রচনাটি খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর মাত্র তুলবে স্বপন তার আগেই রেখা এসে ঢুকল রুমে। স্বামীকে তখনও বিছানায় দেখে অবাক হল। ওমা, তুমি দেখি এখনও ওঠোইনি!
তেরো বছর একসঙ্গে থাকার ফলে স্ত্রীর গলার রুক্ষ্মতা বেশ সয়ে গেছে স্বপনের। কখন সত্যিকার রুক্ষ্ম হয় তার গলা কখন কোমল, ভালই বুঝতে পারে।
এখনও পারল। গলা স্বাভাবিকই আছে রেখার। হাসি হাসি মুখে তারপর স্ত্রীর দিকে তাকাল স্বপন। উঠিনি তো কী হয়েছে? এজন্য নিজের মাকে ডাকতে হবে নাকি?
কথাটা বুঝতে পারল না রেখা। বলল, কী বললে?
না মানে ‘মা’ বললে তো!
তাতে কী হয়েছে?
কিছুই হয়নি। যা বলছিলে বল।
তুমি বাথরুমে ঢুকবে কখন, কখন নাশতা করবে, কখন বেরুবে?
এত কখন কখন করো না। মজার একটা লেখা পড়লাম। মুডটা খুব ভাল। সেটা নষ্ট করো না।
তোমার মুড নষ্ট করার দরকার আমার নেই। ভাইয়া রেডি হয়ে বসে আছেন।
আমি আজ ভাইয়ার সঙ্গে বেরুব না। আমার লেট হবে।
কেন?
কোনও কারণ নেই। আমার ইচ্ছে। আমি কারও চাকরি করি না। পৈতৃক বিজনেস দুভাইয়ে মিলে দেখি। একদিন একভাই একটু লেটে গেলে কোনও অসুবিধা নেই।
সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে জব্দ করার চান্সটা নিল রেখা। ঠিক আছে, কথাগুলো তাহলে ভাইয়াকে গিয়ে বলে আসি।
শুনে ভয় পেয়ে গেল স্বপন। না না এভাবে বললো না। বলো আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। আমি ঘন্টাখানেক পরে যাব।
সকালবেলা মিথ্যে কথা আমি বলতে পারব না।
রেখার চোখের দিকে তাকিয়ে খুবই রোমান্টিক স্বরে স্বপন বলল, হাজব্যান্ডের জন্য মেয়েরা কত স্যাক্রিফাইস করে, আর তুমি এই সামান্য কাজটা করতে পারবে না?
রেখার বোধহয় একটু মায়া হল। স্বভাবসুলভ রক্ষ্ম গলা যতটা সম্ভব নরম করে বলল, ঠিক আছে, করছি।
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে রেখা, গলা আগের চেয়েও বেশি রোমান্টিক করে স্বপন বলল, শোন।
রেখা ঘুরে দাঁড়াল। কী?
কাছে এস।
আনমনা ভঙ্গিতে স্বামীর কাছে এসে দাঁড়াল রেখা। উঠে বসল স্বপন। হাত বাড়িয়ে স্ত্রীর চিবুকের কাছটা ধরল। তুমি কী ভাল! তোমার মতো ভাল বউ আমি জীবনে দেখিনি।
সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা মেরে স্বপনের হাত সরিয়ে দিল রেখা। সত্যিকার রুক্ষ্ম গলায় বলল, সকালবেলা এসব ঢং করো না। বিচ্ছিরি লাগে।
ব্যাপারটা একটু অপমানকর। কিন্তু এই অপমান গায়েই লাগল না স্বপনের। নির্বিকার গলায় সে বলল, আচ্ছা করলাম না। কিন্তু আমার যে একটা মেয়ে আছে, সাত আটবছর বয়স, নাম হচ্ছে টুপলু, সে কোথায়?
জানি না।
.
টুপলুর খুবই সাজগোজের শখ।
আটবছর বয়সে সে একটু বেশি লম্বা, বেশি রোগা। হলে হবে কী, মুখটা অসম্ভব মিষ্টি। কথা বলে একটু বেশি জোর দিয়ে। ফলে কথা বলার সময় গলার একপাশের রগ ফুলে ওঠে।
আর টুপলু হচ্ছে অসম্ভব আদুরে স্বভাবের। যে কোনও বিষয়ে তার অনেক অভিযোগ, অনেক কান্না। ছোটখাট বহু ব্যাপার তীক্ষ্ণচোখে খেয়াল করে।
ছোট খালামণির গায়ে হলুদ উপলক্ষে টুপলুকে তার মা আড়াই হাজার টাকা দামের লাল টুকটুকে একটা কাতান শাড়ি কিনে দিয়েছিল। সঙ্গে ব্লাউজ ছায়া, রুপোর গহনা, মল। বেইলি রোডের শাড়ির মার্কেটে শিশুদের এইসব জিনিসও পাওয়া যায়।
সেই লাল কাতান আর গহনা ইত্যাদি পরে খালামণির বিয়েতে টুপলু একেবারে ছবির মতো ফুটেছিল। কতজন কত যে ছবি তুলেছে তার! মা বাবার বেডরুমে একটা ছবি বড় করে বাঁধানোও আছে।
আজ সকালে টুপলুর ইচ্ছে হল ওরকম সাজ সাজার।
শাড়ি গহনা ইত্যাদি হাতের কাছেই থাকে, চেসটার ড্রয়ারে। ড্রয়ার খুলে জিনিসগুলো নিয়ে সে সোজা এসেছে মুন্নির রুমে। আপু, আমাকে বউ সাজিয়ে দাও।
মুন্নি একটু মোটাসোটা, গোলগাল ধরনের ফর্সা মেয়ে। ঘাড়টা সামান্য ছোট। কখনও কখনও তীক্ষ্ণচোখে খেয়াল করলে তাকে সামান্য কুঁজো দেখায়। তবে বেশ মেজাজি মেয়ে সে। মুড ভাল থাকলে টুপলুর জন্য সব করে আর খারাপ থাকলে ধমক দিয়ে বিদেয় করে দেয়।
ধমক খেয়ে কাঁদে টুপলু ঠিকই কিন্তু আবার যখন কোনও ব্যাপারে মুন্নির দরকার হয় সব ভুলে তার কাছে আসে। মুন্নির মুড ভাল কী খারাপ তোয়াক্কা না করে নিজের কথাটা বলে। ধমক খাবে কী খাবে না বুঝতে পারে না।
আজও পারেনি।
তবে ভাগ্য ভাল টুপলুর মুন্নির মুড আজ ভাল ছিল। নিজের বিছানায় শুয়ে কমিকস পড়ছিল সে। কমিকসটা বোধহয় ভাল লাগছিল না। এজন্য কথাটা টুপলু বলার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল। আয় সাজিয়ে দিচ্ছি। খুব মজা হবে।
তারপর থেকে টুপলুকে শাড়ি পরাচ্ছে মুন্নি। বউ সাজাচ্ছে। যে কোনও কাজ একটু সময় নিয়ে করার স্বভাব তার। আস্তেধীরে গুছিয়ে গাছিয়ে নিখুঁতভাবে করার স্বভাব। এখনও সেভাবেই করছে। হঠাৎ টুপলু বলল, আপু, আমাকে যেন একদম বউর মতো লাগে।
টুপলুর ছোট্ট কোমরে শাড়ি গুজতে গুজতে মুন্নি বলল, লাগবে। কিন্তু কথা বললে হবে না।
কেন?
নতুন বউরা কথা বলে না।
কথা বললে কী হয়?
এবার মুন্নি একটু রাগল। জানি না।
মুন্নির রাগ পাত্তা দিল না টুপলু। বলল, কেন জান না?
আমার ইচ্ছে আমি জানি না।
এমন ইচ্ছে কেন তোমার?
চুপ করলি?
এবার মুন্নির রাগ বুঝতে পারল টুপলু। সে চুপ করল।
শাড়ি পরানো শেষ করে টুপলুকে গহনা পরাতে লাগল মুন্নি। পরাতে পরাতে বলল, প্রথমে যাবি ভাইয়ার রুমে।
টুপলু অবাক। ভাইয়ার রুমে কেন?