তুই যে বউ সেজেছিস ভাইয়াকে দেখাবি না?
দেখাব তো!
তাহলে?
আচ্ছা যাব।
তারপর যাবি ফুপির রুমে। গিয়ে আড়াল থেকে নাম ধরে ডাকবি। তারপর হঠাৎ করে সামনে যাবি।
কেন এমন করব?
মজা করার জন্য। তোকে দেখে যেন চমকে যায়।
শুনে খুশি হয়ে গেল টুপলু। আচ্ছা।
পুরোপুরি বউ সাজার পর পা টিপে টিপে বাবলুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াল টুপলু। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতর উঁকি দিল।
পড়ার টেবিলে বসে আছে বাবলু। সামনে মোটা একটা বই খোলা পড়ে আছে। কিন্তু পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। কানে ওয়াকম্যানের হেডফোন লাগানো। তারপরও কোনওদিকে তাকাচ্ছে না।
পাখির মতো গলায় বাবলুকে ডাকল টুপলু। বাবলু ভাইয়া।
বাবলু শুনতে পেল না।
টুপলু আবার ডাকল। এবারও শুনতে পেল না বাবলু। খানিক দাঁড়িয়ে টুপলু ভাবল, কী করা যায়? তারপর পা টিপে টিপে বাবলুর পেছনে এসে দাঁড়াল। দুবার ডেকে সাড়া পায়নি বলে মেজাজ বোধহয় একটু খারাপ হয়েছিল। এবার ডাকলেও হয়তো শুনবে না ভেবে বাবলুর কোমরের কাছে একটা খোঁচা মারল সে। এই বাবলু ভাইয়া, এই, তুমি শোন না?
চমকে পেছন ফিরে তাকাল বাবলু। কান থেকে হেডফোন খুলল। কানে হেডফোন থাকলে বাইরের কথা তেমন শোনা যায় না। তাছাড়া ওয়াকম্যানে বাজছে রিকি মার্টিনের মারিয়া। অত ধুমধারাক্কা মিউজিক এবং চিৎকার চেঁচামেচির গান বাজলে কি অন্যকিছু শোনা যায়?
হেডফোন খুলে অবাক বিস্ময়ে টুপলুর দিকে তাকাল বাবলু। তুই কে রে?
টুপলু অবাক। আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?
না।
একদম চিনতে পারছ না?
একদম চিনতে পারছি না।
টুপলু হি হি করে হাসল। আমি টুপলু।
বাবলু খুবই মজার মুখভঙ্গি করল। ও তুই টুপলি?
তারপরই আচমকা রেগে গেল। যা ভাগ এখান থেকে।
বাবলুর বাঁজখাই গলা শুনে প্রথমে একটু ভড়কাল টুপলু। তারপর শাড়িটা সামান্য তুলে ধরে, মুখ ভেংচে দৌড় দিল।
শাড়ি পরা থাকলে দৌড়তে যে অসুবিধা এই বয়সেই টুপলু তা বুঝে গেছে।
.
এ্যালবামের মাঝামাঝি জায়গায় নিজের সুন্দর ছবির তলায় শুভর একটা ছবি রেখে দিয়েছে সেতু। যখনই ইচ্ছে হয় ছবিটা একবার বের করে দেখে। ছবির সঙ্গে মনে মনে কথা বলে।
আজ সকালে বারান্দা থেকে ফিরে এসে শুভর জন্য এতই কাতর হল সে, ছবিটা বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। মনে মনে কথা বলা শুরু করার আগে বেশ কিছুদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল। শুভ বলেছিল সাড়ে বারোটার দিকে রমনা রেস্টুরেন্টে সেতুর জন্য অপেক্ষা করবে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আসবে সেতু। আর সেতুর আগেই রেস্টুরেন্টের লেক সাইডের ঝুল বারান্দায় এসে বসে থাকবে শুভ। কোত্থেকে আসবে, বলেনি।
সেতুর নিয়ম হল শুভ যে সময় দেয় তারচে পাঁচ দশমিনিট দেরি করে পৌঁছানো। দেরিটা সে ইচ্ছে করেই করে। কারণ জায়গা মতো পৌঁছে শুভকে না পেলে তার মেজাজ খুবই খারাপ হয়। সময়ের পাঁচ দশমিনিট আগ থেকেই এসে বসে থাকে শুভ। সেতুর জন্য অপেক্ষা করে। এসব সেতু জানে। তবু সে আসে দেরি করে। যদি শুভর কখনও পাঁচ দশমিনিট দেরি হয়ও তবু সেতু এসে তাকে পাবে।
সেদিন হয়ে গেল ভয়ংকর কাণ্ড। পৌনে একটার দিকে পৌঁছে সেতু দেখে শুভ নেই। দেখে প্রথমে বিশ্বেস হয়নি শুভ সত্যি সত্যি পৌঁছয়নি। মনে হয়েছে নিশ্চয় পৌঁছে গেছে। হয়তো টয়লেট ফয়লেটে গেছে।
কিন্তু টয়লেটে যাওয়ার দরকার হলেও সেতু এসে পৌঁছবার আগেই শুভ তা সেরে রাখে। সেতুর আসার সময় হয়ে গেছে আর শুভ পৌঁছয়নি কিংবা টয়লেটে, এমন কখনও হয়নি।
সেতু বেশ বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল কিন্তু বিশ্বাস করল না যে শুভ পৌঁছয়নি। সে একটা টেবিলে বসে রইল।
পাঁচমিনিট দশমিনিট পনেরমিনিট চলে গেল শুভর দেখা নেই। ভেতরে ভেতরে মেজাজ খারাপ হতে লাগল সেতুর। সুন্দর মুখে এসে ভর করতে লাগল বিরক্তি।
এইসব রেস্টুরেন্টের ওয়েটারগুলো তালে থাকে কাস্টমার এসে টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গে কতক্ষণে অর্ডার নেবে, কতক্ষণে খাবার সার্ভ করবে।
সেতুর ক্ষেত্রেও তাই করল।
মেনু হাতে ওয়েটার এসে সামনে দাঁড়াল। কী খাবেন ম্যাডাম? চায়নিজ থাই। ইন্ডিয়ান না বাংলাদেশী খাবার?
সেতুর প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল, তোমার মুণ্ডু।
অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল সে। কোনও রকমে বলল, পরে অর্ডার দেব।
লোকটির বোধহয় বেশি কথা বলার স্বভাব। বলল, কত পরে?
জানি না।
জ্বী?
আমি একজনের জন্য ওয়েট করছি। সে আসুক, তারপর।
লোকটি বিগলিত হাসল। আমিও তাই ভেবেছি। আপনার মতো ম্যাডামরা একা এসে কখনও খায় না। স্যার আসবেন কখন?
বিরক্তি তখন চরমে সেতুর। তবু চেপে রাখতে হল। এই এক্ষুণি চলে আসবে।
শুভ এল একটা দশে। অর্থাৎ তার হিসেবে চল্লিশমিনিট লেট, আর সেতু আসার পর পঁচিশমিনিট। কিন্তু মুখটা খুবই করুণ তার এবং সামান্য হাঁপাচ্ছিল। দিশেহারা ভঙ্গিতে রেস্টুরেন্টের ঝুলবারান্দায় ছুটে এসেছিল সে, প্রায় হুড়মুড় করে সেতুর মুখোমুখি চেয়ারে বসেছিল। কখন এসেছ তুমি? নিশ্চয় অনেকক্ষণ! ইস আমার অনেক দেরি হয়ে। গেল। কী করব বল? আমাদের তো গাড়ি নেই! রিকশা স্কুটারে চলাফেরা করতে হয়। স্কুটার বেশ এক্সপেনসিভ। তারপরও তোমার জন্য আজ স্কুটারে চড়েছিলাম। কিন্তু। স্কুটারগুলোর যা নেচার। হয় প্লাকে ময়লা আসে, নয় স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। আমারটারও তাই হয়েছে আজ। পার্কের ওদিকটায় এসে একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছিল না।