আশ্চর্য এক ভালবাসার দৃশ্য।
এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আবার শুভর কথা মনে পড়ে সেতুর। সেই কথাটি মনে পড়ে। ভালবাসা থাকলে সব হয়। কথাটা যদি সত্য হয় শুভকে তাহলে সে নিশ্চয় পাবে। কেমন করে পাবে সেই পথ খুঁজে বের করতে হবে।
পথটা সেতু আজ থেকে খুঁজবে।
মামুনের রুম থেকে ঠিক তখুনি ভেসে এল, শিলা, শিলা। কোথায় গেলে তুমি?
বড়ভাই ডাকছেন ভাবীকে। তার অফিসে যাওয়ার সময় হল।
.
স্ত্রীর সঙ্গে মামুনের সম্পর্কে চিনির পরিমাণটা একটু বেশি।
অর্থাৎ খুবই মিষ্টি সম্পর্ক দুজনার। বাবলু ফাঁইয়ারে পড়ে, মুন্নি পড়ে ক্লাশ এইটে, হলে হবে কী, ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে কথাটা যেন মনেই থাকে না তাদের। দুজন সারাক্ষণই আছে ঠাট্টা মশকরার মধ্যে, হাসি মজার মধ্যে।
এই যেমন এখন।
স্বামীর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে বেডরুমে ঢুকেছে শিলা। মামুন ছিল ড্রেসিংরুমে। মাত্র টাই বাঁধা শেষ করেছে। শিলার সাড়া পেয়েই ড্রেসিংরুম থেকে গলা বাড়াল। মুখটা কার্টুনের মতো করে বলল, এসেছ?
শিলা গম্ভীর গলায় বলল, হ্যাঁ।
তোমাকে খানিক না দেখলে জানটা আমার বেরিয়ে যায়। এজন্য অমন ত্রাহি ডাক ছাড়ছিলাম।
বলতে বলতে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এল মামুন। শিলার একেবারে গা ঘেষে দাঁড়াল।
সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে সরে যেতে চাইল শিলা। হাতে পানির গ্লাস আছে বলে লাফটা সে দিতে পারল না। ছটফটে গলায় বলল, কাছে এস না, কাছে এস না।
প্রিয়তমা স্ত্রীর আচমকা এরকম কাছে এস না, কাছে এস না শুনে মামুন খুবই ভড়কে গেল। থতমত খেয়ে বলল, কেন? কী হয়েছে? আপন স্ত্রীর কাছে আসতে অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। ভীষণ অসুবিধা।
না বললে বুঝব কী করে?
সকালবেলা ওসব তোমাকে বলতে চাই না।
বললে কী হবে?
তেমন কিছুই হবে না। শুধু মনটা তোমার খারাপ হবে। অফিসে যাওয়ার সময় স্বামীর মন খারাপ করে দেয়া কোনও স্ত্রীর কর্তব্য হতে পারে না।
মামুন বিগলিত ভঙ্গিতে মুখটা হাসি হাসি করল। না না, তাতে কী? আমার মন যে খারাপ হবে তুমি তা কী করে বুঝলে?
আমি জানি, হবে।
হবে না, তুমি বল।
তারপর দূর থেকে হাত বাড়িয়ে শিলার গালটা ছুঁয়ে দিল মামুন। এই দুষ্টু, বল না!
মুখ নিচু করে খুবই লাজুক ভঙ্গিতে শিলা বলল, তুমি যে আমার চে অনেক বেটে, কাছে এসে দাঁড়ালে তা খুব বোঝা যায়। স্বামীর চে স্ত্রী মাত্র একবিঘত লম্বা এ কেমন কথা, বল। আমার বুঝি লজ্জা করে না?
সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ম্যানেজ করল মামুন। অযথা হে হে করে একটু হাসল। না, তাতে কী? বারোহাত কাকুড়ের তেরোহাত বিচি তো হতেই পারে! স্বামীর চে স্ত্রী লম্বা হলে ক্ষতি কী? আমি সব সময় হাতে একখানা জলচৌকি নিয়ে ঘুরব।
কেন?
চুমু খেতে হলে জলচৌকির ওপর দাঁড়িয়ে নেব।
শিলা খিলখিল করে হেসে উঠল।
মামুনও হাসছিল। হাসতে হাসতে গ্লাসের দিকে হাত বাড়াল। চুমু না, দাও এখন পানিটা খাই।
পানি খেয়ে গ্লাসটা শিলার হাতে ফিরিয়ে দিল মামুন। খুবই পরিতৃপ্ত গলায় বলল, অফিসে যাওয়ার সময় তোমার হাতের পানিটা খেয়ে গেলে মন এবং মাথা দুটোই বেশ ঠাণ্ডা থাকে। বিজনেসটা খুবই মন দিয়ে করতে পারি।
শিলা মুখ ঝামটে বলল, এসব ছাড়।
কেন ছাড়ব?
আমার সঙ্গে চালাকির দরকার নেই।
কোথায় চালাকি করছি?
এটাই তো চালাকি। আমার হাতের পানি নিয়ে যা বললে এটা তোমার পুরনো কায়দা। আমাকে পটাবার জন্য বলছ।
একুশ বছরের পুরনো স্ত্রীকে পটাবার কী আছে। সঙ্গে তো এই মুহূর্তে জলচৌকিও নেই!
শিলা আবার হাসল। ওহ্! তুমি পারও।
সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়াস হল মামুন। ঠিক আছে, আর ঠাট্টা নয়। রানিকে পাঠাও, স্বপন রেডি হয়েছে কি না দেখে আসুক।
পাঠাচ্ছি।
খালি গ্লাস হাতে বেরিয়ে গেল শিলা।
.
আজকালকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর ফিচার পাতায় মজার মজার সব লেখা ছাপা হয়। একদম চানাচুরের মতো। পাঠকরা এসব লেখা পড়ে না। খায়।
লেখা খাওয়ার কথাটা বলেছিল স্বপনের বন্ধু হাসান। সে একটি নতুন ধরনের দৈনিক পত্রিকার ফিচার এডিটর। তার পাতাগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। এইসব পাতার জন্য পত্রিকাটিও খুব জনপ্রিয় হয়েছে। পুরনো এবং জাদরেল বেশ কয়েকটি পত্রিকার বিক্রি কমে গেছে। কারণ তাদের পাঠক ভাগিয়ে নিয়ে গেছে হাসানদের পত্রিকা।
স্বপনের অফিসে আড্ডা দিতে এসে, চা খেতে খেতে হাসান একদিন বলল, আমাদের কাগজটা তুই পড়িস না?
স্বপন মাত্র সিগ্রেট ধরিয়েছে। টান দিয়ে বলল, না।
কেন?
আমি পড়ি ইত্তেফাঁক আর জনকণ্ঠ।
আমাদেরটাও পড়ে দেখ।
কেন, কী আছে তোদের কাগজে?
চানাচুরে ভর্তি।
মানে?
চা শেষ করে স্বপনের প্যাকেট থেকে সিগ্রেট নিয়ে ধরাল হাসান। মানে প্রচুর মজার মজার লেখা থাকে। বিশেষ করে আমি যে পাতাগুলো করি সেগুলো তো মজায় ভর্তি। ওসব পাতার লেখা পাঠকরা খুব খাচ্ছে। একবার হাতে নিলে তুইও খেতে থাকবি।
শুনে স্বপন একেবারে হতভম্ব। সিগ্রেটে টান দিতে ভুলে গেল। লেখা আবার খায় কী করে?
পড়লেই বুঝতে পারবি।
তারপর হাসতে হাসতে স্বপন বলল, কালচারাল মিডিয়াতে খাওয়া শব্দটা খুব চলছে আজকাল। বাজার কাটতি জিনিসগুলোকে জনপ্রিয় না বলে খাওয়া’ বলা হচ্ছে। যেমন ধর সিনেমার অমুক নায়িকা খুব জনপ্রিয়। যে ছবিতে সে আছে সেই ছবি হিট। আমাদের ভাষায় নায়িকাটিকে আমরা কিন্তু জনপ্রিয় বলব না। বলব অমুক নায়িকাকে লোকে আজকাল খুব খাচ্ছে।