চোখ বন্ধ করে শাহিন বলল, মাথাটাও খুব ধরে আছে।
মাথায় পানি দিয়ে দেব?
দাও। একটা চাঁদরও গায়ে দিয়ে দাও। ঠাণ্ডা লাগছে।
ওয়ার্ডরোব থেকে চাঁদর বের করে শাহিনের গায়ে দিয়ে দিল সুরমা। তারপর বাথরুম থেকে প্লাস্টিকের বড় বালতি ভরে পানি আনল, মগ আনল, এনে অতিযত্নে। স্বামীর মাথায় পানি দিতে লাগল।
এ সময় হন্তদন্ত হয়ে মা এসে ঢুকলেন। শাহিন, কী হয়েছে বাবা?
তারপর ছেলের কপালে হাত দিলেন। ইস্ শরীর একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। কখন এরকম জ্বর এল? সকালবেলা আমাকে বলবি না! জ্বর নিয়ে অফিসে গেলি কেন?
শাহিন মুমুর্ষ গলায় বলল, তখন ছিল না। অফিসে যাওয়ার পর মাথা ব্যথা শুরু হল। শীত করতে লাগল। তারপর জ্বর এল।
পানি দেয়া বন্ধ করে উঠল সুরমা। তোয়ালে দিয়ে শাহিনের মাথা ভাল করে মুছে ঠিকঠাক মতো শুইয়ে দিল তাকে। তারপর কিচেনের দিকে চলে গেল। মা বসে রইলেন শাহিনের মাথার কাছে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এককাপ র চা আর একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নিয়ে এল সুরমা। শাহিনকে বলল, উঠে বস। গরম গরম র চায়ের সঙ্গে ট্যাবলেটটা খেয়ে নাও। এ এমন কিছু না। শর্দি জ্বর। তিনবেলা তিনটা ট্যাবলেট খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে মুখিয়ে উঠলেন মা। কে বলেছে তোমাকে এসব ছাইপাস খেলে ঠিক হয়ে যাবে! তুমি কি ডাক্তার যে নিজের ইচ্ছে মতো অমুদ খাওয়াচ্ছ?
শাশুড়ির এই ধরনের আচরণে সুরমা একেবারে বিব্রত হয়ে গেল। কোনও রকমে বলল, শর্দি জ্বরে এই ট্যাবলেটই দেয় মা।
মা আগের মতোই রুঢ় গলায় বললেন, কোন ট্যাবলেট দেয় না দেয় সেটা ডাক্তার বুঝবেন। জ্বর এসেছে, তোমার উচিত ছিল টেলিফোন করে ডাক্তার ডেকে আনা।
চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকাল শাহিন। এইটুকু জ্বরে ডাক্তার ডাকবার দরকার কী?
তুই চুপ কর। দরকার আছে কি নেই আমি বুঝব! একা এতবড় একটা সংসার টানতে টানতে শেষ হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা কিন্তু বাড়িতে তার কোনও যত্নআত্তি নেই। ঠিক আছে, আমিই ডাক্তারকে ফোন করছি।
রাগি ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন মা।
শাহিন তারপর উঠে বসল। চায়ের কাপ এবং ট্যাবলেটের জন্য সুরমার দিকে হাত বাড়াল। দাও।
গভীর অভিমানে হাত সরিয়ে দিল সুরমা। না থাক। কেন? এসব খাওয়ার দরকার নেই। ডাক্তার আসুক।
স্ত্রীর অভিমানটা বুঝল শাহিন। মায়াবি গলায় বলল, মন খারাপ করো না। মা সব সময়ই এমন।
এমন ছিলেন না, হয়ে গেছেন। বাচ্চাকাচ্চা হয় না বলে আমাকে তিনি পছন্দ করেন না।
চায়ের কাপ এবং ট্যাবলেট হাতে কিচেনের দিকে চলে গেল সুরমা। শাহিনের মনটা খারাপ হয়ে রইল।
.
দুহাতে সেতুর একটা হাত ধরে শুভ বলল, কী করা যায় বল তো!
চোখ তুলে শুভর দিকে তাকাল সেতু। কী হয়েছে?
উঠতে বসতে মা শুধু গালাগাল করছেন।
কেন?
চাকরির জন্য। আমার এখনও রেজাল্ট বেরয়নি। এ অবস্থায় কোথায় চাকরি পাব? কে আমাকে চাকরি দেবে?
সেতু মুখ গোমরা করে বলল, এসব শুনতে আমার ভাল লাগছে না।
ভাল না লাগার কী হল?
এলাম তোমার সঙ্গে প্রেম করতে, তুমি বলছ সমস্যার কথা।
সমস্যা থাকলে বলব না?
না বলবে না।
তাহলে কী করব?
আমাকে দেখবে।
দেখছি তো।
না দেখছ না। শাড়ি পরে, এত সুন্দর করে সেজে এলাম আর তুমি আমার দিকে তাকিয়েও দেখছ না।
হাত ছেড়ে এক হাতে সেতুকে বুকের কাছে টেনে আনল শুভ। মুখটা সেতুর মুখের কাছে নিয়ে বলল, কে বলেছে তাকাইনি? তাছাড়া তাকাতে হবেই বা কেন? আমার। চোখ জুড়ে সারাক্ষণই তুমি! মন জুড়ে তুমি! চোখ বুজে, চোখ খোলা রেখে সারাক্ষণই তোমাকে দেখছি আমি।
সেতুর গালে ঠোঁট ছোঁয়াল শুভ। তারপর দুহাতে তার মুখটা তুলে ধরল। সেতুর চোখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বলল, তোমার মতো এত সুন্দর মুখ আমি আর কারও দেখিনি।
একথার পর দুহাতে শুভর গলা জড়িয়ে ধরল সেতু। এভাবে বল বলেই আর কারও কথা ভাবতে পারি না আমি।
শুভ অবাক হল। আর কারও কথা মানে? কার কথা ভাবতে চাও?
ভাবতে চাই না। বাধ্য হতে পারি।
কথাটার অর্থ কী?
অর্থটা তুমি জান। তোমার সঙ্গে বিয়েতে ভাইয়ারা কিছুতেই রাজি হবে না।
আবার সেতুর চোখের দিকে তাকাল শুভ। সেতু যেভাবে কথাটা তাকে বলেছিল ঠিক সেইভাবে বলল, এলাম তোমার সঙ্গে প্রেম করতে আর তুমি বলছ সমস্যার কথা।
শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল সেতু। আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিলে?
দিলাম। কিন্তু ভাইয়ারা যদি বিয়েতে রাজি না হন তাহলে তুমি কী করবে?
জানি না।
ভাবনি?
না।
আজ থেকে ভাববে।
এসব ভাবার দায়িত্ব আমার না।
তাহলে কার?
তোমার।
আমি যা ভাবব, যা করব তুমি তা মেনে নেবে?
তোমার কী মনে হয়?
মনে হয় নেবে। তবে ওই ধরনের পরিস্থিতি হলে তোমাকে নিয়ে আমি পালিয়ে যাব।
তাই নাকি?
কেন তুমি বিশ্বাস করছ না?
না।
বল কী?
কেন বিশ্বাস করছি না জানো? যত সহজে বলছ আমি জানি এত সহজে কাজটা তুমি করবে না। চট করেই বড় বড় কথা যারা বলে আসল সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তারা সাধারণত পিছিয়ে থাকে।
তার মানে আমার ওপর তোমার ভরসা নেই?
সেতু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, এইসব প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দেব না। আমি শুধু জানি, আমি তোমাকে ভালবাসি, এই জীবন আমি তোমার সঙ্গে কাটাব। কেমন করে কাটাব তুমি না পারলে সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব।
কথাটা শুনে খুব ভাল লাগল শুভর। মুগ্ধ চোখে সেতুর দিকে তাকিয়ে রইল সে।