জিনিয়া বলল, “ঠিক আছে।”
উদ্দালক আবার শুয়ে পড়ল। পড়া মাত্রই আবার ঘুম। জিনিয়া হতাশ চোখে উদ্দালকের দিকে তাকাল। ভীষণ হিংসে হল। এত সহজে কেউ কী করে ঘুমিয়ে পড়তে পারে?
২
জিনিয়ার রাতে ঘুম হয়নি। ভোর পাঁচটার দিকে উঠোনে শব্দ শুনে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখল উদ্দালকের মা একাই উঠোন ধুচ্ছেন। তাকে দেখে বললেন, “তুমি ঘুমোওনি?”
জিনিয়া বলল, “ঘুম আসছিল না।”
উদ্দালকের মা বললেন, “ও হয়। নতুন জায়গা তো। কোনও অসুবিধা হয়নি তো কাল রাতে?”
জিনিয়া বলল, “না।”
উদ্দালকের মা কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হুঁ।”
জিনিয়া বুঝল ভদ্রমহিলা অন্য কিছু বলতে চাইছিলেন। সে বলল, “খুব টায়ার্ড ছিলাম।”
উদ্দালকের মা বললেন, “সে যাই হোক, আমাদের বয়স বাড়ছে। নাতি নাতনি যাই হোক, তাড়তাড়ি হলে ভালো হয়। ছেলে তো ধনুকভাঙা পণ করে বসল বিয়ে করলে তোমাকেই করবে।”
ঝাঁটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মহিলা। জিনিয়া বলল, “আমি হেল্প করব?”
মা বললেন, “না, না। আমি করে নিচ্ছি। এত লোক, ধুলোবালি গিজগিজ করছে উঠোনে। পারা যায় না। তোমাকে তো আমার কিছু জিজ্ঞেস করাও হয়নি। রান্নাবান্না পারো কিছু? আগেকার দিন হলে বউমাকেই বউভাতে রান্না করতে হত। এখন আর সেই দিন নেই। ক্যাটারার এসে গেছে।”
জিনিয়া বলল, “পারি। রান্না করতে আমার ভালো লাগে।”
মা বললেন, “তাও ভালো। আমি তো জানতাম কলকাতার মেয়ে মানে ম্যাগি ছাড়া আর কিছু রান্না করতে পারে না।”
জিনিয়া বলল, “ভুল জানতেন। দেখুন না, আমাদেরও ধারণা ছিল মফস্সলের শাশুড়ি মানেই অশিক্ষিত হবে। তা তো না। আপনি মাস্টার্স করেছেন।”
উদ্দালকের মার মুখে হালকা হাসি এল, “তা করেছি। পড়াশোনা করতে ভালো লাগত। চাকরির পরীক্ষাও দিয়েছি। ওরা পার্টির লোককে নিল। বাবুর বাবা বা আমরা তো কোনও দিন ওসব পার্টি করিনি। তাই হল না। বরাবরই আমার পড়াশোনা ভালো লাগে।”
ঝাঁটা রেখে উদ্দালকের মা বললেন, “এসো রান্নাঘরে। চা খাই।”
জিনিয়া উদ্দালকের মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে গেল। উদ্দালকের মা বিভাবরী গ্যাস জ্বালিয়ে বললেন, “ওই টুলটায় বসো।”
জিনিয়া বসল। বিভাবরী বললেন, “চিনি খাও তো?”
জিনিয়া বলল, “হ্যাঁ।”
বিভাবরী বললেন, “আমাদের ছেলে বরাবরই ইন্ট্রোভার্ট। কারও অসুবিধা হবে এমন কাজ কখনও করে না। একবার ওর বন্ধু ওর কতগুলো বই নিয়ে চলে গেল। দেয় আর না। সে বন্ধু এ বাড়িতে এসেছে। বাবুকে বললাম, বাবু বল তোর বইগুলো দিয়ে যাক। ছেলে বলে, থাক মা। এখন বললে লজ্জা পাবে। অন্যে লজ্জা পাবে সে নিয়েই ছেলে চিন্তায় পড়ে থাকে। এ ছেলের কী আর হবে। তা তোমাদের প্রেমটা কবছর ছিল?”
বিভাবরী হঠাৎ করে জিনিয়াকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন।
জিনিয়া একটু থতোমতো খেয়ে বলল, “প্রেম মানে?”
বিভাবরী বললেন, “তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল না? আমি জানি সব। আমাকে বলতে পারো।”
জিনিয়া একটু থমকে গিয়ে বলল, “তিন বছরের ছিল। আশীর্বাদও হয়ে গেছিল।”
বিভাবরী চা ছেঁকে তার দিকে কাপ এগিয়ে একটা টুলে বসে কথাটা ঘুরিয়ে দিলেন, “বিয়ের পর বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন আসবে। বাবু তো যাবে না আমি জানি। পারলে এখনই ও স্কুলে চলে যায়। বাবুর ইচ্ছা আরও পড়াশোনা করতে আমেরিকার কোনও ইউনিভার্সিটিতে যাবে। আমার অত চাহিদা নেই। ছেলে বাড়ির কাছে থাকলেই ভালো। তোমার অফিস কবে থেকে যেন?”
জিনিয়ার মুড অফ হয়ে গেছিল। চা খেতে ইচ্ছা করছিল না আর। তবু বিভাবরীর প্রশ্নের উত্তরে বলল, “চার দিন পর।”
বিভাবরী বললেন, “লেডিজ স্পেশাল আছে। ওতেই যাবে। উলটোডাঙায় নেমে আবার অটো করতে হবে, তাই না?”
জিনিয়া বলল, “হ্যাঁ।” বিভাবরী বললেন, “শাঁখা পলাগুলো খুলে রেখেছ?”
জিনিয়া ঘাড় নাড়ল।
বিভাবরী বললেন, “ঠিক আছে। ওসব আজকাল কেউ পরেও না। হাতে কিছু একটা পরে থেকো, তাহলেই হবে। আমাকে একটা কথা বলবে?”
জিনিয়া বলল, “বলুন।”
বিভাবরী বললেন, “বাবুকে বিয়ে করলে কেন তুমি? কী দেখলে ওর মধ্যে?”
জিনিয়া বিভাবরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ঠিক বলতে পারব না। আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন ও আমার মধ্যে কী দেখল।”
বিভাবরী তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তাহলে কি আর তোমাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতাম? সে আদর্শবাদী ছেলে। মেয়েদের কমোডিটি হিসেবে নাকি দেখা উচিত না। ঘরে ঘরে খাবার ধ্বংস করে শাড়ি পছন্দ অপছন্দ করার মতো মেয়ে পছন্দ করা যাবে না। কত ভারী ভারী কথা! নিজের ছেলেকে নিজেই চিনতে পারি না ভালো করে।”
জিনিয়া চুপ করে বসে রইল।
৩
বিকেল নাগাদ পৌঁছল তারা। গাড়ি থেকে নামতেই পল্টু একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে এসে উদ্দালককে আর জিনিয়াকে প্রণাম করে বলল, “স্যার ঘর একদম পরিষ্কার করে রেখেছি। কোনও অসুবিধা হবে না।”
প্রণাম পেয়ে জিনিয়া খানিকটা ঘাবড়ে গেছিল। উদ্দালক হাসিমুখে বলল, “আরে এই তো পল্টু। ওর কথা বললাম না আপনাকে?”
জিনিয়া বলল, “ও হ্যাঁ।”
বাড়িওয়ালা সদাশিববাবু আর তাঁর স্ত্রী শোভনা গাড়ির শব্দ শুনে নেমে এসেছিলেন। জিনিয়াকে আদর করে গৃহপ্রবেশ করালেন।
উদ্দালক ঘরের অবস্থা দেখে খুশি হয়ে পল্টুকে বলল, “তুই এসব করেছিস?”