উদ্দালক ধমক দিয়ে সবাইকে তাড়াল।
ঘরে ঢুকে এসির তাপমাত্রা আরও কমিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার গরম লাগছে না?”
জিনিয়া বলল, “লাগছে।”
উদ্দালক বলল, “তাহলে চেঞ্জ করে নিন। আমি মেঝেতে শুয়ে নিচ্ছি। বিছানা আনিয়ে রেখেছি। প্রচুর পরিশ্রম হল। মাংসটা আপনাদের বাড়িতেই বেশি ভালো হয়েছিল। সাধে কি বলে কলকাতার রান্না? ব্যাপারই আলাদা। মিষ্টিটাও বড্ড ভালো। কোথাকার ছিল?”
জিনিয়া বলল, “আমাদের বাড়ি গেলে দেখিয়ে দেব। বলছি, আমাকে একবার ও বাড়ি নিয়ে যাবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এই বিয়ের ঝামেলায় যাওয়া হচ্ছে না। সৌপ্তিকের ঘরটা নোংরা হয়ে গেছে মনে হয় অ্যাদ্দিনে।”
উদ্দালক মেঝেতে তোশক পেতে বিছানা করে নিয়ে বালিশে আরাম করে শুয়ে বলল, “একদম। ওসব ভাববেন না। কলকাতা ঘোরাও হবে। খাওয়াদাওয়াও হবে। কত জায়গা আছে।”
জিনিয়া বলল, “আমি তো বেশি ঘুরতে ভালোবাসি না। আমি ওদের বাড়িতে থাকব, আপনি ঘুরে নেবেন, ঠিক আছে?”
উদ্দালক বলল, “ঠিক আছে। আচ্ছা শুনুন, ফুলশয্যায় নাকি বউকে আংটি দিতে হয়। আমি কিনতে ভুলে গেছিলাম। মা কিনে দিয়েছে। এটা আপনি খুব অসুবিধা না হলে পরে থাকুন।”
উদ্দালক পকেট থেকে আংটি বের করে জিনিয়াকে দিল।
জিনিয়া নিয়ে বলল, “ঠিক আছে। তবে আমি এ বাড়িতে সিঁদুর পরলেও আপনার ওই ভাড়াবাড়িতে গিয়ে সিঁদুর পরতে পারব না। আশা করি জোর করবেন না।”
উদ্দালক বলল, “প্রশ্নই ওঠে না জোর করার। বিয়ের ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছেন আপনি আমায়। আমি তো কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। আচ্ছা, আমি ঘুমালাম। গুড নাইট।”
উদ্দালক পাশ ফিরল এবং ঘুমিয়ে পড়ল।
জিনিয়া অবাক হয়ে গেল।
অদ্ভুত লোক তো! সৌপ্তিক চলে যাবার পর রাতের পর রাত তার ঘুম হয় না। এদিকে এ শুল আর ঘুমিয়ে পড়ল? পৃথিবীতে এরকম মানুষও আছে?
কেমন হালকা নাকও ডাকছে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ঘর সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে এল। বিয়েবাড়ির সানাই এখনও মৃদু শব্দে বাজছে। জিনিয়ার চোখে জল চলে এল। সৌপ্তিক বেঁচে থাকলে এই রাতটাই কত আনন্দময় হয়ে উঠতে পারত।
বাইরে থেকে লোকের কথাবার্তার আওয়াজ আসছে। কাজের বাড়ি। অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছে। তাদের ঘুমানোর তোড়জোড় চলছে। সে আর উদ্দালক সব কিছু মেনে বিয়ে করেছে। তেমনই চুক্তি হয়েছিল। যে যা বলেছে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। ফটোগ্রাফার যতবার হাসতে বলেছে সে নিক্তিতে মেপে হেসেছে।
সবার বউ ভারী পছন্দ হয়েছে। তার সামনেই বলেছে মুখ ভারী মিষ্টি। জিনিয়ার মন পড়ে আছে সৌপ্তিকের বাড়িতে। কী হচ্ছে কে জানে। একজন লোক ঠিক করে রাখা আছে রাতে ঘুমানোর জন্য। তাতে অন্তত চুরিটা হবে না।
সালোয়ার পরেছে সে। হাতে বিয়ের একগাদা চুড়ি, শাঁখাবাঁধানো, পলাবাঁধানো শব্দ করছে। এই শব্দটা এককালে তার ভারী প্রিয় ছিল। পিসতুতো দাদা বিয়ের ঠিক পরে তাদের বাড়ি এসেছিল। বউদির হাতে চুড়িগুলো শব্দ করছে, কী ভালো লাগছিল। সে ঠিক করেছিল বিয়ের পরেও সে হাত বেশি খালি রাখবে না। সারাক্ষণ সব চুড়ি পরে থাকবে।
এখন সব গয়না খুলে রেখে দিল। গয়নাপ্রিয় জিনিয়ার গয়নার উপর কোনও মোহই নেই এখন আর। বিনা কারণেই দু চোখ ভরে জল এল। সব কিছু কেমন ছারখার হয়ে গেল। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল।
ফোনের হিডেন ফোল্ডারে রাখা তার আর সৌপ্তিকের ফটোগুলো দেখে চলল সে। যত দেখতে থাকল, তত কাঁদতে থাকল। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ উদ্দালক উঠে ঘরে রাখা জলের বোতল থেকে অনেকটা জল খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার ঘুম আসেনি এখনও?”
জিনিয়া বলল, “আমার ঘুম আসে না। নিশাচর হয়ে গেছি আজকাল।”
উদ্দালক বলল, “সে কী? না ঘুমালে অনেক রোগ হয় তো।”
জিনিয়া বলল, “জানি। কী করব বলুন? আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
উদ্দালক বলল, “ঘুমাব। আমার তো ইচ্ছাঘুম। চোখ বুজলেই ঘুমিয়ে পড়তে পারি। কিন্তু আপনি না ঘুমালে আমার অস্বস্তি হবে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আচ্ছা, জেগেই যখন আছেন, একটা কাজ করি দাঁড়ান।”
জিনিয়া অবাক হয়ে বলল, “কী?”
উদ্দালক বলল, “দাঁড়ান না। আসছি।”
দরজা খুলে উদ্দালক বেরোল। কয়েক মিনিট পরে আইসক্রিমের একটা বড়ো বার নিয়ে এসে বলল, “চলুন, দুজনে মিলে মেরে দি। বেঁচে গেছে জিনিসটা। খান খান। ভ্যানিলা ভালো লাগে না?”
জিনিয়া বলল, “না না, থাক না।”
উদ্দালক প্লেট আর ছুরি নিয়ে এসেছিল। বার থেকে কেটে আইসক্রিম প্লেটে রেখে চামচ দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে জিনিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “খেয়ে নিন। লজ্জা করে লাভ নেই। আইসক্রিম সামনে রেখে না খেলে ঠাকুর পাপ দেয়। আপনি তো পল্টুকে চেনেন না। পল্টু একাই এই বার দুটো মেরে দেবে। চ্যাম্পিয়ন ছেলে। অথচ সারাদিন দৌড়োচ্ছে, ঘুরছে, সাঁতার কাটছে, শরীরে মেদের লেশমাত্র নেই। আর শহরের লোক কত কিছু ভেবে খাওয়াদাওয়া করে। এই ক্যালোরি বেড়ে যাচ্ছে, এই ফ্যাট বেড়ে যাচ্ছে, কার্বোহাইড্রেট কন্ট্রোল করো, বাপরে।”
উদ্দালক এমন করে কথাটা বলল, জিনিয়ার হাসি পেল। সে অল্প হেসে সামলে নিয়ে আইসক্রিমের একটু মুখে দিল। সেই সাড়ে বারোটার সময় খেয়েছে। ঠুসে খাইয়েছে সবাই বেশি আদর দেখিয়ে। জিনিয়া তবু খেতে পারেনি তেমন। এখন আইসক্রিমটা খেতে অমৃতের মতো লাগল। উদ্দালক তার নিজের ভাগের আইসক্রিমটা খেয়ে প্লেটটা খাটের তলায় রেখে বলল, “আপনার খাওয়া হয়ে গেলে এখানেই রেখে দেবেন। আমি সকালে ম্যানেজ করে পাচার করে দেব।”