উদ্দালক বলল, “কেন, বিয়ে করে আপনার বাড়িতে থাকলে সমস্যা আছে?”
সদাশিববাবু লজ্জিত হয়ে হাসলেন, “না না, আমি কি তাই বলতে চেয়েছি নাকি? আমি বলছি বউমাকে নিয়ে এই কটা ঘরে থাকতে পারবেন?”
উদ্দালক বলল, “খুব ভালোভাবে থাকব।”
সদাশিববাবু বললেন, “ঠিক আছে। তবু কোনও অসুবিধে হলে বলবেন। অবশ্য আমার গিন্নি আছে। বউমার অসুবিধা হবে না কোনও।”
উদ্দালক হাসল। বাস্তবিকই এমন ভালো বাড়িওয়ালা পাওয়া যায় না। নিঃসন্তান দম্পতি। বাড়িতে কিছু ভালো রান্না হলে তাকে দিয়ে যাবেন ভদ্রমহিলা। এমন আন্তরিকতা আজকালকার দিনে বিরল হয়ে যাচ্ছে।
পল্টু সাইকেল নিয়ে এল। উদ্দালক বলল, “কি রে, তুই এখন কি অঙ্ক করতে এলি?”
পল্টু বলল, “স্যার মাছ ধরতে দিচ্ছে বড়ো পুকুরে। যাবেন নাকি?”
উদ্দালক বলল, “মাছ ধরা আমার পোষায় না। গিয়ে কী করব?”
পল্টু বলল, “মাছ ধরবেন। তিনশো টাকা এন্ট্রি ফি। যে যা মাছ পাবে, তার।”
উদ্দালক বলল, “ধুস, তুই যা। আমার পোষাবে না।”
পল্টু মুখ কালো করে চলে যাচ্ছিল। উদ্দালক পিছু ডাকল, “ঠিক আছে চ। তবে ছিপ তুই-ই ফেলিস। ওসব আমার দ্বারা হবে না।”
সঙ্গে সঙ্গে পল্টুর মুখে যেন টিউবলাইট জ্বলে উঠল।
১৮
অফিস থেকে বেরিয়ে দুজনে একটা ক্যাফেতে বসল। অফিসে ব্যক্তিগত কথা বেশি আলোচনা করা সম্ভব হয় না। কথা বললেই চারপাশ থেকে কৌতূহলী কান পেতে সবাই বসে থাকবে।
কফি অর্ডার করার পরেই সুলগ্না অবাক চোখে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আর ইউ সিরিয়াস? তুই বিয়ে করবি?”
জিনিয়া বলল, “হ্যাঁ। কেন? প্রবলেম কী আছে এতে?”
সুলগ্না বলল, “আমার কেমন ঘেঁটে যাচ্ছে সব কিছু। এত তাড়াতাড়ি?”
জিনিয়া বলল, “হ্যাঁ। বাড়ি থেকে মারাত্মক প্রেশার আসছে। বাবার চাপ আছে, মায়ের চাপ আছে। নেওয়া যাচ্ছিল না আর।”
সুলগ্না বলল, “তুই পারবি? মানে সংসার করতে পারবি?”
জিনিয়া বলল, “সংসার তো করব না। ইট উইল বি ওয়ান টাইপ অফ এগ্রিমেন্ট। উদ্দালকের বাড়ি থেকে প্রেশার আছে বিয়ে করার, আমার বাড়ি থেকেও প্রেশার আছে। সো উই ডিসাইডেড টু স্টে টুগেদার। দ্যাটস ইট। কন্ট্র্যাক্ট ম্যারেজ বলতে পারিস। সৌপ্তিককে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব না। বাড়ির প্রেশার না থাকলে আমি এ বিয়ের ঝামেলায় যেতাম না। বাড়ি গেলেই বাবা-মার গম্ভীর মুখ, মার কথায় কথায় সেন্টু দেওয়া, আমি আর নিতে পারছিলাম না জাস্ট।”
সুলগ্না বলল, “আর ইউ শিওর, দিস ম্যান, উদ্দালক… এই কন্ট্র্যাক্ট মেনে চলার ম্যাচিওরিটি দেখাতে পারবে?”
জিনিয়া মাথা নিচু করে বলল, “প্রোপোজালটা ও-ই দিয়েছিল। আমার মনে হয়েছে পারবে। দেখা যাক। না পারলে আমাকে অন্য রাস্তা দেখতে হবে। তখন আর বাড়ি ফিরব না। শহরের বাইরে কোথাও ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসব। নইলে হয়তো সৌপ্তিকদের বাড়িতে যদি থাকতে দেয়, সেখানে থাকব।”
সুলগ্না বলল, “আর ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে অফিস আসবি নাকি তুই?”
জিনিয়া বলল, “দেখা যাক কী করি। ভাবিনি এখনও। মিটে যাক সব কিছু। শোন না, সৌপ্তিকদের বাড়ির ওদিকে একটা নার্সারিতে গেছিলাম। কয়েকটা গাছ পুঁতব ঠিক করেছি। এই উইকএন্ডে যাবি? একা চাপ হয়ে যাবে।”
সুলগ্না কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বলল, “ম্যান, ইউ আর সো ফাকড আপ। তুই কী করছিস, কেন করছিস, নিজেও বুঝতে পারছিস না।”
জিনিয়া বলল, “তুইও বলবি তো আমি পাগল হয়ে গেছি? বল। একশোবার বল, আমি কিচ্ছু বলব না। না গেলে যাস না। আমি একাই যাব। আগের দিন গিয়ে সৌপ্তিকের ঘর পরিষ্কার করলাম। প্রাইমারি স্কুলে সবকটা পরীক্ষায় ও ফার্স্ট হত। সেই রেজাল্টগুলো গুছিয়ে রাখলাম। এইগুলো নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে আমাকে।”
সুলগ্না জিনিয়ার কাঁধে হাত রাখল, “আমি তোকে বুঝতে পারি। কিন্তু একটা দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আর-একটা যেটা করতে যাচ্ছিস, সেটা ঠিক না ভুল, আমার বোঝার ক্ষমতা নেই। দেখিস, সেটাও যেন দুঃস্বপ্ন না হয়ে যায়।”
জিনিয়া বলল, “সৌপ্তিকের খবরটা শোনার পর থেকে আমি আর নিজের মধ্যে নেই। যা করি, করতে হয় বলেই করি। সুইসাইড করা পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটা আর এত কিছুর পরেও আমার মনে হয় বাবা-মার প্রতি কিছু হলেও কর্তব্য করা বাকি আছে আমার। শুধুমাত্র এ কারণেই সেটা করে উঠতে পারিনি। নইলে…”
সুলগ্না বলল, “ভুলেও ভাবিস না। সুইসাইড ইজ নট দ্য সলিউশন। তাহলে পৃথিবীর সবাই সুইসাইড করে বেঁচে যেতে পারত। মরতে সবাইকেই হবে, তা বলে কাপুরুষের মতো মরাটা কখনও সলিউশন হতে পারে না। আচ্ছা, এই উদ্দালক ছেলেটা কেমন দেখতে? হ্যান্ডু?”
জিনিয়া বলল, “দেখিনি ভালো করে। খেয়ালই ছিল না।”
সুলগ্না বলল, “ছেলেটাই তোকে প্রোপোজালটা দিয়েছে ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং কিন্তু। ব্যাটারও কোনও অ্যাফেয়ার ছিল নাকি? বা অন্য কোনও কেস না তো? গে না তো?”
জিনিয়া কাঁধ ঝাঁকাল, “জানি না। থাকলে থাকবে। আমার কোনও সমস্যা নেই। আমার আর সৌপ্তিকের স্মৃতির মাঝে এক্সক্ল্যামেট্রি সাইন হয়ে না দাঁড়ালে আমি কিচ্ছু বলব না, ব্যস।”
সুলগ্না বলল, “বুঝেছি। রিলেশন, উইদাউট ইমোশন। তাই তো?”
জিনিয়া ম্লান হাসল, “রাইট।”
পর্ব ২
১
বউভাত।
রাত দেড়টা বাজে।
উদ্দালকের ভাইবোনেরা হইহই করে উদ্দালককে ফুলশয্যার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করল। বাইরে অনেকেই আড়ি পাতছে।