মালতী চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে বললেন, “আর কত আঘাত দিবি আমাকে দেখব। কিছু বলব না তোকে। দেখে যাব।”
জিনিয়া বলল, “আহত হওয়ার মতো কথা বোলো না। আমাকে একটু শান্তি দাও। ঠিক হয়ে যাবে। এরকমভাবে বারবার খোঁচালে সব আবার অগোছালো হয়ে যাবে। বোঝো দয়া করে।”
মালতী উঠলেন, “যাই। রান্নাবান্না দেখি। মশার কামড় খাস না।”
জিনিয়া কিছু বলল না।
মালতী বেরিয়ে গেলেন। জিনিয়ার আবার কান্না পেল। বালিশটায় মুখ গুঁজল। সৌপ্তিক সারাদিন ধরে তাকে একগাদা বস্তাপচা জোকস পাঠাত। মোবাইল খুলে সে জোকগুলো দেখতে লাগল। ভয়েস মেসেজগুলো একের পর এক শুনতে শুরু করল।
বালিশ ভিজে গেল চোখের জলে।
২
আদিদেব বাগানে জল দিচ্ছিলেন। রোহিণী বারান্দায় চুপ করে বসেছিলেন।
জিনিয়া গেট খুলে ঢুকল।
আদিদেব জিনিয়াকে দেখে ম্লান হাসলেন। জিনিয়া প্রত্যুত্তরে হাসল।
রোহিণী জিনিয়াকে দেখে বললেন, “আজ অফিস গেলে না?”
জিনিয়া রোহিণীর পাশে বসে বলল, “ছুটি নিয়েছি কাকিমা। কেমন আছ এখন?”
রোহিণী বললেন, “কেমন থাকা যায়?”
জিনিয়া চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। আদিদেবের গাছে জল দেওয়া হয়ে গেছিল।
জল বন্ধ করে বারান্দায় এসে বসলেন।
জিনিয়া বলল, “রান্নাবান্না কিছু করেছ কাকিমা?”
রোহিণী বললেন, “করব। দেখি কী করা যায়।”
আদিদেব বললেন, “তোমার বাবা মা কেমন আছেন জিনিয়া?”
জিনিয়া ঘাড় নাড়ল, “ভালো।”
আদিদেব বললেন, “তোমার ট্রমা? কেটেছে?”
জিনিয়া ঘাড় নাড়ল, “জানি না।”
রোহিণী আদিদেবকে বললেন, “এসব কথা কেন বলছ ওকে?”
আদিদেব বললেন, “আমরা যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, জিনিয়ারও একই ফিলিংস হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে ক্ষতি নেই তো কোনও।”
জিনিয়া বলল, “না না, ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করছি। শুধু মাঝে মাঝে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে বড্ড।”
আদিদেব বললেন, “সবখানেই এক ব্যাপার। সকালটা যাও বা কেটে যায়, রাত কাটতে চায় না।”
জিনিয়া বলল, “আমি একবার সৌপ্তিকের ঘরে যাই?”
আদিদেব ঘাড় নাড়লেন, “যাও।”
জিনিয়া উঠে সৌপ্তিকের ঘরে গেল।
সৌপ্তিক চলে যাওয়ার পর থেকে এ ঘরে এসে বসাটা কেমন নেশার মতো হয়ে যাচ্ছে তার। আলনায় সৌপ্তিকের জামা, চাদরে যেন এখনও সৌপ্তিকের গন্ধ লেগে আছে।
খাটে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল জিনিয়া।
সৌপ্তিকের সব কিছু আছে। অথচ সে-ই নেই।
মাথা কাজ করে না মাঝে মাঝে। সব এলোমেলো হয়ে যায়। পড়ার টেবিল। কম্পিউটার। ড্রয়ার।
রোহিণী এসে বললেন, “চা করছি। খাবে তো?”
জিনিয়া বলল, “খাব। আচ্ছা ওর ছোটোবেলার অ্যালবামটা দেবে আর-একবার?”
রোহিণী এক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “আচ্ছা। নিয়ে আসছি।”
অ্যালবামটা হাতে নিয়ে ভারী যত্ন করে দেখতে শুরু করল জিনিয়া।
প্রথমবার যেদিন অ্যালবামটা দেখিয়েছিল সৌপ্তিক, সেদিন ওর জন্মদিন ছিল।
প্রতিটা ছবি দেখে কত হাসিঠাট্টা করেছিল দুজনে।
একটা একটা করে ছবি খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল আবার। কত ছবি। মুখেভাত। প্রথম জন্মদিন। আত্মীয়স্বজনের মাঝে ছবি। তেল চপচপে মাথায় তোলা ছবি একটার পর একটা ছবি দেখে যেতে লাগল জিনিয়া। প্রতিটা ছবি তার মাথায় গেঁথে গেছে এ কদিনে। তবু বারবার দেখতে ভালো লাগে। আবার দেখতে ভালো লাগে। ভালো লাগাও ঠিক না, এ যেন সময় কাটানোর নতুন কোনও উপায়। আজকাল তো সময় কাটতেই চায় না। সবসময় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সৌপ্তিকের কথাই মনে পড়ে। এরকম সময় ও থাকলে কী হত, কী বলত? বিকেল হলে কীভাবে বলত, “উফ, কতদিন রোল খাই না। চল চল, ডায়েটিং গুলি মার।”
অথচ দেখা যাবে আগের দিনই রোল খেয়েছে। পুরো পাগল ছিল ছেলেটা।
রোহিণী চা নিয়ে ঢুকলেন। জিনিয়া বলল, “দার্জিলিংয়ের ছবিগুলো দেখছি না।”
রোহিণী খাটের ওপর চা রেখে বসলেন, বললেন, “ও হ্যাঁ। সেগুলোও আছে তো। ঠিক আছে, এনে দিচ্ছি।”
জিনিয়ার কী মনে হতে বলল, “থাক কাকিমা। আমি এরকম আসি, তোমার খারাপ লাগে, না?”
রোহিণী বললেন, “নাহ। ভালো লাগে। সতুকে এত ভালোবাসো তুমি, ভাবলে তোমার জন্যও কষ্ট হয়।”
জিনিয়া বলল, “চেষ্টা করছি, একদিন হয়তো আসা বন্ধ হয়ে যাবে।”
রোহিণী জিনিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “নিজের খেয়াল রেখো। ভালো করে খাওয়াদাওয়া কোরো। আমি ওর মা হয়েও বলছি, এত বেশি করে ওর মধ্যে জড়িয়ে পোড়ো না, কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবে না আর।”
জিনিয়া মাথা নাড়ল, “জানি।”
রোহিণী বললেন, “তোমায় একটা কথা বলা হয়নি। আজ সমু আসছে বিকেলে। ট্রেনে আছে এখন।”
জিনিয়া বলল, “ও।”
রোহিণী বললেন, “ছুটি পেল কোনওমতে। খুব জোর করছে আমাদের দেরাদুন নিয়ে যাবে বলে। বড়ো ছেলের দায়িত্ব পালন করতে চাইছে আর কি। ওর বাবা শুনবে না, জানি। দেখি। ছেলে জোরাজুরি করে যদি। আমার কাছেও অসহ্য হয়ে উঠছে এ বাড়ি।”
জিনিয়া বলল, “চলে যাবে তোমরা? এ বাড়ি কী হবে?”
রোহিণী বললেন, “বিক্রি হয়ে যাবে হয়তো।”
জিনিয়া দিশেহারার মতো বসে রইল।
৩
হাওড়ায় নেমে সৌম্য দরদাম না করেই ট্যাক্সি নিল। গরম লাগছে। প্রি-পেড ট্যাক্সি না নিলে অনেকগুলো টাকা নিয়ে নেয়, ট্রেন থেকে নেমে আর লাইনে ইচ্ছা করছিল না।
শহরে পৌঁছে বরাবরই ভালো লাগে। হাওড়া ব্রিজ, গঙ্গা অনেক কিছু ভুলিয়ে দিতে পারে। এবার দিচ্ছিল না।