উদ্দালক বলল, “মুরগিই আন। হাঁস পোষায় না।”
পল্টু ডিম নিয়ে এল। মাস্টার ছাত্রতে মিলে রান্না শুরু হল। পল্টু পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলল, “স্যার, পেম মানেই টাকা খরচ মনে হয়। বিনোদ ওর বাপের মানিব্যাগ থেকে টাকা ঝেড়েছিল বলে খুব ক্যালানি খেল।”
উদ্দালক ডিম সেদ্ধ দিয়েছিল। চারটে ডিম সেদ্ধ হয়েছে। একটা ডিম ছুরি দিয়ে কেটে গোলমরিচ ছড়িয়ে পল্টুকে বলল, “এ নে, হাফ খা।”
পল্টু হাফ ডিম মুখে চালান করে দিল।
উদ্দালক ডিম খেতে খেতে বলল, “বিনোদের বিয়ে দিয়ে দিতে পারে ওর বাবা। প্রেমের নেশা ঘুচে যাবে।”
পল্টু কৌতূহলী হল, “কেন স্যার? বিয়ে করলে পেম চলে যায়?”
উদ্দালক বলল, “ওরকমই কিছু ব্যাপার।”
পল্টু বলল, “আপনি পেম করেননি?”
উদ্দালক বলল, “না।”
পল্টুর এবার আরও কৌতূহল বাড়ল। বলল, “কেন স্যার?”
উদ্দালক বলল, “সময় পাইনি।”
পল্টু বলল, “তা হবে স্যার। পেমে অনেক সময় লাগে। বিনোদ তো সারাক্ষণ ফোনে কথা বলে যায়। খেলতে ডাকি, আসে না। আপনি তো সারাদিন পড়েছেন বলুন?”
উদ্দালক দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “হ্যাঁ, অনেক পড়ে এখন তোদের পড়াচ্ছি।”
পল্টু বকে যেতে লাগল। উদ্দালক আবার সিগারেট ধরাল।
লাল লাল ডিমের ঝাল ঝোল খেতে দারুণ হল। পল্টু দাঁত বের করে বলল, “যাই স্যার। আবার বাড়িতে গিয়ে খেতে হবে। বাবা বলেছে কাল আপনার জন্য ভেটকি মাছ পাঠিয়ে দেবে। ওটাও ঝাল করে রান্না করা যাবে।”
উদ্দালক বলল, “সাবধানে যা।”
পল্টু চলে গেলে উদ্দালক দরজা বন্ধ করে ডায়েরি নিয়ে বসল।
একটা লেখা মাথায় আসছে। দেখা যাক, কতটা পাতায় নামাতে পারে…
১০
টিচার্স রুমে তারাপদবাবু আর সমরেশবাবুর প্রায়ই ঝামেলা লাগে। দুজনে দুই রাজনৈতিক দলের সমর্থক। উদ্দালক স্কুলে পৌঁছে দেখল শুরু হয়ে গেছে ঝামেলা।
তার ফার্স্ট পিরিয়ড অফ আছে। সে চেয়ারে বসে মন দিয়ে দুজনের বক্তব্য শুনতে লাগল। পাশ থেকে সুদেববাবু ফিসফিস করে বললেন, “আজ আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন তোমার, মনে আছে তো?”
উদ্দালক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অবিবাহিত হবার এই এক সমস্যা। সবাই বিভিন্ন জায়গার মেয়েদের সঙ্গে তাকে জুড়ে ফেলবে। সুদেববাবুর শালি আছে। বেশ কয়েকবার কথা তুলেছেন। উপরোধে শেষে একবার “হ্যাঁ” বলে ফেলেছে। সেদিন যে আজকেই তা মাথায় ছিল না। বলল, “হ্যাঁ, মনে আছে।”
সুদেববাবু বললেন, “চিংড়ি চলে তো?”
উদ্দালক বলল, “চলে।”
সুদেব বললেন, “মাটন? রেজালাটা আমার মিসেস দারুণ করে বুঝলে?”
উদ্দালক বলল, “হ্যাঁ।”
সুদেব বললেন, “কাঁচা আমের চাটনি?”
উদ্দালক বলল, “হ্যাঁ। আচ্ছা আমাকে হেডস্যারের ঘরে যেতে হবে। আমি ঘুরে আসি।”
সুদেববাবু বললেন, “কেন বলো তো?”
উদ্দালক বলল, “মা এক মেয়ে দেখেছে। শনিবার আশীর্বাদ। ছুটি নিতে হবে।”
সুদেববাবুর মুখটা এতক্ষণ কর্পোরেশনের ভেপার লাইটের মতো জ্বলছিল। উদ্দালকের কথায় সে মুখে লোডশেডিং চলে এল, “মানে? তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”
উদ্দালক বলল, “হ্যাঁ। ঠিক হয়ে গেছে তো। ওহ আপনাকে বলা হয়নি তার মানে।”
সুদেববাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আজকের রাতের প্রোগ্রামটা ক্যানসেল হতে পারে বুঝলে? গিন্নি বলছিল বটে কী একটা সমস্যা আছে।”
উদ্দালক গম্ভীর মুখে বসে রইল। মানুষের মতো হাড়হারামি জিনিস খুব কম আছে। যতক্ষণ ধান্দা আছে, ততক্ষণ জ্বালিয়ে খাবে। যেই দেখবে তাকে দিয়ে ধান্দা মেটার সম্ভাবনা নেই, তখন মুখ ঘুরিয়ে নেবে। সুদেববাবু কিছুক্ষণ পরেই উঠে গিয়ে কোত্থেকে ঘুরে এসে বললেন, “না হে, আজ প্রোগ্রামটা হচ্ছে না। আমার গিন্নির শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেছে।”
তারাবাবু আর সমরেশবাবুর কাজিয়াটা বেড়ে উঠেছে। উদ্দালক এবার গলা নামিয়ে বোমাটা ছাড়ল, “আসলে আশীর্বাদ না, এমনি দেখতে যেতাম। ঠিক আছে, প্রোগ্রাম যখন ক্যানসেল করেছেন, তখন থাক।”
সুদেববাবুর মুখের ঔজ্জ্বল্য ফিরে এল। বললেন, “ওহ, আমারও তাই মনে হচ্ছিল। আসলে বুঝলে না, গিন্নির শরীর খারাপ থাকলেও শালিই সব করবে। তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই। আর তোমাকে একটা কথা বলি, বাইরে এসো।”
সুদেববাবু উঠলেন। অগত্যা উদ্দালককেও উঠতে হল। টিচার্স রুমের বাইরে করিডরে দাঁড়িয়ে সুদেববাবু গলা নামিয়ে বললেন, “কলকাতার মেয়েদের বিয়ে করবে না কখনও। ওখানে তো ফ্রি সেক্স চলে। বিয়ের আগে সবার হয়ে যায়।”
উদ্দালক ভালো মানুষের মতো মুখ করে বলল, “কী হয়ে যায়?”
সুদেববাবু বললেন, “আরে জীবনবিজ্ঞানে পড়ায় না, নিষেক; নিষেক হয়ে যায়। সব পর্দাছেঁড়া মাল। কলকাতার মেয়ে বিয়ে কোরো না হে। আমার কথা শোনো, আমার শালিকে দেখো আজ, যেমন নম্র, তেমন ভদ্র। ছেলেদের দিকে চোখে চোখ রেখে কথা পর্যন্ত বলতে গিয়ে গলা কেঁপে-টেপে একশা হয়ে যায়। তোমার বাবা মার নাম্বারটাও দিয়ো আমাকে। দরকার হলে আমি কথা বলে নেব।”
উদ্দালক বলল, “ঠিক আছে, আপনি তো আজকের প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করেই দিয়েছেন, শনিবার আমি কলকাতা থেকে ফিরি, তারপর নাহয় একদিন নেমন্তন্ন করবেন? আজ ছেড়ে দিন।”
সুদেববাবু হতাশ মুখে বললেন, “আর কলকাতার মেয়ে যদি তোমার পছন্দ হয়ে যায়, তখন কী হবে?”
উদ্দালক বলল, “পছন্দ হবে না। আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে মনে থাকবে।”