শুনে হো হো করে হেসেছিল স্বপন। নায়িকাকে খাচ্ছে? সর্বনাশ!
তারপর থেকে বাড়িতে ইত্তেফাঁক এবং জনকণ্ঠের সঙ্গে হাসানের কাগজটাও সে রাখতে শুরু করেছে। সত্যি, পাতায় পাতায় নেশা ধরানো সব লেখা। পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না।
আজ সকালে তেমন একটি লেখা চোখে পড়ল স্বপনের। বাঁশের কী কী প্রতিভা আছে ওই নিয়ে লিখেছেন ইমদাদুল হক মিলন। সত্যি চানাচুর, খাঁটি চানাচুরের মতো লেখা। পড়তে শুরু করলে কুড়মুড় কুড়মুড় শব্দও হয়।
দিকপাশ ভুলে লেখাটির ওপর হামলে পড়ল স্বপন। নিবিষ্ট মনে খেতে লাগল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে সে। হাতের কাছে চায়ের কাপ, চাটা পুরো শেষ হয়নি, সেই চায়ের কথা ভুলে গেল। ঠোঁটে সিগ্রেট জ্বলছে, টান দিতে ভুলে গেল।
প্রতিভার দিক দিয়ে বাঁশের কোনও তুলনা হয় না।
বস্তুটির ভাল নাম বংশ। যার তিনটি সরল অর্থ বাঁশ বাঁশি এবং মেরুদণ্ড।
বাঁশের এক অর্থ মেরুদণ্ড জেনে আমি খুবই পুলকিত। আমার এক চীন ফেরত বন্ধুর মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। নানা রকম চিকিৎসার পরও প্রায়ই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে
সে। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। এই অবস্থায় তাকে একটু আনন্দ দানের জন্য আমি একদিন টেলিফোনে বললাম, বন্ধু, তোমার বাঁশটি কেমন আছে?
শুনে প্রথমে সে একটু হকচকিয়ে গেল, তারপর শব্দটির একটি কদর্য অর্থ করল। ভাবল পুরুষমানুষের শরীরের নিচের দিককার বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি আমি। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু এই ধরনের ঠাট্টা করতেই পারে।
বন্ধুটি বিবাহিত। সুতরাং সবিস্তারে সে ওই বিষয়ের দিকে ধাবিত হল। আমার তখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। কোনও রকমে বললাম, তুমি যা ভেবেছ তা নয়, বন্ধু। বাঁশ অর্থ মেরুদণ্ড।
শুনে সে খুবই হতাশ হল। তোমরা লেখকরা কত সহজ শব্দের কত বকা অর্থ কর। হাতে কলম আছে বলে যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছ। কর, আমরা নিরীহ মানুষরা পিঠের বাঁশে ব্যথা নিয়ে শুনে যাই।
তবে বাঁশের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক সত্যি খুব গভীর। বাগচী মহাশয়ের বাড়িতে যদি বাঁশঝাড় না থাকত তাহলে বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হত এক অসাধারণ কবিতা থেকে। ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ’। বাংলা গল্প উপন্যাস বঞ্চিত হত বাঁশঝাড়ের বর্ণনা থেকে। জীবনানন্দ দাশ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় খুবই ফাঁপড়ে পড়তেন। আর বাংলা সাহিত্যের গ্রামীণ ভূতগুলো তো সব বাঁশের ডগায়ই বসে থাকে। বাঁশ এবং তার ঝাড় না থাকলে ভূতগুলো যেত কোথায়? ভূতের গল্পের লেখকরা তাদেরকে কোত্থেকে জোগাড় করতেন?
এ তো গেল সাহিত্যে সংক্ষেপে বাঁশের ভূমিকা। এমনকি অংকশাস্ত্রেও একটি তৈলাক্ত বাঁশের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। একটি বানর দিনে কতবার তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে উঠবে এবং কতবার নামবে এই নিয়ে জটিল একখানা অংক তৈরি করে পাঠ্য বইতে বাঁশের মতো করেই প্রবিষ্ট করিয়ে রেখেছেন আমাদের পণ্ডিতরা।
বাঁশের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তো আরও গভীর। ভাবা যায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেম কাহিনীটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাঁশ। ওই যে বাঁশের দ্বিতীয় অর্থ, বাঁশি। কৃষ্ণের হাতে যদি বাঁশিটি না থাকত তাহলে রাধার সঙ্গে তার প্রেমই হত না। কৃষ্ণের বাঁশি শুনেই তো রাধা তার প্রেমে পাগল হয়েছিলেন! এবং একদা বাংলা গান বলতেই কানু বিনে গীত নাই। শচীনদেব বর্মন ‘সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’ বলে চিরকাল কেঁদে গেলেন। তারাশঙ্করের মতো মহান ঔপন্যাসিকও গান লিখলেন,
‘মধুর মধুর বংশি বাজে
কোথা কোন কদমতলীতে’।
গ্রামের প্রেমিক প্রেমিকারা এখনও রাতের আঁধারে কিংবা দিনের নির্জনতায় মিলিত হয় বাঁশঝাড় তলায়। দুষ্ট লোকেরা অবশ্য মলও ত্যাগ করে ওইসব জায়গায়। প্রেমের সঙ্গে মলেরও একটা সম্পর্ক আছে। গ্রাম্য ভিলেনরা প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকাকে মিলিত হতে দিতে চায় না বলে দল বেঁধে বাঁশঝাড় তলায় যে মল ত্যাগ করে আসে এরকম ঘটনা আমি নিজ কানে বহুবার শুনেছি।
এরকম অজস্র বিষয় জড়িত বাঁশের সঙ্গে। যে বাঁশে বাঁশি হয় সেই বাঁশে আবার লাঠিও হয়। লাঠির ব্যবহারবিধি আর নাই বা বললাম। সবাই জানে। এবং এও জানে বাঁশ দিয়ে দেয়া’ বলে একটা কথা আছে। সেটার অর্থও বিশদ বলবার দরকার নেই। জীবনে বহুবার বহুভাবে আমরা এ ওকে বাঁশ দিয়ে যাচ্ছি। যে দিচ্ছে সেও টের পাচ্ছে জিনিসটা কী, যে নিচ্ছে সে তো পাচ্ছেই।
বাঁশের সর্বশেষ প্রতিভা শুনে আমি প্রায় ভিড়মি খাচ্ছিলাম। যার বাঁশে ব্যথা আমার ওই বন্ধু চীনদেশ থেকে ফিরে বলল, প্রকাশনা জগতে চীন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কী রকম?
যন্ত্রের একদিক দিয়ে বাঁশ দিয়ে দিচ্ছে আরেক দিক দিয়ে চাররঙা দৈনিক পত্রিকা ছাপা হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বলে কী?
হ্যাঁ। যন্ত্রের ভেতর বাঁশ ঢুকবার পর সেই বাঁশ থেকে মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে কাগজ, সেই কাগজে ছাপা হয়ে যাচ্ছে দৈনিক পত্রিকা।
লেখা টেখা?
তাও নিয়ন্ত্রণ করছে বাঁশ।
কীভাবে?
লেখক টেখকদের পেছনে সক্রিয় একখানা বাঁশ তো সব সময়ই আছে। সেই বাঁশের গুতো না খেলে কি লেখা বেরয়!
এই বন্ধুই একবার ঈদের আগে আমাকে বলেছিল, আজকাল আকাশের চাঁদও নিয়ন্ত্রণ করছে বাঁশ। চাঁদ দেখা কমিটি না সমিতি কী যেন একখানা আছে, তার সদস্যরা। বাঁশ হাতে জনমানবহীন নির্জন স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম চাঁদগুলো উঠতে না চাইলেও বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে আগে ভাগেই তুলে দেয় তারা। ফলে সবেবরাত, ঈদ এইসব মহান দিবস কোনও কোনও সময় আগেভাগেই পালন করতে হচ্ছে আমাদের।’