বর্ষা আনমনা গলায় বলল, চলুন।
.
বড়ঘরের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার রাখা।
বিকেলবেলায় সেই চেয়ারে বসে আছেন হাদি সাহেব। দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে মিনু এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলেন হাদি সাহেব। কদিন ধরে মনটা খুব ভাল, বুঝলে।
হাদি সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। বাদলের মৃত্যুর পর বাড়িটা যে রকম গুমোট ধরে গিয়েছিল সেই ভাবটা কেটেছে।
নিজের কাপে চুমুক দিয়ে মিনু বললেন, ঠিকই বলেছ। বর্ষা একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রেয়াজ করছে। আজ দুপুরের পর দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে সাজছে। বাড়ির টুকটাক কাজ করছে। নাহিদ শুভর জন্য চা নিয়ে যাচ্ছে।
আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন। মেয়েটাকে নিয়ে টেনশনে ছিলাম। বহুদিন কোনও কাজ করতে পারিনি। কাজগুলো আবার শুরু করতে হবে।
কী কাজ?
পারুর বিয়ের চেষ্টা করতে হবে। পুবপাড়ার একটা জমি নিয়ে ঝামেলা লেগে আছে। সেই ঝামেলা মিটাতে হবে। কিছু জমি বিক্রি করে ঢাকায় ছোটখাট একটা বাড়ি করব ভেবেছিলাম, সেই কাজটাও শুরু করা দরকার।
কাপে শেষ চুমুক দিয়ে মিনু বললেন, ঢাকার বাড়িটাই আগে করা উচিত।
কেন?
নাহিদ থাকবে ঢাকায়। বর্ষার বিয়ে হলে সেও নিশ্চয় ঢাকায়ই থাকবে। তখন আমরা দুজন এখানে একা একা পড়ে থাকব কেন? ছেলেমেয়ে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।
হাদি সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ঠিকই বলেছ, একজন চলে গেছে, বাকি দুজনকে আমিও আর চোখের আড়াল করতে চাই না।
মিনু আর কথা বললেন না।
৯. নাহিদদের বাড়ির উত্তর দিকটায়
নাহিদদের বাড়ির উত্তর দিকটায় শাল মহুয়ার নিবিড় একখানা বন। হাঁটতে হাঁটতে বনের দিকটায় চলে এসেছে শুভ এবং বর্ষা। হঠাৎ বর্ষা বলল, আপনাকে একটা কথা বলব?
বর্ষার চোখের দিকে তাকাল শুভ। দুঃখ কষ্ট কিংবা মন খারাপের কথা হলে বলল না। শুনতে আমার ভাল লাগবে না। আমি নিজে এত দুঃখ বেদনার মধ্যে আছি…।
কথা শেষ করল না শুভ।
বর্ষা বলল, কী দুঃখ আপনার?
শুভ হাসল। যা বলতে চাইছ, বলো।
জানতাম প্রশ্নটা আপনি এড়িয়ে যাবেন।
সব কথা কি বলা যায়?
কাউকে কাউকে বলা যায়।
আমি কথা এড়াই কেন জান? মিথ্যে বলতে লজ্জা করে বলে।
তাহলে সত্য কথা বলুন।
সব সময় তাই বলি, কিন্তু এটা বলব না।
আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। আপনার মনের সব কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করে আমার।
কেন?
জানি না।
শুভ এবং বর্ষা যখন বনের দিকটায় হাঁটছে নাহিদ তখন বাড়ি ঢুকে শুভকে খুঁজছিল। পারুকে পেয়ে বলল, এই পারু, শুভকে দেখেছিস?
পারু বলল, না তো!
বর্ষাকে জিজ্ঞেস করে আয় তো শুভ কোথায় গেছে ও জানে কী না।
বর্ষাও বাড়ি নেই।
দুজনে তাহলে এক সঙ্গেই কোথাও গেছে। ঠিক আছে আমি দেখছি।
দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল নাহিদ, বনের দিকে হাঁটতে লাগল।
বর্ষা আর শুভ তখন বনের মাঝামাঝি সুন্দর একটা মাঠের ধারে এসেছে। চারদিকে নিবিড় গাছপালার বন তার মাঝামধ্যিখানে ঘন সবুজ ঘাসের একটুখানি একটা মাঠ। হঠাৎ করে তাকালে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
এই মাঠ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল শুভ। বাহ, সুন্দর জায়গা।
বর্ষা বলল, জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। এখানে এলে আমার মন অন্যরকম হয়ে যায়। আজ আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আমার প্রিয় জায়গাটা আপনাকে দেখাই।
কিন্তু এখানে এসে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে আমার মনের সবকথা তোমাকে বলে দিই। এভাবে কেন হঠাৎ করে তোমাদের এখানে এলাম, কেন এতদিন ধরে আছি।
শুভর কথা শুনে বর্ষার কী রকম অভিমান হল। মাঠের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমি শুনব না।
কেন?
জোর করে কারও মনের কথা আমি শুনতে চাই না।
বর্ষার অভিমানটা বুঝল শুভ। বর্ষার দিকে তাকিয়ে দুহাতে বর্ষার মুখটা প্রার্থনার ভঙ্গিতে তুলে ধরল সে। বর্ষার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, মন খারাপ করো না। আমি অবশ্যই একদিন তোমাকে সব বলব। আমার মনের সব কথা তোমাকে বলব।
এই দৃশ্যটা দেখে ফেলল নাহিদ।
শুভ এবং বর্ষাকে খুঁজতে এদিকেই আসছিল সে। বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে তাকাতেই দৃশ্যটা তার চোখে পড়ল। নিজের অজান্তে পা আটকে গেল তার। নাহিদ যেন বনের বৃক্ষ হয়ে গেল। হাঁটা চলার ক্ষমতা রইল না তার।
.
শাহিন অফিসে চলে যাওয়ার পর নিজের রুম গুছাচ্ছে সুরমা।
মা এসে ঢুকলেন। তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে চাই বউমা।
সুরমা কাজ বন্ধ করল, কী পরামর্শ?
তার আগে বলি, সেদিন শাহিনকে আমি বলেছিলাম সেতুর ভাইদের কাছে যেতে, ও যেতে রাজি হল না।
কিন্তু থানায় গিয়েছিল।
ওখানে না গেলেও কোনও অসুবিধা ছিল না। এ ব্যাপারে থানা পুলিশ না করাই। ভাল। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করা উচিত। কারণ দুদিন আগে বা পরে সম্পর্ক ওদের সঙ্গে আমাদের ঠিক হবেই। সেতুর ভাইদের কাছে না গিয়ে ভুল করেছে শাহিন। আমি ওর ওপর বিরক্ত হয়েছি।
মায়ের কথা শুনে স্বামীর পক্ষ নিল সুরমা। না মা, ওতো বলেছিল সেতুর ভাইরা যদি বোস কোনও কথাটথা বলে ফেলে সেটা খুব অপমানকর…
কথা শেষ করতে পারল না সুরমা। মা গম্ভীর গলায় বললেন, স্বামীর সাফাই গাইবার দরকার নেই। এসব ক্ষেত্রে এতকিছু ভাবা ঠিক নয়। ছোটভাইর জন্য না হয় একটু অপমান হতোই।
এবার কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল সুরমা, আপনি যেন কী পরামর্শের কথা বললেন?