চিন্তিত চোখে স্বপনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মামুন।
.
শিলা বলল, আপনারা এভাবে আমাদের বাড়িতে আসবেন আমরা কল্পনাই করিনি।
সুরমা বলল, আমরাও ভাবিনি এভাবে আসতে হবে। পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছি।
রেখা বলল, চা খান।
সেতুদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে ওরা। শিলা রেখা, সুরমা মালা। খানিক আগে ট্রলিতে করে প্রচুর খাবার নিয়ে এসেছে রানি। ট্রলিটা এখন সেন্টার টেবিলের একপাশে দাঁড় করানো। সেই ট্রলি থেকে চায়ের সরঞ্জাম নামাতে নামাতে কথাটা বলল রেখা। শুনে মালা বলল, না না, চা খাব না। আপনি অযথা কষ্ট করবেন না।
তারপর সুরমার দিকে তাকাল সে। ভাবী, কথা শুরু কর।
শিলা এবং রেখার দিকে তাকাল সুরমা। কথা যা বলতে চাই তা বোধহয় আপনারা বুঝতে পেরেছেন।
চায়ের সরঞ্জাম রেখে শিলার পাশে বসল রেখা। সুরমার মুখের দিকে তাকাল।
সুরমা বলল, ব্যাপারটা এত জটিল করা ঠিক হচ্ছে না। দুটো পরিবারেই বেশ বড় রকমের অশান্তি চলছে। সবমিলে পরিস্থিতিটা খুব বাজে হয়ে গেছে।
রেখা বলল, আমরাও তা বুঝি। কিন্তু আমরা হচ্ছি বাড়ির বউ। এক্ষেত্রে আমাদের কী করার আছে?
শিলা বলল, ওর কথা ঠিক। ফ্যামিলির যে কোনও ব্যাপারে সেতুর ভাইদের ডিসিশানই সব। আমাদের মতামতে তেমন কিছু হয় না।
কথাটা আমি বিশ্বাস করলাম না।
কেন?
বাড়ির বউরা চাইলে অবশ্যই স্বামীদেরকে কনভিন্স করতে পারে। আপনারা আপনাদের স্বামীদেরকে বোঝান যে দুটো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিজেদের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছে তাদেরকে এভাবে টর্চার করা ঠিক না। ব্যাপারটা তারা মেনে নিক।
রেখা বলল, আপনারা কিন্তু চা খেলেন না।
মালা হঠাৎত্র উঠে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক অবস্থায় যখন আসব তখন খাব।
তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, আমরা কি সেতুর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?
এক পলক মালার দিকে তাকিয়ে সুরমার দিকে তাকাল শিলা। আমার জায়গায় আপনি হলে কী করতেন?
কথাটা বুঝতে পারল না সুরমা। বলল, কী করতাম মানে?
এই অবস্থায়, মানে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সেতুর সঙ্গে কি আমি আপনাদেরকে দেখা করতে দিতে পারি?
না তা পারেন না। মালা ইমোশনালি বলে ফেলেছে। সেতুর সঙ্গে দেখা আমরা আজ করবও না।
সুরমাও উঠল। তবে আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনারা দুজনে মিলে সেতুর ভাইদেরকে বোঝাবেন। ব্যাপারটা দয়া করে আপনারা মেনে নিন।
রাতেরবেলা স্বপনকে রেখা বলল, তোমার জায়গায় যদি শুভ হতো আর আমার জায়গায় সেতু তখন আমাদের মনের অবস্থা কী রকম হতো একবার ভেবে দেখ।
স্বপন বলল, এসব আমি ভেবে দেখব না। কারণ আমাদের ক্ষেত্রে এরকম হয়নি।
কিন্তু শিক্ষিত এবং বিবেকবান মানুষের উচিত অন্যের সমস্যা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা।
রেখার চোখের দিকে তাকাল স্বপন। পরিষ্কার করে বল কী বলতে চাও তুমি?
আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পেরেছ।
না পারিনি।
তাহলে পরিষ্কার করে বলি। শুভকে তোমরা মেনে নাও।
কী?
আপন বোনকে এরকম কষ্ট দিচ্ছ, ব্যাপারটা খুবই অমানবিক।
হঠাৎ এভাবে সেতুর পক্ষে চলে গেলে?
অনেক ভেবেই গিয়েছি।
নিজেকে দিয়ে, আমাকে দিয়ে তো উদাহরণ দিলে, এবার আমি একটা উদাহরণ দিই? তোমার নিজের মেয়েটি যদি সেতুর মতো করে তুমি মেনে নেবে?
রেখা সঙ্গে সঙ্গে বলল, অবশ্যই নেব। আমার মেয়ে যদি কাউকে ভালবেসে বিয়ে করে সুখী হয়, কেন আমি তা মেনে নেব না? যার জীবন সে যাপন করবে, আমার কী? আমি কেন তাকে বাধা দেব।
খানিক কী ভাবল স্বপন তারপর বলল, সবকিছুর পরও সেতুর ব্যাপারে আমি কিছুই বলব না। ডিসিশান যা নেয়ার ভাইয়া নেবে।
.
তার মানে ওরা প্ল্যান করেই এসেছে। দুজন বাড়িতে, একজন আমার অফিসে।
মামুনের কথা শুনে শিলা একটু গম্ভীর হল। ওদের জায়গায় আমরা হলেও তাই করতাম। আমাদের কাছে এসে ওরা কোনও অন্যায় করেনি। অন্যায় আসলে করছি আমরা। সেতুকে নিয়ে আমরা যা করছি এরচে’ বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে এটা অপরাধ। তাছাড়া মানুষের মনের ওপর জোর করা আল্লাহ খুবই ঘৃণা করেন।
এসব কি ওরা বলে গেল?
ওরা বলবে কেন? আমি কি অশিক্ষিত মানুষ? আমি এসব বুঝি না?
মামুন কথা বলল না।
শিলা বলল, শোন, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, সেতু যা চাইছে তা মেনে নাও।
ওর জীবন ওরই। শুভকে নিয়ে ও যদি সুখী হয় তাতে তোমার অসুবিধা কী? ওর জীবন ওকে কাটাতে দাও।
মামুন কঠিন গলায় বলল, তোমার কথা আমি শুনব না। শুভকে ওর ডিভোর্স করতে হবে। এটাই ফাইনাল।
গ্রীবা বাঁকিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল শিলা। কেন?
কোনও ব্যাখাও তোমাকে আমি করব না।
ব্যাখ্যা তোমাকে করতে হবে। আমার স্বামী হয়ে অন্যায়ভাবে তুমি একটা কাজ করবে আর আমি তা মেনে নেব, তেমন স্ত্রী আমি নই। সেতুর ব্যাপারে কোনও রকমের বাড়াবাড়ি তুমি আর করবে না।
মামুন উঠে দাঁড়াল। আমার যা ডিসিশান তাই হবে। ডিভোর্স ছোকরাটিকে ওর। করতেই হবে।
শিলার দিকে আর তাকাল না মামুন। গটগট করে বেরিয়ে সেতুর রুমে এসে ঢুকল।
সেতু শুয়েছিল। মামুনকে দেখে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে উঠে বসল।
টেবিলের ওপর ডিভোর্স ফর্মটা পড়ে আছে। পাশে একটা কলম। ফর্ম এবং কলম হাতে নিয়ে মামুন বলল, আমি আজ শেষবারের মতো তোর কাছে এসেছি। ফাইনাল ডিসিশান নিয়ে এসেছি। সই করে দে, নয়তো পরিণতি খুব খারাপ হবে।
সেতু বলল, কী খারাপ হবে? মেরে ফেলবে আমাকে? মেরে ফেল।