শাহিন অফিস থেকে ফিরুক, ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি কী করা যায়।
শাহিন ফিরল সন্ধেবেলা। সব শুনে বলল, পুলিশের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছি না।
সুরমা অস্থির গলায় বলল, তুমি এতদিন যাওনি কেন? বলেছিলে না জিডি করবে।
ভুলে গিয়েছিলাম।
শুনে মা খুবই ক্ষিপ্ত হলেন। ভুলে গিয়েছিলি? কেমন ভাই তুই? ছোট ভাইর এরকম বিপদ আর তার কথা তুই ভুলে যাস?
শাহিন কাঁচুমচু গলায় বলল, শুভ এখানে নেই বলে ব্যাপারটা আমি তেমন গুরুত্ব দিই নি।
মালা বলল, এটা তুমি ঠিক করনি ভাইয়া। এখন ওরা যদি নাহিদদের গ্রামে গিয়ে শুভকে…
কথা শেষ হওয়ার আগেই মালাকে ধমক দিলেন মা। চুপ কর। অলুক্ষুণে কথা বলবি না।
সুরমা শাহিনের দিকে তাকাল। তারচে’ তুমি বরং এক কাজ কর।
চোখ তুলে সুরমার দিকে তাকাল শাহিন। কী?
সেতুর ভাইদের সঙ্গে দেখা কর। তাদেরকে বল এসব আপনারা ঠিক করছেন না। মাস্তান টাস্তানদেরকে ফেরান। আমার ভাইয়ের যদি কোনও ক্ষতি হয়, আপনাদেরকে আমরা ছাড়ব না। দেশে আইন আছে। আমরা আপনাদেরকে দেখে নের।
মা বললেন, এবং এও বলবি, আপনারা ভালয় ভালয় ব্যাপারটা মেনে নিন। আমার ভাই কোনও ফেলনা ছেলে না। আপনার বোনের জন্য এরচে’ ভাল পাত্র পাবেন না। আর বিয়ে যেখানে হয়ে গেছে সেখানে এত বাড়াবাড়িরই বা কী আছে!
শাহিন গম্ভীর গলায় বলল, আমি ওদের কাছে যাব না মা। মা অবাক হলেন। কেন?
ওদের কাণ্ডকারখানা যা দেখছি তাতে ওদের কাছে গেলে অপমান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর যাই হোক অপমান আমি হতে পারব না। তারচে’ আমি কাল থানায় যাব। পুলিশের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা আলাপ করব। নিশ্চয় তারা কোনও ব্যবস্থা নেবে।
মা দুঃখি মুখ করে বললেন, যা ভাল বুঝিস কর।
তারপর একটু থেমে বললেন, গুণ্ডাপাণ্ডাদের ব্যাপারে ভয় তো পাচ্ছিই তার ওপর মনও খারাপ লাগছে। এতদিন হল বাড়ি ছাড়া হয়ে আছে ছেলেটি। এতদিন ওকে না দেখে আমি কখনও থাকি নি। নাহিদদের বাড়িতে হয়তো সে ভালই আছে, তারপরও আমার মনটা কেমন করে। খেতে বসলে ছেলেটার কথা মনে হয়, ঘুমাতে গেলে মনে হয়। শুভর জন্য আমার কিছু ভাল লাগে না।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মা। আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন। করুণ গলায় বললেন, আল্লাহ, আমার ছেলেকে তুমি ভাল রেখ।
.
এখানে আসার পর থেকে বিকেলের দিকে শুভর মনটা কী রকম খারাপ হয়। কী রকম উদাস বিষণ্ণ লাগে।
দুপুরের পর আজ ছোটখাট একটা ঘুম দিয়েছিল সে। খানিক আগে ঘুম থেকে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জানালা থেকে আকাশটা বড় অদ্ভুত দেখায়। একটু যেন বেশি নীল, একটু যেন বেশি সাদা। এই আকাশের দিকে তাকালে শুভ সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়।
আজও হয়েছিল।
এ সময় বর্ষা এসে দাঁড়াল তার পেছনে। শুভ টের পেল না।
এই প্রথম, বহুদিন পর বিকেলবেলা সুন্দর করে আজ সেজেছে বর্ষা। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। মুখে সামান্য প্রসাধন, ব্যান্ড দিয়ে সুন্দর করে চুল বেঁধেছে। নিজেকে আজ নতুন মানুষ মনে হচ্ছে বর্ষার।
কিন্তু সে যে এই ঘরে এল শুভ তা টেরই পেল না।
খানিক দাঁড়িয়ে শুভকে দেখল বর্ষা। তারপর কথা বলল, কী হয়েছে আপনার?
চমকে পেছন ফিরে তাকাল শুভ। ও তুমি! কখন এলে?
বেশিক্ষণ না।
তারপর আবার প্রশ্নটা করল বর্ষা। কী হয়েছে আপনার?
কিছু না।
তারপর কথা ঘোরাল শুভ। কী আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি এলে আর আমি তা টেরই পাই নি।
আপনি খুব আনমনা ছিলেন।
মনটা ভাল নেই।
কেন?
শুনলে তোমার মন খারাপ হবে।
শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে বর্ষা গম্ভীর গলায় বলল, আমার মন খারাপ হলে আপনার কী?
সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছল হওয়ার চেষ্টা করল শুভ। বল কী! তোমার মন খারাপ হলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। জানতে চাও কী সর্বনাশ হবে?
জানতে চাইছি।
বর্ষার বলার ভঙ্গিতে অবাক হল শুভ। তুমি খুব অন্যরকম ভঙ্গিতে কথা বল।
কী রকম?
আমার প্রশ্ন শুনে যে কেউ বলবে, আচ্ছা বলুন। তুমি বললে, জানতে চাইছি।
তাতে কী হয়েছে?
এভাবে কথা বলা অন্যের সঙ্গে মেলে না।
আমার কোনও কিছুই কি অন্যের সঙ্গে মেলে?
না, তা মেলে না।
আমি অতি সাধারণ একটি মেয়ে। দেখতে ভাল নই। বেঁটে। সামান্য গান গাইতে পারি কিন্তু গলা তেমন ভাল নয়। বিএ পড়ি, কিন্তু পাস করতে পারব কীনা জানি না। আমার সোকতাপ খুব বেশি। কোনও কিছুই ভুলতে পারি না।
বর্ষার চোখের দিকে তাকিয়ে শুভ বলল, এসবই তোমার সৌন্দর্য। তুমি জান না তুমি কী সুন্দর মেয়ে। তোমার মুখটা খুব মিষ্টি। চোখ দুটো সুন্দর। কী সুন্দর করে কথা বল তুমি। তোমার লম্বা হওয়ার দরকার নেই। তুমি যেটুকু লম্বা, ওই যথেষ্ট। তোমার মতো মেয়ের কখনও বয়স বাড়ে না। মুখের দিকে তাকালেই তোমার জন্য মায়া লাগে।
বর্ষা আচমকা বলল, আপনার লাগছে?
শুভ থতমত খেল, তারপর হাসল, আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।
বর্ষাও হাসল। শেষ করুন।
তোমার মন খারাপ হলে আমার কী সর্বনাশ হবে শোন। তুমি ছাড়া, মানে এই বাড়িতে তুমি ছাড়া আমার খোঁজ খবর নেবে কে? আমার মন খারাপ হলে কে জিজ্ঞেস করবে, কী হয়েছে আপনার? আমার চা এনে দেবে কে?
শুভর কথা শুনে অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষা। শুভ তা খেয়াল করল না, বলল, একটা কথা বলব?
বলুন।
চল কোথাও বেরিয়ে আসি, বাড়িতে একদম ভাল লাগছে না।