উদ্দালক বলল, “চেষ্টা করছি স্যার।”
তপনবাবু বললেন, “ঠিক আছে যাও। যেটা বললাম মনে রেখো। বি এ ম্যান। বুঝলে? বি এ ম্যান। শো ইওর ম্যানফোর্স।”
বলেই তপনবাবু জিভ কাটলেন।
৭
জিনিয়ার প্রস্তাব শুনে আদিদেব আর রোহিণী দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
আদিদেব বললেন, “তুমি ভেবে বলছ, যা বলছ?”
জিনিয়া বলল, “হ্যাঁ। আমি ভেবে নিয়েছি। তোমরা কি বাড়ি বেচবে?”
উৎসুক চোখে তাকাল জিনিয়া।
আদিদেব বললেন, “দ্যাখো মা, এ নিয়ে তো আমরা কিছুই ভাবিনি এখনও। পুরোটাই সৌম্য ঠিক করবে। ওর সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাব নাহয়?”
জিনিয়া বলল, “ঠিক আছে। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। কোথায় উনি?”
আদিদেব ইতস্তত করলেন। জিনিয়ার প্রস্তাব শুনে সৌম্য জিনিয়াকে অপমান করে বসতে পারে। বললেন, “ও বেরিয়েছে। ফিরলে কথা বলে তোমাকে ফোন করি?”
জিনিয়া বলল, “অসুবিধা নেই। আমি অপেক্ষা করতে পারি। আচ্ছা উনি ফোন নিয়ে বেরোননি? দ্যাখো না একটু ফোন করে যদি পাওয়া যায়।”
রোহিণী জিনিয়ার হাত ধরে বললেন, “মা, তোমাকে একটা কথা বলি?”
জিনিয়া বলল, “বলো।”
রোহিণী বললেন, “কথাটা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে, তবু বলি। তুমি সতুকে ভুলে যাও।”
জিনিয়া রোহিণীর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “তুমি চাইছ না আমি এ বাড়িটা কিনি?”
রোহিণী বললেন, “আমি চাইছি তুমি এবার এগিয়ে যাও। থেকো না আর এই কাল্পনিক পৃথিবীটাতে। তুমি একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছ। দ্যাখো, আমি তো মা, আমি বুঝতে পারছি সতু নেই বলে তোমার ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই বোধহয় একটা সময় আসে, যখন আমাদের পুরোনো সব কিছুকে ভুলে এগিয়ে যেতে হয়। তুমি ভুলে যাও সতুকে। আমি বলছি তোমায়।”
জিনিয়া মাথা নিচু করে বলল, “সবাই আমাকে শুধু একটা কথাই সর্বক্ষণ বলে যাচ্ছে। ভুলে যাও, ভুলে যাও। আমি কেন ভুলে যাব বলো তো? কেন ভুলে যাব? আমার কোনও অনুভূতি থাকতে পারে না? আমি যদি চাই ওর স্মৃতিটাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে, কেন আমার সেই অধিকার থাকবে না? বিয়েবাড়ি যাবে বলে বেরোল। হঠাৎ করে শুনি ভিড় ট্রেন থেকে পড়ে গেছে। ও আর নেই। আমি সেদিন থেকে প্রতিটা দিন মরছি একটু একটু করে। আমি যদি চাই কোনওভাবে ওর সঙ্গেই থেকে যেতে, কেন আমাকে থাকতে দেওয়া হবে না? কেন আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে সবাই? কী পাপ করেছি আমি?”
কান্নায় ভেঙে পড়ল জিনিয়া। রোহিণী জিনিয়ার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। জড়িয়ে ধরলেন জিনিয়াকে।
সৌম্য বাজার গেছিল। অনেক দিন পরে চেনা বাজার ঘুরতে ভালো লাগছিল। সবজি কিনল বেশ খানিকটা। মাংস কিনতে গিয়ে থমকে গেল। সতু মাংস খেতে ভালোবাসত। উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ বাজার নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বাড়ি ঢুকে দেখল জিনিয়া কাঁদছে।
সে আদিদেবের দিকে তাকাল, “কী হচ্ছে এখানে বাবা?”
হঠাৎ করে সৌম্য আসায় খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে আদিদেব বললেন, “ও আমাদের বাড়িটা কিনতে চায়। সতুর স্মৃতি…”
কথা বলা শেষ করে উঠে পারলেন না আদিদেব, সৌম্য চেঁচিয়ে উঠল, “ইয়ার্কি হচ্ছে এখানে? এ বাড়ি কি আমার বাড়িও না? কী শুরু হয়েছে? যে মারা গেছে সে কি আমারও ভাই না? ন্যাকামি মারার একটা সীমা থাকা দরকার!”
সৌম্যর চিৎকারে জিনিয়া স্থবির হয়ে গেল।
রোহিণী তাড়াতাড়ি সৌম্যর হাত ধরে বললেন, “তুই ঘরে চ। ঘরে চ। এখন রাগারাগি করিস না বাবা।”
সৌম্য ভীষণ রেগে গেছিল। সে বলল, “কেন ঘরে যাব? কেন বেচব বাড়ি? আপনি আমাকে বলুন তো, আপনার বাড়ি কেউ কিনতে চাইলে আপনি বেচে দেবেন?”
জিনিয়া মাথা নিচু করে কেঁদে চলল। আদিদেব বললেন, “সমু ঘরে যা প্লিজ। মাথা ঠান্ডা কর। যা। পাড়ার লোক চলে আসবে এখানে চ্যাঁচামেচি হলে। সিন ক্রিয়েট হয়ে যাচ্ছে। তুই ঘরে গিয়ে মাথা ঠান্ডা কর।”
সৌম্য ছটফট করতে করতে নিজের ঘরে গেল।
রোহিণী বললেন, “তুমি ওর কথায় কিছু মনে কোরো না মা, ও খুব সেন্টিমেন্টাল। বাড়ি বেচতে চাইছে না আসলে।”
জিনিয়া ভাঙা গলায় বলল, “তাহলে তোমরা যে চলে যাচ্ছ?”
রোহিণী বললেন, “তুমি সতুর অ্যালবাম, জামাকাপড় নিয়ে যাও। আমরা তো কাল চলে যাব, তুমি আজ নিয়ে যাও সব। তাহলে হবে না?”
জিনিয়া শূন্য দৃষ্টিতে একবার রোহিণী, আর-একবার আদিদেবের দিকে তাকাল।
৮
রান্নাঘরে বাজার রেখে সৌম্য ঘরে গিয়ে চুপ করে বসে মোবাইল খুটখুট করছিল।
আদিদেব ঢুকলেন। বললেন, “রাগ কমেছে? তোর রাগ তো হাউইয়ের মতো, এই উঠে গেল, তারপর নেমে যায়। কমেছে রাগ?”
সৌম্য গুম হয়ে বসে থাকল।
আদিদেব বললেন, “কাজটা কি ভালো হল সমু? মেয়েটার সঙ্গে সতুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। একগাদা স্বপ্ন দেখেছিল। সব শেষ হয়ে যাবার পর মেয়েটা যদি একটু পাগলামিও করে, সেটাকে এভাবে চ্যাঁচামেচি করে কমানো সম্ভব?”
সৌম্য বলল, “তো কী করব, তুমি বলো। ওকে বাড়ি বিক্রি করব? এ বাড়িতে আমিও তো বড়ো হয়েছি। সতুর সঙ্গে আমার স্মৃতি নেই? হুট করে এসে যদি বলে বাড়ি কিনতে চায়, আর তাতে যদি আমার মাথা গরম হয়ে যায়, সেটা কি খুব অস্বাভাবিক কিছু?”
আদিদেব সৌম্যর কাঁধে হাত রাখলেন, “একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু আমাদের ছেলে মারা গেছে। তোর ভাই মারা গেছে। আমরা ওকে ভুলতে শহর ছেড়েই চলে যাচ্ছি। মেয়েটাকে তো এখানেই থাকতে হবে। ওর কথা ভাবব না কেউ?”