উদ্দালক বলল, “কোনও ঝামেলা না। বিয়ে করব ঠিক করলেই বিয়ে হয়। অত চিন্তা করতে হবে না। তোমরা হ্যাঁ বলে দাও।”
মা গালে হাত দিল, “সে কী রে, একদিন দেখে এসেই মেয়ের বাড়ির হয়ে কথা বলা শুরু করেছিস! বিয়ের পরে তো পুরো বউয়ের আঁচলে বাঁধা পড়বি বাবু!”
উদ্দালক হাসল, “তা পড়ব। বিয়ে দিচ্ছ যখন, জোর করেই দিচ্ছ যখন, তখন এসব হ্যাজার্ড তো নিতেই হবে মা।”
মা বাবার দিকে তাকাল, “শুনলে তোমার ছেলের কথা? শুনলে?”
বাবা বলল, “ঠিকই তো বলেছে। বউয়ের ন্যাওটা হলে তো লোকে ভালোই থাকে। আমি কি খারাপ আছি?”
মা বলল, “হুহ। তুমি নাকি বউয়ের ন্যাওটা। তাস খেলতে গেলে আমার ডাকটুকু শুনতে পাও না, এসেছেন আমার ন্যাওটা হতে। ফালতু কথা বোলো না তো একদম। তুমি যেখানে যেখানে যোগাযোগ করার করো। খবর নাও এই মেয়েটা কেমন। পরিবার কেমন। তোমার বন্ধু পুলিশে আছে না? খবর নাও। বিয়ের পর ফোর নাইন্টি এইট যেন না খাই বাবু। খুব ঝামেলা।” মা দু হাত তুলে প্রণাম করল।
বাবা বলল, “বাবা! তুমি জেল অবধি ভেবে নিলে? সাধে কি তোমায় ত্রিকালদর্শী ভাবি?”
মা কটমট করে বাবার দিকে তাকাল।
#
স্টেশন পৌঁছে মা একচোট কান্নাকাটি করল। “ভালো থাকিস বাবু, ঠিক করে খাওয়াদাওয়া করিস। একদম নিজের খেয়াল রাখিস না। ঘরদোর পরিষ্কার করে রাখবি তো? বল?”
উদ্দালক মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সব রাখব। তোমরা সাবধানে যাও।”
বাবা আলাদা করে ডেকে নিয়ে তাকে বলল, “এ বাড়িই ফাইনাল তো?”
উদ্দালক ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ।”
বাবা হাঁফ ছেড়ে বলল, “বাঁচালি বাবা! এ বয়সে দৌড়াদৌড়ি কি আর পোষায়? তাও আজকের তাসের আড্ডাটা মনে হয় গেল।”
বাবার গলা শেষটায় বিমর্ষ শোনাল।
উদ্দালক হেসে ফেলল।
১৬
সন্ধে নাগাদ স্টেশনে নেমে উদ্দালক দেখল পল্টু একটা বাইক নিয়ে হাজির হয়েছে। সে অবাক হয়ে বলল, “বাইক কোত্থেকে পেলি তুই?”
পল্টু বলল, “কাকুর বাইক। উঠুন স্যার। ঝড়ের বেগে নিয়ে যাব।”
উদ্দালক বলল, “খেপেছিস? তোর লাইসেন্স আছে?”
পল্টু বলল, “লাইসেন কী স্যার?”
পল্টু অবাক পৃথিবী মোডে চলে যায় মাঝে মাঝেই। এমন একটা মুখ করে প্রশ্নটা করল, দেখে উদ্দালকের হাসি পেয়ে গেল।
সে বলল, “তুই পিছনে বস। আমাকে চালাতে দে।”
পল্টু বলল, “ঠিক আছে স্যার। আপনি চালান।”
উদ্দালক গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। পল্টু বসে বলল, “স্যার কি বিয়ে করতে গেছিলেন?”
উদ্দালক বলল, “একদিনে কে বিয়ে করে রে পল্টু?”
পল্টু বলল, “বিনোদ করেছে স্যার। মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বাড়িতে ফোন করেছে বিয়ে করে ফেলেছে নাকি। হেবি ঝামেলা চলছে এলাকায়।”
উদ্দালক বিষম খেয়ে বলল, “বিনোদের কত বছর বয়স?”
পল্টু বলল, “কত আর, চোদ্দো-পনেরো হবে। মেয়েটার এগারো।”
উদ্দালক বলল, “বাহ। খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিনোদ। বিনোদের বাবা কী বলছে?”
পল্টু বলল, “বিনোদের বাপ বলছে শুয়োর মারার গরম রড ছেলের পিছনে ঢোকাবে। ওর মা কান্নাকাটি করছে। সব মিলিয়ে হেবি ঝামেলা।”
হাসতে হাসতে উদ্দালক আর-একটু হলেই বাইক নিয়ে পড়ছিল। চৌরাস্তার মোড় এলে উদ্দালক বাইক থামিয়ে বলল, “দাঁড়া চা খেয়ে নি। তুই কী খাবি?”
পল্টু বলল, “আমিও চা খাই। মালাই চা খান স্যার। ভালো করে।”
উদ্দালক দুটো মালাই চা নিল।
পল্টু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “স্যার বউদি চলে এলে কি আমাকে আর পড়াবেন না?”
উদ্দালক বলল, “কেন পড়াব না? সব চলবে যেমন চলছিল।”
পল্টু খুশি হয়ে বলল, “তাহলে ঠিক আছে স্যার। নইলে আমি অশিক্ষিত থেকে যাব।”
উদ্দালক পল্টুর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “তুই আজকাল যা অঙ্ক করছিস তাতে এখনও তোকে শিক্ষিত বলা যাবে না পল্টু।”
পল্টু মাথা চুলকে বলল, “শিখে নেব স্যার। চিন্তা করবেন না।”
উদ্দালকের ফোন বাজছিল।
উদ্দালক দেখল বাড়ি থেকে ফোন আসছে। চায়ের ভাঁড়টা এক চুমুকে শেষ করে সে ফোনটা ধরল, “হ্যালো।”
মার গলা ভেসে এল, “পৌঁছে গেছিস বাবু?”
উদ্দালক বলল, “হ্যাঁ মা। এই তো চৌরাস্তায় চা খাচ্ছি।”
মা বলল, “শোন, পরের শনিবার ছুটি নিবি। আসানসোল যেতে হবে। বর্ণালী একটা সম্বন্ধ এনেছে। এ মেয়ে ক্যানসেল।”
উদ্দালক অবাক হয়ে বলল, “কেন? এ মেয়ে ক্যানসেল কেন? কী হয়েছে?”
মা বলল, “আরে সে অনেক কাণ্ড। এখনই জানতে পারলাম। এ মেয়ের আগে প্রেম ছিল। সে ছেলে একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। এরকম বাড়িতে বিয়ে করতে হবে না। একে তো প্রেম ছিল, তার ওপর অপয়া মেয়ে।”
উদ্দালক বলল, “সে জানি তো। জিনিয়া আমায় সে কথা বলেছে তো। তাতে কী হয়েছে? সাইন্সের স্টুডেন্ট হয়ে পয়া অপয়া মানব কেন? তাহলে পড়াশোনা করতে গেলাম কেন মা?”
মা বলল, “আমি জানি না, তুই এই বিয়ে করবি না।”
উদ্দালক কয়েক সেকেন্ড থমকে গিয়ে বলল, “আমিও আর কোনও মেয়ে দেখতে যাব না। বিয়ে করলে এই মেয়েকেই করব, আর নইলে কোনও দিন করব না।”
মা বলল, “মানে? আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনও দাম নেই তোর কাছে?”
উদ্দালক বলল, “অবশ্যই দাম আছে মা। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে কোনও মেয়ের এক্স মারা গেছে বলে তাকে বিয়ে করা যাবে না, এরকম কুযুক্তির জন্য আমি আমার সিদ্ধান্ত পালটাতে পারব না। আমি তোমাকে বলে দিলাম, বিয়ে করলে এই বাড়িতেই করব। তোমরা কথা এগোও।”