তোকে মারব না। মারব ওই ছোকরাটাকে। ব্যবস্থাও করে ফেলেছি।
একথা শুনে সেতু একেবারে কেঁপে উঠল। ভাইয়া!
মামুন অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, তুই জানিস আমি সহজে কোনও ডিসিশান নিই, কিন্তু একবার যদি নিই তার কোনও নড়চড় হয় না। তোর ওপর ওই ছোরাটার জীবন নির্ভর করছে।
ছটফট করতে করতে সেতু তারপর বিছানা থেকে নামল। না ভাইয়া না। ওর কোনও ক্ষতি তুমি করো না। মারতে হয় আমাকে মার, আমাকে মেরে ফেল। শুভর। কোনও দোষ নেই।
আমি কোনও কথা শুনব না। সই করলে ছোকরাটাকে আমি কনসিডার করব, নয়তো লোক ঠিক করা আছে, শুধু একটা ফোন করব। চাইলে ওর লাশও তোকে দেখাব।
সেতু পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল। না না, না। দাও, আমি সই করে দিচ্ছি। যত সই চাও আমি করে দিচ্ছি। তবু, তবু শুভ বেঁচে থাক। ওকে তোমরা মেরো না। ওর কোনও দোষ নেই। সব দোষ আমার, আমার।
ডিভোর্স ফর্ম আর কলম হাতে নিয়ে করুণ ভঙ্গিতে কাঁদতে লাগল সেতু। প্রথমে সেতুর কান্নাটা পাত্তা দিল না মামুন। কিন্তু একটা সময়ে তার মনে হল মায়ের মৃত্যুর পর, বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের লাশের সামনে গড়াগড়ি খেয়ে যেমন করুণ স্বরে কেঁদেছিল সেতু, কান্নাটা যেন তেমন। জীবনের গভীর, গভীরতর দুঃখ ছাড়া এমন কান্না মানুষ কাঁদতে পারে না।
সেতুর এই কান্না মন বদলে দিল মামুনের। বহুকাল আগে একদিন মায়ের লাশের সামনে থেকে যেভাবে আদরের বোনটিকে নিজের বুকে টেনে এনেছিল সে, তারপর আরেকদিন বাবার লাশের সামনে থেকে যেভাবে টেনে এনেছিল নিজের অজান্তে ঠিক সেইভাবে সেতুকে বুকের কাছে টেনে আনল সে, আয়, আমার কাছে আয়।
সঙ্গে সঙ্গে ডিভোর্স ফর্ম আর কলম ছুঁড়ে ফেলে দুহাতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরল সেতু। আগের মতোই করুণ স্বরে কাঁদতে লাগল।
মামুনেরও ততোক্ষণে জলে চোখ ভরে গেছে। বোনের মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে, কাঁদতে কাঁদতে মামুন বলল, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে। খুব অন্যায় হয়ে গেছে আমার। তোর মনের ওপর এতটা জোর করা আমার ঠিক হয়নি। শুভকে আমি মেনে নিলাম। কাদিস না। তুই যা চাস তাই হবে। তাই হবে।
স্বামীর পিছু পিছু সেতুর রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল শিলা। এখন দুইভাই বোনের এই অবস্থা দেখে তার চোখও জলে ভরে এল।
.
বিকেলের মুখে নিজের ঘরে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে বর্ষা। ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।
বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিল শুভ, বর্ষার গান শুনে বেরুল না, তার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। কিন্তু বর্ষা তাকে দেখতে পেল না। চোখ বুজে গান গাইছে সে। বর্ষাকে এভাবে দেখে আর তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল শুভ।
গান গাইতে গাইতে একসময় চোখ খুলল বর্ষা। শুভকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে গান থামাল। আপনি কখন এলেন?
শুভ হাসল। অনেকক্ষণ।
আমাকে ডাকেননি কেন?
তুমি গান গাইছিলে, শুনছিলাম। এত ভাল লাগছিল!
তুমি বলেছিলে আমাকে একদিন গান শোনাবে, শোনালে না তো, এজন্য নিজে নিজেই। চুরি করে শুনে নিচ্ছি।
বর্ষা হাসল। ভালই করেছেন। গানটা আমি আপনার জন্যই গাইছিলাম।
তাহলে আবার গাও।
কেন?
শুনলে মনটা ভাল হবে।
তার মানে আজও আপনার মন খারাপ। আপনার মন এত খারাপ হয় কেন? কী কারণে হয়? কার জন্য হয়?
গভীর করে বর্ষার চোখের দিকে তাকাল শুভ। যার জন্য খারাপ হয় খুব শীঘ্রই তার কথা তোমাকে আমি বলব।
বর্ষা আবদারের গলায় বলল, আজই বলুন না! এক্ষুণি বলুন না!
মুখের মজাদার একটা ভঙ্গি করল শুভ। না।
তারপর উঠোনে নামল। নেমেই নাহিদকে দেখতে পেল উদাস হয়ে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে!
শুভ তারপর নাহিদের সামনে এসে দাঁড়াল। কী হয়েছে রে তোর?
নাহিদ বলল, কী হবে?
বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি তুই কেমন উদাস, চিন্তিত হয়ে আছিস। কী হয়েছে?
নাহিদ হাসার চেষ্টা করল। কিছু না।
চিন্তিত থাকার কথা আমার, থাকছিস তুই। আবার বলছিস কিছু হয়নি।
সত্যি কিছু হয়নি।
কিছু না হলে বাড়ি বসে আছিস কেন? ঢাকায় যা। ওদিককার খোঁজ খবর নিয়ে আয়। অনেকদিন হয়ে গেল।
যদি সব ঠিক হয়ে যায় তাহলে তুই ফিরে যাবি?
একথা শুনে শুভ খুবই অবাক হল। কী রকম কথা বলছিস? চিরকাল তোদের এখানে থাকব নাকি! ঠিক হোক না হোক ফিরে তো যাবই।
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাই তো! ঠিক আছে দুতিন দিনের মধ্যেই আমি ঢাকায় যাব।
যা। আমার খুব অস্থির লাগছে।
নাহিদ আর কথা বলল না।
.
বর্ষার হাতে গীতবিতান।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে গীতবিতানের পাতা উল্টাচ্ছে সে। কিন্তু কিছুই যেন দেখছে না।
পারু আছে এই ঘরে। ব্যাপারটা সে খেয়াল করল। বলল, কী হয়েছে তোমার?
বর্ষা একটু চমকাল। কই কিছু না।
পারু হাসল, আমি তোমার চে’ বয়সে বড়।
তাতে কী হয়েছে?
এসব বুঝি।
কী সব বুঝিস?
পরে বলব, তার আগে আমার একটা কথার জবাব দাও।
কী কথা? শুভ ভাইকে তোমার কেমন লাগে?
বর্ষা থতমত খেল। কেমন লাগে মানে? ভাল লাগে। খুব ভাল লাগে।
সে যখন এখান থেকে চলে যাবে তখন কেমন লাগবে?
বর্ষা গম্ভীর হল। পারু, কী বলতে চাচ্ছিস তুই?
পারু আবার হাসল। তুমি যা বুঝেছ তাই বলতে চেয়েছি। শুভ ভাইর সঙ্গে তোমার ব্যবহার দেখে, তোমার মুখ দেখে আমি সব বুঝে গেছি।
বর্ষা কথা বলল না।
পারু বলল, তবে শুভ ভাইকে তুমি বোধহয় তোমার মনের কথা এখনও বলতে পারনি।