একথা শুনে বর্ষা কাতর হল। না পারিনি।
কেন?
কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। তুই আমাকে বলে দে।
তার আগে আরেকটা কথা আছে।
কী?
শুভ ভাইর মন কি তুমি বুঝতে পারছ? তুমি যা ভাবছ সেও তা ভাবছে কি না, জানো?
আমার তো মনে হচ্ছে।
কীভাবে?
কথায়, ব্যবহারে।
তাহলে অপেক্ষা করো। আমার মনে হয় সে-ই আগে বলবে। তারটা শোনার পর তুমি বলো।
পারুর কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষা।
.
সন্ধের মুখে বাড়ি ফেরার সময় মাঠের ধারে বর্ষা এবং শুভকে দেখতে পেলেন হাদি সাহেব। আস্তেধীরে হেঁটে বাড়ির দিকে ফিরছে তারা। এতটাই মগ্ন নিজেদের মধ্যে দুজনের কেউ হাদি সাহেবকে দেখতে পেল না। শুভর কী কথায় খিলখিল করে হাসতে। লাগল বর্ষা। হাসতে হাসতে শুভর গায়ে ঢলে পড়ল।
দৃশ্যটা খারাপ লাগল না হাদি সাহেবের। বাড়ি ফিরে শুভকে নিয়ে স্ত্রীকে কিছু প্রশ্ন করলেন।
মিনু বললেন, হঠাৎ শুভকে নিয়ে এতকিছু জানতে চাইছ?
আসলে ওদের ফ্যামিলি নিয়ে আমি কিছুই জানি না।
জানবার দরকার কী? নাহিদের বন্ধু এই যথেষ্ট। আর ছেলেটি খুব ভাল।
বর্ষার সঙ্গে বেশ মানায়, না?
মানে?
বোঝনি?
এবার উচ্ছ্বসিত হলেন মিনু। বুঝেছি, বুঝেছি।
হাদি সাহেব বললেন, আমার কেন যেন মনে হয় শুভর কারণেই বাদলকে ভোলার চেষ্টা করছে বর্ষা। স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
হতে পারে।
শুভকে নিয়ে কি তাহলে ভাববে?
হলে খুব ভাল হয়।
আমি তাই মনে করি। ঠিক আছে নাহিদকে ডাক, ওর সঙ্গে কথা বলি।
নাহিদ আসার পর মিনু বললেন, তোর বাবার মাথায় একটা চিন্তা এসেছে।
নাহিদ উদাস গলায় বলল, কীসের চিন্তা?
বর্ষার বিয়ের।
চমকে মায়ের মুখের দিকে তাকাল নাহিদ। কোথায় বিয়ে? কার সঙ্গে?
হাদি সাহেব স্নিগ্ধ গলায় বললেন, ছেলে আমাদের হাতের কাছেই আছে। বর্ষার ব্যাপারে ওর বোধহয় আগ্রহ আছে। আচার আচরণে মনে হল বর্ষারও আছে।
মিনু বললেন, এত ভণিতা করছ কেন? নামটা সরাসরি ওকে বল।
হাদি সাহেব বললেন, ওর বোঝা উচিত যে আমি শুভর কথা বলছি।
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে খুবই শীতল গলায় নাহিদ বলল, না, এটা হবে না।
কেন?
শুভ বিবাহিত।
কথাটা শুনে দুজন মানুষ একেবারে বোবা হয়ে গেলেন।
মিনু বললেন, কী?
হ্যাঁ। এরচে’ বেশি কিছু আমি বলতে পারছি না। শুভর কাছে আমি প্রমিজ করেছি। প্রমিজ না করলে আগেই তোমাদেরকে সব বলতাম।
হাদি সাহেব বড় করে শ্বাস ফেললেন। কী ভাবলাম, কী হল! আমাদের সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। ভাবি এক, হয় আর এক।
নাহিদ বলল, আমার ধারণা বর্ষাও তোমাদের মতো ভাবছে। যখন সব শুনবে, খুব কষ্ট পাবে। ওকে তোমরা সামলে রেখ।
নাহিদ মন খারাপ করে উঠল।
.
দুপুরের মুখে মুখে শুভ আজ একাকী সেই মাঠে চলে এসেছে।
মাঠের চারদিকে বনের গাছে হা হা করছিল হাওয়া। তীব্র গন্ধের বুনোফুল ফুটেছিল কোথাও। হাওয়ায় ভাসছিল সেই গন্ধ। দূরে কোথায় ডাকছিল অচেনা এক পাখি। বনের নির্জনতায় মিলেমিশে যাচ্ছিল সেই ডাক।
এই নির্জনতায় শুভর শুধু মনে পড়ছিল সেতুর কথা।
কদিন সেতুর সঙ্গে কথা বলা হয় না, সেতুকে ছোঁয়া হয় না। আরও কতদিন এভাবে কাটবে, কে জানে।
সেতুর কথা ভেবে বুকটা তোলপাড় করছিল শুভর। কান্না পাচ্ছিল।
ঠিক এসময় গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বর্ষা। মাঠের দিকে শুভকে দেখে অপূর্ব এক হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। যেন বহুকাল ধরে হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে হঠাৎ করেই খুঁজে পেয়েছে সে এমন করে শুভর দিকে ছুটতে লাগল।
বর্ষাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে নিজেকে সামলাল শুভ। দ্রুত হেঁটে নিজেও এগুলো বর্ষার দিকে।
বর্ষা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আপনি এখানে, আর আমি আপনাকে কোথায় না খুঁজেছি। শেষ পর্যন্ত এখানে এলাম।
শুভ হাসল। বুঝলে কী করে আমি যে এখানে?
মনে হল। আমার মন কখনও কখনও কিছু কথা বলে জানেন? এবং তার প্রতিটা কথা সত্য হয়। এই তো আপনাকে যখন আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি, কোথাও পাচ্ছি না, আমার মন হঠাৎ বলল আপনি এই মাঠের দিকে এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটতে শুরু করলাম।
কিন্তু আমাকে হঠাৎ এভাবে খুঁজতে শুরু করলে কেন তুমি?
নিশ্চয় কারণ আছে।
কী কারণ?
আপনার একটা জিনিস আমার হাতে এসে পড়েছে।
কী?
অনুমান করুন তো!
আমার অনুমান শক্তি খুব কম।
আপনার অনেক কিছুই খুব কম।
যেমন?
বলব না।
তারপর গলার কাছ দিয়ে কামিজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দুভাঁজ করা হলুদ খামের একটা চিঠি বের করল বর্ষা। ঢাকা থেকে আপনার একটা চিঠি এসেছে। পিয়ন এসে চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাছে আসার একটা অজুহাত পেলাম আমি। চিঠিটা যাতে অন্য কেউ দেখতে না পায় এজন্য ভাঁজ করে বুকের কাছে রেখেছি।
কিন্তু ঢাকা থেকে চিঠি এসেছে শুনে এমনই দিশেহারা হল শুভ, বর্ষার কথা বেশির ভাগই সে শুনতে পেল না। প্রায় থাবা দিয়ে চিঠিটা সে নিল। চিঠি এসেছে এতক্ষণ বলনি কেন?
পাগলের মতো খামটা ছিঁড়ল শুভ। কোনওদিকে না তাকিয়ে দ্রুত চিঠি পড়তে লাগল।
সুরমা চিঠি লিখেছে।
কিন্তু চিঠি পড়ে শুভ যেন সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল। প্রথমে শিশুর মতো দুতিনটে লাফ দিল তারপর আচমকা কোমরের কাছটায় জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল বর্ষাকে। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, কী যে আনন্দ হচ্ছে তোমাকে তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সংবাদ নিয়ে যে চিঠি এসেছে, বর্ষা, বর্ষা তুমি সেই চিঠি নিয়ে এসেছ আমার কাছে। তোমাকে যে আমি কেমন করে কৃতজ্ঞতা জানাব! কোন ভাষায় যে জানাব! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি বর্ষা। খুশিতে আনন্দে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মরে যাচ্ছি।