চিঠি পড়ে মানুষ যে এমন করতে পারে জানা ছিল না বর্ষার। কী লেখা আছে এই চিঠিতে! শুভ এমন করছে কেন?
তারপর গোপন এক ভাল লাগায় শরীর মন ভরে গেল বর্ষার।
এই প্রথম কোনও পুরুষমানুষ তাকে স্পর্শ করল। তাও সেই পুরুষ যাকে সম্পূর্ণ করে চায় বর্ষা। সারাজীবনের জন্য নিজের করে চায়। সেই পুরুষ তাকে কোলে নিয়েছে। দুহাতে জড়িয়ে রেখেছে তার শরীর। তার স্পর্শে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ষার কাঁটা নয় যেন ফুল ফুটতে শুরু করেছে। নদীর চোরাস্রোতের মতো শরীর অভ্যন্তরে প্রবল বেগে বইতে শুরু করেছে রক্তস্রোত। নিজের কাছে নিজেই যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা। গভীর আবেশে বাকরুদ্ধ হচ্ছে। শ্বাস ফেলতে ভুলে যাচ্ছে।
তখুনি সেই আনন্দলোক থেকে মাটির দুঃখময় পৃথিবীতে তাকে নামিয়ে আনল শুভ। সব ঠিক হয়ে গেছে বর্ষা, সব ঠিক হয়ে গেছে। কালই ঢাকায় ফিরে যাব আমি।
শুভর কথায় মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না বর্ষা। শরীর জুড়ে তার তখনও সেই আবেশ। মন জুড়ে আশ্চর্য এক ভাল লাগা। চোখে লেগে আছে স্বপ্নের মতো ঘোরলাগা দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে শুভর মুখের দিকে তাকাল সে। কী ঠিক হয়ে গেছে? কেন ঢাকায় ফিরে যাবেন আপনি?
তোমাকে তো বলা হয়নি। তুমি তো কিছুই জানো না। এখন আমি তোমাকে সব বলব। সেতুর কথা সব তোমাকে বলব। কেমন করে আমরা দুজন দুজনার জন্য পাগল হয়েছিলাম, কেমন করে আমাদের বিয়ে হল, কেন আমি তোমাদের এখানে এসে এভাবে বসে আছি, সব, সব তোমাকে আমি এখন বলব।
শুভর কথা শুনে বর্ষার মনে হল বহুদূরের আকাশ থেকে নিঃশব্দে এক বজ্রপাত হয়েছে আচমকাই। পৃথিবীর অন্য কোথাও নয়, সেই বজ্রপাতে ঝাঁঝরা হয়েছে শুধু তার। হৃদয়। বনের মাটিতে চিরকালের তরে যেন আটকে গেছে তার দুখানা পা, স্বরনালি চেপে ধরেছে মৃত্যুর মতো অদৃশ্য এক ঘাতক, চোখের দৃষ্টি থেকে কে যেন কেড়ে নিয়েছে। দেখার শক্তি। বর্ষা যেন এখন আর কোনও মানুষ নয়, বর্ষা যেন বনভূমির এক নির্বাক বৃক্ষ।
শুভর মুখে তখন কথার ফুলঝুরি ফুটেছে। সেতুকে নিয়ে মনের ভেতর জমে থাকা সব কথা বর্ষাকে সে বলে যাচ্ছে। বর্ষা শুনছে কী শুনছে না বুঝতে পারছে না।
অনেকক্ষণ পর যেন বুঝতে পারল। অনেকক্ষণ পর যেন নিজের মধ্যে ফিরে এল সে। তীক্ষ্ণচোখে বর্ষার মুখের দিকে তাকাল। তুমি যে কোনও কথা বলছ না?
এই প্রথম চোখে পলক পড়ল বর্ষার। এই প্রথম বর্ষা একটু কেঁপে উঠল। নিজের অজান্তে চোখের কোল ভরে গেল জলে। নিজেকে সামলাবার জন্য অন্যদিকে মুখ ফেরাল সে।
ব্যাপারটা খেয়াল করল শুভ। আনন্দে ফেটে পড়া মুখ ম্লান হল তার। আলতো করে বর্ষার একটা হাত ধরল সে। কী হয়েছে?
একথার জবাব দিল না বর্ষা। আকাশের দিকে তাকিয়ে শূন্য গলায় বলল, চলুন, ফিরি।
কিন্তু কয়েক পা গিয়েই থমকে দাঁড়াল সে। শুভ দেখতে পেল চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে বর্ষার। নিঃশব্দে আকূল হয়ে কাঁদছে সে।
শুভ দিশেহারা হল। কী হয়েছে, এমন করে কাঁদছ কেন তুমি?
কান্না জড়ানো গলায় কোনও রকমে বর্ষা বলল, আমার আবার বাদলের কথা মনে পড়ছে। বাদলের জন্য আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে।
দুহাতে বুক চেপে বনের মাটিতে বসে পড়ল বর্ষা। শিশুর মতো শব্দ করে কাঁদতে লাগল। বাদল, বাদল, আমাকে ছেড়ে তুই কোথায় চলে গেলি? কেন চলে গেলি? এখন আমার কষ্টের কথা আমি কাকে বলি? আমার যে কেউ রইল না, কিছু রইল না।
বর্ষার কান্না দেখে বনের গাছপালার মতো স্তব্ধ হল শুভ। মানুষের এমন কষ্টের কান্না সে কখনও দেখেনি।
রচনাকাল : মে-জুন ১৯৯৯