মা বলল, “আমার তোকে জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে। আগেই জেনেশুনে নিয়ে ক্যানসেল করা উচিত ছিল। যাওয়াটাই উচিত হয়নি।”
উদ্দালক বলল, “মেয়েটা কিন্তু আমাকে শুরুতেই বলেছে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল, ছেলেটা মারা গেছে। কোনও তথ্য গোপন করেনি আমার কাছে। তুমি কথা এগোও। আমি এ বাড়িতেই বিয়ে করব। আর কোনও মেয়েও দেখতে যেতে পারব না।”
মা রেগেমেগে ফোন কেটে দিল।
পল্টু কান খাড়া করে সব কথা শুনছিল। গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার স্যার? খুব বাওয়াল?”
উদ্দালক দোকানে তার জন্য আর-এক কাপ চা অর্ডার করে ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ রে পল্টু, খুব বাওয়াল। আজ লুচি খাবি? আর-একবার চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে, কী বলিস?”
পল্টু দাঁত বের করে রাজি হয়ে গেল।
১৭
রবিবার সকাল।
বাজারে যেতেই সুদেববাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল উদ্দালকের। সুদেববাবু তাকে দেখেই এগিয়ে এলেন, “কী হে, কী খবর মাস্টার? কাটিয়ে দিয়েছ তো কলকাতার সম্বন্ধটা?”
উদ্দালক বলল, “ওই আর কি।”
সুদেব বললেন, “তাহলে আজ রাতেই চলে এসো। বাজার তো করেই নিচ্ছি। কী বলো?”
উদ্দালক বলল, “আজ একটু সমস্যা আছে সুদেববাবু। পরে কোনও এক দিন হবে।”
সুদেব বললেন, “কী সমস্যা? আমাকে বলো।”
উদ্দালক শ্বাস ছাড়ল। এরা প্রাইভেট স্পেস বলে কিছু আছে বুঝতে চায় না। সে বলল, “আছে কিছু একটা। আজ হবে না।”
সুদেব বললেন, “ঠিক আছে। জানিয়ো। আজ কিন্তু ভালো পাবদা উঠেছিল।”
উদ্দালক বলল, “আমি পাবদা খাই না।”
সুদেব হাঁ করলেন, “পাবদা খাও না? আড় মাছ?”
উদ্দালক মাথা নাড়ল।
সুদেব বললেন, “তাহলে চিংড়ি? আগের দিন তো বললে চিংড়ি খাও?”
উদ্দালক বলল, “না। আমার অ্যালার্জি ধরা পড়েছে। চিংড়ি খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছি।”
সুদেব তার আগাপাশতলা দেখে বললেন, “অ। ঠিক আছে। তোমরা আজকালকার দিনের ছেলেপিলে। তোমাদের ঠিক বুঝতে উঠতে পারি না বাপু। কখন যে কী বলো কিছুই বুঝি না। ঠিক আছে।”
সুদেববাবু তাকে না ঘাঁটিয়ে চলে গেলেন। উদ্দালক হাঁফ ছাড়ল। একটা জ্যান্ত কাতলা নিয়ে বাজার থেকে বেরোতে যাবে, দেখল বাবা ফোন করছে। ধরল, “বলো।”
বাবা বলল, “কাল তো সব শুনলাম। তোর মা খুব রাগারাগি করছে। সে নাহয় আমি সামলে নেব। কিন্তু তুই আমাকে বল দেখি, তুই শিওর তো?”
উদ্দালক মিষ্টির দোকানে ঢুকে এক প্লেট কচুরি আর দুটো রসগোল্লা অর্ডার করে বলল, “হ্যাঁ, শিওর।”
বাবা বলল, “তোর মা মাঝে মাঝে পাগলের মতো করে ঠিকই, কিন্তু তোকে নিয়ে চিন্তাও করে। এতদিন বিয়ে করিসনি। তার ওপর তুই মফস্সলের ছেলে। কলকাতার মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে পারবি তো?”
উদ্দালক বলল, “এ তো কোনও বিগ বস খেলা হচ্ছে না বাবা। একটা বিয়ে হবে। মেয়েটা আমাকে ওর সমস্যার কথা আগেই বলে দিয়েছিল। আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। তা ছাড়া মেয়েদের এরকম কমোডিটি বানিয়ে মেয়ে দেখার নামে এইসব অসভ্যতা আমার পোষায় না কোনও কালেই। আমি ঠিকই করেছিলাম, যে মেয়েকে প্রথম দেখব তাকেই বিয়ে করব। আর ডিসপুটের কোনও ব্যাপার নেই। মেয়েটা একজনকে ভালোবাসত। ঠিক আছে। তাতে সমস্যা কোথায়?”
বাবা বলল, “তোর জন্য গর্ব হয় আমার। তোকে একটা কথা বলি, থিওরিটিক্যালি তুই ঠিক। একশো ভাগ ঠিক। তবে মেয়েটা যদি তোকে কোনও দিন ভালো না বাসে, সেক্ষেত্রেও তো সমস্যায় পড়বি।”
উদ্দালক বলল, “ভালোবাসতেই হবে এরকম কোনও মাথার দিব্যি আমি দিচ্ছি না বাবা। না হলে না হবে। সব বিয়েই কি উত্তীর্ণ হয়?”
বাবা বলল, “জেনেশুনে বিষ পান করতে চাস? কী কারণে?”
উদ্দালক বলল, “কোনও কারণ নেই। শুধু আগে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিল বলে বিয়ে ক্যানসেল করে দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা আমি অন্তত খুঁজে পাচ্ছি না, এটা বলতে পারি।”
বাবা বলল, “ঠিক আছে। আমি তোর মাকে বোঝাচ্ছি। রাজি করিয়ে নেব ঠিক, কবে বিয়ে করতে চাস বল।”
উদ্দালক বলল, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। করতে যখন হবেই, তখন দেরি করে লাভ নেই।”
বাবা বলল, “বেশ। কথা বলছি আমি। ওদেরও আমাদের বাড়ি আসতে বলছি।”
উদ্দালক ফোন রেখে কচুরি খেয়ে নিল।
ফিরে রান্না বসাল। মাছের ঝোল আর ভাত। রান্না হয়ে গেলে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে সিলিং দেখায় মন দিল। এটা তার প্রিয় কাজ। টিকটিকি দেখতে ভালো লাগে তার। শিকারের সামনে কী করে এত অবিচল, শান্ত থাকে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
বাড়িওয়ালা সদাশিববাবু ভালো মানুষ। বেশি জ্বালাতন করেন না। মাস্টার বলে সম্মানও করেন যথেষ্ট। এ এলাকায় আর কিছু না থাক, শিক্ষকদের সম্মান আছে।
লুঙ্গি পরে সদাশিববাবু তারে কাপড় মেলছিলেন। জানলা দিয়ে তার দিকে চোখ পড়ায় বললেন, “মাস্টারবাবু, আপনি কবে আমার দলে ভিড়বেন? আপনাকে এরকম শুয়ে থাকতে দেখে আমার ভারী হিংসা হয় যা বলুন।”
উদ্দালক হেসে ফেলল, “মনে হচ্ছে আর বেশিদিন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারব না। আমারও সমন এসে পড়েছে।”
সদাশিববাবু দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, “হায় রে, সুখে থাকতে কেন যে ভূতে কিলোয় মানুষকে। অ্যাদ্দিন দিব্যি ছিলেন, চোখের সামনে আপনাকে বলি হতে দেখতে হবে। তা এ বাড়িতেই সংসার করবেন তো, নাকি অন্য বাড়ি দেখতে শুরু করেছেন?”