“ওহ, এখন যিনি আছেন?”
“সৎমা।”
“ওহ, এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট।”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“এমনি, বেসিক কৌতূহল আর কি!”
“আচ্ছা, আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“বলুন।”
“আপনাদের এখানে কে আসতে বলেছে?”
“সেটার উত্তর আমরা দিতে পারব না সান্যালবাবু। আপনি বরং চেষ্টা করুন আমাদের প্রশ্নগুলোর যথাসম্ভব ঠিক উত্তর দিতে।”
“আমি তো আশা করি সব উত্তরই দিয়েছি।”
“চন্দ্রিমা দেবীর সঙ্গে কথা বলতে চাই আমরা।”
“নিশ্চয়ই। উপরের ঘরে আছে ও। তবে ওর সঙ্গে বেশি কথা না বলাই ভালো। ওর মেন্টাল স্টেট খুব খারাপ।”
চারজন উঠে দাঁড়ালেন। “ওকে মিস্টার সান্যাল। আপনি যখন বারণ করছেন তবে পরেই কথা বলা যাবে। থ্যাংকু ফর কো-অপারেটিং আস। আমরা এখন বেরোচ্ছি। পরে আবার দরকার হলে আসব।”
সত্যেনের দরজা ভেজানো ছিল। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে দরজাটায় নকের শব্দ পাওয়া গেল। চারজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
একজন বললেন, “আপনি বসুন সত্যেনবাবু। আমি দেখছি।”
দরজাটা খোলা হল। দরজার ওপাশে চন্দ্রিমাকে নিয়ে প্রণতি দাঁড়িয়ে আছেন।
সত্যেন ঘরের ভিতর থেকেই রাগি গলায় বললেন, “তোমরা এখানে কেন?”
চন্দ্রিমা দৃঢ় পায়ে ঘরের ভিতর এসে বসল। বলল, “আপনারা কি লোকাল থানা থেকে আসছেন?”
“আজ্ঞে না। আমরা একটু দূর থেকে আসছি।”
সত্যেন প্রণতিকে বললেন, “ওকে নিয়ে যাও না। ও তো অসুস্থ।”
প্রণতি ঘরের মধ্যে ঢুকে গম্ভীর মুখে বসলেন। বললেন, “একটুও অসুস্থ নেই। জ্বর নেই, বমি ভাবটা নেই। মিষ্টি এক্কেবারে সেরে গেছে।”
একজন ইন্সপেক্টর বললেন, “ওঁকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”
চন্দ্রিমা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ওঁর বোনের মেয়ে। আমার হাজব্যান্ডকেই উনি লোক দিয়ে খুন করিয়েছিলেন।”
৩৩
ঠাকুরদালান ভর্তি গ্রামের লোক। সবার সামনে দিয়ে সত্যেন পুলিশের গাড়িতে গিয়ে বসলেন।
পুজোর ঢাক শুধু অনবরত বেজে চলেছে। কিছুক্ষণ পরে অঞ্জলি শুরু হবে।
গাড়িটা বেরিয়ে যেতে সংবিৎ ফিরল রিংকুর। জীবেন একপাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
রিংকু দৌড়ে গিয়ে বলল, “কী হল কাকামণি, বাবাকে নিয়ে কোথায় গেল ওরা?”
জীবেন রিংকুকে বললেন, “কিছু প্রশ্ন করার আছে, সেজন্যই নিয়ে গেল। দেখ, বিকেলের মধ্যেই দিয়ে যাবে হয়তো।”
রিংকু অবুঝের মতো বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু সেটা তো বাড়িতেই করা যেত? সভাপতিকে ফোন করো না, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। বাবাকে পুজোর দিন বাড়ি থেকে নিয়ে চলে গেল! এত বড়ো সাহস ওরা পায় কী করে!?”
জীবেন বাকিদের দিকে তাকালেন। সবাই তাঁদের দেখছে। বললেন, “তোরা অঞ্জলিটা দে। দাদা বলে গেছে যেন কোনও কিছু না আটকায়।”
জীবেন বৈঠকখানার দিকে রওনা হলেন, রিংকু জীবেনের পিছন পিছন এল, “ওরা কি বাবাকে অ্যারেস্ট করেছে?”
জীবেন রিংকুকে সান্ত্বনা দিতে গেলেন, “না না, সেসব কিছু না।”
বৈঠকখানায় কল্যাণ, সোমা চন্দ্রিমাকে নিয়ে বসে আছেন। পিকলুও আছে।
ঘরে ঢুকেই রিংকুর তাদের দেখে মাথায় আগুন জ্বলে উঠল, বলল, “এক বাড়িতে থেকে নিজের থেকে পরের জন্য দরদ বেশি, তাই না? এইজন্য বলে সৎ বোন কখনও আপন হয় না।”
সোমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বসেছিলেন। রিংকুর প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। পিকলু জীবেনকে বলল, “দিদিকে বাইরে নিয়ে যাও। ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
জীবেন সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। চন্দ্রিমা বলল, “রিংকুদি, আপন হয় না বলেই আমার বরটাকে মেরে দিল মামা, বলো?”
জোঁকের মুখে যেন কেউ নুন দিল। রিংকু চন্দ্রিমার দিকে তাকাতে পারল না। একপ্রকার পালিয়ে গেল ঘর থেকে।
পিকলু বলল, “ক্যাপ্টেনের উইকেট পড়ে গেছে বাবা। তুমি তো আবার নাইট ওয়াচম্যান। বলা যায় না, উইকেটে থাকবে, না যখনতখন আউট হয়ে যাবে।”
জীবেন পিকলুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন, “তুই অঞ্জলি দিবি না?”
পিকলু বলল, “দেব, অবশ্যই দেব। রাজদম্ভ দূর হয়েছে। দেবীপক্ষ শুরু হল আজ থেকে। আজ দেব না তো আর কবে দেব?”
জীবেন পিকলুর দিকে রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে বললেন, “মা অবশ্যই আছেন, তিনিই দাদাকে রক্ষা করবেন।”
পিকলু জীবেনের চোখে চোখ রেখে বলল, “যারা ধর্মের নামে মানুষে মানুষে হানাহানি বোঝে, যারা ধর্ম বলতে শুধুই হিংসা বোঝে, তাদের জন্য মা কোনও দিনও ছিলেন না বাবা। থাকবেনও না। অসুর কোনও কালেই দেবতা হতে পারেনি। পারবেও না। তোমরা ভেবে এসেছ ক্ষমতা আছে মানে যা ইচ্ছা তাই করবে, আইনকানুন সব পকেটে রেখে দেবে! সব এত সহজ? এত? তোমরা হয়তো জানো না, পুলিশে শুধু নির্মল চৌধুরীরা নেই। আরও অনেকে আছে। এবারে জানবে।”
জীবেন মাথা নিচু করলেন। ছেলের চোখে চোখ রেখে তাকানোর ক্ষমতা আর নেই তাঁর।
পিকলু বলল, “চিরকাল ভেবে এসেছ সব বড়ো বড়ো লোকেদের সঙ্গে তোমাদেরই আনাগোনা, তাই না? একটা ছোট্ট ইনফো দিয়ে দি। পিসেমশাইয়ের বন্ধুই সুদর্শনবাবু। মাংসটা এতক্ষণ নুন ছাড়া রান্না হচ্ছিল বলো? এবার একটু মশলা পড়ল। ভেবো না বাবা, তুমিও রেহাই পাবে না।”
জীবেন কল্যাণের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। কল্যাণ চুপ করে রইলেন।
প্রতিবারের মতোই।
#
রিংকু ঠাকুরদালানে এসে দেখল গ্রামের মেয়ে বউরা সবাই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
দীপক চুপচাপ এক কোণে বসে আছে। তার সব রাগ পড়ল গিয়ে দীপকের ওপর। থমথমে মুখে দীপককে বলল, “এদিকে এসো।”
দীপক রিংকুর কথা যেন শোনেনি এমন মুখ করে বসে রইল।
রিংকুর ভিতরে ভিতরে এতক্ষণ চেপে থাকা রাগটার বিস্ফোরণ ঘটল, সে চেঁচিয়ে উঠল, “এই তোমাকে ডাকছি না আমি? শুনতে পাচ্ছ না?”
সবাই রিংকুর দিকে তাকাল।
দীপক উঠল। রিংকুর সামনে এসে দাঁড়াল, রিংকু বলল, “কী হল? না চ্যাঁচালে শুনতে পাও না, না?”
দীপক বলল, “আমি বাড়ি যাব আজ। এখন বেরোব। তুমি কী করবে ঠিক করে নাও।”
রিংকু বলল, “বাড়ি যাবে মানেটা কী? এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেল বাড়িতে আর তুমি বাড়ি যাবে?”
দীপক চোয়াল শক্ত করল, “হ্যাঁ। একজন খুনির বাড়িতে থাকার কোনও ইচ্ছা আমার নেই।”
রিংকু দীপকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে ভাবতেই পারেনি দীপক এই কথাটা বলতে পারে।
দীপক বলল, “আর-একটা কথা, ভবিষ্যতে এই বাড়ির সঙ্গে যদি তোমার কোনও সম্পর্ক থাকে, তাহলে এই বাড়ির সঙ্গেই রেখো, আমার কাছে আসার কথা ভেবো না। এখন নটা কুড়ি বাজে, দশটার মধ্যে আমি বেরোব। তুমি ঠিক করে নাও, তুমি কী করবে, থাকবে, না যাবে।”
রিংকু ঠাকুরদালানের মেঝেতে বসে পড়ল। দীপক হনহন করে নিজেদের ঘরে রওনা দিল।
৩৪
সান্যালবাড়ির বাইরে দেবু গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে এতক্ষণ ছিল না। এসে খবরটা শুনে মুষড়ে পড়েছে।
জীবেনের বাড়ির ভিতর ভালো লাগছিল না। বাইরে বেরিয়েছিলেন। দেবুকে দেখে ডাকলেন, “তুই কোথায় ছিলি?”
দেবু বলল, “বাবু তো আমাকে থানায় পাঠিয়েছিলেন।”
জীবেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আর পাঠিয়ে কী হবে? খেলা তো শেষ।”
দেবু বললেন, “কেন শেষ হবে বাবু? কোর্টে কত খেলা বাকি জানেন? আসল খেলাই তো কোর্টে। প্রমাণই করতে পারবে না কেউ।”
বাড়ির ভিতরে নিতান্ত নিয়মরক্ষার মতো অঞ্জলি হচ্ছে। দেবুর কথাটা জীবেন শুনলেও আমল দিলেন না। বললেন, “অনেক লোক আসবে। থাকিস। আমি আজকে হয়তো বেশি তদারকি করতে পারব না।”
দেবু কিছু বলল না। জীবেন বাড়ির ভিতরে এলেন। দীপক ব্যাগ নিয়ে বসে আছে গম্ভীর মুখে। কিছুক্ষণ পরেই ওরা বেরিয়ে যাবে। পিকলুকে ঠাকুরদালানে দেখতে না পেয়ে পিকলুর ঘরে গেলেন। পিকলু মন দিয়ে পুরোনো খবরের কাগজ পড়ছে। তাঁকে দেখে বলল, “আবার কোনও হুমকি দিতে এলে বাবা?”
জীবেন কথা বললেন না, চুপ করে খাটে এসে বসলেন।
পিকলু কাগজে মুখ রেখে নির্লিপ্ত গলায় বলল, “আমাকে কিছু বলে লাভ নেই বোধহয়। পিসেমশাইও যথেষ্ট শক্ত মানুষ। পোষা গুন্ডাগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে বড়োজোর খুন করাতে পারো। কিন্তু তাতে জেঠু আরও বেশি ফাঁসবে মনে রেখো।”
জীবেন বললেন, “আমি কি তোর কাছে একটু বসতেও পারি না?”
পিকলু অবাক হয়ে জীবেনের দিকে তাকাল। বলল, “তোমার শরীর-টরীর ঠিক আছে তো? নাকি জেঠু নেই বলে মস্তিষ্কহীন হয়ে পড়েছ?”
জীবেন রাগ করলেন না। বললেন, “ছোটোবেলা থেকে মা না থাকার যন্ত্রণা সবাই বোঝে না পিকলু। একটা সময় ছিল যখন দাদা নিজের হাতে আমাকে খাইয়েও দিয়েছে। তুই আমাকে এসব বলে রাগাতে পারবি না।”
পিকলু বলল, “তোমাকে রাগানোর কোনও ইচ্ছা আমার কোনও কালেই ছিল না বাবা। তবে মেরুদণ্ডহীন একটা লোককে বাবা বলে ডাকতে খুব কষ্ট হয় আজকাল। ধর্মের নামে যারা একটা তরতাজা যুবককে খুন পর্যন্ত করতে পারে, তারা সব কিছু পারে।”
জীবেন বললেন, “তোকে সব কিছু বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না। তোরা চোখে ঠুলি পরে বসে আছিস।”
পিকলু বলল, “বেশ করেছি ঠুলি পরে বসে আছি। যাদের মেয়ে তার চিন্তা নেই, মামাদের ঘুম নেই! সত্যেন সান্যালের মেয়ে মিষ্টি? তার বাপের কী ছিল? যে মেয়ের বাপ মা মেনে নিয়েছে জামাইকে, তোমাদের কী সমস্যা ছিল, বলতে পারবে?!”
জীবেন পিকলুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন, “প্ল্যানটা মেরে ফেলার ছিল না প্রথমে।”
পিকলু অবাক হয়ে বলল, “তবে?”
জীবেন বললেন, “প্রথমে ঠিক ছিল মিষ্টি এখানে এলে ওকে বোঝানো হবে। মিঠুনের সেদিনই কলকাতা ফিরে যাবার কথা ছিল। মিষ্টিকে এখানেই আটকে রেখে ওকে আর কলকাতা যেতে না দেওয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু দাদা ওকে আর মিঠুনকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিল। তারপরে আর মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।”
পিকলু একটু গুছিয়ে বসে বলল, “ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে থাকলে সমস্যাগুলো ঠিক কোথায় বাবা? ধরো, আমি আর তনয়া এই ঘরে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আছি, তুমি ভুল করে দরজা খুলে দেখে ফেলেছ। তুমি কি আমাদের খুন করতে বলে দেবে? নাকি ছেলেটা মিঠুন ছিল বলেই তোমাদের যত সমস্যা?”
জীবেন বললেন, “আমার তোকে বোঝানোর ক্ষমতা নেই। তুই কাগজ পড়। আমি চুপচাপ বসে থাকি। বাড়ির যেখানে যাচ্ছি, লোকের প্রশ্নবাণ আমি আর নিতে পারছি না। আমাকে একটু বসে থাকতে দে দয়া করে।”
পিকলু কাঁধ ঝাঁকিয়ে কাগজে মন দিল। জীবেন চুপচাপ বসে থাকলেন।
দীপক এসে জীবেনকে দেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল, পিকলু বলল, “এসো এসো, বাবা এখন স্লিপ মোডে আছে, তোমার চিন্তা নেই।”
দীপক ঘরের ভিতর ঢুকে বলল, “আমরা বেরোব একটু পরে।”পিকলু অবাক হয়ে বলল, “সে কী! বাড়িতে পুজো হচ্ছে আর তুমি বাড়ির লক্ষ্মীকে নিয়ে চলে যাবে? ইয়ার্কি নাকি?”
দীপক জীবেনের দিকে একবার তাকিয়ে পিকলুর দিকে তাকাল, “রিংকু থাকলে এখানে সমস্যা বাড়বে পিকলু। ও বারবার মিষ্টিকে আঘাত করতে পারে, যেটা এই সময় অভিপ্রেত নয়।”
পিকলু দীপকের কথায় আমল না দিয়ে বলল, “গতবার আমি পাঁপড় খাইয়েছিলাম, এবার তোমার পালা ছিল। পালিয়ে গেলে হবে ভাই?”
জীবেন উঠছিলেন। পিকলু বলল, “বসো বাবা। অনেক কথা আছে। পুজোটা তো আমাদেরই সামলাতে হবে। মা এসেছেন বাড়িতে, তাঁর যেন কোনওরকম অনাদর না হয়। দ্য শো মাস্ট গো অন।”
জীবেন পিকলুর কথা শুনে ছেলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।
৩৫
দশটা নাগাদ গাড়িটা যশোর রোডে উঠল। একজন সত্যেনকে বললেন, “কিছু খাবেন?”
সত্যেন গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন, বললেন, “না, আমার খিদে নেই। আপনাদের নামগুলো আমাকে দেবেন। আমি ওপরমহলে কথা বলব।”
জিপের পিছনের সিটে সত্যেনের দুপাশে যে দুজন বসে ছিলেন তাঁরা হাসলেন, সত্যেনের ডানদিকের জন বললেন, “কী ব্যাপারে কথা বলবেন? আমাদের প্রোমোশনের ব্যাপারে নিশ্চয়ই?”
সত্যেন চুপ করে গেলেন। ড্রাইভারের পাশে যিনি বসেছিলেন তিনি বললেন, “আমার নাম সুদর্শন রায়, আপনার ডানদিকে যিনি বসে আছেন তিনি রাতুল মিত্র, বাঁদিকে মাসুদ হক, ড্রাইভারের নাম আর বললাম না। ওর প্রোমোশন না হলেও চলবে বোধহয়।”
সত্যেন বললেন, “আপনারা জানেন না, আপনারা কত বড়ো ভুল করছেন। কিছুক্ষণ পরে আমাদের বাড়িতে জেলা সভাপতি আসবেন।”
সুদর্শনবাবু ড্রাইভারকে বললেন, “গাড়িটা দাঁড় করাও।”
গাড়িটা রাস্তার পাশে সাইড করল ড্রাইভার। সুদর্শন বললেন, “বলুন সত্যেনবাবু, অনেকক্ষণ ধরে আপনি বলে যাচ্ছেন আমরা ভুল করেছি। বলুন, কী কী ভুল করেছি।”
সত্যেন রাগি গলায় বললেন, “যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন, নিয়ে চলুন। ফালতু কথাবার্তা আমার একেবারে ভালো লাগছে না।”
সুদর্শন বললেন, “আপনার জন্য দুটো খবর আছে সত্যেনবাবু।”
সত্যেন বললেন, “কে খবর দিল? কোনও ফোন এল না তো?”
সুদর্শন হাসলেন, “খবরটা একটু দূরে এসেই বলব ভেবেছিলাম।”
সত্যেন বললেন, “বলুন। যা বলার বলুন।”
সুদর্শন বললেন, “এক নম্বর খবর, মিঠুনকে লোক দিয়ে খুন করিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আপনি জানতেন না, যাকে আপনি খুন করাচ্ছেন, তার বীজ চন্দ্রিমার শরীরে বপন করা হয়ে গেছে। ইয়েস স্যার, শি ইজ প্রেগন্যান্ট। তাই আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেও মিঠুনকে শেষ পর্যন্ত মারতে পারলেন না। কপাল কত ভালো বলুন তো মেয়েটির, আপনাকে সুখবরটা আগে দেয়নি। দিলে হয়তো মেয়েটিকেও আর আপনি ইহজগতে বাঁচিয়ে রাখতেন না।”
সত্যেন কড়া চোখে সুদর্শনের দিকে তাকালেন, “আর দু নম্বর খবর?”
সুদর্শন বললেন, “আমরা আপনাকে কলকাতা অবধি নিয়ে যাচ্ছি না।”
সত্যেন বললেন, “মানে?”
সুদর্শন বললেন, “পোয়েটিক জাস্টিস মানে কাকে বলে জানেন?”
সত্যেন কড়া গলায় বললেন, “যা বলার পরিষ্কার করে বলুন।”
সুদর্শন বললেন, “সত্যেন সান্যাল। ইনফ্লুয়েনশিয়াল পলিটিশিয়ান। মাকে হারিয়েছেন দাঙ্গায়। দাঙ্গার দগদগে ঘা মেটার নয়। এই অবস্থায় মানুষ দুরকম ভাবে রিঅ্যাক্ট করে। এক, মানুষ দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে, এবং এর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে সারাজীবন ধরে। দুই, মানুষটা সামান্য কিছু এদিক ওদিক দেখলেই নিজের রেফারেন্স টেনে আনে এবং তার মাথায় আর অন্য কোনও কিছুই চলে না। সে এতটাই ভায়োলেন্ট হয়ে যায় যে চরমতম অপরাধ করতেও সে দ্বিধাবোধ করে না।”
সত্যেন বললেন, “কী বলতে চাইছেন আপনি?”
সুদর্শন বললেন, “ফ্যাক্ট নম্বর ওয়ান, মিষ্টি যেমন আপনার ভাগনি, তেমনি আমারও ভাইঝি। হ্যাঁ, রক্তের সম্পর্ক নেই হয়তো। কিন্তু সেটা ম্যাটার করে না। একজোড়া মানুষ ভালোবেসেছিল সেটাই ম্যাটার করেছিল সেদিন। ওদের বিয়েটা আমিই দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছিলাম মিস্টার সান্যাল। ফ্যাক্ট নাম্বার টু, মর্গে মিঠুনের পাশের ট্রে-টা খালি আছে।”
সত্যেন অবাক হয়ে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
সুদর্শন বললেন, “কী আশ্চর্য বলুন, হিন্দু মুসলিম শিখ বৌদ্ধ খ্রিস্টান, মর্গে পাশাপাশি শুয়ে থাকে। মৃতরা দাঙ্গাও করতে পারে না।”
সত্যেন দরদর করে ঘামছিলেন।
সুদর্শন বললেন, “ঘুমের ওষুধ দেব সত্যেনবাবু? এফেক্টিভ। চিন্তা করবেন না, আপনার মৃত্যু হবার আগে অবধি আমরা আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব না। কিংবা আপনার কোনও অল্টারনেটিভ ওয়ে জানা আছে?”
সত্যেন একটু গলা খাঁকরিয়ে বললেন, “আমার মার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারলে ভালো হত।”
সুদর্শন বললেন, “সৎমা তো। ভদ্রমহিলাকে ঘরের এক কোণে ফেলে রেখে দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছি আপনি খেতেও দেন না ভালো করে। আর আমাদের দয়া করে এসব সেন্টিমেন্ট দেবেন না। বুঝতেই পারছেন, আমাদের হৃদযন্ত্রে রস কষ তেমন নেই।”
সত্যেন বললেন, “পুজোর দিনে… আপনারা এটা করতে পারবেন?”
সুদর্শন হাসলেন, “পরশু ষষ্ঠী ছিল সত্যেনবাবু। আপনি করতে পেরেছিলেন যখন, আমরাও নাহয় কষ্টেসৃষ্টে করে নেব!”
সত্যেন মাথা নিচু করে জিপের মধ্যে বসে রইলেন।
সুদর্শন একটা সিগারেট ধরালেন।
দূর থেকে কোথাও একটা ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে।
সুদর্শন মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলেন।
পুজোর সময় ঢাকের আওয়াজ শুনলে মনে হয় স্বর্গ পৃথিবীতেই নেমে এসেছে…