শিলা বললেন, তোমাদের কি টাকার অভাব আছে? ইচ্ছে করলে ব্যাংকলোন ছাড়াও এরকম তিনটা বিল্ডিং তোমরা করতে পার।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন মামুন। পারলেও করব না। অসুবিধা আছে। ইনকামট্যাক্সওয়ালারা খেয়ে ফেলবে।
স্বপন বলল, আর একটা কাজ করা যায়। সেটা সব চাইতে সহজ। আজকাল সেভাবেই অনেকে করছে। বাড়িটা আমরা ডেভলাপারকে দিয়ে দিলে পারি। ফ্ল্যাটের হিসেবটা হবে সিক্সটি ফোরটি। একেক বিল্ডিংয়ের ছটা ফ্ল্যাট ওদের, চারটা আমাদের। চারটা ফ্ল্যাটের সঙ্গে আটটা গ্যারেজ। তিনকোটি বিশলাখ টাকার প্রপার্টি। সঙ্গে আরও লাখ পঞ্চাশেক করে ক্যাশ টাকা। এছাড়া নিজেরা ফ্ল্যাট করে বিক্রি করলেও ভাল বিজনেস হবে।
মামুন মাথা নাড়লেন। তা হবে। এবং বিজনেস হিসেবে এটা এখন খুবই ভাল। এলাকার অনেকেই করছে। আসলে ব্যাপারটা হল এত দামী জায়গা আজকাল এভাবে কেউ ফেলে রাখে না।
অনেকক্ষণ ধরে সবার কথা শুনছিল সেতু। এবার সে বলল। কিন্তু আমরা ফেলে রাখব ভাইয়া। আমাদের অত টাকা পয়সার দরকার নেই। আমাদের যা আছে তাই যথেষ্ট। এতবড় বিজনেস তোমাদের, এই বাড়ি ছাড়াও আরও অনেক প্রপার্টি আছে। দিন দিন টাকা পয়সা, প্রপার্টি আরও বাড়বে। চাইলে ওরকম বিল্ডিং যে কোনও জায়গায় তোমরা করতে পারবে। এই বাড়িটা যেমন আছে তেমনই থাকুক।
তারপর মাথা নিচু করে বলল, মা মারা গেলেন এই বাড়িতে, বাবা গেলেন। দুজনের কত চিহ্ন ছড়ানো বাড়িতে, কত স্মৃতি। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন বাগান নিয়ে, গাছপালা নিয়ে। মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর হার্টএ্যাটাক করল বাবার। সিঙাপুর থেকে বাইপাস করিয়ে আনলে তোমরা। তারপর থেকে সারাক্ষণ নিজের রুমের সঙ্গের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে থাকতেন। এখনও হঠাৎ হঠাৎ বাবাকে যেন সেভাবে বসে থাকতে দেখি আমি। টাকার জন্য এসব স্মৃতি নষ্ট করে ফেলা কি ঠিক হবে? সবচে’ বড় কথা আমাদের কোনও অভাব নেই।
সেতুর কথা শুনে থমথমে হয়ে গিয়েছিল পরিবেশ। খানিক কেউ কোনও কথা বলেনি।
শেষ পর্যন্ত মামুন বললেন, ঠিক আছে, তোর কথাই থাকবে। তোর কথা শুনে আমার ভাল লেগেছে। এত সুন্দর করে কথাগুলো বললি তুই! তোকে তো সব সময়ই আমি খুব ছোট্ট মনে করি, আজ মনে হল তুই বেশ বড় হয়ে গেছিস।
শিলা বলল, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, বড় হবে না!
শিলার কথায় সেতু বেশ লজ্জা পেয়েছিল। আবার মনে পড়েছিল শুভর কথা। বড় তো সে হয়েছেই। বড় না হলে কি শুভকে সে এমন করে ভালবাসে! শুভকে পাওয়ার জন্য এমন করে পাগল হয়!
তারপর আরেকটি কথা মনে হয়েছিল সেতুর। বিয়ে হলে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে তাকে। শুভদের বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে। তখন? তখন এত মায়া জড়ানো প্রতিদিনকার বাড়িটির জন্য মন কেমন করবে না তার!
ঠিক এই কথাটাই দুদিন পর শিলা তাকে বলেছিল। এই বাড়ির জন্য এত যে মায়া তোমার, এই বাড়ি তুমি তাহলে ছেড়ে যাবে কী করে?
বুঝেও বেশ ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে শিলার কথার জবাব দিয়েছিল সেতু। ছেড়ে যাব মানে? কোথায় যাব?
শ্বশুরবাড়ি যাবে না?
সেতু হেসেছিল। না ওতো যেতে পারি।
তার মানে কী? তুমি বিয়ে করবে না?
নিশ্চয় করব।
তাহলে?
বিয়ে করলেই যে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে এমন কোনও কথা নেই। আমার ক্ষেত্রে উল্টোটাও হতে পারে।
বর নিয়ে আসবে এই বাড়িতে?
হতে পারে।
তাহলে তোমার ভাইদের বলি তোমার জন্য ঘরজামাই দেখতে।
সেতু ছটফট করে উঠেছিল। এই, না ভাবী! খবরদার! বিয়ে টিয়ের কথা এক্ষুনি বলবে না।
তারপর যা হয় আর কী, সঙ্গে সঙ্গে শুভর কথাও মনে পড়েছিল। শুভর সঙ্গে বিয়েতে ভাইভাবীরা কিছুতেই রাজি হবে না। শুভরা বেশ গরিব। ওরকম গরিব ফ্যামিলিতে সেতুকে কিছুতেই বিয়ে দেবে না ভাইরা। যত ভালই সেতুকে তারা বাসুক, কিন্তু এ কিছুতেই মেনে নেবে না। এ কারণেই শুভর কথা বাড়ির কাউকে বলেনি সেতু। জীবনের সবচে ভাললাগা মানুষটির কথা, সবচে ভালবাসার মানুষটির কথা বাড়ির সবার কাছে চেপে রেখেছে।
বারান্দার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে এখন এসব কথা মনে পড়ল সেতুর। মন খারাপ হয়ে গেল। শুভকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসা সম্ভব নয় তার, অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
কিন্তু শুভকে সে কেমন করে পাবে?
ঠিক তখুনি আতাগাছের দোয়েল পাখি শিস বন্ধ করল। খানিক চুপচাপ থেকে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে বাঁশঝাড়ের দিকে উড়াল দিল। ডুমুরঝোঁপের আবছা অন্ধকার থেকে ছটফটে ভঙ্গিতে উড়ে এল একজোড়া টুনটুনি। এসে মেহেদিঝোঁপের চারপাশে ওড়াউড়ি করতে লাগল, উত্তেজিত ভঙ্গিতে ডাকাডাকি করতে লাগল।
কী ব্যাপার? পাখি দুটো এমন করছে কেন?
তারপরই টুনটুনিদের উত্তেজনার কারণ বুঝতে পারল সেতু। কচুঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে একজোড়া বেজী। স্বভাব চঞ্চল ভঙ্গিতে বাগানের ইতিউতি চড়তে শুরু করেছে। এই দেখে ছোট্ট টুনটুনিরা ভয় পেয়েছে। কিন্তু বেজীরা নির্বিকার।
সেতু তারপর বেজী দেখতে লাগল। চঞ্চল ভঙ্গিতে একবার মানকচু ঝোঁপটার দিকে যায়, একবার ডুমুরঝোঁপের দিকে। বাঁশঝাড়ের ওদিকটা ঘুরে এল একবার। তারপর বাগানের মাঝামাঝি এসে মেহেদিঝোঁপের ছায়ায় অলস ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল একটি। আরেকটি খানিক দাঁড়াল শুয়ে পড়াটির সামনে, তারপর একবার এদিক যায় আরেকবার ওদিক, যেদিকেই যায় খানিক গিয়েই আবার ফিরে আসে। শুয়ে পড়াটির মুখের কাছে মুখ নেয়, মুখ তোলে।