না।
তাহলে সারাক্ষণ শুয়ে থাক কেন? রুম থেকে বেরও না, কারও সঙ্গে কথা বল না। কী হয়েছে?
কিছু না।
তুমি কি কারও ওপর রাগ করেছ?
না মা।
হাত বাড়িয়ে মুন্নির একটা হাত ধরল সেতু। তুই এখন যা। কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না।
মুন্নি দেখতে পেল কথা বলতে বলতে জলে চোখ ভরে আসছে সেতুর। হয়ত চোখের জল লুকোবার জন্যই পাশ ফিরল সে।
মুন্নি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মন খারাপ করে সেতুর রুম থেকে বেরিয়ে এল।
.
বাবলু বলল, পঞ্চাশটা টাকা দাও মা।
আনমনা ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে শিলা। ছেলের কথা শুনে তার দিকে তাকাল। কেন?
কম্পিউটার ডিস্ক কিনব।
এখন হবে না। পরে।
বাবলু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল।
শিলা বিরক্ত হল। বললাম তো পরে দেব। তারপরও দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
বাবলু চিন্তিত গলায় বলল, তোমাদের কী হয়েছে?
কী হবে?
সবাই কী রকম চেঞ্জ হয়ে গেছ। আমি টাকা চেয়েছি আর তুমি দাওনি এমন কখনও হয়নি।
হয়নি, আজ হল। এসব নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। যা এখান থেকে।
বাবলু এবার একটু রাগল। এত বাজে বিহেভ করছ কেন? তুমি না বললেও যাব।
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল বাবলু।
শিলা বলল, শোন।
বাবলু ঘুরে দাঁড়াল। বল।
টাকা নিয়ে যা।
শিলা উঠল।
বাবলু বলল, লাগবে না।
.
রাতেরবেলা খেতে বসে টুপলু বলল, ফুপি এখন আমাদের সাথে খেতে বসে না কেন?
এ বাড়ির নিয়ম হচ্ছে রাতেরবেলা সবাই এক সঙ্গে খেতে বসে। ডাইনিং রুমের বিশাল টেবিলে মামুন, শিলা, স্বপন, রেখা, সেতু এবং বাবলু মুন্নি টুপলু। কদিন ধরে সবাই থাকে শুধু সেতু থাকে না। তার চেয়ারটা খালি।
আজ সেই চেয়ারের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল টুপলু।
শুনে মেয়ের দিকে তাকাল রেখা। চুপ কর।
সঙ্গে সঙ্গে টুপলুর পক্ষ নিল মুন্নি। কেন চুপ করবে? ঠিকই তো বলেছে। ফুপিকে তোমরা ডাকো না কেন?
ব্যাপারটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করল শিলা। সেতুর শরীর খারাপ। ডাকলেও সে আমাদের সঙ্গে খেতে আসে না। এজন্য ওর খাবার ওর রুমেই পাঠিয়ে দিই।
বাবলু বলল, মিথ্যে কথা বলছ কেন? কে বলছে ফুপির শরীর খারাপ?
বাবলুর কথা বলার ভঙ্গিতে রেগে গেল স্বপন। চোপ। মায়ের মুখে মুখে তর্ক করছ। তোর মা যা বলেছেন তাই ঠিক। কোনও কথা বলবি না। চুপচাপ খেয়ে নে।
সেতুর কথা ওঠার পর থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন মামুন। খাবার নাড়াচাড়া করছিলেন কিন্তু মুখে দিচ্ছিলেন না। এখন ব্যাপারটা খেয়াল করল শিলা। বলল, কী হল।
মামুন মন খারাপ করা গলায় বলল, কী?
খাচ্ছ না কেন?
খেতে ইচ্ছে করছে না।
প্লেট সরিয়ে উঠে দাঁড়াল মামুন। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকল।
খানিক পর এই রুমে এসে ঢুকল স্বপন। মামুনের মুখোমুখি বসল। সঙ্গে সঙ্গে মাঝখান থেকে কথা বলতে শুরু করল মামুন। ওর মুখ দেখতে আমার ইচ্ছে করে না। এজন্য ওর সামনে আমি যাই না।
স্বপন বলল, কিন্তু আমরা যেমন চুপচাপ বসে আছি, এভাবে বসে থাকলে সেতু ভাববে ব্যাপারটা আমরা মেনে নিচ্ছি।
তা ভাববার কোনও কারণ নেই। মাথায় যদি ঘিলু থাকে তাহলে বুঝবে, বাড়িতে ওকে এক রকম বন্দি করে রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছাড়া কাজটা আমরা করিনি।
সবকিছু মিলিয়ে আমার যে কী রাগ লাগছে ভাইয়া! বোন না হয়ে ও যদি আমার ছোট ভাই হত, ওকে এমন মারতাম আমি!
একটু থামল স্বপন। মামুনের মুখের দিকে তাকাল। ভাইয়া, ওই বদমাশটাকে একটা মার দিয়ে দিই।
মামুন গম্ভীর গলায় বলল, না না, মারামারি করা ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না?
এককান দুকান করে কথাটা ছড়িয়ে যাবে। আমি চাই না কিছুতেই এসব কথা বাইরের কেউ শুনুক। বাইরের কাউকে জানাতে চাইলে তোকে নিয়ে নিজেই ওদের বাড়িতে যেতাম না। অন্য কাউকে পাঠাতাম।
স্বপন তার স্বভাব মতো রাগল। এখন তাহলে কী করব? হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব?
সঙ্গে সঙ্গে স্বপনকে ধমক দিল মামুন। চোপ। কোনও বাড়াবাড়ি করবি না। আমি যা বলব তাই হবে।
স্বপন থতমত খেয়ে মাথা নিচু করল, সরি ভাইয়া।
মামুন এবার নরম হল। মাথা গরম করে সব কাজ করা যায় না। নোংরা যত ঘাটবি ততো দুর্গন্ধ বেরুবে। কাজ করতে হবে অন্যভাবে। বোস, কী করতে হবে বলছি।
.
সকালবেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেতু। ছোট্ট টেবিলে নাস্তা পড়ে আছে। সেতু ছুঁয়েও দেখেনি।
সেতুর রুমে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে অবাক হল রেখা। বলল, নাস্তা খাওনি কেন?
সেতু কথা বলল না। যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাকিয়ে রইল।
রেখা বলল, কাল রাতে ভাতও খাওনি শুনলাম। এভাবে চললে তো অসুখ হয়ে যাবে।
গভীর অভিমানের গলায় সেতু বলল, আমি চাই আমার অসুখ হোক। আমি চাই আমি মরে যাই।
এসব ছেলেমানুষির কোনও মানে নেই। এমনিতেই এমন ছেলেমানুষি করেছ, এত সুন্দর ফ্যামিলিটাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছ। নতুন করে আর কোনও ঝামেলা করো না।
কথা বলতে বলতে সেতুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে রেখা। ব্যাপারটা পাত্তা দিল না সেতু। বলল, যা বলতে এসেছ তাই বল। অন্য কথা বলে কোনও লাভ নেই।
রেখা একটু বিরক্ত হল। কোনও কথা বলতেই তোমার কাছে আমি আসতে চাইনি। তোমার ভাই আমাকে পাঠিয়েছেন।
কেন?
যা করে ফেলেছ তার একটা সমাধান তোমার ভাইরা করতে চান।
একথায় মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল সেতুর। শুভকে তারা মেনে নেবে?
না।
উজ্জ্বল মুখ আগের মতো ম্লান হল সেতুর। তাহলে?
শুভকে তোমার ছেড়ে দিতে হবে।
মানে?
ডিভোর্স করতে হবে তাকে।
শ্লেষের হাসি হাসল সেতু। তাই নাকি! কিন্তু ভাইয়াদের ভাবনাটা ঠিক হয়নি। ডিভোর্স করার জন্য শুভকে আমি বিয়ে করিনি। ভালবেসে যাকে বিয়ে করেছি মৃত্যু ছাড়া তার কাছ থেকে আমাকে কেউ সরাতে পারবে না। কথাটা ভাইয়াদেরকে তুমি বলে দিও।
অফিসে যাওয়ার আগে শিলার মুখে কথাগুলো শুনল মামুন। শুনে অবাক হল। তাই নাকি? একথা বলেছে?
শিলা বলল, রেখা তো তাই বলল!
রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে থাপড়ে ওর দাঁতগুলো ফেলে দিই।
নিজের বোনটিকে যত সহজ তুমি মনে কর তত সহজ সে নয়।
আমার ধারণা ছিল, সামান্য অ্যাফেয়ার ট্যাফেয়ার হওয়ার পর সেতু ফসকে যেতে পারে ভেবে ছোকরাটা ওকে পটিয়ে পাটিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। ছোকরাটার সঙ্গে কথা বলে আমার তাই মনে হয়েছে।
ঠিক না।
মানে?
আমার ধারণা দুজনেই তখন সিরিয়াস ছিল। সেতু যে ধরনের মেয়ে, তাকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলা সম্ভব নয়। সবদিক ভেবেই কাণ্ডটা সে করেছে।
মামুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কিন্তু ডিভোর্স ওই ছোকরাকে সেতুর করতেই হবে। ওর কাছে সেতুকে আমরা কিছুতেই দেব না। রেখা কথা বলেছে, এখন বলবে তুমি। দেখা যাক কতদিন সে আমাদের কথা না শুনে পারে।
কিন্তু শিলাকে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেল সেতু। বলল, আমি জানি তুমি কী বলতে এসেছ।
শিলা বলল, তুমি অনেক কিছুই জানো। আমার ধারণার চে’ তুমি অনেক বেশি চালাক। তোমার সঙ্গে কোনও কিছুতেই আমি কিংবা রেখা পারব না।
পারবে না তো আস কেন?
আসতে চাই না। তোমার ভাইরা আমাদেরকে বাধ্য করেন।
উষ্ণ সুরে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই নরম হল শিলা। সেতুর কাঁধে হাত দিল। আমরা কেউ তোমার খারাপ চাই না। রাজকন্যার মতো মানুষ হয়েছ তুমি। আমরা চাই সারাজীবন রাজকন্যা হয়েই থাক তুমি। জীবনটা সুখে আনন্দে কাটাও।
যদি তাই চাও তাহলে শুভকে তোমরা মেনে নাও।
তা আমরা নেব না। কারণ ওরা হতদরিদ্র।
পৃথিবীর সবাই কি বড়লোক হয়ে জন্মাবে?
না তা জন্মাবে না।
তাহলে?
ওদের সঙ্গে আমাদের স্ট্যাটাসেও মিলবে না।
টাকা ছাড়া তোমাদের আবার স্ট্যাটাস কী?
একথায় রেগে গেল শিলা। তর্ক করো না। ধরে নাও টাকাই আমাদের স্ট্যাটাস। আজকালকার দিনে টাকা ছাড়া কিছু হয় না। সামান্য চাকরি বাকরি করে ওই ছেলে তোমাকে নিয়ে চলতে পারবে না। এসব ছেলেমানুষি ছেড়ে দাও। সংসারে অভাব দেখা দিলে ভালবাসা থাকে না।
সেতু মৃদু হাসল। এখন যদি আমাদের সংসারে অভাব দেখা দেয়, তুমি কি আমার ভাইয়াকে ছেড়ে চলে যাবে? তোমার ভালবাসা কি নষ্ট হয়ে যাবে?
আমাদের সঙ্গে ওকে তুমি জড়াচ্ছ কেন?
জড়াচ্ছি এজন্য, তুমি তোমার স্বামীকে যেমন ভালবাস, আমিও আমার স্বামীকে তেমন ভালবাসি। কোনও অবস্থাতেই ওকে আমি ছাড়ব না। বেঁচে থাকব ওর হাত ধরে, মরে যাব ওর হাত ধরে।
সেতুর এসব কথা শুনে খুবই বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে ফিরল শিলা। মামুন তখনও বেরুয়নি। শিলাকে দেখে বলল, কী হল?
শিলা ঝাঁঝাল গলায় বলল, তোমার বোনের কাছে আমাকে আর কখনও পাঠাবে না।
কেন? সেতু কি তোমার সঙ্গে কোনও দুর্ব্যবহার করেছে?
দুর্ব্যবহার না। যুক্তি দিয়ে চটাং চটাং কথা বলেছে। ওসব কথার জবাব দেয়া মুশকিল। যার সঙ্গে কথায় পারব না তার কাছে আমি যেতে চাই না।
সংসারে কোনও জটিলতা দেখা দিলে বড়দেরকেই সামলাতে হয়। তুমি বাড়ির বড় বউ, কিছু ঝক্কি ঝামেলা তোমাকে সামলাতেই হবে।
এটা বোধহয় সামলানো যাবে না।
কেন?
সেতু খুব সিরিয়াস। কিছুতেই তোমাদের কথা সে শুনবে না।
বল কী? তাহলে?
শিলা গম্ভীর গলায় বলল, একটাই পথ আছে।
কী?
সে পথে চললে সমস্যাটা সহজেই মিটিয়ে ফেলা যায়।
মামুন অধৈর্যের গলায় বলল, কিন্তু পথটা কী?
শুভকে মেনে নাও।
মামুন থতমত খেল। শিলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কথা শুনে খুবই রেগে যাওয়া উচিত আমার। কিন্তু আমি এখন রাগব না। শোন সেতুর জায়গায় যদি তোমার মুন্নি হতো তাহলে কি এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে তুমি?
একথায় আবার বিরক্ত হল শিলা। তুমি এবং সেতু একরকম। কথায় কথায় যুক্তি দাও। আমিও যুক্তি দিচ্ছি। মুন্নির ক্ষেত্রে এরকম হলে আমি কখনও হাল ছেড়ে দেব না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে মেয়েকে ফিরিয়ে আনব। কারণ সে আমার মেয়ে আর সেতু হচ্ছে ননদ। মেয়ে আর ননদ এক নয়।
শিলার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে তার কাঁধে হাত দিল মামুন। অনুরোধের গলায় বলল, আমার জন্য, শুধু আমার জন্য মুন্নি এবং সেতুকে তুমি এক ভাব। সেতুকে তুমি ফেরাও। আমি বেঁচে থাকতে ওর জীবনটা যেন নষ্ট না হয়।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল মামুন। স্বামীর চোখের জল দেখে মনটা অন্যরকম হয়ে গেল শিলার।
৭. বারান্দায় মামুনকে দেখে
বারান্দায় মামুনকে দেখে এগিয়ে এল স্বপন। ভাইয়া, তুমি কি লইয়ারের সঙ্গে কথা বলেছ? পেপারস রেডি করেছ?
মামুন গম্ভীর গলায় বললেন, না।
কেন?
লজ্জা করছে।
লজ্জা করছে মানে? কীসের লজ্জা?
ড্রয়িংরুমে চল। বলছি।
ড্রয়িংরুমে এসে মুখোমুখি বসল দুভাই।
মামুন বলল, ল ইয়ারও তো পরিচিত মানুষ!
কথাটা বুঝতে পারল না স্বপন। বলল, তাতে কী হয়েছে?
আমাদের ফ্যামিলির এমন একটা কেলেঙ্কারির কথা সে জেনে যাবে।
শুনে বিরক্ত হল স্বপন। খুবই ছেলেমানুষি কথা বললে ভাইয়া।
কী রকম?
সমস্যাটা এমন, এটা মিটাতে হলে কাউকে না কাউকে ব্যাপারটা বলতেই হবে। কিছু কিছু মানুষ এটা জানবেই।
তা ঠিক।
তাছাড়া এই ধরনের কাণ্ড অনেক ফ্যামিলিতেই হয়। সেতুর বয়স কম। সে একটা ভুল করে ফেলেছে। এটা খুব বড় কোনও লজ্জার ব্যাপার নয়। লজ্জার ব্যাপার হবে যদি ব্যাপারটা আমরা মেনে নিই। সেই ছোকরার কাছে যদি সেতুকে….
কিন্তু সেতুকে ম্যানেজ করবি কী করে? সে তো কোনও কথা শুনছে না।
যেমন করেই হোক, ওকে বাধ্য করতে হবে। রেখা এবং ভাবী কথা বলেছে। এখন আমি বলব।
স্বপন সেতুর সঙ্গে কথা বলবে শুনে মামুন কেমন ভয় পেয়ে গেল। না না, তোর বলার দরকার নেই।
কেন?
তুই রগচটা ধরনের। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে ওর গায়ে হাত টাত তুলে ফেলতে পারিস।
স্বপন হাসল। না, তা তুলব না। যত রাগই হোক, নিজেকে কন্ট্রোল করব।
সেতুর রুমে এসে সত্যি সত্যি নিজেকে খুবই সংযত রাখল স্বপন। সে এসে সেতুর মুখোমুখি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে সেতু বলল, তুমি কেন এসেছ?
তুই জানিস কেন এসেছি।
কিন্তু যা বলার ভাবীদেরকে আমি বলে দিয়েছি।
কী বলেছিস?
ওসব নিয়ে তোমার সঙ্গে আমি আর কথা বলতে চাই না।
সেতুর চোখের দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় স্বপন বলল, তুই এমন হয়ে গেলি কী করে? আমরা দুটো ভাই কত কষ্টে, কত আগলে আগলে তোকে বড় করেছি। জীবনে কখনও তোর সঙ্গে ঝগড়া করিনি, তোকে একটা ধমক দিইনি। তুই হচ্ছিস আমাদের জান, নয়নের মণি। সেই তুই কোথাকার কার জন্য আমাদের সবাইকে এভাবে সাফার করাচ্ছিস। এই ফ্যামিলির জন্য, আমাদের কারও জন্য কি তোর একটুও টান নেই? একটুও মায়া নেই আমাদের কারও জন্য?
এবার সেতুও তাকাল স্বপনের চোখের দিকে। কথাটা যদি উল্টো করে আমি তোমাদেরকে বলি?
বল শুনি।
আমি তোমাদের একমাত্র বোন। আমার পছন্দে আমি আমার জীবনের সবচে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। যার সঙ্গে নিজের জীবন জড়িয়েছি, তোমাদের বিবেচনায় সে যেমনই। হোক, আমার বিবেচনায় সে ই আমার জন্য প্রকৃত মানুষ। আমার কথা ভেবে, আমার সুখ শান্তির কথা ভেবে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে তোমরা মেনে নিলেই পার! তা করছ না কেন?
করছি না তোর কথা ভেবেই। তোকে সন্তানের চে’ বেশি ভালবাসি বলে।
তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
তোর বয়স কম। এই বয়সে আবেগতাড়িত হয়ে চলে মানুষ। কিন্তু জীবন অনেক বড়। কাঁচা আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। যাকে নিয়ে সমগ্র জীবন কাটাতে চাস তুই, আমরা মনে করি জীবনটা তার সঙ্গে সুখে আনন্দে কাটাতে তুই পারবি না।
কেন? তার অসুবিধা কী?
তুই জানিস অসুবিধাগুলো কী?
টাকা, স্ট্যাটাস এসব বোঝাতে চাইছ তো?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমার কাছে এসব একেবারেই মূল্যহীন।
কেন?
একজন মানুষকে সুখে আনন্দে জীবন কাটাতে হলে দরকার তার জীবনসঙ্গীর একটি সুন্দর মন আর গভীর ভালবাসা। আমাদের দুজনেরই তা আছে। আমাদের আর কিছু লাগবে না।
লাগবে, অবশ্যই আরও অনেক কিছু লাগবে। বোঝালেও এখন তুই তা বুঝতে চাইবি না।
সেতু কাতর গলায় বলল, ভাইয়া, সবকিছু বুঝেই কাজটা আমি করেছি। এভাবে বিয়ে হোক শুভ চায়নি। সে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে। আমি বুঝতে চাইনি। কারণ আমি জানতাম এভাবে না হলে ওকে আমি কোনওদিন পাব না।
তারপর কেমন ভেঙে পড়ল সেতু। ওর কাছ থেকে আমাকে সরাবার একটিই পথ আছে ভাইয়া। আমাকে তোমরা মেরে ফেল।
সেতুর ভেঙে পড়া একদমই পাত্তা দিল না স্বপন। নিঃশব্দে উঠে ড্রয়িংরুমে চলে এল। এভাবে হবে না ভাইয়া।
সোফায় বসা মামুন নড়েচড়ে উঠল। তাহলে কীভাবে হবে?
অন্য কোনও একটা পথ বের করতে হবে।
কী পথ?
সেতুকে আমরা কেউ কিছুই আর বলব না। বাড়িতে যেভাবে সে আছে সেভাবেই থাকবে। তবে চোখ রাখতে হবে কিছুতেই যেন বাড়ি থেকে বেরুতে না পারে।
বুঝলাম কিন্তু আসল কাজটা হবে কীভাবে?
ছোকরাটাকে প্রেসারে ফেলতে হবে। বা তার চেয়েও বেশি কিছু।
মানে?
শীতল, গম্ভীর গলায় স্বপন বলল, ওকে মেরে ফেলতে চাই।
মামুন একেবারে আঁতকে উঠলেন। কী বলছিস তুই?
ঠিকই বলছি।
না না।
এছাড়া কোনও উপায় নেই ভাইয়া।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? একটা মানুষ খুন করে ফেলবি?
আমি নিজে করব না।
তাহলে?
একজন প্রফেসনাল মার্ডারার ঠিক করব। দুচার লাখ টাকার বিনিময়ে কাজটা সে করে দেবে। এমনভাবে করবে, কেউ কিছু বুঝতেই পারবে না।
মামুন ভয়ার্ত গলায় বলল, না না, এসব করা ঠিক হবে না।
স্বপন বলল, তুমি আমাকে বাধা দিও না ভাইয়া। তুমি চুপচাপ থাক। দেখ কী সুন্দরভাবে ব্যাপারটা আমি ম্যানেজ করি। সাপ মারা এবং লাঠি না ভাঙার কাজটা আমি খুব ভাল জানি।
স্বপন আর দাঁড়াল না।
.
লালু খুবই কায়দার সানগ্লাস পরতে পছন্দ করে।
সানগ্লাস পরে মোটর সাইকেল চালাবার সময় সে যতটা না মাস্তান তার চেয়েও বড় মাস্তান মনে হয়। পেছনে দিলুকে সে রাখেই। লালুর সর্বক্ষণের চামচা দিলু। লালুর সঙ্গে দিলুর নামেরও খুব মিল। খুঁজে পেতে চামচাটা লালু ভালই যোগাড় করেছিল।
সেই চামচা নিয়ে লালু এখন মোটর সাইকেল চালাচ্ছে। মাঝারি ধরনের স্পিডে মোটর সাইকেল চালাবার অভ্যেস তার। ফলে ঠিক সময়ের মিনিট দশেক পরে মামুন স্বপনের অফিসের সামনে এসে পৌঁছাল সে। মোটর সাইকেল লক করে অফিসে ঢুকল এই বিল্ডিংয়ের মালিকের ভঙ্গিতে। স্বপনের রুমে ঢুকল মহাভাব ধরে।
স্বপন রুমেই ছিল, লালুকে দেখে উৎফুল্ল হল। এস লালু, এস।
লালু কোনও কথা বলল না, স্বপনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল। দিলু দাঁড়িয়ে রইল তার পিঠের কাছে।
কোনও ভণিতা না করে স্বপন বলল, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে লালু।
লালু নির্বিকার গলায় বলল, জানি।
শুনে চমকে উঠল স্বপন। কী করে জানো?
কাজ ছাড়া আপনাদের মতো লোকরা আমাদেরকে ডাকে না।
ও তাই বল।
কাজের সাইজ কেমন? হাঁড়ি না বোতল?
কথাটা বুঝতে পারল না স্বপন। বলল, মানে?
বড় না ছোট? কী ধরনের কাজ?
একটু সময় নিয়ে বলতে হবে।
তারপর দিলুর দিকে তাকাল, তোমার সঙ্গে কে?
জিনিসটার নাম দিলু। আমার চামচ।
চামচ মানে?
স্বপনকে একটা ধমক দিল লালু। ধুৎ মিয়া! আপনে তো আমার ল্যাংগুয়েজই বোঝেন না। খালি মানে মানে করেন। চামচ মানে হচ্ছে চামচা। লেজুড়, ট্যান্ডল। অর্থাৎ আমি যা বলব সেই কাজই করবে।
স্বপন আশ্বস্ত হল, বুঝেছি।
বোঝেন নাই। জিনিসটা দেখতে যোবার মতন। অর্থ হচ্ছে দিলু কথায় একদমই বিশ্বাস করে না। কাজ, শুধু কাজে বিশ্বাস করে। কথা বলার আগেই মার্ডার করে দেয়। খুবই চিকন হারামি জিনিস।
দিলুর গুণপনা শুনে স্বপন একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। এরকম লোকই আমার দরকার। ব্যাপারটা তাহলে খুলে বলি তোমাদেরকে। তবে একেবারেই সিক্রেট ব্যাপার। তোমরা দুজন ছাড়া কাকপক্ষীটিও যেন টের না পায়।
কাকপক্ষী শব্দটা বুঝল না লালু। চিন্তিত চোখে স্বপনের দিকে তাকাল। কাকপক্ষী জিনিসটা কী?
কাক, কাক।
বুঝেছি, কাউয়া।
তারপর একটু থেমে বলল, তবে কথা শুরুর আগে দুই প্যাকেট বেনসন আনান। চা আমি আজকাল খাই না। দুই বোতল ঠাণ্ডা আনান। আর কিছু ক্যাশ মাল টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর বলেন মার্ডারটা কবে করতে হবে?
এবারও স্বপন খুব অবাক হল। মার্ডার করতে হবে বুঝলে কী করে?
কথার সাইজে বোঝা যায়।
ঠিক তখুনি ট্রেতে করে তিন কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে স্বপনের রুমের সামনে এসেছে পিয়ন আলী। বন্ধ দরজা ঠেলে মাত্র ঢুকবে, ভেতর থেকে লালুর গলা শুনতে পেল। যাকে মার্ডার করতে হবে তার নাম কী?
মার্ডার শব্দটা শুনে পাথর হয়ে গেল আলী। ভেতরে না ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে। ভেতরের সব কথা শুনতে লাগল।
স্বপন বলল, ছোকরাটির নাম শুভ।
থাকে কোথায়?
সব তোমাকে চিনিয়ে দেব।
ঠিক আছে, এখন ঠাণ্ডা আর বেনসন আনান।
স্বপন বেল বাজাল, সেই শব্দে দরজার সামনে দাঁড়ান আলী চমকে উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। স্বপন অবাক হল, বেল বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে তুই ঢুকলি কী করে? কোথায় ছিলি?
চট করেই ব্যাপারটা মনে করল আলী। লালু এবং দিলুকে দেখিয়ে হাসিমুখে বলল, স্যারদের দেখলাম আপনার রুমে ঢুকতে, দেখেই চা বিস্কুট নিয়ে আসছিলাম। আপনার রুমের দরজায় মাত্র এসেছি, বেলটা বাজল।
শীতল চোখে আলীর দিকে তাকাল লালু। তোমার মাথায় ঘিলুটা একটু বেশি।
জ্বি?
বেশি ঘিলু থাকা ভাল না। হিঙ্গুল চেন, হিঙ্গুল? সর্দি হলে মানুষের নাক দিয়ে পড়ে। যাদের মাথায় ঘিলু বেশি তাদের মাথায় ভাল করে একটা কিল দিলে ঘিলুটা হিঙ্গুলের মত নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে। আমার এখন ইচ্ছে করছে তোমার মাথায় একটা কিল দিই?
কেন স্যার?
চা বিস্কুট নিয়ে আসার আগে তোমার বোঝা উচিত ছিল এই মাল সবাই খায় না।
তারপর ধমকের সুরে বলল, যাও ঠাণ্ডা নিয়া আস। আর দুই প্যাকেট বেনসন।
সঙ্গে সঙ্গে স্বপন বলল, হ্যাঁ, এজন্যই তোকে ডেকেছিলাম, যা, তাড়াতাড়ি যা।
হাতে ধরা চা বিস্কুটের ট্রে নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল আলী, স্বপন বলল, আমার চাটা দিয়ে যা। আমি চা ই খাব।
বিনীত ভঙ্গিতে স্বপনের সামনে এককাপ চা নামিয়ে রাখল আলী।
.
হোটেল লবিতে আলীকে বসে থাকতে দেখে খুবই অবাক হল নাহিদ। কী রে আলী, তুই এলি কোত্থেকে?
আলী উঠে দাঁড়াল। আপনার খোঁজে এসেছি।
কী করে জানলি আমি এই হোটেলে থাকি?
কার কাছে যেন শুনেছিলাম ঢাকায় এলে এই হোটেলেই থাকেন আপনি।
ঠিকই শুনেছিস।
কিন্তু আজ আছেন কি না জানতাম না। আন্দাজের ওপর এলাম।
বা, বা।
দুজনে মুখোমুখি বসল।
নাহিদ বলল, খবর কী বল। চাকুরি বাকরি করছিস না?
জ্বি করছি।
আগেরটাই?
জ্বি।
আজ অফিসে যাসনি?
না।
কেন?
ছুটি নিয়েছি।
তীক্ষ্ণচোখে আলীর দিকে তাকাল নাহিদ। তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ না কি?
না শরীর ঠিকই আছে।
তাহলে?
টেনশনে ছিলাম।
কীসের টেনশন?
আপনাকে পাই কি না? না পেলে কীভাবে কী করব ওসব ভেবে চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে। তাছাড়া আমার ধারণাটা ঠিক কি না, যার নাম শুনেছি সে আপনার বন্ধুই কি না তাও বুঝতে পারছিলাম না।
আলীর কথা বুঝতে পারল না নাহিদ। বলল, কী হয়েছে?
আপনার একজন বন্ধু আছে না শুভ নামে?
হ্যাঁ, খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কী হয়েছে শুভর?
আপনি বলতে পারবেন কি না জানি না, আমার অফিসের দুই মালিক মামুন সাহেব, স্বপন সাহেব….
আলীর কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তেজিত হল নাহিদ। হ্যাঁ, হ্যাঁ শুভর সঙ্গে ওরা রিলেটেড।
এবার আলীও উত্তেজিত হল। তাহলে ঠিক ধারণাই করেছি আমি। ঠিক জায়গাতেই এসেছি।
কী হয়েছে বল আমাকে।
আপনার বন্ধুর জন্য খুব খারাপ একটা খবর আছে। কিন্তু এরকম খোলামেলা জায়গায় বসে ওসব কথা আমি বলতে চাই না।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল নাহিদ। তাহলে আমার রুমে চল।
চলুন।
ওরা দুজন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
.
নাহিদের কথা শুনে লাফিয়ে উঠল শুভ, কী? মেরে ফেলবে আমাকে? মাস্তান লাগিয়েছে আমার পেছনে?
নাহিদ বেশ নার্ভাস। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তাই তো শুনলাম। তিনদিন হল ঢাকায় এসেছি। আজ বিকেলের ট্রেনে চলে যাওয়ার কথা। এসব শুনে আর যেতে পারলাম না।
কিন্তু তুই শুনলি কার কাছে?
শুভর বিছানায় বসল নাহিদ। এও এক অদ্ভুত যোগাযোগ। সেতুর ভাইদের অফিসে আমার একটা পরিচিত ছেলে পিয়নের কাজ করে। এক সময় ছেলেটাকে আমি একটু সাহায্য করেছিলাম। সে জানে তুই আমার বন্ধু। সেতুর ছোট ভাইর রুমে চা দিতে ঢুকে তোর নাম এবং মার্ডার শব্দ দুটো সে শুনে ফেলেছে। ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝেনি। কিছু একটা অনুমান করে আমার হোটেলে এসেছে, আমাকে বলেছে। এইটুকু শুনেই যা বোঝার বুঝে গেছি আমি।
শুভ গম্ভীর গলায় বলল, ওরা আমাকে খুবই আন্ডারএস্টিমেট করেছে।
মানে?
বাড়ি এসে ডিভোর্সের জন্য ধমক দিয়ে গেছে। এখন লাগিয়েছে মাস্তান। ভেবেছে মাস্তান ফাস্তানদের কথা শুনে ভয়ে সেতুকে আমি ছেড়ে দেব। কোন মাস্তান লেগেছে আমার পেছনে, তাদেরকে আমি একটু দেখতে চাই।
মাথা গরম করিস না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হয়।
মাথা বোধহয় আমি আর ঠাণ্ডা রাখতে পারব না।
কেন?
সীমাহীন বাড়াবাড়ি করছে ওরা। সেতুকে বাড়িতে আটকে রেখেছে। নিশ্চয় খুব মেন্টাল প্রেসারে রেখেছে ওকে। তার ওপর আমার পেছনে লাগিয়েছে মাস্তান। আমি ওদেরকে ছাড়ব না, আমি ওদেরকে দেখে নেব।
কী কাজে শুভর রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মা, শুভর উত্তেজিত গলা শুনে কী রকম সন্দেহ হল তার। আড়াল থেকে শুভর শেষ দিককার কথা কিছুটা শুনে ফেললেন, শুনে সুরমাকে খুঁজতে ডাইনিং স্পেসের দিকে চলে এলেন। নিজের রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল সুরমা। মা ডাকলেন, বউমা, শোন।
সুরমা এসে তার সামনে দাঁড়াল, জ্বি মা।
মা ভয়ার্ত গলায় বললেন, আমার খুব ভয় করছে বউমা, খুব টেনশন হচ্ছে।
সুরমা অবাক হল। কেন? হঠাৎ কী হল আপনার?
শুভর পেছনে কারা নাকি মাস্তান লাগিয়ে দিয়েছে।
শুনে সুরমাও ভয় পেল। কী?
হ্যাঁ।
কে বলল আপনাকে?
আমি নিজ কানে শুনেছি। শুনেই আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। নিশ্চয় শুভ কোথাও কিছু একটা ঝামেলা করেছে। কিছুদিন ধরে ওকে বেশ চিন্তিত দেখি। সেদিন কারা যেন ওর কাছে এসেছিল।
সুরমা চিন্তিত গলায় বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কারা মাস্তান লাগাবে শুভর পেছনে? কী করেছে ও?
আমি জিজ্ঞেস করলে কোনও কথাই ও আমাকে বলবে না। তুমি ওর সঙ্গে কথা বল বউমা, সব জেনে আমাকে জানাও। আমি তারপর শাহিনের সঙ্গে কথা বলি।
মাকে সাহস দিয়ে সুরমা বলল, আপনি এত টেনশন করবেন না। আমি শুভর সঙ্গে কথা বলব।
শুভর সঙ্গে সুরমা কথা বলল, রাতেরবেলায়।
শুভ বলল, ভেবেছিলাম চুপচাপ থাকব। আস্তেধীরে ব্যাপারটা ঠিক হয়ে আসবে। কিন্তু ওরা আমাকে চুপচাপ থাকতে দিচ্ছে না। আমিও দেখব কোন মাস্তান কী করে আমার।
সুরমা বলল, সেতুর ভাইরা এই ধরনের কাজ করবে এ আমি ভাবতেই পারছি না।
কাজটা ওর ছোট ভাই করেছে। সে নিজেও মাস্তান টাইপের।
এসব তোর আগেই ভাবা উচিত ছিল।
শুভ অবাক হল। কী বলছ ভাবী? ঠিকই বলছি।
না ঠিক বলছ না। কার ভাই মাস্তান, কার কত টাকা আছে ওসব ভেবে কেউ কারও সঙ্গে প্রেম করে? ভালবাসার সাথে এসব বিষয়ের কী সম্পর্ক?
কিন্তু এখন সামলাবি কী করে?
দেখি।
মাস্তানরা তোর যদি কোনও ক্ষতি করে?
কী ক্ষতি করবে?
আজকাল কত রকমের কাণ্ড হয়।
কিছু হবে না। কেউ কিছুই করতে পারবে না আমার। সেতু আমার বিয়ে করা বউ। আইন আমার পক্ষে, দরকার হলে আইনের সাহায্য নেব আমি।
এদিকে বাড়িতেও তো সমস্যা আছে, মা এখনও ব্যাপারটা জানেনই না। তাঁকে ম্যানেজ করাও তো কম ঝামেলার কাজ না।
শুভ নির্বিকার গলায় বলল, নিজেদের বাড়ি নিয়ে এখন আমি আর ভাবছিই না। ওসব তুমি বুঝবে।
সুরমা চিন্তিত চোখে শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
.
সন্ধের পর কখনও কখনও চুপচাপ শুয়ে থাকতে খুব পছন্দ করে শাহিন। টিভি দেখে না, দিনের পুরনো খবরের কাগজ পড়ে না, এমন কি কিছু ভাবেও না।
আজও তেমন করে শুয়ে ছিল।
একসময় সুরমা এসে দাঁড়াল তার সামনে। সেতুর ভাইরা যে মাস্তান লাগিয়ে দিয়েছে শুভর পেছনে সে কথা বলল। শুনে ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল শাহিন। তারপর উত্তেজিত ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে বসল। বল কী?
সুরমা বলল, হ্যাঁ। সব মিলে বেশ বড় রকমের ঝামেলা লেগে গেছে।
তাইতো দেখছি।
শুভর বিয়ের কথা যেদিন তোমাকে বললাম, তোমার উচিত ছিল সেদিনই কথাটা মাকে জানিয়ে দেয়া এবং তাকে ম্যানেজ করা।
আমি ভাবলাম এত তাড়াহুড়োর কী আছে! সময় যাক, আস্তেধীরে মাকে বলব।
এখন তো দুটো দিক সামলাতে হবে। একদিকে মাস্তান, আরেকদিকে তোমার মা।
মাকে নিয়ে আমি ভাবছি না। যত রাগীই হোন, শুভ তো তার ছেলে।
তবু তুমি আগে তাঁকেই ম্যানেজ কর। তারপর পুলিশে জানাও।
পুলিশে?
হ্যাঁ। দুটো ম্যাচিউর ছেলেমেয়ে নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছে, এটা আইনসম্মত। আইন আমাদেরকে সাহায্য করবে।
কিন্তু টাকার জোরে ওদের সঙ্গে আমরা পারব না।
সুরমা একটু বিরক্ত হল, এসব চিন্তা পরে করা যাবে। আগে মাকে ম্যানেজ কর। তিনি খুব টেনশনে আছেন।
সামান্য সময় কী ভাবল শাহিন, তারপর উঠল। চল।
সুরমা অবাক হল। কোথায়?
মার রুমে।
মায়ের রুমে মালাও ছিল। শাহিন কথা শুরু করল মালার দিকে তাকিয়ে। তুই কিছু শুনেছিস?
মা বলল, কী?
শুভর ব্যাপারে।
মালা একটা ঢোক গিলল।
সুরমা বলল, আমি জানি তুমি শুনেছ। বলে ফেল। এখন আর না বলে উপায় নেই।
মা সুরমার দিকে তাকালেন। কী হয়েছে?
সুরমা নয় শাহিন বলল, আমাদের উচিত ছিল আগেই তোমাকে জানানো। কিন্তু তোমার ভয়ে…
এত ভণিতার দরকার নেই। কী হয়েছে পরিষ্কার করে বল।
শুভ বিয়ে করেছে।
কথাটা যেন বুঝতে পারলেন না মা। থতমত খেলেন। কী? কী বললি? শুভ বিয়ে করেছে?
হ্যাঁ।
আমার ছেলে লুকিয়ে বিয়ে করেছে? আমার ছেলে?
মালা বলল, মেয়েটা খুব সুন্দর মা।
মালাকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন মা। চুপ কর, সুন্দর অসুন্দর দিয়ে আমি কী করব? লোকে শুনলে বলবে কী? আমাদের মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিল সে!
সুরমা বলল, এতে মান-সম্মান নষ্টের কী হল? এরকম বিয়ে আজকাল অনেক হয়।
খরচোখে সুরমার দিকে তাকালেন মা। তুমি কথা বলবে না। আমার সামনে একদম কথা বলবে না তুমি। অতিরিক্ত লাই দিয়ে ছেলেটির মাথা তুমি নষ্ট করেছ।
শাহিন বলল, ওর সঙ্গে অযথা রাগ করছ তুমি। ও কি শুভকে বিয়ে করার কথা শিখিয়ে দিয়েছে?
কিন্তু আমার কাছে এসব কথা তোরা লুকিয়ে গেছিস কেন? বাড়ির সবাই জানে, আমি কেন জানি না?
মালা বলল, কথা বললেই যেমন করে ওঠ তুমি, কে যাবে তোমার সঙ্গে কথা বলতে!
মালার কথায় আরও রাগলেন মা, খুঁচিয়ে কথা বলবি না আমার সঙ্গে। আমার মেজাজ খুব খারাপ।
শাহিন শান্ত গলায় বলল, মেজাজ খারাপ করো না মা। বিয়ে করে শুভ না হয় অন্যায় করেছে কিন্তু এখন যে সে বড় রকমের একটা বিপদে পড়েছে তার কী করবে?
শুনে মা একেবারে নিভে গেলেন। কীসের বিপদ?
শুভর পেছনে ওরা মাস্তান লাগিয়ে দিয়েছে। শুভকে মেরে ফেলতে চাইছে।
শাহিনের কথা শুনে নিজের অজান্তেই যেন উঠে দাঁড়ালেন মা। দিশেহারা গলায় বললেন, সর্বনাশ! কোথায়, আমার ছেলে কোথায়?
আর কোনও দিকে তাকালেন না মা। পাগলের মতো শুভর রুমে এসে ঢুকলেন।
চিন্তিত ভঙ্গিতে বিছানায় বসেছিল শুভ। মা এসে অদূরে দাঁড়ালেন। এক পলক মাকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল শুভ।
অপলক চোখে শুভকে খানিক দেখলেন মা। তারপর আস্তেধীরে হেঁটে শুভর সামনে এসে দাঁড়ালেন। শুভর মাথায় হাত দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিশুর ভঙ্গিতে দুহাতে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরল শুভ, মায়ের কোলের কাছে মুখ রেখে হুহু করে কেঁদে ফেলল। আমাকে তুমি মাফ করে দাও মা, আমাকে তুমি মাফ করে দাও।
কোন ফাঁকে যেন শুভর মাথাটা জড়িয়ে ধরেছেন মা। ছেলের কান্নায় তারও চোখ ফেটে কান্না এল।
শুভর রুমে মা এবং ছেলে দুজনেই যখন কাঁদছে ঠিক তখুনি লালুর মোটর সাইকেল এসে থামল এই বাড়ির সামনে। লাইটপোস্টের তলায় মোটর সাইকেল দাঁড় করাল লালু। সঙ্গে সঙ্গে দিলু নামল পেছন থেকে, কিন্তু মোটর সাইকেলের স্টার্ট বন্ধ করার পরও লালু নামল না। সিটে বসেই শুভদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।
নিজের রুমের জানালা থেকে এই দৃশ্যটি দেখে ফেলল মালা। লোক দুটো যে মাস্তান বুঝে ফেলল। তাদের বাড়ির দিকেই যে তাকিয়ে আছে, বুঝে ফেলল, তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
এদিকে নিজেকে একসময় সামলেছে শুভ। শুকনো গলায় মাকে বলছে, মাস্তানদেরকে আমি ভয় পাচ্ছি না মা। ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি ভয়। পাচ্ছিলাম তোমাকে। এমনিতেই তুমি আমাকে দেখতে পার না, তার ওপর এমন একটা কাজ করে ফেললাম।
চোখের জল সামলে মা বললেন, তোকে আমি দেখতে পারি না, একথা কে বলেছে? আমার মেজাজটা একটু খিটখিটে, এজন্য তুই ভাবিস তোকে আমি কম আদর করি। আসলে ছোট সন্তানের জন্য মায়ের টান থাকে সবচাইতে বেশি, আর বাড়ির সবাই যে কথা জেনে যাবে আমি কেন সে কথা জানব না!
এ সময় হাঁপাতে হাঁপাতে মালা ঢুকল। মা, শুভ, আমাদের বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল নিয়ে দুজন মাস্তান দাঁড়িয়ে আছে।
শুনে চমকে উঠলেন মা। সর্বনাশ!
শুভ উঠে দাঁড়ায়, ওরা যে মাস্তান তুই বুঝলি কী করে? চেহারা দেখে বোঝা যায়। আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে! চল তো দেখি।
সঙ্গে সঙ্গে শুভর হাত ধরলেন মা। না, তুই যেতে পারবি না। আমি তোকে ওদের সামনে যেতে দেব না।
শুভ অবাক হল। তোমরা এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি একটু দেখি কোন মাস্তানরা আমার পেছনে লেগেছে।
না না দেখতে হবে না। যদি দেখতে হয় মালার রুমের জানালা থেকে দেখ।
কিন্তু শুভ মালার রুমে আসার আগেই লালু দিলু চলে গেছে।
রাস্তায় কাউকে না দেখে মালার দিকে তাকাল শুভ। বাইরে কোথায় কোন মাস্তান দেখলি আপা? রাস্তায় তো কেউ নেই।
মালা তার জানালা দিয়ে উঁকি দিল। ছিল। রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন নেই।
মা বললেন, মালাকে বোধহয় দেখে ফেলেছিল। এজন্য চলে গেছে।
শুভ হাসল। তোমরা সবাই এত বেশি নার্ভাস হয়েছ, কী বলব! আমি একটু বেরুই। চারপাশটা ঘুরে দেখে আসি।
না, একদম না। আজ রাতে বাড়ি থেকে তুই বেরুতেই পারবি না। চল শাহিনের সঙ্গে কথা বলি। ওর সঙ্গে পরামর্শ করে, যা করার করব।
শুভর সঙ্গে মা কোনও রাগারাগি করেনি দেখে সুরমা এবং শাহিন দুজনেই বেশ উৎফুল্ল। কিন্তু বাড়ির সামনে মাস্তান এসেছিল শুনে দুজনেই চিন্তিত হল।
মা বললেন, আমার খুব নার্ভাস লাগছে।
শাহিন বলল, তা তো লাগারই কথা। কীভাবে ব্যাপারটা সামাল দেব বুঝতে পারছি না।
সুরমা বলল, তুমি কি সেতুর ভাইদের সঙ্গে কথা বলবে?
মনে হয় না এই ধরনের পরিস্থিতিতে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলবে। অযথা অপমান। হওয়ার দরকার আছে?
মা বললেন, তাহলে কী করবি?
ওয়েট করতে চাই। যতদিন যাবে ব্যাপারটা তত স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এদিকে মাস্তানরা যদি শুভর কোনও ক্ষতি করে?
ভাবছি থানায় একটা জিডি করে রাখব।
.
মালা তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে স্বামীকে চিঠি লিখছে, সামনে সেতুর সেই ছবিটা।
ছবিটার দিকে একবার তাকাচ্ছে তারপর আবার লিখছে।
এসময় শুভ এসে দাঁড়াল এই রুমের সামনে। আপা, আসব?
মালা উঠে বসল। আয়।
শুভ ভেতরে ঢুকল। বিছানায় সেতুর ছবি দেখে অবাক হল। এই ছবি দিয়ে কী করছিস?
মালা হাসল। ছবির দিকে তাকিয়ে সেতুর বর্ণনা লিখছিলাম।
বুঝতে পারলাম না। কীসের বর্ণনা?
তোর দুলাভাইকে চিঠি লিখছি। তোর আর সেতুর পুরো ঘটনা লিখে দিয়েছি। সেতু দেখতে কেমন চিঠিতে ওই বর্ণনাই লিখেছি।
আমার এদিকে জান বেরুচ্ছে আর তুই…
ভাইকে সান্ত্বনা দিল মালা। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই এত ভেঙে পড়িস না তো!
একটু থেমে অনুরোধের গলায় মালা বলল, শুভ, সেতুর এই ছবিটা আমি নিই?
কেন?
তোর দুলাভাইকে পাঠাব।
শুভ হাসল। বর্ণনা তো লিখেই দিয়েছিস, ছবি পাঠাবার আর দরকার কী?
বর্ণনা পড়ে হয়ত বুঝতে পারবে না আমার ছোটভাইর বউটি কী পরিমাণ সুন্দর।
তারপর অনুনয়ের গলায় বলল, ছবিটা নেব?
নে। ওর আরও ছবি আমার কাছে আছে।
মালা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। খুব খুশি হলাম।
শুভ কথা বলল না। দরজার দিকে পা বাড়াল।
মালা ডাকল। শোন।
শুভ ঘুরে দাঁড়াল। কী?
আমার সামনে এসে একটু বস।
শুভ নিঃশব্দে মালার সামনে এসে বসল।
মন খারাপ করা সন্তানকে যেভাবে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করেন মা ঠিক সেইভাবে শুভর মাথায় পিঠে হাত বুলাতে লাগল মালা, মায়াবি গলায় বলল, তুই আমার চে’ খুব বেশি ছোট না। তবু ছেলেবেলায় মা তোকে বকলে, তুই যখন খুব মন খারাপ করতি, আমি তোকে কোলে নিতাম। তুই বেশ ভারি ছিলি। তোকে কোলে নিয়ে বেশি দূর হাঁটতে পারতাম না আমি। তবু নিতাম। আমি কোলে নিলেই মনটা তোর ভাল হয়ে যেত। আজ সেসব দিনের মতো তোকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে। আমি কোলে নিলে যদি তোর মনটা ভাল হয়।
মালার কথা শুনে চোখ ছলছল করে উঠল শুভর। এভাবে বলিস না আপা, এভাবে বলিস না। আমার খুব কান্না পাচ্ছে।
ততোক্ষণে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলেছে শুভ। চোখ মুছতে মুছতে তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।
ভাইর জন্য অনেকক্ষণ পর্যন্ত মনটা খারাপ হয়ে রইল মালার।
.
লালু চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে এবং একটা টেবিলে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে দেখে দিলু বলল, এখানে এলি কেন?
লালু নির্বিকার গলায় বলল, গান গাইতে!
তারপর সত্যি সত্যি গান গাইতে লাগল। চাল সাইয়া সাইয়া সাইয়া সাইয়া, চাল সাইয়া সাইয়া সাইয়া…
লালুর মুখোমুখি বসে দিলু বলল, তোর কায়দা কানুন আমি বুঝতেই পারি না।
গরুদের পক্ষে সব কিছু বোঝা সম্ভব না।
তারপরই ছোট্ট একখানা ধমক দিল। এই ব্যাটা রেস্টুরেন্টে লোকে কী করতে আসে?
দিলু সঙ্গে সঙ্গে বলল, খেতে।
আমিও সেই কাজেই আসছি। এখন দাপটের একখানা খাওয়া দেব। আমি রসিয়ে রসিয়ে খাব আর তুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবি।
আবার সেই গান ধরল লালু। চাল সাইয়া সাইয়া…
একজন ওয়েটার এসে দাঁড়াল এই টেবিলের সামনে। অর্ডার দেবেন স্যার?
লালু নির্বিকার গলায় বলল, না।
জ্বি?
কোনও অর্ডার দেব না। তোমার যা মনে হয় নিয়ে আস।
ওয়েটার হাসল, সত্যি স্যার?
একদম সত্যি। যাও।
লোকটি সত্যি সত্যি চলে গেল।
দিলু গাল ফুলিয়ে বলল, তুই কিন্তু আমাকে খুব ইনসাল্ট করেছিস।
লালু অবাক হল। তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তোর কথার ধরনে করেছি।
কী বলেছি আমি?
এত ভাল একটা রেস্টুরেন্টে খেতে এলাম, ঢুকে তুই জিজ্ঞেস করলি, এখানে এলি কেন? তোর সেই কথায় আমি মাইন্ড করেছি। এজন্যই গরু বললাম। ঠিক আছে এখন আর কোনও মাইন্ড নাই। ঠিক আছে?
দিলু খুশি হল। ঠিক আছে।
শোন, স্বপন সাহেব খুবই ভাল মোয়াক্কেল। কাজটা করে ফেলতে পারলে মালের কোনও অভাব হবে না।
তাহলে করছিস না কেন? এইসব মার্ডার তো আমাদের জন্য তেলপানি। বাড়ি চিনি, ছেমড়াটারেও চিনি। মার্ডারে অসুবিধা কী?
কোনও অসুবিধা নাই।
তবে?
কাজটা যখন হাতে নিয়েছি, করতে তো হবেই। করলে এক সঙ্গে মালও অনেক, কিন্তু কাজটা আমি ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে করতে চাই। কাজ যত ঝুলবে খুচরা ইনকাম ততো বাড়বে। দুই চারদিন পর পর স্বপন সাহেবের কাছে যাব, পাঁচ দশ হাজার নিয়ে আসব। মূল কনটাক্টের সঙ্গে এই টাকার কোনও সম্বন্ধ নাই। পলিসিটা বুঝেছিস?
দিলু বিগলিত গলায় বলল, একদম ক্লিয়ার। খুবই ভাল পলিসি।
সঙ্গে সঙ্গে লালু আবার গান ধরল। চাল সাইয়া সাইয়া সাইয়া…।
.
তুই যাসনি?
নাহিদ গম্ভীর গলায় বলল, তোর এই ধরনের পরিস্থিতি জেনে কী করে যাই।
শুভ বেশ বিরক্ত হল। আমার মা ভাইবোন ভাবী কারও সঙ্গে তোর কোনও ব্যবধান নেই। তোরা সবাই একই রকমের ভীতু।
কোনও কোনও পরিস্থিতিতে মানুষ ভীতু হতে বাধ্য হয়। দুচারজন মাস্তান তো আমিও চিনি, তোর বন্ধু বান্ধবের সার্কেল খুব ছোট নয়। ইচ্ছে করলেই সেতুর ভাইদের ভাড়াটিয়া মাস্তানদের দেখে নিতে পারি আমরা। কিন্তু এখন ওসব করা ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না?
সেতু যদি ঠিক থাকে, দুদিন আগে পরে ওর ভাইরা ব্যাপারটা মেনে নিতে বাধ্য হবেন। তখন এইসব অপকর্মের জন্য লজ্জা পেতে হবে।
লজ্জা আমি একা পাব কেন? ওরাও তো পাবে! আমার সবচে’ বড় ভয় ছিল আমার মা, মা সব মেনে নিয়েছেন। এখন আমার কোনও ভয় নেই। তার চে’ এক কাজ করি…
কী?
সরাসরি সেতুদের বাড়ি চলে যাই। সেতুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি।
সেতু যদি এভাবে না আসে?
শুভ একটু থতমত খেল। তোর মনে হয় আসবে না?
নাহিদ চিন্তিত গলায় বলল, নাও আসতে পারে। আমার ধারণা ইচ্ছে করে সময় নিচ্ছে সেতু। ভাইদের রাগ কমে এলে সবাইকে ম্যানেজ করে তোর সংসারে আসবে সে। বেশির ভাগ মেয়ে কিন্তু তাই করে।
শুভ অস্থির গলায় বলল, তাহলে আমাকে তুই কী করতে বলিস?
তুই একটা কাজ কর, আমার সঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চল।
কী বললি?
আগে কথাটা শোন। যতদিন এদিককার পরিস্থিতি ঠিক না হয় ততদিন আমাদের ওখানে থাকলি। ঠিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলি?
শুভ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, যেতে পারি কিন্তু তোদের বাড়ির কাউকে এসব কথা বলতে পারবি না।
নাহিদ হাসল। বলব না।
কিন্তু যাওয়ার আগে একটা কাজ করে যেতে চাই।
কী?
গভীর রাতে সেতুদের বাড়ির সামনে গিয়ে বিশাল করে ওদের দেয়ালে লিখে দিয়ে যাই, শুভ + সেতু।
নাহিদ হাসল। তুই একেবারে পাগল হয়ে গেছিস।
.
সব শুনে শাহিন বলল, আমি মনে করি এটাই সবচে ভাল সিদ্ধান্ত।
রাতেরবেলা শুভদের ড্রয়িংরুমে একত্রিত হয়েছে সবাই। মা শাহিন সুরমা মালা শুভ . এবং নাহিদ। সেই যে এসেছে নাহিদ, এখনও ফিরে যায়নি।
কথা শুরু করেছিল নাহিদই। তার কথার রেশ ধরেই কথা বলল শাহিন। তারপর মায়ের দিকে তাকাল। তুমি কী বল মা?
মা গম্ভীর গলায় বললেন, তোরা যা ভাল বুঝিস তাই কর।
সুরমা বলল, শুভ চলেই যাক।
মালা চিন্তিত গলায় বলল, এদিকে সেতুর যদি কোনও অসুবিধা হয়?
নাহিদ বলল, তা মনে হয় হবে না। শুভকে বাড়িতে রেখে আমি মাঝে মাঝে এসে খবর নেব।
শুভ কোনও কথা বলছিল না। মুখটা পাথরের মতো হয়ে আছে তার।
তারপর থেকে একটা রাত গেছে, একটা প্রায় পুরোদিন, মুখের ভাবটা বদলায়নি শুভর। ট্রেনে সারাক্ষণই চুপচাপ ছিল। নাহিদ টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করেছে, সেসব কথার হু হ্যাঁ না ছাড়া তেমন কোনও জবাব দেয়নি।
নাহিদদের বাড়িতে পৌঁছেও চুপচাপই আছে শুভ।
যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে তাকে সেই ঘরে খাটের এককোণে উদাস হয়ে বসে আছে এখন। পাশে ব্যাগটা। নাহিদ গেছে তার মা বাবার সঙ্গে দেখা করতে।
এসময় বর্ষা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে।
বর্ষাকে দেখে গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই প্রথম পুরো একটা বাক্য বলল শুভ। কেমন আছ, বর্ষা?
বর্ষা কথা বলল না। অপলক চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে রইল।
শুভ বলল, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ?
বর্ষা কথা বলল না, মাথা দোলাল।
এবার একটু উফুল্ল হল শুভ। কী মনে করে বলল, তোমার কথা ভেবে তোমাদের এখানে চলে এলাম।
বর্ষা উদাস গলায় বলল, কেন?
শুভ একটু থতমত খেল। না মানে নাহিদ, আমি আমরা সবাই থাকলে তোমার মনটা হয়তো ভাল থাকবে।
তারপর একটু থেমে বলল, অনেকদিন থাকব তোমাদের এখানে।
একথায় মুখটা কেমন উজ্জ্বল হল বর্ষার। সত্যি?
সত্যি।
ধীর, শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে বর্ষা তারপর শুভর সামনে এসে দাঁড়াল। সত্যি আপনি অনেকদিন থাকবেন আমাদের এখানে?
শুভ হাসল। তোমার সঙ্গে আমি মিথ্যে বলছি না। সত্যি অনেকদিন থাকব তোমাদের এখানে।
সঙ্গে সঙ্গে ডানহাতটা শুভর দিকে বাড়িয়ে দিল বর্ষা। শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য রকমের সরল গলায় বলল, আমাকে ছুঁয়ে বলুন।
শুভ একটু থতমত খেল। একটু দ্বিধাও হল তার।
বর্ষার হাতটা ধরল শুভ।
৮. বারবাড়ির দিক থেকে দ্রুত হেঁটে
বারবাড়ির দিক থেকে দ্রুত হেঁটে আসছিল পারু।
উঠোনের মাঝামাঝি আসতেই নিজের ঘরের বারান্দা থেকে বর্ষা তাকে ডাকল। পারু।
পারু থমকে দাঁড়াল।
বারান্দা থেকে নেমে পারুর সামনে এসে দাঁড়াল বর্ষা। তোকে না বলেছিলাম ফুল তুলে আনতে?
পারু উচ্ছল গলায় বলল, এনেছি তো!
কোথায়?
তোমার ঘরেই রেখে দিয়েছি।
কই, আমি যে দেখলাম না!
পারু হাসল। তুমি হয়তো খেয়াল করনি।
কখন তুলেছিস?
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই।
ঠিক আছে, আমি এখানে দাঁড়াই, ফুলগুলো তুই নিয়ে আয়।
আচ্ছা।
পারু ছুটে চলে গেল।
কেন কে জানে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বর্ষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আশ্চর্য ব্যাপার, বর্ষার এই দীর্ঘশ্বাসটাই যেন মিনুর বুকে এসে লাগল। তিনি একটু কেঁপে উঠলেন।
ব্যাপারটা খেয়াল করলেন হাদি সাহেব। উতলা গলায় বললেন, কী হল?
মিনু বললেন, হঠাৎ বুকটা কেমন কেঁপে উঠল।
কেন?
কী জানি!
নাহিদ বলল, শরীর খারাপ লাগছে না তো?
না।
এমনি এমনিও অনেক সময় বুক কাঁপে মানুষের।
তারপর বাবার দিকে তাকাল নাহিদ। কী যেন বলছিলে বাবা?
হাদি সাহেব বললেন, শুভর কথা। হঠাৎ শুভ এল আমাদের বাড়িতে?
নাহিদ বলল, আসতে চায়নি, আমি নিয়ে এসেছি।
মিনু মুগ্ধ গলায় বললেন, ভাল করেছিস। শুভ খুব ভাল ছেলে। দেখলেই কেমন যেন মায়া লাগে। মুখটা এত মায়াবী!
হাদি সাহেব বললেন, ছেলেটিকে আমার ভাল লেগেছে বিনয় এবং ভদ্রতার জন্য। হোটেলে যেদিন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল সেদিনই ব্যাপারগুলো আমি খেয়াল করলাম। আজকালকার এই বয়সি ছেলেমেয়েদের এত বিনয়, এত ভদ্রতা দেখা যায় না। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো কেমন যেন রুক্ষ। বিনয় ভদ্রতার ধার ধারে না।
তারপর একটু থেমে বললেন, শুভ কি কয়েকদিন থাকবে আমাদের এখানে?
নাহিদ বলল, হ্যাঁ বাবা, বেশ কিছুদিন থাকবে। আমরা দুজনেই রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছি। রেজাল্ট বেরুবার পর চাকরি বাকরির চেষ্টা করব। এরকম ফ্রি সময় তো আর পাওয়া যাবে না, এজন্য শুভকে আমি বললাম, চল, মাসখানেক আমাদের বাড়িতে থেকে আয়।
নাহিদের কথা শুনে মিনু বললেন, মাসখানেক পর যখন চলে যাবে তখন আমার মনটা খুব খারাপ হবে। বাদল চলে যাওয়ার পর বাড়িটা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কাল থেকে মনে হচ্ছে, মানে শুভ আছে, মনে হয় বাদলই আছে। বাড়িটা আবার ভরে উঠেছে।
একথা শুনে নাহিদ যেন একটু বিরক্ত হল। সব সময় এভাবে ভেব না মা। তোমার কথা শুনে মনে হয় বাদলই তোমার সব ছিল। আমি তোমার কেউ নই, বর্ষা তোমার কেউ নয়।
মিনু হাহাকারের গলায় বললেন, না বাবা না। এভাবে বলিস না। মা বাবার কাছে প্রতিটি সন্তানই পাঁজরের একেকটি হাড়। একজন চলে যায় একটি হাড় ভেঙে যায়। সেই ভাঙা হাড়ের কষ্ট সারাজীবন থাকে।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মিনু। আঁচলে চেপে চেপে চোখ মুছতে লাগলেন।
তখন হঠাই যেন বর্ষার কথা মনে পড়ল হাদি সাহেবের। তিনি একটু উদ্বিগ্ন হলেন। আমরা তিনজন এই ঘরে, বর্ষা কোথায়?
আঁচলে ফুল নিয়ে বর্ষা তখন বাদলের কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। খানিক দাঁড়িয়ে, কবরের দিকে তাকিয়ে আঁচলে হাত দিল। মুঠো মুঠো ফুল তুলে কবরে ছড়াতে ছড়াতে ফিসফিসে গলায় বাদলকে ডাকল। বাদল, বাদল! তুই কি ঘুমিয়ে আছিস? এত বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায়? এই যে আমি ফুল নিয়ে এসেছি তুই দেখতে পাচ্ছিস?
কথা বলতে বলতে জলে চোখ ভরে এল বর্ষার। ধরা গলায় সে বাদলের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তুই কোথায় চলে গেলি? আমার কথা তোর মনে পড়ে না? আমাকে ছেড়ে তুই কেমন করে চলে গেলি? তোর জন্য আমি খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না। আমি কী করব তুই বলে দে।
বাদলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল বর্ষা।
দূর থেকে এই দৃশ্যটা দেখতে পেল শুভ।
হাঁটতে হাঁটতে মাঠের দিকটায় এসেছে সে। মাঠের এক কোণে বাদলের কবর। এখনও পাকা করা হয়নি। বাঁশের বেড়া দেয়া। সেই বেড়া দুহাতে ধরে কাঁদছে বর্ষা।
দৃশ্যটা দেখে বুকের ভেতর হু হু করে উঠল শুভর। নিজের অজান্তেই যেন বর্ষার পাশে এসে দাঁড়াল সে। বর্ষার কাঁধে হাত দিল।
চমকে শুভর দিকে তাকাল বর্ষা।
শুভ বলল, কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে হয় না। কাদলে যে মারা যায় তার আত্মা খুব কষ্ট পায়। তুমি চাও মৃত্যুর পরও কষ্ট পাক তোমার ভাই?
কথাটা শুনে বর্ষা একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। না না, আমি চাই না। আমি কিছুতেই চাই না বাদল আর কোনও রকমের কোনও কষ্ট পাক। অসুখে অসুখে অনেক কষ্ট সে পেয়েছে। অনেক কষ্ট। আমি চাই আল্লাহ ওকে সুখে রাখুন, ভাল রাখুন। কোনও কষ্ট যেন ওকে আর কখনও পেতে না হয়।
তাহলে কবরের সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে আর কখনও কাঁদবে না। দোয়া করবে। আল্লাহকে বলবে ওর আত্মাকে তিনি যেন সুখে রাখেন।
শুভ একটু থামল। তারপর বলল, বাড়ি চল।
বর্ষা কোনও কথা বলল না। ওড়নায় চোখ মুছে কবরের সামনে থেকে সরে এল।
.
শুভর বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে নাহিদ।
শুভর জন্য অপেক্ষা করছে।
একা একা কোথায় চলে গেল সে!
শুভ এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। নাহিদকে এই ঘরে দেখে অবাক হল। তুই এই ঘরে বসে আছিস?
নাহিদ উঠে বসল। বসে না, শুয়ে আছি।
শুভ হাসল। বুঝলাম কিন্তু কেন?
তোর জন্য।
আচ্ছা!
কোথায় গিয়েছিলি?
বাদলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল বর্ষা। ওকে নানা রকমের সান্ত্বনা দিলাম। তারপর তোদের গ্রামটা একটু ঘুরে দেখলাম।
কেমন লাগল?
নাহিদের পাশে বসল শুভ। আমার কাছে সব গ্রামই একরকম লাগে। স্নিগ্ধ সবুজ মায়াবি। একা একা ঘুরে বেড়ালে মন অন্যরকম হয়ে যায়।
তোর হয়েছে?
হ্যাঁ। তবে অন্য একটা কথাও মনে হয়েছে।
কী বলতো!
তোর সঙ্গে আমার এতদিনের বন্ধুত্ব কিন্তু আমি তোদের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুই জানি না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। খালুজান কী করেন রে?
নাহিদ হাসল।
হাসিটা খেয়াল করল না শুভ। বলল, এখানে আসার পর থেকে দেখছি সারাক্ষণই বাড়িতে বসে আছেন। কখনও কখনও কাছারি ঘরে গিয়ে বসছেন, কৃষক ধরনের কিছু লোকজন আসছে। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
এটাই তার পেশা।
মুখ ঘুরিয়ে নাহিদের দিকে তাকাল শুভ। মানে?
আমাদের গ্রামের চারপাশে যত ধানের জমি আছে সেগুলোর বেশির ভাগই আমাদের। যারা বাবার কাছে আসে তারা ওইসব জমি চাষ করে।
তার মানে বিশাল অবস্থা তোদের! তোরা হচ্ছিস এই এলাকার জমিদার!
ন তেমন বিশাল আর কই!
বিনয়ের দরকার নেই।
বিনয় করছি না। আমার বাবা হচ্ছেন অত্যন্ত নরম হৃদয়ের, দয়ালু ধরনের মানুষ। একটু কঠিন হলে অবস্থা আরও ভাল থাকত আমাদের।
বুঝেছি।
কী বুঝলি বল তো?
কৃষকরা এসে কেঁদেকেটে পড়লে অনেক কিছুই মাফ করে দেন তিনি।
রাইট।
এই ধরনের মানুষদের আমার খুব ভাল লাগে। অবশ্য তোরা সবাই বেশ নরম ধরনের। খালাম্মা খালুজান, তুই বর্ষা।
নাহিদ চুপ করে রইল।
যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন সুরে শুভ বলল, আচ্ছা শোন, এই পারু মেয়েটা কে রে? দেখে তো বাড়ির কাজের মেয়ে মনে হয় না!
আলতো করে চশমা খুলল নাহিদ। কাজের মেয়ে সে নয়।
তাহলে?
আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। বাড়ির অবস্থা ভাল না, এজন্য আমাদের এখানে থাকে। বাবা ওর জন্য পাত্র দেখছেন। আমরাই বিয়ে দিয়ে দেব।
একথার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে কেমন বদলে ফেলল শুভ। আর এই যে তোর হতভাগা বন্ধুটা বিয়ে করে ফেরার হয়ে আছে তার কী করবি?
নাহিদ হাসল। কী করতে হবে?
ণা না হাসি নয়, হাসি নয়। ওপরে ওপরে যত হাসি আনন্দেই থাকি, মনটা কিন্তু আমার ভাল না বন্ধু।
তা জানি।
পুরোটা মনে হয় জানো না। আমার কিন্তু সারাক্ষণই সেতুর কথা মনে হয়।
একটু উদাস হল শুভ। জানালার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলল, সেতু কী করছে, কেমন আছে কিছুই জানি না। ও জানে না আমার কথা। আমি যে তোদের এখানে চলে এসেছি…।
শুভর কাঁধে হাত দিল নাহিদ। এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। কয়েকদিন পর আমি ঢাকায় যাব, যেমন করে পারি সব খবর নিয়ে আসব।
কীভাবে নিবি?
দেখা যাক।
একটা সোর্স ছিল দোলন, কিন্তু ওর তো সেতুদের বাড়িতে যাওয়া নিষেধ!
এতকিছু তুই এখন ভাবিস না। যতদিন এখানে থাকবি, আনন্দে থাক। সেতু খুবই সিরিয়াস টাইপের মেয়ে। বিয়ে যখন একবার হয়ে গেছে, দুদিন আগে পরে সব ঠিক হবেই।
শুভ আর কথা বলল না। আনমনা হয়ে রইল।
.
মিনু বললেন, পারুর বিয়ের ব্যাপারে আর চেষ্টা করছ না?
হাদি সাহেব মাত্র শুতে যাবেন, স্ত্রীর কথা শুনে থমকালেন। কখন করব? বাদলকে নিয়ে এতবড় একটা ধকল গেল, ছেলেটা মারা যাওয়ার পর এখন যাচ্ছে বর্ষাকে নিয়ে। ছেলেমেয়ে নিয়ে টেনশান থাকলে অন্যকোনও দিকে মন দেয়া যায়?
স্বামীর পাশে বসলেন মিনু। বর্ষা এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে। এখন চেষ্টা করো।
পিঠের তলায় দুটো বালিশ দিয়ে আধশোয়া হলেন হাদি সাহেব। কোথায় স্বাভাবিক হয়েছে? আমি তো ওর কোনও চেঞ্জ দেখছি না! বাদলের কবরের সামনে যাচ্ছে, কাঁদছে, চুপচাপ বসে থাকছে।
হয়তো আরও কিছুদিন এরকম থাকবে, তারপর ঠিক হয়ে যাবে।
হাদি সাহেব কীরকম আনমনা হলেন। বর্ষাও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল!
চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকালেন মিনু। হঠাৎ একথা বললে যে!
মনে হল।
তুমি কি ওর বিয়ের কথা ভাবছ?
ভাবা উচিত না?
আগে পারুর বিয়েটা দাও, তারপর দেখা যাবে। বিএ পাসটা করুক বর্ষা।
হাদি সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তা কী আর হবে!
কেন হবে না?
মনে যে রকম আঘাত পেয়েছে, এই আঘাত কাটিয়ে পড়াশুনো চালানো খুব কঠিন। তারচে’ বিয়ে দিয়ে দিলে অবস্থাটা চেঞ্জ হতে পারে।
না, এখন এসব ভেব না।
কেন ভাবব না?
মাত্র কিছুদিন হল যে মেয়ের যমজ ভাই মারা গেছে সেই মেয়ের এখন বিয়ে হতে পারে না।
তা আমিও বুঝি। বর্ষার কথা ভেবেই বিয়ের চিন্তাটা আমার মাথায় এসেছিল।
কথা বলতে বলতে গলা ধরে এল হাদি সাহেবের। চোখ ভরে এল জলে। স্ত্রীর কাছ থেকে চোখের জল লুকোবার জন্য অন্যদিকে মুখ ফেরালেন তিনি। মেয়েটির জন্য আমি খুব কষ্ট পাই। আমি চাই ও আবার আগের মতো হোক। হাসি আনন্দে ভরিয়ে রাখুক বাড়ি। এটা চাক আমার কাছে, ওটা চাক। গলা ছেড়ে গান করুক, ছুটোছুটি করুক।
মায়াবি হাতে স্বামীর একটা কাঁধ ধরলেন মিনু। তুমি মন খারাপ করো না। আমি বলছি, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ওকে ভাল করে বোঝাও। তুমি যা যা চাও জোর দিয়ে বল ওকে। আমার মনে হয় তাতে বেশ কাজ হবে।
স্ত্রীর কথা মনে রেখেই বুঝি পরদিন সকালে মেয়ের ঘরে এসে ঢুকলেন হাদি সাহেব।
বর্ষার ঘুম ভেঙেছে অনেক সকালে।
ঘুম ভাঙার পর মাথার কাছের জানালা খুলে দিয়েছে সে। বিছানায় বসে এখন ফাঁকা শূন্য দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাবার পায়ের শব্দে চোখ তুলে তাকাল।
হাদি সাহেব বললেন, নাস্তা খেয়েছ মা?
বর্ষা শান্ত গলায় বলল, খেয়েছি।
কথাটা শুনে হাদি সাহেব আনমনা হয়ে গেলেন। পাশে বসে অপলক চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বর্ষা বলল, কী হয়েছে বাবা? এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?
তোমাকে দেখছি।
আমাকে আবার দেখার কী হল?
আগে নাস্তা খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে তুমিও সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জিজ্ঞেস করতে, আমি নাস্তা খেয়েছি কি না!
বর্ষা কথা বলল না।
মেয়ের মাথায় হাত দিলেন হাদি সাহেব। যে চলে গেছে শুধু তার জন্যই তোমার মায়া? আমাদের জন্য মায়া নেই?
দুহাতে বাবার হাতটা ধরল বর্ষা। এমন করে বলো না বাবা, এমন করে বলো না। আমার কষ্টটা আরও বাড়ে। আর এই যে তুমি আমাকে তুমি তুমি করে বলছ, শুনে আমি যে কষ্ট পাচ্ছি তুমি তা বুঝতে পার?
পারি।
তোমার মুখে তুমি শুনলে নিজেকে খুব দূরের মনে হয়।
হাদি সাহেব ধরা গলায় বললেন, মৃত্যু আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে বাদলকে, আর বেঁচে থেকে তুই নিজে নিজে অনেক দূরে চলে গেছিস।
বর্ষা কাতর গলায় বলল, আমি কী করব বাবা? আমার কিছু ভাল লাগে না।
লাগতে হবে। বাদলের শোক তোকে ভুলতে হবে। তুই আগের মতো হয়ে যাবি। হাসবি, আনন্দ করবি। লেখাপড়া করবি, গান করবি। এভাবে জীবন চলে না মা। প্রত্যেক মানুষকেই একদিন মরতে হবে। একথা জেনেও আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের ধর্ম।
আমিও চেষ্টা করি বাবা। ভেতরে ভেতরে খুব চেষ্টা করি আগের মতো হতে। পারি না, কিছুতেই পারি না।
চেষ্টা করলে হয় না এমন কাজ মানুষের অভিধানে নেই। তুই আরও চেষ্টা কর।
বর্ষা তারপর হঠাৎ করেই কেমন শিশু হয়ে গেল। আধো আধো গলায় বলল, বাবা, তুমি আমাকে একটু আদর কর।
আয় মা আয়, আমার কাছে আয়।
বলে দুহাতে মেয়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরলেন হাদি সাহেব। কোত্থেকে যে বুকফাটা এক কান্না এল তার। চোখের জলে গাল মুখ ভেসে গেল যেন নিজের অজান্তে।
.
কাছারি ঘরের বাইরের দিককার দরজা দিয়ে খুবই উচ্ছল ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল শুভ। বর্ষা ছিল ওদিকটাতেই। এখানে বেশ বড়সড় একটা বাগান। বাগান ছাড়িয়ে মাঠ। গাছপালা, ফুল আর সবুজ ঘাসে মনোরম হয়ে আছে জায়গাটা। এই পরিবেশে বর্ষাকে খুব অন্যরকম লাগল। বোধহয় এজন্যই শুভ তাকে ডাকল। এই, শোন।
বর্ষা অবাক চোখে শুভর দিকে তাকাল। আমাকে বলছেন?
শুভ সিরিয়াস মুখ করল। না তোমাকে না।
তাহলে?
হাওয়াকে বলেছি।
জ্বি?
হাওয়া মাঠ ফুলের বাগান, এদেরকে বলছি।
সঙ্গে সঙ্গে মুখ গম্ভীর হল বর্ষার। ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না। কী জন্য ডাকলেন, বলুন।
বর্ষার মুখভঙ্গি এবং কথা বলার ধরনে শুভ একেবারে বিব্রত হয়ে গেল। কোনও কারণ নেই। তুমি সবসময় মনমরা হয়ে আছ, ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু মজা করি, তোমার মনটা ভাল করি। তুমি বিরক্ত হবে এটা আমি বুঝতে পারিনি। তাহলে, তাহলে এভাবে তোমাকে ডাকতাম না। সরি।
শুভ মন খারাপ করে ভেতর বাড়ির দিকে চলে এল।
ঘরে ঢুকে নিজের বিছানায় কিছুক্ষণ বসে রইল তারপর খাটের তলা থেকে ব্যাগটা বের করে জামাকাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে নাহিদ এসে ঢুকল এই ঘরে। শুভকে জামাকাপড় গুছাতে দেখে অবাক হল। কী ব্যাপার? হঠাৎ জামাকাপড় গোছাচ্ছিস?
নাহিদের দিকে তাকাল না শুভ। গম্ভীর গলায় বলল, চলে যাব।
কোথায়?
শিলা তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, তোমার পক্ষে এখন সবকিছুই সম্ভব। এই মুহূর্তে তুমি যদি বাড়ি থেকে বেরিয়েও যাও, আর কখনও এই বাড়িতে ফিরে না আস তাও আমি অবাক হব না।
না, তা আমি করব না। ওরকম প্ল্যান থাকলে আরও আগেই চলে যেতে পারতাম। চলে যাওয়া সবচে’ সহজ কাজ।
তা অবশ্য ঠিক।
এজন্যই ওই কাজটা আমি করব না। শুভকে আমার বর হিসেবে তোমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রপার সম্মানটা তাকে দিতে হবে।
কথাটা আমি একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই।
মানে?
মানে হচ্ছে তোমার বর হিসেবে শুভর সম্মান টম্মান কোনও ব্যাপার নয়, তুমি তোমার পৈতৃক সম্পত্তির শেয়ার না নিয়ে এখান থেকে যাবে না।
ওসব নিয়ে আমি ভাবছি না।
নিশ্চয় ভাবছ।
আসলেই ভাবছি না। কারণ বাবার প্রপার্টি থেকে আমাকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। ইচ্ছে করলেই কেউ তা পারবে না।
ইচ্ছে করলে পারবে।
কী করে?
আমি তোমাকে সেটাই বলতে চাই।
বল, শুনি।
তোমার ভাইরা ইচ্ছে করলে প্রপার্টি থেকে সম্পূর্ণই বঞ্চিত করতে পারে তোমাকে। তুমি যে রকম বাড়াবাড়ি করছ, বিরক্ত হয়ে তোমার ভাইরা যদি তাই করে, তখন তুমি কী করবে?
অদ্ভুত এক নির্মোহ চোখে শিলার চোখের দিকে তাকাল সেতু। শান্ত গলায় বলল, আমি কোনও প্রপার্টি চাই না। কিছু চাই না আমি। আমি শুধু শুভকে চাই।
সেতুর কথা শুনে অবাক হয়ে গেল শিলা।
.
চায়ের কাপ হাতে মামুন সাহেবের রুমের দিকে যাচ্ছে আলী, হঠাই সামনে পড়ল লালু দিলু। আচমকা এই দুজনকে দেখে আলী কেমন ভড়কে গেল। তার ভড়কানো ভাবটা খেয়াল করল না লালু। গম্ভীর গলায় বলল, নাম কী?
আলী থতমত খেল। কার নাম?
তোর।
আমার? আমার নাম আলী আজম।
এই নাম রাখতে তোকে কে বলেছে?
জ্বি?
লালু একটু গলা চড়াল। এই নাম রাখতে তোকে কে বলেছে?
নামটা আমার বাবা রেখেছে।
যেই রাখুক, আজমের কোনও দরকার নাই। শুধু আলী। ঠিক আছে?
জ্বি।
তাহলে দুটো ঠাণ্ডা আর দুপ্যাকেট বেনসন নিয়ে আয়।
স্যার না বললে তো আনতে পারি না।
সঙ্গে সঙ্গে ধমকে উঠল লালু, তর স্যারের খেতাপুরি। যা নিয়া আয়।
লালু দিলু আর ফিরে তাকাল না, স্বপনের রুমে ঢুকল। ঢুকে চেয়ার টেনে স্বপনের মুখোমুখি বসল।
লালু বলল, কিছু মাল ছাড়তে হয় যে।
স্বপন বিরক্ত হল। কেন?
শোন কথা! কাজ করতে মাল লাগবে না!
কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। প্রায়ই এসে টাকা নিয়ে যাচ্ছ। এই পর্যন্ত কত টাকা নিয়েছ, হিসেব আছে?
অকারণে গলা মোটা করে লালু বলল, হিসাব কিতাব করে টাকা পয়সা আমি নেই না। দরকার হলেই আসব। লেকচার ছাড়া, যাকে বলে নিঃশব্দে, নিঃশব্দে টাকাটা দিয়ে দেবেন। আর যদি ইচ্ছা না হয় দেবেন না। কিন্তু লেকচার মারবেন না। লালু কারও লেকচারের ধার ধারে না।
লালুর কথা বলার ভঙ্গিতে স্বপন একেবারে চুপসে গেল। কোনও রকমে বলল, কিন্তু কাজটা করছ না কেন?
ঘাড় বাঁকা করে স্বপনের দিকে তাকাল লালু। মার্ডার করাটা আপনার কাছে কী মনে হয়? খুব সোজা?
তোমার জন্য তো সোজাই।
হলেও তার জন্য একটা চান্স দরকার। চান্সটাই পাচ্ছি না।
আঙুল নাচিয়ে টাকার ভঙ্গি করল লালু। ছাড়েন, তাড়াতাড়ি ছাড়েন।
এসময় দুগ্লাস ঠাণ্ডা কোক আর দুপ্যাকেট বেনসন সিগ্রেট ট্রেতে নিয়ে স্বপনের রুমে ঢুকল আলী। দেখে অবাক হল স্বপন। এসব আনলি কেন? আমি তোকে এসব আনতে বলিনি।
লালু বলল, আমি বলেছি।
কোকের গ্লাস হাতে নিয়ে ফুরুক করে চুমুক দিল লালু। এটা আমার নিয়ম। যখন যার কাজ করি তখন আমি তার বস। আমি যা বলব তাই করতে হবে।
আলীর সামনে লালুর এসব কথা, স্বপন কী রকম অপমান বোধ করল। আলীর দিকে না তাকিয়ে বলল, এই, তুই যা।
আলীও যেন একথা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল সে।
এবার লালুর দিকে তাকাল স্বপন। পিয়ন টিয়নদের সামনে এভাবে কথাগুলো না বললেও পারতে।
লালু নির্বিকার গলায় বলল, আপনার জন্যই বলেছি। আপনেরে একটু সাইজ করলাম। আজকের মালটা ছাড়েন। কাজ হয়ে যাবে।
পকেট থেকে বেশ কিছু পাঁচশো টাকার নোট বের করে লালুকে দিল স্বপন। দশ হাজার আছে।
টাকাটা নিয়ে পকেটে রাখল লালু।
স্বপন বলল, কাজটা তাড়াতাড়ি কর লালু।
করব।
তবে সাবধানে। আমি যে জড়িত কেউ যেন টের না পায়।
কাউয়ায়ও টের পাইব না।
তারপর আচমকা বলল, কিন্তু মার্ডারটা আপনি কেন করাচ্ছেন? পোলাটা কি আপনের বইনরে ভাগাইয়া নিয়া বিয়া করছে?
স্বপন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। কে বলল তোমাকে?
লালু সিগ্রেট ধরাল। কেউ বলে নাই। অনুমান করলাম। পোলাটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়া মার্ডারের কোনও কারণ পাই নাই। এইজন্যই জিজ্ঞাসা করলাম। অসুবিধা নাই। যে কারণে ইচ্ছা মার্ডার করেন, সেইটা আপনের ব্যাপার। আমার সঙ্গে মালের কনটাক্ট, আমার কাজ আমি করে দেব।
টেবিলের ওপর রাখা দুপ্যাকেট সিগ্রেট পকেটে নিয়ে উঠল লালু। নিঃশব্দে তার সঙ্গে উঠল দিলু।
তারপর মোটর সাইকেল চালিয়ে লালু এল শুভদের বাড়ির সামনে। পেছন থেকে নেমে দিলু বলল, এখানে আসলা কেন?
লালু নির্বিকার গলায় বলল, তোকে কোরবানি দিতে।
কী?
তোর মাথায় মগজ বলে তো কিছু নাই। কুকুর বিড়ালের ইয়ে দিয়ে, মানে বাহ্যি দিয়ে তোর মাথা ভর্তি। এজন্য আমার কোনও কাজেরই অর্থ তুই বুঝতে পারিস না।
এবার হে হে করে হাসল দিলু। বুঝছি।
কী, বল তো?
কেসটা রেকি করতে আসছ। রেগুলার মাল খাইতাছ। কিছুটা কাম না করলে কেমতে হয়।
দিলুর কথা শুনে খুশি হল লালু। কারেক্ট।
তখুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মালা। সুন্দর টাঙ্গাইল শাড়ি পরেছে। মুখে সামান্য প্রসাধন। দেখতে ভাল লাগছে তাকে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে চারদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজতে লাগল মালা। রাস্তার ওপাশে মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল লালু দিলু। মালা বেশ হকচকিয়ে গেল। আপনারা? কী, কী চান?
লালু নিঃশব্দে হাসল। কিছু না, কিছু চাই না। আমরা কোনও ছ্যাচড়া মাস্তান না। রাস্তায় একা একটা সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাকে একটু ইয়ে করা কিংবা ছিনতাই ফিনতাই আমরা করি না। আমরা খুবই প্রেস্টিজিয়াস জিনিস।
আরেকদিন আপনাদেরকে আমি দেখেছি। মোটর সাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এরপর গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।
কেন?
কথা শুনে মনে হল মোটর সাইকেল জিনিসটা আপনার পছন্দ হয়নি।
আমার পছন্দ অপছন্দে আপনাদের কী যায় আসে?
কিছুই যায় আসে না।
তাহলে?
আপনার সঙ্গে একটু খাজুইরা আলাপ করলাম।
তারপরই গলার স্বর নৃশংস করল লালু। শুভ আপনার কী হয়?
লালুর এ রকম গলা শুনে ভয় পেয়ে গেল মালা। কোনও রকমে বলল, আমার ভাই।
কোথায় সে?
মালা একটা ঢোক গিলল। তা আপনাকে বলব কেন?
বলার দরকার নাই। খুঁজে বের করে নেব।
লালু দিলু আর দাঁড়াল না। আয়েশি ভঙ্গিতে হেঁটে মোটর সাইকেলটার সামনে গেল। মুহূর্তে মোটর সাইকেল নিয়ে উধাও হয়ে গেল।
.
মা আতঙ্কিত গলায় বললেন, কী বলছিস?
মালা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ মা, শুভকে খুঁজছিল, আমি ওদেরকে চিনেছি। আগেও একদিন আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
সর্বনাশ!
লালু দিলু চলে যাওয়ার পর যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে আর যায়নি মালা। ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢুকেছে। ঢুকে সোজা মায়ের রুমে। এখনও হাঁপাচ্ছে সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ভাগ্যিস নাহিদদের গ্রামে চলে গেছে শুভ, নয়তো বিপদ হয়ে যেত।
মা উতলা গলায় বললেন, এসব নিয়ে আর বসে থাকা যায় না।
বসে থাকা ঠিকও হবে না মা। ওরা নিশ্চয় শুভকে খুঁজে বের করে ফেলবে। পরিষ্কার বলে গেছে।
শাহিন অফিস থেকে ফিরুক, ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি কী করা যায়।
শাহিন ফিরল সন্ধেবেলা। সব শুনে বলল, পুলিশের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছি না।
সুরমা অস্থির গলায় বলল, তুমি এতদিন যাওনি কেন? বলেছিলে না জিডি করবে।
ভুলে গিয়েছিলাম।
শুনে মা খুবই ক্ষিপ্ত হলেন। ভুলে গিয়েছিলি? কেমন ভাই তুই? ছোট ভাইর এরকম বিপদ আর তার কথা তুই ভুলে যাস?
শাহিন কাঁচুমচু গলায় বলল, শুভ এখানে নেই বলে ব্যাপারটা আমি তেমন গুরুত্ব দিই নি।
মালা বলল, এটা তুমি ঠিক করনি ভাইয়া। এখন ওরা যদি নাহিদদের গ্রামে গিয়ে শুভকে…
কথা শেষ হওয়ার আগেই মালাকে ধমক দিলেন মা। চুপ কর। অলুক্ষুণে কথা বলবি না।
সুরমা শাহিনের দিকে তাকাল। তারচে’ তুমি বরং এক কাজ কর।
চোখ তুলে সুরমার দিকে তাকাল শাহিন। কী?
সেতুর ভাইদের সঙ্গে দেখা কর। তাদেরকে বল এসব আপনারা ঠিক করছেন না। মাস্তান টাস্তানদেরকে ফেরান। আমার ভাইয়ের যদি কোনও ক্ষতি হয়, আপনাদেরকে আমরা ছাড়ব না। দেশে আইন আছে। আমরা আপনাদেরকে দেখে নের।
মা বললেন, এবং এও বলবি, আপনারা ভালয় ভালয় ব্যাপারটা মেনে নিন। আমার ভাই কোনও ফেলনা ছেলে না। আপনার বোনের জন্য এরচে’ ভাল পাত্র পাবেন না। আর বিয়ে যেখানে হয়ে গেছে সেখানে এত বাড়াবাড়িরই বা কী আছে!
শাহিন গম্ভীর গলায় বলল, আমি ওদের কাছে যাব না মা। মা অবাক হলেন। কেন?
ওদের কাণ্ডকারখানা যা দেখছি তাতে ওদের কাছে গেলে অপমান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর যাই হোক অপমান আমি হতে পারব না। তারচে’ আমি কাল থানায় যাব। পুলিশের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা আলাপ করব। নিশ্চয় তারা কোনও ব্যবস্থা নেবে।
মা দুঃখি মুখ করে বললেন, যা ভাল বুঝিস কর।
তারপর একটু থেমে বললেন, গুণ্ডাপাণ্ডাদের ব্যাপারে ভয় তো পাচ্ছিই তার ওপর মনও খারাপ লাগছে। এতদিন হল বাড়ি ছাড়া হয়ে আছে ছেলেটি। এতদিন ওকে না দেখে আমি কখনও থাকি নি। নাহিদদের বাড়িতে হয়তো সে ভালই আছে, তারপরও আমার মনটা কেমন করে। খেতে বসলে ছেলেটার কথা মনে হয়, ঘুমাতে গেলে মনে হয়। শুভর জন্য আমার কিছু ভাল লাগে না।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মা। আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন। করুণ গলায় বললেন, আল্লাহ, আমার ছেলেকে তুমি ভাল রেখ।
.
এখানে আসার পর থেকে বিকেলের দিকে শুভর মনটা কী রকম খারাপ হয়। কী রকম উদাস বিষণ্ণ লাগে।
দুপুরের পর আজ ছোটখাট একটা ঘুম দিয়েছিল সে। খানিক আগে ঘুম থেকে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জানালা থেকে আকাশটা বড় অদ্ভুত দেখায়। একটু যেন বেশি নীল, একটু যেন বেশি সাদা। এই আকাশের দিকে তাকালে শুভ সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়।
আজও হয়েছিল।
এ সময় বর্ষা এসে দাঁড়াল তার পেছনে। শুভ টের পেল না।
এই প্রথম, বহুদিন পর বিকেলবেলা সুন্দর করে আজ সেজেছে বর্ষা। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। মুখে সামান্য প্রসাধন, ব্যান্ড দিয়ে সুন্দর করে চুল বেঁধেছে। নিজেকে আজ নতুন মানুষ মনে হচ্ছে বর্ষার।
কিন্তু সে যে এই ঘরে এল শুভ তা টেরই পেল না।
খানিক দাঁড়িয়ে শুভকে দেখল বর্ষা। তারপর কথা বলল, কী হয়েছে আপনার?
চমকে পেছন ফিরে তাকাল শুভ। ও তুমি! কখন এলে?
বেশিক্ষণ না।
তারপর আবার প্রশ্নটা করল বর্ষা। কী হয়েছে আপনার?
কিছু না।
তারপর কথা ঘোরাল শুভ। কী আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি এলে আর আমি তা টেরই পাই নি।
আপনি খুব আনমনা ছিলেন।
মনটা ভাল নেই।
কেন?
শুনলে তোমার মন খারাপ হবে।
শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে বর্ষা গম্ভীর গলায় বলল, আমার মন খারাপ হলে আপনার কী?
সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছল হওয়ার চেষ্টা করল শুভ। বল কী! তোমার মন খারাপ হলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। জানতে চাও কী সর্বনাশ হবে?
জানতে চাইছি।
বর্ষার বলার ভঙ্গিতে অবাক হল শুভ। তুমি খুব অন্যরকম ভঙ্গিতে কথা বল।
কী রকম?
আমার প্রশ্ন শুনে যে কেউ বলবে, আচ্ছা বলুন। তুমি বললে, জানতে চাইছি।
তাতে কী হয়েছে?
এভাবে কথা বলা অন্যের সঙ্গে মেলে না।
আমার কোনও কিছুই কি অন্যের সঙ্গে মেলে?
না, তা মেলে না।
আমি অতি সাধারণ একটি মেয়ে। দেখতে ভাল নই। বেঁটে। সামান্য গান গাইতে পারি কিন্তু গলা তেমন ভাল নয়। বিএ পড়ি, কিন্তু পাস করতে পারব কীনা জানি না। আমার সোকতাপ খুব বেশি। কোনও কিছুই ভুলতে পারি না।
বর্ষার চোখের দিকে তাকিয়ে শুভ বলল, এসবই তোমার সৌন্দর্য। তুমি জান না তুমি কী সুন্দর মেয়ে। তোমার মুখটা খুব মিষ্টি। চোখ দুটো সুন্দর। কী সুন্দর করে কথা বল তুমি। তোমার লম্বা হওয়ার দরকার নেই। তুমি যেটুকু লম্বা, ওই যথেষ্ট। তোমার মতো মেয়ের কখনও বয়স বাড়ে না। মুখের দিকে তাকালেই তোমার জন্য মায়া লাগে।
বর্ষা আচমকা বলল, আপনার লাগছে?
শুভ থতমত খেল, তারপর হাসল, আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।
বর্ষাও হাসল। শেষ করুন।
তোমার মন খারাপ হলে আমার কী সর্বনাশ হবে শোন। তুমি ছাড়া, মানে এই বাড়িতে তুমি ছাড়া আমার খোঁজ খবর নেবে কে? আমার মন খারাপ হলে কে জিজ্ঞেস করবে, কী হয়েছে আপনার? আমার চা এনে দেবে কে?
শুভর কথা শুনে অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষা। শুভ তা খেয়াল করল না, বলল, একটা কথা বলব?
বলুন।
চল কোথাও বেরিয়ে আসি, বাড়িতে একদম ভাল লাগছে না।
বর্ষা আনমনা গলায় বলল, চলুন।
.
বড়ঘরের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার রাখা।
বিকেলবেলায় সেই চেয়ারে বসে আছেন হাদি সাহেব। দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে মিনু এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলেন হাদি সাহেব। কদিন ধরে মনটা খুব ভাল, বুঝলে।
হাদি সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। বাদলের মৃত্যুর পর বাড়িটা যে রকম গুমোট ধরে গিয়েছিল সেই ভাবটা কেটেছে।
নিজের কাপে চুমুক দিয়ে মিনু বললেন, ঠিকই বলেছ। বর্ষা একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রেয়াজ করছে। আজ দুপুরের পর দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে সাজছে। বাড়ির টুকটাক কাজ করছে। নাহিদ শুভর জন্য চা নিয়ে যাচ্ছে।
আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন। মেয়েটাকে নিয়ে টেনশনে ছিলাম। বহুদিন কোনও কাজ করতে পারিনি। কাজগুলো আবার শুরু করতে হবে।
কী কাজ?
পারুর বিয়ের চেষ্টা করতে হবে। পুবপাড়ার একটা জমি নিয়ে ঝামেলা লেগে আছে। সেই ঝামেলা মিটাতে হবে। কিছু জমি বিক্রি করে ঢাকায় ছোটখাট একটা বাড়ি করব ভেবেছিলাম, সেই কাজটাও শুরু করা দরকার।
কাপে শেষ চুমুক দিয়ে মিনু বললেন, ঢাকার বাড়িটাই আগে করা উচিত।
কেন?
নাহিদ থাকবে ঢাকায়। বর্ষার বিয়ে হলে সেও নিশ্চয় ঢাকায়ই থাকবে। তখন আমরা দুজন এখানে একা একা পড়ে থাকব কেন? ছেলেমেয়ে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।
হাদি সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ঠিকই বলেছ, একজন চলে গেছে, বাকি দুজনকে আমিও আর চোখের আড়াল করতে চাই না।
মিনু আর কথা বললেন না।
৯. নাহিদদের বাড়ির উত্তর দিকটায়
নাহিদদের বাড়ির উত্তর দিকটায় শাল মহুয়ার নিবিড় একখানা বন। হাঁটতে হাঁটতে বনের দিকটায় চলে এসেছে শুভ এবং বর্ষা। হঠাৎ বর্ষা বলল, আপনাকে একটা কথা বলব?
বর্ষার চোখের দিকে তাকাল শুভ। দুঃখ কষ্ট কিংবা মন খারাপের কথা হলে বলল না। শুনতে আমার ভাল লাগবে না। আমি নিজে এত দুঃখ বেদনার মধ্যে আছি…।
কথা শেষ করল না শুভ।
বর্ষা বলল, কী দুঃখ আপনার?
শুভ হাসল। যা বলতে চাইছ, বলো।
জানতাম প্রশ্নটা আপনি এড়িয়ে যাবেন।
সব কথা কি বলা যায়?
কাউকে কাউকে বলা যায়।
আমি কথা এড়াই কেন জান? মিথ্যে বলতে লজ্জা করে বলে।
তাহলে সত্য কথা বলুন।
সব সময় তাই বলি, কিন্তু এটা বলব না।
আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। আপনার মনের সব কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করে আমার।
কেন?
জানি না।
শুভ এবং বর্ষা যখন বনের দিকটায় হাঁটছে নাহিদ তখন বাড়ি ঢুকে শুভকে খুঁজছিল। পারুকে পেয়ে বলল, এই পারু, শুভকে দেখেছিস?
পারু বলল, না তো!
বর্ষাকে জিজ্ঞেস করে আয় তো শুভ কোথায় গেছে ও জানে কী না।
বর্ষাও বাড়ি নেই।
দুজনে তাহলে এক সঙ্গেই কোথাও গেছে। ঠিক আছে আমি দেখছি।
দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল নাহিদ, বনের দিকে হাঁটতে লাগল।
বর্ষা আর শুভ তখন বনের মাঝামাঝি সুন্দর একটা মাঠের ধারে এসেছে। চারদিকে নিবিড় গাছপালার বন তার মাঝামধ্যিখানে ঘন সবুজ ঘাসের একটুখানি একটা মাঠ। হঠাৎ করে তাকালে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
এই মাঠ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল শুভ। বাহ, সুন্দর জায়গা।
বর্ষা বলল, জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। এখানে এলে আমার মন অন্যরকম হয়ে যায়। আজ আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আমার প্রিয় জায়গাটা আপনাকে দেখাই।
কিন্তু এখানে এসে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে আমার মনের সবকথা তোমাকে বলে দিই। এভাবে কেন হঠাৎ করে তোমাদের এখানে এলাম, কেন এতদিন ধরে আছি।
শুভর কথা শুনে বর্ষার কী রকম অভিমান হল। মাঠের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমি শুনব না।
কেন?
জোর করে কারও মনের কথা আমি শুনতে চাই না।
বর্ষার অভিমানটা বুঝল শুভ। বর্ষার দিকে তাকিয়ে দুহাতে বর্ষার মুখটা প্রার্থনার ভঙ্গিতে তুলে ধরল সে। বর্ষার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, মন খারাপ করো না। আমি অবশ্যই একদিন তোমাকে সব বলব। আমার মনের সব কথা তোমাকে বলব।
এই দৃশ্যটা দেখে ফেলল নাহিদ।
শুভ এবং বর্ষাকে খুঁজতে এদিকেই আসছিল সে। বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে তাকাতেই দৃশ্যটা তার চোখে পড়ল। নিজের অজান্তে পা আটকে গেল তার। নাহিদ যেন বনের বৃক্ষ হয়ে গেল। হাঁটা চলার ক্ষমতা রইল না তার।
.
শাহিন অফিসে চলে যাওয়ার পর নিজের রুম গুছাচ্ছে সুরমা।
মা এসে ঢুকলেন। তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে চাই বউমা।
সুরমা কাজ বন্ধ করল, কী পরামর্শ?
তার আগে বলি, সেদিন শাহিনকে আমি বলেছিলাম সেতুর ভাইদের কাছে যেতে, ও যেতে রাজি হল না।
কিন্তু থানায় গিয়েছিল।
ওখানে না গেলেও কোনও অসুবিধা ছিল না। এ ব্যাপারে থানা পুলিশ না করাই। ভাল। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করা উচিত। কারণ দুদিন আগে বা পরে সম্পর্ক ওদের সঙ্গে আমাদের ঠিক হবেই। সেতুর ভাইদের কাছে না গিয়ে ভুল করেছে শাহিন। আমি ওর ওপর বিরক্ত হয়েছি।
মায়ের কথা শুনে স্বামীর পক্ষ নিল সুরমা। না মা, ওতো বলেছিল সেতুর ভাইরা যদি বোস কোনও কথাটথা বলে ফেলে সেটা খুব অপমানকর…
কথা শেষ করতে পারল না সুরমা। মা গম্ভীর গলায় বললেন, স্বামীর সাফাই গাইবার দরকার নেই। এসব ক্ষেত্রে এতকিছু ভাবা ঠিক নয়। ছোটভাইর জন্য না হয় একটু অপমান হতোই।
এবার কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল সুরমা, আপনি যেন কী পরামর্শের কথা বললেন?
আমি নিজেই সেতুর ভাইদের কাছে যেতে চাই।
জ্বি?।
হ্যাঁ। সরাসরি ওদের সঙ্গে কথা বলব। দেখি ওরা কী বলে!
সেতুর ছোট ভাইটা খুব রাগী।
হোক, তাতে আমার কী?
মানে সে যদি আপনাকে কোনও অপমানকর কথা বলে ফেলে?
ও রকম পরিবারের ছেলের এতটা অদ্র হওয়ার কথা না।
কিন্তু সেতুর বন্ধু দোলনকে সে খুব অপমান করেছে।
মা এসব কেয়ারই করলেন না। বললেন, দোলন আর আমি এক নই। আমি আজই যাব।
দুপুরবেলা সত্যি সত্যি মামুন-স্বপনের অফিসে এলেন তিনি। স্বপনের নয়, মামুনের রুমে ঢুকলেন।
উদাস হয়ে নিজের চেয়ারে বসেছিল মামুন। আচমকা বয়স্ক এবং বনেদি ধরনের মহিলাকে তার রুমে দেখে থতমত খেল। নিজের অজান্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিল। স্লামালেকুম বসুন, বসুন।
মা সালামের জবাব দিলেন। তারপর বসলেন।
মামুন বলল, আমি আপনাকে ঠিক, মানে চিনতে পারিনি আর কি!
মা সরল গলায় বললেন, আমি শুভর মা।
শুভ নামটা শুনে যেন নিভে গেল মামুন। জ্বি?
হ্যাঁ বাধ্য হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা বলা। দরকার।
মামুন গম্ভীর গলায় বলল, বলুন।
আমার ছেলে কী এমন অন্যায় করেছে যে তাকে আপনারা মেরে ফেলতে চাইছেন?
কথাটা বুঝতে পারল না মামুন। ভুরু কুঁচকে বলল, মেরে ফেলতে চাইছি?
হ্যাঁ। মাস্তান লাগিয়ে দিয়েছেন তার পেছনে।
মামুন অবাক। কী বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি।
না এমন কিছু তো আমরা করিনি।
করেছেন।
আমরা কোনও অভদ্রলোক নই যে এ ধরনের আচরণ করব!
আমিও তই মনে করতাম। অভদ্র বাড়ির মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের কোনও সম্পর্ক হওয়ার কথা নয়। আমার ছেলের রুচি খারাপ হতে পারে না।
মামুন গম্ভীর গলায় বলল, মাস্তানদের ব্যাপারে যা বলছিলেন, বলুন।
আমাদের বাড়ির সামনে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকছে দুজন মাস্তান। শুভ কোথায় আছে জানার জন্য আমার মেয়েকে ভয় দেখিয়েছে। ওদের ভয়ে গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে আছে আমার ছেলে।
এসব যে আমরাই করাচ্ছি তা আপনার মনে হল কেন? হতে পারে আপনার ছেলেও ওদের দলেরই। চাদা টাদার শেয়ার নিয়ে কোনও বিরোধ ইত্যাদির কারণে বন্ধু মাস্তানরাই তাকে খুঁজছে।
মামুনের কথা শুনে রেগে গেলেন মা। বাজে কথা বলবেন না। ওরকম ছেলের মা আমি নই। নিজের ছেলের সততা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা আছে বলেই এই পরিস্থিতিতে আপনার কাছে আমি আসতে পেরেছি। কখনো ভাববেন না আপনাদের টাকা পয়সা কিংবা জায়গা সম্পত্তির লোভে পড়ে আপনার বোনের সঙ্গে আমার ছেলের সম্পর্ক হয়েছে। বড়ছেলের শ্বশুর বাড়ির এক পয়সার জিনিস আমার বাড়িতে ঢোকে নি। ওসব আমরা ঘৃণা করি। টাকা পয়সা আমাদের নেই কিন্তু সতোর অহঙ্কার আছে।
এসব আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?
ব্যাপারটা আপনারা মেনে নিন আর ওসব মাস্তানদের ফেরান।
মামুন একটু সামনের দিকে ঝুঁকল। আমরা কী মেনে নেব না নেব সেটা আমাদের ব্যাপার। এই নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলবো না। তবে মাস্তান ইত্যাদি নিয়ে যে নোংরামোর কথা বললেন সেটা আমি অবশ্যই দেখব। আপনি কি চা খাবেন?
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন মা। না।
এদিকে মাকে নিয়ে খুবই টেনশান করছে মালা। সুরমার রুমে এসে বলল, আমার খুব ভয় করছে ভাবী।
সুরমা অবাক হল। কেন?
মা এখনও আসছে না কেন?
তাতে কী হয়েছে?
মানে সেতুর ভাইরা কী রকম ব্যবহার করে…
মালার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুরমা বলল, তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি।
তুমি বুঝতে পারছ না ভাবী। ওরা যে রকম গুণ্ডাপাণ্ডা লাগিয়েছে, মাকে এভাবে যেতে দেয়া তোমার ঠিক হয়নি। আমি জানলে কিছুতেই যেতে দিতাম না।
তোমাকেও যেতে হবে।
কোথায়?
সেতুদের বাড়ি।
মানে?
হ্যাঁ।
কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি। মা গেছেন সেতুর ভাইদের কাছে, তুমি আর আমি যাব ওর ভাবীদের কাছে। দেখি এভাবে ব্যাপারটা আমরা ম্যানেজ করতে পারি কী না!
মালার মুখ শুকিয়ে গেল। আমার ভয় করছে।
সুরমা বলল, ভয় করলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি একাই যাব।
সুরমার চোখের দিকে তাকিয়ে কী ভাবল মালা, তারপর বলল, না, সবাই শুভর জন্য এত করছে আমি করব না কেন? আমিও তোমার সঙ্গে যাব। যা হবার হবে। এক্ষুণি রেডি হয়ে আসছি।
দ্রুত হেঁটে নিজের রুমের দিকে চলে গেল মালা।
.
শুভর মা চলে যাওয়ার পর স্বপনকে নিজের রুমে ডেকে পাঠাল মামুন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এল স্বপন। রাগী ভঙ্গিতে মামুন বলল, মিথ্যে বলার দরকার নেই। ছোকরাটির মা আমার কাছে এসেছিলেন। তুই কি ওর পেছনে মাস্তান লাগিয়েছিস?
ভাইর মুখের দিকে তাকিয়ে স্বপন পরিষ্কার গলায় বলল, হ্যাঁ। ওর ওপর আমার খুব রাগ।
রাগ তো আমারও। সেজন্য এই ধরনের নোংরামো করতে হবে নাকি! ওরা যদি পুলিশের কাছে যায়! মাস্তানরা যদি ধরা পড়ে এবং পুলিশের কাছে যদি তোর নাম বলে দেয়, কেঁচো খুড়তে গিয়ে তো তখন সাপ বেরিয়ে পড়বে। সেতুর কেলেঙ্কারির কথা তখন চাপা থাকবে না।
ঠিক আছে আমি ওসব ম্যানেজ করছি। মাস্তান উইথড্র করব।
হ্যাঁ তাই কর।
সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল হল স্বপন। ভাইয়া, ফ্যান্টাসটিক একটা আইডিয়া পাওয়া গেছে। সেতুকে আমরা বলি, তুই যদি ডিভোর্স না করিস তাহলে শুভকে আমরা মেরে ফেলব। মাস্তান রেডি করেছি। দেখবে সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়ে যাবে।
স্বপনের কথা শুনে মামুনও খুশি হল। আইডিয়াটা ভাল।
কিন্তু আমি বললে কাজ হবে না বলতে হবে তোমাকে। সেতু জানে তুমি কখনও ফালতু কথা বল না।
চিন্তিত চোখে স্বপনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মামুন।
.
শিলা বলল, আপনারা এভাবে আমাদের বাড়িতে আসবেন আমরা কল্পনাই করিনি।
সুরমা বলল, আমরাও ভাবিনি এভাবে আসতে হবে। পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছি।
রেখা বলল, চা খান।
সেতুদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে ওরা। শিলা রেখা, সুরমা মালা। খানিক আগে ট্রলিতে করে প্রচুর খাবার নিয়ে এসেছে রানি। ট্রলিটা এখন সেন্টার টেবিলের একপাশে দাঁড় করানো। সেই ট্রলি থেকে চায়ের সরঞ্জাম নামাতে নামাতে কথাটা বলল রেখা। শুনে মালা বলল, না না, চা খাব না। আপনি অযথা কষ্ট করবেন না।
তারপর সুরমার দিকে তাকাল সে। ভাবী, কথা শুরু কর।
শিলা এবং রেখার দিকে তাকাল সুরমা। কথা যা বলতে চাই তা বোধহয় আপনারা বুঝতে পেরেছেন।
চায়ের সরঞ্জাম রেখে শিলার পাশে বসল রেখা। সুরমার মুখের দিকে তাকাল।
সুরমা বলল, ব্যাপারটা এত জটিল করা ঠিক হচ্ছে না। দুটো পরিবারেই বেশ বড় রকমের অশান্তি চলছে। সবমিলে পরিস্থিতিটা খুব বাজে হয়ে গেছে।
রেখা বলল, আমরাও তা বুঝি। কিন্তু আমরা হচ্ছি বাড়ির বউ। এক্ষেত্রে আমাদের কী করার আছে?
শিলা বলল, ওর কথা ঠিক। ফ্যামিলির যে কোনও ব্যাপারে সেতুর ভাইদের ডিসিশানই সব। আমাদের মতামতে তেমন কিছু হয় না।
কথাটা আমি বিশ্বাস করলাম না।
কেন?
বাড়ির বউরা চাইলে অবশ্যই স্বামীদেরকে কনভিন্স করতে পারে। আপনারা আপনাদের স্বামীদেরকে বোঝান যে দুটো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিজেদের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছে তাদেরকে এভাবে টর্চার করা ঠিক না। ব্যাপারটা তারা মেনে নিক।
রেখা বলল, আপনারা কিন্তু চা খেলেন না।
মালা হঠাৎত্র উঠে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক অবস্থায় যখন আসব তখন খাব।
তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, আমরা কি সেতুর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?
এক পলক মালার দিকে তাকিয়ে সুরমার দিকে তাকাল শিলা। আমার জায়গায় আপনি হলে কী করতেন?
কথাটা বুঝতে পারল না সুরমা। বলল, কী করতাম মানে?
এই অবস্থায়, মানে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সেতুর সঙ্গে কি আমি আপনাদেরকে দেখা করতে দিতে পারি?
না তা পারেন না। মালা ইমোশনালি বলে ফেলেছে। সেতুর সঙ্গে দেখা আমরা আজ করবও না।
সুরমাও উঠল। তবে আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনারা দুজনে মিলে সেতুর ভাইদেরকে বোঝাবেন। ব্যাপারটা দয়া করে আপনারা মেনে নিন।
রাতেরবেলা স্বপনকে রেখা বলল, তোমার জায়গায় যদি শুভ হতো আর আমার জায়গায় সেতু তখন আমাদের মনের অবস্থা কী রকম হতো একবার ভেবে দেখ।
স্বপন বলল, এসব আমি ভেবে দেখব না। কারণ আমাদের ক্ষেত্রে এরকম হয়নি।
কিন্তু শিক্ষিত এবং বিবেকবান মানুষের উচিত অন্যের সমস্যা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা।
রেখার চোখের দিকে তাকাল স্বপন। পরিষ্কার করে বল কী বলতে চাও তুমি?
আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পেরেছ।
না পারিনি।
তাহলে পরিষ্কার করে বলি। শুভকে তোমরা মেনে নাও।
কী?
আপন বোনকে এরকম কষ্ট দিচ্ছ, ব্যাপারটা খুবই অমানবিক।
হঠাৎ এভাবে সেতুর পক্ষে চলে গেলে?
অনেক ভেবেই গিয়েছি।
নিজেকে দিয়ে, আমাকে দিয়ে তো উদাহরণ দিলে, এবার আমি একটা উদাহরণ দিই? তোমার নিজের মেয়েটি যদি সেতুর মতো করে তুমি মেনে নেবে?
রেখা সঙ্গে সঙ্গে বলল, অবশ্যই নেব। আমার মেয়ে যদি কাউকে ভালবেসে বিয়ে করে সুখী হয়, কেন আমি তা মেনে নেব না? যার জীবন সে যাপন করবে, আমার কী? আমি কেন তাকে বাধা দেব।
খানিক কী ভাবল স্বপন তারপর বলল, সবকিছুর পরও সেতুর ব্যাপারে আমি কিছুই বলব না। ডিসিশান যা নেয়ার ভাইয়া নেবে।
.
তার মানে ওরা প্ল্যান করেই এসেছে। দুজন বাড়িতে, একজন আমার অফিসে।
মামুনের কথা শুনে শিলা একটু গম্ভীর হল। ওদের জায়গায় আমরা হলেও তাই করতাম। আমাদের কাছে এসে ওরা কোনও অন্যায় করেনি। অন্যায় আসলে করছি আমরা। সেতুকে নিয়ে আমরা যা করছি এরচে’ বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে এটা অপরাধ। তাছাড়া মানুষের মনের ওপর জোর করা আল্লাহ খুবই ঘৃণা করেন।
এসব কি ওরা বলে গেল?
ওরা বলবে কেন? আমি কি অশিক্ষিত মানুষ? আমি এসব বুঝি না?
মামুন কথা বলল না।
শিলা বলল, শোন, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, সেতু যা চাইছে তা মেনে নাও।
ওর জীবন ওরই। শুভকে নিয়ে ও যদি সুখী হয় তাতে তোমার অসুবিধা কী? ওর জীবন ওকে কাটাতে দাও।
মামুন কঠিন গলায় বলল, তোমার কথা আমি শুনব না। শুভকে ওর ডিভোর্স করতে হবে। এটাই ফাইনাল।
গ্রীবা বাঁকিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল শিলা। কেন?
কোনও ব্যাখাও তোমাকে আমি করব না।
ব্যাখ্যা তোমাকে করতে হবে। আমার স্বামী হয়ে অন্যায়ভাবে তুমি একটা কাজ করবে আর আমি তা মেনে নেব, তেমন স্ত্রী আমি নই। সেতুর ব্যাপারে কোনও রকমের বাড়াবাড়ি তুমি আর করবে না।
মামুন উঠে দাঁড়াল। আমার যা ডিসিশান তাই হবে। ডিভোর্স ছোকরাটিকে ওর। করতেই হবে।
শিলার দিকে আর তাকাল না মামুন। গটগট করে বেরিয়ে সেতুর রুমে এসে ঢুকল।
সেতু শুয়েছিল। মামুনকে দেখে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে উঠে বসল।
টেবিলের ওপর ডিভোর্স ফর্মটা পড়ে আছে। পাশে একটা কলম। ফর্ম এবং কলম হাতে নিয়ে মামুন বলল, আমি আজ শেষবারের মতো তোর কাছে এসেছি। ফাইনাল ডিসিশান নিয়ে এসেছি। সই করে দে, নয়তো পরিণতি খুব খারাপ হবে।
সেতু বলল, কী খারাপ হবে? মেরে ফেলবে আমাকে? মেরে ফেল।
তোকে মারব না। মারব ওই ছোকরাটাকে। ব্যবস্থাও করে ফেলেছি।
একথা শুনে সেতু একেবারে কেঁপে উঠল। ভাইয়া!
মামুন অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, তুই জানিস আমি সহজে কোনও ডিসিশান নিই, কিন্তু একবার যদি নিই তার কোনও নড়চড় হয় না। তোর ওপর ওই ছোরাটার জীবন নির্ভর করছে।
ছটফট করতে করতে সেতু তারপর বিছানা থেকে নামল। না ভাইয়া না। ওর কোনও ক্ষতি তুমি করো না। মারতে হয় আমাকে মার, আমাকে মেরে ফেল। শুভর। কোনও দোষ নেই।
আমি কোনও কথা শুনব না। সই করলে ছোকরাটাকে আমি কনসিডার করব, নয়তো লোক ঠিক করা আছে, শুধু একটা ফোন করব। চাইলে ওর লাশও তোকে দেখাব।
সেতু পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল। না না, না। দাও, আমি সই করে দিচ্ছি। যত সই চাও আমি করে দিচ্ছি। তবু, তবু শুভ বেঁচে থাক। ওকে তোমরা মেরো না। ওর কোনও দোষ নেই। সব দোষ আমার, আমার।
ডিভোর্স ফর্ম আর কলম হাতে নিয়ে করুণ ভঙ্গিতে কাঁদতে লাগল সেতু। প্রথমে সেতুর কান্নাটা পাত্তা দিল না মামুন। কিন্তু একটা সময়ে তার মনে হল মায়ের মৃত্যুর পর, বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের লাশের সামনে গড়াগড়ি খেয়ে যেমন করুণ স্বরে কেঁদেছিল সেতু, কান্নাটা যেন তেমন। জীবনের গভীর, গভীরতর দুঃখ ছাড়া এমন কান্না মানুষ কাঁদতে পারে না।
সেতুর এই কান্না মন বদলে দিল মামুনের। বহুকাল আগে একদিন মায়ের লাশের সামনে থেকে যেভাবে আদরের বোনটিকে নিজের বুকে টেনে এনেছিল সে, তারপর আরেকদিন বাবার লাশের সামনে থেকে যেভাবে টেনে এনেছিল নিজের অজান্তে ঠিক সেইভাবে সেতুকে বুকের কাছে টেনে আনল সে, আয়, আমার কাছে আয়।
সঙ্গে সঙ্গে ডিভোর্স ফর্ম আর কলম ছুঁড়ে ফেলে দুহাতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরল সেতু। আগের মতোই করুণ স্বরে কাঁদতে লাগল।
মামুনেরও ততোক্ষণে জলে চোখ ভরে গেছে। বোনের মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে, কাঁদতে কাঁদতে মামুন বলল, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে। খুব অন্যায় হয়ে গেছে আমার। তোর মনের ওপর এতটা জোর করা আমার ঠিক হয়নি। শুভকে আমি মেনে নিলাম। কাদিস না। তুই যা চাস তাই হবে। তাই হবে।
স্বামীর পিছু পিছু সেতুর রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল শিলা। এখন দুইভাই বোনের এই অবস্থা দেখে তার চোখও জলে ভরে এল।
.
বিকেলের মুখে নিজের ঘরে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে বর্ষা। ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।
বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিল শুভ, বর্ষার গান শুনে বেরুল না, তার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। কিন্তু বর্ষা তাকে দেখতে পেল না। চোখ বুজে গান গাইছে সে। বর্ষাকে এভাবে দেখে আর তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল শুভ।
গান গাইতে গাইতে একসময় চোখ খুলল বর্ষা। শুভকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে গান থামাল। আপনি কখন এলেন?
শুভ হাসল। অনেকক্ষণ।
আমাকে ডাকেননি কেন?
তুমি গান গাইছিলে, শুনছিলাম। এত ভাল লাগছিল!
তুমি বলেছিলে আমাকে একদিন গান শোনাবে, শোনালে না তো, এজন্য নিজে নিজেই। চুরি করে শুনে নিচ্ছি।
বর্ষা হাসল। ভালই করেছেন। গানটা আমি আপনার জন্যই গাইছিলাম।
তাহলে আবার গাও।
কেন?
শুনলে মনটা ভাল হবে।
তার মানে আজও আপনার মন খারাপ। আপনার মন এত খারাপ হয় কেন? কী কারণে হয়? কার জন্য হয়?
গভীর করে বর্ষার চোখের দিকে তাকাল শুভ। যার জন্য খারাপ হয় খুব শীঘ্রই তার কথা তোমাকে আমি বলব।
বর্ষা আবদারের গলায় বলল, আজই বলুন না! এক্ষুণি বলুন না!
মুখের মজাদার একটা ভঙ্গি করল শুভ। না।
তারপর উঠোনে নামল। নেমেই নাহিদকে দেখতে পেল উদাস হয়ে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে!
শুভ তারপর নাহিদের সামনে এসে দাঁড়াল। কী হয়েছে রে তোর?
নাহিদ বলল, কী হবে?
বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি তুই কেমন উদাস, চিন্তিত হয়ে আছিস। কী হয়েছে?
নাহিদ হাসার চেষ্টা করল। কিছু না।
চিন্তিত থাকার কথা আমার, থাকছিস তুই। আবার বলছিস কিছু হয়নি।
সত্যি কিছু হয়নি।
কিছু না হলে বাড়ি বসে আছিস কেন? ঢাকায় যা। ওদিককার খোঁজ খবর নিয়ে আয়। অনেকদিন হয়ে গেল।
যদি সব ঠিক হয়ে যায় তাহলে তুই ফিরে যাবি?
একথা শুনে শুভ খুবই অবাক হল। কী রকম কথা বলছিস? চিরকাল তোদের এখানে থাকব নাকি! ঠিক হোক না হোক ফিরে তো যাবই।
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাই তো! ঠিক আছে দুতিন দিনের মধ্যেই আমি ঢাকায় যাব।
যা। আমার খুব অস্থির লাগছে।
নাহিদ আর কথা বলল না।
.
বর্ষার হাতে গীতবিতান।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে গীতবিতানের পাতা উল্টাচ্ছে সে। কিন্তু কিছুই যেন দেখছে না।
পারু আছে এই ঘরে। ব্যাপারটা সে খেয়াল করল। বলল, কী হয়েছে তোমার?
বর্ষা একটু চমকাল। কই কিছু না।
পারু হাসল, আমি তোমার চে’ বয়সে বড়।
তাতে কী হয়েছে?
এসব বুঝি।
কী সব বুঝিস?
পরে বলব, তার আগে আমার একটা কথার জবাব দাও।
কী কথা? শুভ ভাইকে তোমার কেমন লাগে?
বর্ষা থতমত খেল। কেমন লাগে মানে? ভাল লাগে। খুব ভাল লাগে।
সে যখন এখান থেকে চলে যাবে তখন কেমন লাগবে?
বর্ষা গম্ভীর হল। পারু, কী বলতে চাচ্ছিস তুই?
পারু আবার হাসল। তুমি যা বুঝেছ তাই বলতে চেয়েছি। শুভ ভাইর সঙ্গে তোমার ব্যবহার দেখে, তোমার মুখ দেখে আমি সব বুঝে গেছি।
বর্ষা কথা বলল না।
পারু বলল, তবে শুভ ভাইকে তুমি বোধহয় তোমার মনের কথা এখনও বলতে পারনি।
একথা শুনে বর্ষা কাতর হল। না পারিনি।
কেন?
কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। তুই আমাকে বলে দে।
তার আগে আরেকটা কথা আছে।
কী?
শুভ ভাইর মন কি তুমি বুঝতে পারছ? তুমি যা ভাবছ সেও তা ভাবছে কি না, জানো?
আমার তো মনে হচ্ছে।
কীভাবে?
কথায়, ব্যবহারে।
তাহলে অপেক্ষা করো। আমার মনে হয় সে-ই আগে বলবে। তারটা শোনার পর তুমি বলো।
পারুর কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষা।
.
সন্ধের মুখে বাড়ি ফেরার সময় মাঠের ধারে বর্ষা এবং শুভকে দেখতে পেলেন হাদি সাহেব। আস্তেধীরে হেঁটে বাড়ির দিকে ফিরছে তারা। এতটাই মগ্ন নিজেদের মধ্যে দুজনের কেউ হাদি সাহেবকে দেখতে পেল না। শুভর কী কথায় খিলখিল করে হাসতে। লাগল বর্ষা। হাসতে হাসতে শুভর গায়ে ঢলে পড়ল।
দৃশ্যটা খারাপ লাগল না হাদি সাহেবের। বাড়ি ফিরে শুভকে নিয়ে স্ত্রীকে কিছু প্রশ্ন করলেন।
মিনু বললেন, হঠাৎ শুভকে নিয়ে এতকিছু জানতে চাইছ?
আসলে ওদের ফ্যামিলি নিয়ে আমি কিছুই জানি না।
জানবার দরকার কী? নাহিদের বন্ধু এই যথেষ্ট। আর ছেলেটি খুব ভাল।
বর্ষার সঙ্গে বেশ মানায়, না?
মানে?
বোঝনি?
এবার উচ্ছ্বসিত হলেন মিনু। বুঝেছি, বুঝেছি।
হাদি সাহেব বললেন, আমার কেন যেন মনে হয় শুভর কারণেই বাদলকে ভোলার চেষ্টা করছে বর্ষা। স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
হতে পারে।
শুভকে নিয়ে কি তাহলে ভাববে?
হলে খুব ভাল হয়।
আমি তাই মনে করি। ঠিক আছে নাহিদকে ডাক, ওর সঙ্গে কথা বলি।
নাহিদ আসার পর মিনু বললেন, তোর বাবার মাথায় একটা চিন্তা এসেছে।
নাহিদ উদাস গলায় বলল, কীসের চিন্তা?
বর্ষার বিয়ের।
চমকে মায়ের মুখের দিকে তাকাল নাহিদ। কোথায় বিয়ে? কার সঙ্গে?
হাদি সাহেব স্নিগ্ধ গলায় বললেন, ছেলে আমাদের হাতের কাছেই আছে। বর্ষার ব্যাপারে ওর বোধহয় আগ্রহ আছে। আচার আচরণে মনে হল বর্ষারও আছে।
মিনু বললেন, এত ভণিতা করছ কেন? নামটা সরাসরি ওকে বল।
হাদি সাহেব বললেন, ওর বোঝা উচিত যে আমি শুভর কথা বলছি।
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে খুবই শীতল গলায় নাহিদ বলল, না, এটা হবে না।
কেন?
শুভ বিবাহিত।
কথাটা শুনে দুজন মানুষ একেবারে বোবা হয়ে গেলেন।
মিনু বললেন, কী?
হ্যাঁ। এরচে’ বেশি কিছু আমি বলতে পারছি না। শুভর কাছে আমি প্রমিজ করেছি। প্রমিজ না করলে আগেই তোমাদেরকে সব বলতাম।
হাদি সাহেব বড় করে শ্বাস ফেললেন। কী ভাবলাম, কী হল! আমাদের সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। ভাবি এক, হয় আর এক।
নাহিদ বলল, আমার ধারণা বর্ষাও তোমাদের মতো ভাবছে। যখন সব শুনবে, খুব কষ্ট পাবে। ওকে তোমরা সামলে রেখ।
নাহিদ মন খারাপ করে উঠল।
.
দুপুরের মুখে মুখে শুভ আজ একাকী সেই মাঠে চলে এসেছে।
মাঠের চারদিকে বনের গাছে হা হা করছিল হাওয়া। তীব্র গন্ধের বুনোফুল ফুটেছিল কোথাও। হাওয়ায় ভাসছিল সেই গন্ধ। দূরে কোথায় ডাকছিল অচেনা এক পাখি। বনের নির্জনতায় মিলেমিশে যাচ্ছিল সেই ডাক।
এই নির্জনতায় শুভর শুধু মনে পড়ছিল সেতুর কথা।
কদিন সেতুর সঙ্গে কথা বলা হয় না, সেতুকে ছোঁয়া হয় না। আরও কতদিন এভাবে কাটবে, কে জানে।
সেতুর কথা ভেবে বুকটা তোলপাড় করছিল শুভর। কান্না পাচ্ছিল।
ঠিক এসময় গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বর্ষা। মাঠের দিকে শুভকে দেখে অপূর্ব এক হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। যেন বহুকাল ধরে হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে হঠাৎ করেই খুঁজে পেয়েছে সে এমন করে শুভর দিকে ছুটতে লাগল।
বর্ষাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে নিজেকে সামলাল শুভ। দ্রুত হেঁটে নিজেও এগুলো বর্ষার দিকে।
বর্ষা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আপনি এখানে, আর আমি আপনাকে কোথায় না খুঁজেছি। শেষ পর্যন্ত এখানে এলাম।
শুভ হাসল। বুঝলে কী করে আমি যে এখানে?
মনে হল। আমার মন কখনও কখনও কিছু কথা বলে জানেন? এবং তার প্রতিটা কথা সত্য হয়। এই তো আপনাকে যখন আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি, কোথাও পাচ্ছি না, আমার মন হঠাৎ বলল আপনি এই মাঠের দিকে এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটতে শুরু করলাম।
কিন্তু আমাকে হঠাৎ এভাবে খুঁজতে শুরু করলে কেন তুমি?
নিশ্চয় কারণ আছে।
কী কারণ?
আপনার একটা জিনিস আমার হাতে এসে পড়েছে।
কী?
অনুমান করুন তো!
আমার অনুমান শক্তি খুব কম।
আপনার অনেক কিছুই খুব কম।
যেমন?
বলব না।
তারপর গলার কাছ দিয়ে কামিজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দুভাঁজ করা হলুদ খামের একটা চিঠি বের করল বর্ষা। ঢাকা থেকে আপনার একটা চিঠি এসেছে। পিয়ন এসে চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাছে আসার একটা অজুহাত পেলাম আমি। চিঠিটা যাতে অন্য কেউ দেখতে না পায় এজন্য ভাঁজ করে বুকের কাছে রেখেছি।
কিন্তু ঢাকা থেকে চিঠি এসেছে শুনে এমনই দিশেহারা হল শুভ, বর্ষার কথা বেশির ভাগই সে শুনতে পেল না। প্রায় থাবা দিয়ে চিঠিটা সে নিল। চিঠি এসেছে এতক্ষণ বলনি কেন?
পাগলের মতো খামটা ছিঁড়ল শুভ। কোনওদিকে না তাকিয়ে দ্রুত চিঠি পড়তে লাগল।
সুরমা চিঠি লিখেছে।
কিন্তু চিঠি পড়ে শুভ যেন সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল। প্রথমে শিশুর মতো দুতিনটে লাফ দিল তারপর আচমকা কোমরের কাছটায় জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল বর্ষাকে। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, কী যে আনন্দ হচ্ছে তোমাকে তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সংবাদ নিয়ে যে চিঠি এসেছে, বর্ষা, বর্ষা তুমি সেই চিঠি নিয়ে এসেছ আমার কাছে। তোমাকে যে আমি কেমন করে কৃতজ্ঞতা জানাব! কোন ভাষায় যে জানাব! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি বর্ষা। খুশিতে আনন্দে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মরে যাচ্ছি।
চিঠি পড়ে মানুষ যে এমন করতে পারে জানা ছিল না বর্ষার। কী লেখা আছে এই চিঠিতে! শুভ এমন করছে কেন?
তারপর গোপন এক ভাল লাগায় শরীর মন ভরে গেল বর্ষার।
এই প্রথম কোনও পুরুষমানুষ তাকে স্পর্শ করল। তাও সেই পুরুষ যাকে সম্পূর্ণ করে চায় বর্ষা। সারাজীবনের জন্য নিজের করে চায়। সেই পুরুষ তাকে কোলে নিয়েছে। দুহাতে জড়িয়ে রেখেছে তার শরীর। তার স্পর্শে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ষার কাঁটা নয় যেন ফুল ফুটতে শুরু করেছে। নদীর চোরাস্রোতের মতো শরীর অভ্যন্তরে প্রবল বেগে বইতে শুরু করেছে রক্তস্রোত। নিজের কাছে নিজেই যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা। গভীর আবেশে বাকরুদ্ধ হচ্ছে। শ্বাস ফেলতে ভুলে যাচ্ছে।
তখুনি সেই আনন্দলোক থেকে মাটির দুঃখময় পৃথিবীতে তাকে নামিয়ে আনল শুভ। সব ঠিক হয়ে গেছে বর্ষা, সব ঠিক হয়ে গেছে। কালই ঢাকায় ফিরে যাব আমি।
শুভর কথায় মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না বর্ষা। শরীর জুড়ে তার তখনও সেই আবেশ। মন জুড়ে আশ্চর্য এক ভাল লাগা। চোখে লেগে আছে স্বপ্নের মতো ঘোরলাগা দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে শুভর মুখের দিকে তাকাল সে। কী ঠিক হয়ে গেছে? কেন ঢাকায় ফিরে যাবেন আপনি?
তোমাকে তো বলা হয়নি। তুমি তো কিছুই জানো না। এখন আমি তোমাকে সব বলব। সেতুর কথা সব তোমাকে বলব। কেমন করে আমরা দুজন দুজনার জন্য পাগল হয়েছিলাম, কেমন করে আমাদের বিয়ে হল, কেন আমি তোমাদের এখানে এসে এভাবে বসে আছি, সব, সব তোমাকে আমি এখন বলব।
শুভর কথা শুনে বর্ষার মনে হল বহুদূরের আকাশ থেকে নিঃশব্দে এক বজ্রপাত হয়েছে আচমকাই। পৃথিবীর অন্য কোথাও নয়, সেই বজ্রপাতে ঝাঁঝরা হয়েছে শুধু তার। হৃদয়। বনের মাটিতে চিরকালের তরে যেন আটকে গেছে তার দুখানা পা, স্বরনালি চেপে ধরেছে মৃত্যুর মতো অদৃশ্য এক ঘাতক, চোখের দৃষ্টি থেকে কে যেন কেড়ে নিয়েছে। দেখার শক্তি। বর্ষা যেন এখন আর কোনও মানুষ নয়, বর্ষা যেন বনভূমির এক নির্বাক বৃক্ষ।
শুভর মুখে তখন কথার ফুলঝুরি ফুটেছে। সেতুকে নিয়ে মনের ভেতর জমে থাকা সব কথা বর্ষাকে সে বলে যাচ্ছে। বর্ষা শুনছে কী শুনছে না বুঝতে পারছে না।
অনেকক্ষণ পর যেন বুঝতে পারল। অনেকক্ষণ পর যেন নিজের মধ্যে ফিরে এল সে। তীক্ষ্ণচোখে বর্ষার মুখের দিকে তাকাল। তুমি যে কোনও কথা বলছ না?
এই প্রথম চোখে পলক পড়ল বর্ষার। এই প্রথম বর্ষা একটু কেঁপে উঠল। নিজের অজান্তে চোখের কোল ভরে গেল জলে। নিজেকে সামলাবার জন্য অন্যদিকে মুখ ফেরাল সে।
ব্যাপারটা খেয়াল করল শুভ। আনন্দে ফেটে পড়া মুখ ম্লান হল তার। আলতো করে বর্ষার একটা হাত ধরল সে। কী হয়েছে?
একথার জবাব দিল না বর্ষা। আকাশের দিকে তাকিয়ে শূন্য গলায় বলল, চলুন, ফিরি।
কিন্তু কয়েক পা গিয়েই থমকে দাঁড়াল সে। শুভ দেখতে পেল চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে বর্ষার। নিঃশব্দে আকূল হয়ে কাঁদছে সে।
শুভ দিশেহারা হল। কী হয়েছে, এমন করে কাঁদছ কেন তুমি?
কান্না জড়ানো গলায় কোনও রকমে বর্ষা বলল, আমার আবার বাদলের কথা মনে পড়ছে। বাদলের জন্য আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে।
দুহাতে বুক চেপে বনের মাটিতে বসে পড়ল বর্ষা। শিশুর মতো শব্দ করে কাঁদতে লাগল। বাদল, বাদল, আমাকে ছেড়ে তুই কোথায় চলে গেলি? কেন চলে গেলি? এখন আমার কষ্টের কথা আমি কাকে বলি? আমার যে কেউ রইল না, কিছু রইল না।
বর্ষার কান্না দেখে বনের গাছপালার মতো স্তব্ধ হল শুভ। মানুষের এমন কষ্টের কান্না সে কখনও দেখেনি।
রচনাকাল : মে-জুন ১৯৯৯