সত্যেন বললেন, “কারা?”
জীবেন দীপকের দিকে তাকালেন।
সত্যেন বললেন, “কী হয়েছে? ও তো আমার জামাই। অত চিন্তা করিস না।”
দীপকের অস্বস্তি হচ্ছিল। উঠে চলে যাবার তুমুল ইচ্ছা সত্ত্বেও সে উঠতে পারছিল না।
সদর দরজা দিয়ে দেবু ঢুকল। জীবেন সত্যেনের দিকে তাকালেন। সত্যেন বললেন, “হয়েছে?”
দেবু মাথা নাড়ল। সত্যেন বললেন, “যা, হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে।”
দেবু একবার দীপককের দিকে তাকাল। সত্যেন বললেন, “বল কী বলবি। অসুবিধা নেই।”
দেবু বলল, “বড়োবাবুকে ফোন করে দিয়েছি।”
সত্যেন বললেন, “কোনও সমস্যা হয়নি তো?”
দেবু হেসে বলল, “বুঝতেই পারেনি আগে থেকে।”
সত্যেন বললেন, “ঠিক আছে।”
দেবু বেরিয়ে গেল।
সত্যেন ফোন বের করলেন। দীপক উঠল। সত্যেন বললেন, “কোথায় যাচ্ছ?”
দীপক বলল, “ঘরে।”
সত্যেন বললেন, “আচ্ছা যাও। পরে কথা বলছি তোমার সঙ্গে।”
দীপক তড়িঘড়ি ঘরে এসে দেখল পিকলু আর রিংকু গম্ভীর মুখে বসে আছে। সে বলল, “আমি কি ঘুরে আসব?”
রিংকু বলল, “কেন ঘুরে আসবে? বসো।”
দীপক ইতস্তত করে বসল। রিংকু বলল, “এই ভদ্রলোকের কাণ্ড শুনেছ?”
দীপক বলল, “না তো।”
পিকলু বলল, “আহ দিদি, কী হচ্ছে?”
রিংকু বলল, “তুই থাম। ওই মেয়েটার সঙ্গে অ্যাফেয়ার করার সময় খেয়াল ছিল না? বাবা জানলে কী হতে পারে ভাবতে পারছিস?”
পিকলু হেসে বলল, “জেঠু জানলে তো খুশিই হবে। সারাক্ষণ পুরুষমানুষ পুরুষমানুষ বলে জ্ঞান দেয়। এসব কাজ তো পুরুষমানুষই করে।”
রিংকু একটা বালিশ ছুড়ে মারল পিকলুর দিকে। বলল, “খুব মার খাবি কিন্তু তুই। খুব পেকেছিস না? দেখ ভাই, বাচ্চার বাবা হয়েছিস, এখন সেদিকে মন দে। সব তনয়া করবে? সংসারটা তো ভাঙতেই পারিস, তারপর কী করবি?”
পিকলু দীপকের দিকে তাকাল, “ধর্মবাণী শুনে এলে নিচ থেকে? কেমন লাগছে? কান মাথা সব ভোঁ ভোঁ করছে না?”
রিংকু বলল, “এসব কী হচ্ছে পিকলু? আমার তো বাবা হয়। আমার সামনে নাহয় এসব কথা নাই বা বললি।”
পিকলু বলল, “আমার বাবাকে নিয়ে বলি? দ্যাট গ্রেট চাকর ভাই অফ মিস্টার সত্যেন সান্যাল?”
রিংকু কঠিন চোখে পিকলুর দিকে তাকিয়ে রইল।
পিকলু শিস দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
২০
রম্পা দুপুর রোদে হেঁটে মেলা পৌঁছেছে। নবারুণ সংঘের মাঠে মেলা হয়। তাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মেলার মাঠ। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। হাতে পাঁচশো টাকার নোটটা।
একের পর এক দোকানে মেলার মাঠ জমজমাট। কেউ “হরেক মাল দশ টাকা”য় দিচ্ছে, কেউ কাশ্মীরের সোয়েটার বিক্রি করছে, কেউ আচার বিক্রি করছে, কেউ বা রংবেরঙের গেঞ্জি। রম্পা অনেক ভেবে, অনেক দর করে একশো টাকা দিয়ে একটা পাপোশ কিনল।
একগাদা চুড়ি কিনতে গিয়েও কিনল না। এক দোকান থেকে একশো টাকা দিয়ে দুটো চায়ের কাপ কিনল। শম্ভুর সঙ্গে বসে নতুন কাপে চা খাওয়া যাবে।
মেলার এক কোণে সোয়েটারের দোকান। রম্পা অনেকক্ষণ সোয়েটার দেখল। একটা লাল রঙের সোয়েটার পছন্দ হল শম্ভুর জন্য। বাজেটের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে মনখারাপ হল। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে দরাদরি করে একটা মাফলার কিনল।
একটা পাপোশ, দুটো চায়ের কাপ আর একটা মাফলার নিয়ে রম্পা নাগরদোলার সামনে এল। কোনওবারই সে চড়তে চায় না। শম্ভু জোর করে তাকে নিয়ে উঠবে। রম্পা চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।
রম্পা বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। কী মনে হতে টিকেট কেটে নাগরদোলায় উঠল। অন্য সময় সে চোখ বন্ধ করে থাকে। আজ আর চোখ বন্ধ করল না। বিকেল রোদ এসে পড়ছে নাগরদোলায়। রম্পা উপরে উঠতে উঠতে দেখতে পাচ্ছে চারদিকটা কেমন পায়ের নিচে নেমে যাচ্ছে। ঘূর্ণিতে একটুও তার বমি পাচ্ছে না আর।
নাগরদোলা থেকে নেমে অনেকখানি উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি করে যখন ক্লান্ত হল সে, আচারের দোকান থেকে তেঁতুলের আচার কিনল। মেলার ঘাসের ওপর বসে পড়ে সেই তেঁতুলের আচার খেল। মেলায় মানুষের পর মানুষ আসতে শুরু করেছে। আশেপাশের গ্রামের মানুষ সারাবছর ধরে অপেক্ষা করে থাকে এই মেলার জন্য। টাকা জমায়, ঠিক করে রাখে কী কী কিনবে মেলা এলে। বিছানার চাদর থেকে শুরু করে বাড়ি সাজানোর খুঁটিনাটি, সব কিনতে হবে এখান থেকে। অ্যানাউন্সমেন্ট শুরু হয়ে গেছে, সঙ্গে মেলার বিভিন্ন স্টল থেকে বিচিত্র সব শব্দ, কোথাও বাচ্চা হারিয়ে যাচ্ছে, কাউকে বা মেলা কমিটির অফিসে এসে দেখা করতে বলছে, কোথাও মাকড়সা মানুষ দেখা দিয়েছে, কোথাও আফ্রিকার দুর্লভ পাখি, কোথাও বা হজমি গুলিতেই মানুষের সব রোগ সেরে যাচ্ছে। কান ঝালাপালা করা এক ধরনের বাঁশি বাচ্চারা এন্তারসে বাজিয়ে চলেছে, কোথাও চিনেবাদাম বিক্রি হচ্ছে দেদার, খাওয়ার জায়গা থেকে ভেসে আসছে এগরোল, মোগলাইয়ের গন্ধ, সব মিলিয়ে এক অপূর্ব মায়াবী অভিজ্ঞতা।
রম্পা চোখ বন্ধ করে মেলার শব্দ, গন্ধ অনুভব করল অনেকক্ষণ ধরে। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের দুচোখ ভরে দেখল। কল্পনা করার চেষ্টা করল, শম্ভুর হাত ধরে মেলায় এসেছে, তার বাচ্চা একের পর এক জিনিসের বায়না ধরছে, শম্ভু সব কিনে দিচ্ছে, আর সে ছদ্মরাগে শম্ভুকে বকে চলেছে কেন এতগুলো টাকা ফালতু খরচ করছে।
সন্ধে নামতে একগাদা পাঁপড় কিনে রম্পা মেলা থেকে বেরোল।
এক হাতে পাপোশ, চায়ের কাপ আর মাফলারের ব্যাগ, অন্য হাতে পাঁপড়ের ঠোঙা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত রম্পা যখন থানায় পৌঁছল তখন সন্ধে নেমেছে। থানার সামনে একটা ভ্যানে শম্ভুর লাশটা পরম অবহেলায় ফেলে রাখা। মুখের ওপর ভন ভন করে মাছি ঘুরছে। রম্পা প্রথমে থানার ভিতরে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী খেয়াল হতে লাশটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
মুখের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে কেমন একটা কালচে দাগ পড়ে গেছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। রম্পা হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাশটা দেখল। কিছুক্ষণ বাদে বসে পড়ল। সব প্যাকেট ধুলোয় ফেলে।
২১
দীপক ছাদে এসে দেখল পিকলু একা একা দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। তাকে দেখে বলল, “মেলায় কাল যাব। আজ আর ভাল্লাগছে না।”
দীপক বলল, “আমারও ভালো লাগছে না।”
পিকলু হেসে বলল, “নাকি দিদি বারণ করেছে বলে যাবে না?”
দীপকও হেসে ফেলল। বলল, “না না, সত্যিই ভালো লাগছে না।”
পিকলু বলল, “তোমার একটা এক্সট্রাম্যারিট্যাল অ্যাফেয়ার করা উচিত। বুঝলে?”
দীপক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “মানে?”
পিকলু বলল, “তোমার মনে জং ধরে গেছে। আরাত্রিকা সান্যাল তোমার বস হয়ে গেছে। তিনি উঠতে বললে তুমি উঠছ, বসতে বললে বসছ। দ্যাটস নট লাইফ।”
দীপক অবাক হয়ে বলল, “তুমি চাইছ তোমার দিদির সংসারটা…”
পিকলু বিরক্ত হয়ে বলল, “ধ্যাত। তুমি তো দেখছি বাংলা সিরিয়ালের বউগুলোর থেকেও বেশি সতী। দিদিকে জানিয়ে করতে কে বলেছে?”
দীপক আর-একটু সংকুচিত হয়ে বলল, “ঠিকই জেনে যাবে। তুমিও তো লুকোতে পারোনি বউয়ের কাছে।”
পিকলু সিগারেটে একটা লম্বা টান মেরে বলল, “আমি চাইলে ঠিকই লুকোতে পারতাম। আমি চেয়েছি ও জানুক। ম্যাড়ম্যাড়ে স্থির জলের মতো সংসারে একটা বড়ো ঢিল পড়ুক। এটা একটা লাইফ? সর্বক্ষণ একজন বিগ বসের মতো এই বাড়ি থেকে বাণী দিয়ে যাচ্ছেন, এই করবে না, ওই করবে না, এই মাংস খাবে না, ওই মাংস খাবে না, আর একদিকে সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড় লাইফ!”
দীপক অবাক হয়ে বলল, “তুমিই ইচ্ছা করে জানিয়েছ?”
পিকলু বলল, “সরাসরি জানাইনি। এমনভাবে জানিয়েছি যাতে ও জানতে পারে আমি ওকে চিট করছি। রেজাল্ট ইজ অলসো স্যাটিসফ্যাক্টরি। আমার সঙ্গে ওর এখন কথা বন্ধ। আশা করি বুঝতে পারছ, বউ কথা বন্ধ করবে, এর থেকে সুখের জিনিস আর হয় না।”
দীপক খানিকটা ভেবলে গিয়ে বলল, “যদি রাগের মাথায় উলটোপালটা কিছু করে বসত?”
পিকলু বলল, “সেই রিস্ক ফ্যাক্টরটা ছিল। তবে স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে শুলে সব বউ গায়ে আগুন দেয় না। তনয়া তো একেবারেই সেই টাইপের নয়।”
দীপক বলল, “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার একটা ছেলে হয়েছে। এখন এইসব না করলেই হত না?”
পিকলু বলল, “সেটা তো ভালো হয়েছে। ডিভোর্সের কথা ভাবতে চাইবে না কেউই।”
দীপক বলল, “ব্যাপারটা খুব জটিল।”
পিকলু বলল, “জটিল তো বটেই। এত গতে বাঁধা জীবনের থেকে জটিল জিনিসই আমার ভালো। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি বাপটা দাদার মোসাহেবি করে আসছে। স্পাইনলেস ক্রিচারের ছেলে হয়ে এভাবে জীবনটা কাটিয়ে দেবার থেকে মরে যাওয়া ভালো। বিয়েটা পর্যন্ত তিনি ঠিক করে দেবেন।”দীপক বলল, “তনয়া কিন্তু যথেষ্ট ভালো মেয়ে পিকলু।”পিকলুর সিগারেট শেষ হয়ে গেছিল। সে আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “খারাপ কে? কেউ খারাপ না। সবাই ভালো। নিজের মাথা কাজে না লাগিয়ে দাদার কথা শুনে চলা, কিংবা… তোমার নিজের কথাই ধরো। এটা ভালো ? বউ উঠতে বললে উঠছ, বসতে বললে বসছ, এটা ভালো? তোমার কী মনে হয়?”দীপক বলল, “আমার কেমন অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে।”
পিকলু একগাদা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “যে মেয়েটা জীবিকার প্রয়োজনে সকাল বিকেল নতুন নতুন লোকের সঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়ে, সেও তো অভ্যাসেই শোয়, তাই না? তার সঙ্গে তোমার তফাত কী?”
দীপক চুপ করে রইল।
পিকলু বলল, “একটা লোক, সে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে, তাকে তার মুখের ওপর বলার কেউ নেই। আই হ্যাভ এনাফ ডাউটস দীপক, মিঠুনের ডেথ ইজ নট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট। যেভাবে বারবার আমাদের বলা হচ্ছে এই ব্যাপারে কোনও কালচার না করতে, আমার যথেষ্ট ডাউট হচ্ছে।”
দীপক একটু ভয়ে ভয়ে চারদিক দেখে বলল, “সেটা হয়তো তুমি মিষ্টির সঙ্গে কথা বললেই জানতে পারতে। এত গেস করতে হত না।”
পিকলু অবাক হয়ে বলল, “তুমি কথা বলেছ?”
দীপক বলল, “না।”
পিকলু বলল, “তুমি কী করে জানলে?”
দীপক চুপ করে রইল।
পিকলু সিগারেটটা ফেলে দিয়ে অস্ফুটে বলল, “শিট।”
২২
সত্যেন ঘরে বসে হিসেব করছিলেন। রিংকু বলল, “আসব বাবা?”
সত্যেন বললেন, “আয় মা। কিছু বলবি?”
রিংকু সত্যেনের খাটে এসে বসল। বলল, “তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।”
সত্যেন বললেন, “দীপকের সঙ্গে আমার কথা হল।”
রিংকু বলল, “কী ব্যাপারে বলো তো?”
সত্যেন বললেন, “ওই ছ মাস যখন ও থাকবে না, তুই তখন এখানে থাকবি।”
রিংকু খুশি হল, “তা ভালো করেছ। ওদের বাড়িতে আবার অনেক ঝামেলা।”
সত্যেন বললেন, “কী ঝামেলা?”
রিংকু বলল, “ওই আর কি!”
সত্যেন বললেন, “না না, বল, কী ঝামেলা?”
রিংকু বলল, “আরে তুমি বেশি ভেবে ফেলছ। আমি ঝামেলা বলতে এমনি বলছি। বোঝোই তো, শ্বশুরবাড়ি থাকতে কি ভালো লাগে? তাও একা একা। ওর মা একরকম, বাবা একরকম, সব সামলেসুমলে থাকা। দীপক থাকলে তাও খানিকটা সামাল দেওয়া যায়। তার ওপর ওরা খানিকটা আনকুথ। ধরো ভালো করে হয়তো আমি সোফাটা গুছিয়ে রাখলাম, বলা নেই কওয়া নেই এমনভাবে বসল যে সব এদিক সেদিক হয়ে গেল। বললে অবাক হয়ে বলবে সোফা তো সাজিয়ে রাখার জন্য না। বসার জন্যই। আমি দেখেছি দীপক না থাকলে ওর মা বিশেষ করে ইচ্ছা করে এগুলো করেন।”
সত্যেন বললেন, “তাতে কী? শ্বশুরবাড়ি মানেই তো মেয়েদের সবসময় মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে। যত সমস্যাই হোক নিজেকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হবে।”
রিংকু বলল, “তুমি এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছ বাবা, দিনকাল অনেক বদলেছে। শ্বশুরবাড়ি মানেই মেয়েদের লাথি ঝ্যাঁটা খাবার দিন আর নেই এখন। অনেক আইনকানুন তৈরি হয়েছে মেয়েদের জন্য।”
সত্যেন বললেন, “ওগুলোই তো সমস্যা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন আইন ঢুকে পড়ে তখনই তো অসৎ উপায়ে লোক সেটার ব্যবহার করার কথা চিন্তা করে।”
রিংকু বলল, “সেটার পার্সেন্টেজটা আছে ঠিকই, তবে মেয়েদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতেও এই আইন দরকার ছিল।”
সত্যেন খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কোনও অত্যাচার নয়। মেয়েদের এভাবেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়। কষ্ট তো হবেই, সংসার করবে, কষ্ট হবে না? তা বলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে? ছি ছি, এ কেমন কথা?”
রিংকু বুঝল বাবা উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সে কথা ঘোরানোর জন্য বলল, “মিষ্টির কী হবে বাবা?”
সত্যেন বললেন, “কী হবে?”
রিংকু বলল, “না মানে, একটা গোছানো সংসার ছিল। হঠাৎ করে এত কিছু…”
সত্যেন বললেন, “ওসব নিয়ে এত ভাবছিস কেন? ওর আমি খুব ভালো একটা বিয়ে দেব। ওদের পালটি ঘরেই।”
রিংকু বলল, “ও যদি না করতে চায়?”
সত্যেন বললেন, “ওর ইচ্ছায় হবে নাকি? অত সোজা? দেখল তো নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করলে কী হয়?”
রিংকু চুপ করে গেল।
সত্যেন বললেন, “যারা নিজেদের ইচ্ছায় বিয়ে করে, সব নিয়মকানুন ভেঙে, তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। আর যেখানে যা ইচ্ছা হোক, আমার পরিবারে হবে, সেটা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে, আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না।”
রিংকু বলল, “তুমি কি এবারে ওদের নেমন্তন্ন করেছিলে, না ওরা নিজেরাই এসেছিল?”
সত্যেন বললেন, “আমি নেমন্তন্ন করেছিলাম।”
রিংকু একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলল, “ব্যাপারটা নিয়ে জলঘোলা হবে না তো বাবা?”
সত্যেন বললেন, “কিচ্ছু হবে না। অত চিন্তা করিস না। তোর বাবা এখনও মরে যায়নি।”
রিংকু বলল, “এদিকে তো আর-এক সমস্যা তৈরি হয়েছে।”
সত্যেন বললেন, “পিকলুকে নিয়ে? ওকে দেখেই আমার কেমন কেমন মনে হচ্ছে।”
রিংকু বলল, “হ্যাঁ। একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।”
সত্যেন বললেন, “তা পুরুষমানুষের ওরকম এক আধটা সম্পর্ক থাকেই। সেসব নিয়ে অত চিন্তা করার কিছু নেই। ছেলে বড়ো হবে, দায়িত্ব আসবে, ধীরে ধীরে পিকলু বুঝবে সম্পর্কের মানে। ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না।”
রিংকু বলল, “কিন্তু বাবা, তনয়াও তো…”
সত্যেন বললেন, “তনয়া? মানে?”
রিংকু বলল, “না না, কিছু না।”
সত্যেন কড়া গলায় বললেন, “আমি শুনতে পেয়েছি রিংকু, কী বলতে যাচ্ছিলি বলে ফেল।”
রিংকু ইতস্তত করে বলল, “তনয়াও জেদের বশে একটা ছেলের সঙ্গে…”
সত্যেন বললেন, “তুই কথা বলেছিস?”
রিংকু বলল, “হ্যাঁ, আমাকে তনয়াই বলল।”
সত্যেন বললেন, “আমি কথা বলব ওর সঙ্গে।”
রিংকু ব্যস্ত হয়ে বলল, “না না, তুমি কেন বলবে, তাহলে ও ভাববে এইসব নিয়ে আমি তোমাকে লাগিয়েছি।”
সত্যেন গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।
২৩
কল্যাণ ঘরে ঢুকে দেখলেন সোমা জেগে বসে আছেন। তিনি ঘড়ি দেখলেন। সাড়ে এগারোটা বাজে। বললেন, “ঘুমের ওষুধটা খাওনি?”
সোমা বললেন, “মিষ্টি ঘুমিয়েছে?”
কল্যাণ বসলেন, “হ্যাঁ। ঘুমিয়েছে। খেয়েছেও খানিকটা।”
সোমা বললেন, “আমরা কাল চলে যাই। এখানে থেকে কী হবে?”
কল্যাণ বললেন, “তোমার দাদার সঙ্গে কথা হয়েছে?”
সোমা মাথা নেড়ে না বললেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, “মিঠুনের বাড়ি থেকেও কেউ এল না। ছেলেটার কি কোনও মূল্য থাকল না কারও কাছে?”
কল্যাণ বললেন, “তোমার মনে আছে এই বাড়িতে যখন প্রথম পুজোয় এসেছিলাম আমাকে অন্য থালায় খাবার দিয়েছিল? গ্লাস থেকে শুরু করে সব কিছুই আলাদা। আমি অবাক হইনি খুব একটা। এক্সপেক্টেড ছিল। তবে এটাও আশা করেছিলাম যত দিন যাবে, সব কিছু ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। দেখা যাচ্ছে, ব্যাপারটা তা নয়। যত দিন যাচ্ছে, সমস্ত গোঁড়ামি আরও নতুন করে ফিরে আসছে। এর শিকড় বিস্তৃত হয়ে পড়ছে কোনায় কোনায়, জানি না কে দায়ী এর জন্য? আধুনিকতা কি বড্ড বেশি একপেশে হয়ে গেল? নাকি আসলে আমাদের ভেতরেই ওই প্রচণ্ড গোঁড়ামিটা কোথাও একটা বাসা বেঁধে ছিল, আমরা কেউ বুঝতে পারিনি? নইলে ছেলে নিজের ইচ্ছায় একটা বিয়ে করেছে বলে বাবা মা তার মৃতদেহ পর্যন্ত নিতে চাইছে না? এ কেমন গোঁড়ামি?”
সোমা বললেন, “ছেলেটা তো কিছুই মানত না। তবু…”
দরজায় কেউ নক করল। কল্যাণ বললেন, “খোলা আছে।”
পিকলু দরজা দিয়ে গলা বাড়াল, “ঘুমিয়ে পড়েছ?”
সোমা উঠে বসে ক্লান্ত গলায় বললেন, “আয় বাবা।”
পিকলু ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজাল। সোমার পাশে এসে বসে বলল, “সারাদিন পরে এখন একটু আসার সাহস পেলাম পিসি। তোমাদের সামনে এসে দাঁড়ানোর সৎ সাহসটুকু হারিয়ে গেছে আসলে। মিষ্টির কাছে এখনও যেতে পারিনি।”
সোমা পিকলুর হাতটা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেললেন। পিকলু চুপ করে বসে রইল।
কল্যাণ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “এই তো বেশ সামলে উঠেছিলে, আবার কী হল?”
পিকলু বলল, “পোস্টমর্টেম হয়েছে? বডি কোথায় আছে জানো?”
কল্যাণ বললেন, “সম্ভবত মর্গে।”
পিকলু বলল, “আমরা কিচ্ছু করতে পারি না, তাই না?”
কল্যাণ বললেন, “কী করতে পারি?”
পিকলু বলল, “আমার তো মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে বাড়িটা আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দি।”
সোমা বললেন, “এসব বলিস না বাবা, এভাবে ভাবতে নেই।”
পিকলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটাই। এভাবে একজনই ভাবতে পারে। আমরা ভাবলেই বরং সেটা অস্বাভাবিক ভাবনার আওতায় পড়ে। সত্যি, কী হাস্যকর, তাই না?”
দরজাটা কেউ ধাক্কা মারল। কল্যাণ গলা তুললেন, “কে?”
কেউ সাড়া দিল না দেখে কল্যাণ বেরিয়ে দেখলেন কেউ নেই।
পিকলু বলল, “ওহ, নজরদারি চলছে। রেস্ট্রিকটেড ঘরে ঢুকে পড়েছি কিনা।”
সোমা বললেন, “বাবা, শোন, আজ তনয়া খানিকটা না বুঝেই আমাদের আটকে দিয়েছে। কালকে আমাদের আর আটকাস না। আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে যাই। এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি আর সহ্য করতে পারছি না, দ্যাখ তুইও আর এই ঘরে আসিস না। কী দরকার আমাদের জন্য ঝামেলায় পড়ার?”
পিকলু বলল, “আমাদের বাড়ি পিসি। এটা তোমারও বাড়ি। আমাদের প্রত্যেকটা ঘরে যাবার অধিকার আছে। কেন বলো তো ভয় পেয়ে পেয়ে কাটাতে হবে?”
কল্যাণ বললেন, “বাস্তব আর নিজের ক্ষমতাকে আমরা কতদূর অবধি অস্বীকার করতে পারি পিকলু?”
পিকলু বলল, “নিজেদের অধিকারটাকে তো আমরা বুঝে নিতে পারি, তাই না? কেন তোমরা চলে যাবে? কেন আমাকে সবসময় একটা অলিখিত নিয়মে চলতে হবে? কেন বলতে পারো?”
দরজায় কেউ নক করল।
কল্যাণ বললেন, “কে?”
ওপাশ থেকে সত্যেনের গলা ভেসে এল, “আমি।”
২৪
দীপক জানলার কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল।
রিংকু দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই সিগারেটটা জানলা দিয়ে ফেলে দিল।
রিংকু অবাক হয়ে বলল, “তুমি সিগারেট খাচ্ছিলে?”
দীপক হেসে ম্যানেজ করার চেষ্টা করল, “না না, ওই একটাই।”
রিংকু বলল, “তুমি তো সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলে। আবার ধরলে কবে?”
দীপক বলল, “পিকলুর থেকে একটা নিয়েছিলাম।”
রিংকু বলল, “এখানে এলে পিকলুর সঙ্গে এত মেলামেশা বেড়ে যায় কেন তোমার?”
দীপক কিছু বলল না।
রিংকু বলল, “এত লোক আছে, বাবা আছে, কাকা আছে, কই তাদের সঙ্গে তো বেশি দেখতে পাই না তোমায়!”
দীপক বলল, “তোমার বাবার সঙ্গে তো কথা হয়েছে আমার।”
রিংকু বলল, “সে যাই হোক। কথা হয়েছে ভালো হয়েছে। কিন্তু পিকলুর পাল্লায় পড়লে কেন?”
দীপক বলল, “পাল্লায় পড়ার কী আছে? তুমিই তো প্রথম দিকে বলতে এ বাড়িতে পিকলুর সঙ্গেই একমাত্র কথা বলা যায়, ও অনেক ফ্রেশ মাইন্ডের ছেলে।”
রিংকু বলল, “এখন বলি না। তা ছাড়া ও কেমন পালটে যাচ্ছে যত দিন যাচ্ছে। তোমার কানে মন্ত্র দিয়ে তোমাকেও ও চেঞ্জ করে দেবে ঠিক। তুমি জানো ওর একটা মেয়ের সঙ্গে অ্যাফেয়ার আছে? তুমি নিজে তো ছ মাস লন্ডনে একা ফুর্তি করবে। আমি তো আর দেখতে পাচ্ছি না কী করবে একা একা। বলা তো যায় না কিছুই। সামনে তো এমন ভাব করে থাকো যেন ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানো না।”
দীপক বলল, “সেটুকু বিশ্বাস তো রাখতেই হবে তোমাকে।”
রিংকু বলল, “যে ছেলেটা তোমার একটা ছেড়ে দেওয়া নেশা এতদিন পরে আবার নতুন করে ধরাতে পারে, সে সব কিছু করতে পারে।”
দীপক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একটা কাজ করি তবে, যাওয়াটা ক্যানসেল করে দি।”
রিংকু বলল, “ক্যানসেল করবে না কী করবে সেটা তোমার ডিসিশন, তবে আমি চাইব তুমি এখানে যে কটা দিন থাকবে, পিকলুর সঙ্গে কম মিশবে। আমার ওকে একদম সহ্য হচ্ছে না এবারে।”
দীপক বলল, “আচ্ছা।”
রিংকু বলল, “তুমি জানো ও এখন পিসিদের ঘরে ঢুকেছে?”
দীপক একটু চমকাল কিন্তু সামলে নিয়ে বলল, “আমি কী করে জানব, আমি তো এখানেই ছিলাম। তুমি দেখলে?”
রিংকু বলল, “হ্যাঁ, বাবার ঘর থেকে আসার সময় দেখলাম।”
দীপক বলল, “ওহ। সে তো যেতেই পারে। পিসির ঘরে যাবে এতে সমস্যা কোথায়?”
রিংকু বলল, “কোথাও সমস্যা নেই। আমি কি বলেছি কোনও সমস্যা আছে? কিন্তু ব্যাপারটা অন্য কোনও দিন গেলে তো এই নিয়ে কেউ কিছু বলত না। আজকেই যেতে হল? যখন এত বড়ো একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে? তুমি হয়তো জানো না, পিকলু হঠাৎ করে বিপথে যায়নি। ওর অফিসে বেশ কিছু প্রবলেম তৈরি হয়েছে। সম্ভবত ওর চাকরিটা নিয়ে।”
দীপক অবাক হয়ে বলল, “সেটা তোমাকে কে বলল? তনয়া?”
রিংকু বলল, “সেসব খবর দেওয়ার লোকের অভাব নেই। সব খবরই পাই। পিকলুর মধ্যে সে সব কিছু নিয়েই একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। মেন্টাল ডিস্টার্বেন্সের জন্যই ও এসব উলটোপালটা কাজ করা শুরু করেছে। তোমার এত কিছু জানার কথা না। সেজন্যই বললাম। জেনে রাখো, এবং এখন ওর থেকে দূরে থাকো।”
দীপক খাটে বসল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
রিংকু বলল, “দ্যাখো দীপক, তোমার থেকে আমার বাবার অনেক এক্সপেক্টেশন। তুমি জানো কি না জানি না, তবে বাবা কিন্তু তোমাকে একদম অন্য চোখে দ্যাখে। আমার তো মনে হয় বাবা তোমাকে আমার থেকেও বেশি পছন্দ করে। চেষ্টা করো বাবার কথা শুনে চলতে। অসৎ সঙ্গে পড়লে বুঝতেই পারছ, সবথেকে বেশি ক্ষতিটা আমাদেরই হবে।”
দীপক বলল, “মিষ্টির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?”
রিংকু চোখ ছোটো করে বলল, “হঠাৎ করে মিষ্টির কথা বললে কেন?”
দীপক বুঝল প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। সে বলল, “এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। বাড়িতে এত বড়ো একটা ব্যাপার হয়ে গেল, তাই আর কি।”
রিংকু বলল, “তোমাকে বোধহয় এ বাড়িতে আসার আগে একটা কথা বলেছিলাম। ভুলে গেছ?”
দীপক বলল, “না না, মনে আছে। বললাম তো, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।”
রিংকু গম্ভীর হয়ে বসে থাকল।
২৫
পিকলু দরজা খুলল, “এসো জেঠু।”
সত্যেন ঘরে ঢুকলেন, “তুই এই ঘরে কী করছিস?”
পিকলু বলল, “খবর নিতে এসেছিলাম, মিষ্টি কেমন আছে।”
সত্যেন পিকলুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন, “সেটা এত রাতে নিতে হল? তোরা এখনও ঘুমাসনি?”
সোমা উঠে বসলেন। বললেন, “বস।”
সত্যেন চেয়ারে বসে পিকলুকে বললেন, “তোর সম্পর্কে অনেক কিছু শুনলাম পিকলু।”
পিকলু যেন আকাশ থেকে পড়ল, এমন মুখ করে বলল, “কী শুনলে জেঠু?”
সত্যেন কয়েক সেকেন্ড পিকলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এমন কিছু কথা যেগুলো না শুনলেই হয়তো ভালো হত আমার।”
কল্যাণ বললেন, “তুমি ঘুমাও কখন?”
সত্যেন বললেন, “আমি ঠিক সময়ে ঘুমাই। পিকলু বলুক, আমি যেগুলো শুনেছি সে সম্পর্কে।”
পিকলু বলল, “জেঠু, আমিও একটা কথা শুনলাম।”
সত্যেন একটু রাগলেন, “তুই আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে।”
পিকলু বললেন, “জেঠু, তুমি কি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাও?”
সত্যেন বললেন, “কথা ঘোরাচ্ছিস?”
পিকলু বলল, “না না, কথা ঘোরাব কেন, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। আসলে কী জানো তো, আমার অফিসে মিঠুনের অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা বলায় আমার বস খুব খুশি হয়ে বলল, বাহ, তোমাদের গ্রামের বাড়ি তো খুব উন্নত জায়গায়। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করায় মব গাড়িচালককে মেরে দিল আর তার সুন্দরী বউয়ের গায়ে কেউ ছুঁল পর্যন্ত না? আমাদের গ্রাম হলে তো আগে মেয়েটার গায়ে হাত পড়ত।”
সত্যেন কল্যাণের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, “এতক্ষণ কি এইসব কথা আলোচনা হচ্ছিল?”
পিকলু হাসল, “পিসেমশাই অত আলোচনা করতে পারেন নাকি জেঠু? সেরকম লোক হলে এতক্ষণে খুনিকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিতেন।”
সত্যেন কাঁপতে লাগলেন রাগে, গলা তুলে বললেন, “তোর এত বড়ো সাহস, তুই কার সঙ্গে কী বলছিস বুঝতে পারছিস?”
পিকলু অবাক হবার ভান করে বলল, “কী যে বলো না জেঠু, আমি কী বললাম বলো তো? আমি তো খুনিকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর কথা বলেছি।”
জীবেন ব্যস্ত হয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে বললেন, “কী হল, এত রাতে এই ঘরে সবাই কেন?”
পিকলু হাসতে হাসতে বলল, “ওহ, তুমি, আমি তাই ভাবছিলাম বাবা, তুমি এতক্ষণ কোথায় পড়ে ছিলে?”
জীবেন গম্ভীর হয়ে বললেন, “তুই এই ঘর থেকে যা। রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়।”
পিকলু বলল, “ধুস, আমার তো রাত জাগা অভ্যাস আছে। তুমি বরং জেঠুকে বলো। কাল অতগুলো কাজ বাড়িতে, অঞ্জলি আছে, বড়ো বড়ো সব লোক আসবে, নিজে সুস্থ না থাকলে তো ফ্যামিলির সম্মানটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এখন তো মনে হয় ফ্যামিলির সম্মানটাই সবথেকে বড়ো কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
জীবেন গম্ভীর হয়ে বললেন, “তুই ঘরে যা পিকলু। তোকে আগেও বলেছি, আবার বলছি, এখানে অযথা উলটোপালটা কথা বলবি না। তুই বোধহয় জানিস না, দাদা মিঠুনের খুনিকে শাস্তি দেবার জন্য কতটা চেষ্টা করছে।”
সত্যেন বললেন, “তুই বরং নিজের সংসার সামলা পিকলু। নিজের বউ অন্য ছেলের সঙ্গে দেখা করছে, ছি ছি ছি। সান্যাল বংশের সম্মান এভাবে বাজারে বিক্রি হয়ে গেল! মিষ্টির কথা তোর না ভাবলেও চলবে। মিঠুনের খুনি উপযুক্ত সাজা পেয়েছে। তুই বরং নিজের দিকে তাকা। তোর লজ্জা হওয়া উচিত।”জীবেন অবাক হয়ে সত্যেনের দিকে তাকালেন।
পিকলু জীবেনের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, তুমি সবসময় সাইলেন্ট মুভির সাইড ক্যারেক্টার প্লে করো, ভালো লাগে তোমার?”
কল্যাণ পিকলুকে থামালেন, “পিকলু, আমার মনে হয় তোমার ঘরে যাওয়া উচিত। এত রাতে সোমার উত্তেজনা ভালো নয়। ইন ফ্যাক্ট, সবাই ঘরে গেলেই বোধহয় ভালো হয়।”
সত্যেনের জোরে জোরে শ্বাস পড়ছিল, কল্যাণকে বললেন, “তোমাদের যদি মনে হয়, আমার বাড়িতে থেকে, আমার বিরুদ্ধেই কন্সপিরেসি করবে, তাহলে কিন্তু তোমরা ভুল ভেবেছ, আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি, থাকছ, খাওয়াদাওয়া করছ, ব্যস। পারলে কালকেই তোমরা বিদেয় হও। সান্যালবাড়িতে যারা ঢুকতে কোনও দিন সাহস পেত না, তাদের বাড়িতে ঢোকালে কী হয়, তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি।”
সোমা বললেন, “এটা তুই কী বললি দাদা?”
সত্যেন একবার কড়া চোখে পিকলুর দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পিকলু জীবেনকে বলল, “জেঠুকে একটা কথা বলা হল না বাবা।”
জীবেন ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন। কোনও মতে বললেন, “কী?”
পিকলু বলল, “আমার এক বন্ধু, পুলিশে একটু ওপরের দিকের অফিসার। ওকে মিঠুনের ব্যাপারটা বলেছি। ব্যাপারটা লোকাল থানা দিয়ে মিটবে না বোধহয় আর। পারলে ঘুমোতে যাবার আগে জেঠুকে খবরটা জানিয়ে দিয়ো, ঘুমটা ভালো হবে। মিঠুনের খুনির শাস্তি হোক, সবথেকে বেশি বোধহয় জেঠুই চায়, তাই না?”
জীবেন চমকে পিকলুর দিকে তাকালেন। তাঁর মুখটা ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছিল।
২৬
পিকলু আসেনি দেখে তনয়া দরজা ছিটকিনি না দিয়ে ভেজিয়ে শুয়েছিল। বাচ্চাটা কাঁদছিল। সামলেসুমলে ঘুম পাড়িয়ে মোবাইলটা খুলল। অবনীশ বেশ কয়েকবার পিং করেছে।
তনয়া লিখল, “সরি। বিজি ছিলাম।”
অবনীশ লিখল, “অনেক কাজ করতে হয়?”
তনয়া নিজের মনে হেসে লিখল, “হয়। সংসার মানেই অনেক কাজ।”
“চলে এসো আমার কাছে। কিচ্ছু করতে হবে না।” অবনীশ একদিনের দেখাতেই তার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। সর্বক্ষণ শুধু একই কথা। তনয়া চেষ্টা করে চলেছে এই প্রবল ইচ্ছাকে বাঁধ দিয়ে দমিয়ে রাখতে।
তনয়া একটা স্মাইলি দিয়ে বলল, “আমার বরও একই কথা বলত।”
“আমাকে তোমার বরের মতো ভেবো না। আমি আলাদা।” অবনীশের মুখটা মানসচোখে দেখতে পেল তনয়া।
সে লিখল, “পৃথিবীর সব পুরুষই তাই ভাবে। বলো?”
“আমি ভাবি না, আমি যা, আমি তাই।”
“একজ্যাক্টলি, এটাই সবাই ভাবে।”
“ওহ। প্লিজ। তোমরা মেয়েরা চিরকাল এত কনজারভেটিভ হলে কী করে হবে বলো তো?” অবনীশ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
“ভাগ্যিস কনজারভেটিভ। তাই হয়তো খানিকটা ব্যালান্স থাকল।” তনয়া অনেকটা ভেবে লিখল।
“কীসের ব্যালান্স?” অবনীশ যেন কিছুই বোঝে না।
তনয়া লিখল, “বুঝবে না। সব কথা বুঝে কী করবে?”
দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকল পিকলু। তনয়া মেসেঞ্জার বন্ধ করল না।
পিকলু ঘরে ঢুকে খানিকক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাক, ব্যাটা ঘুমিয়েছে।”
বেশ কিছুদিন হল পিকলুর সঙ্গে তনয়ার কথা নেই।
তনয়া ভেবেছিল এখনও পিকলু কিছু বলবে না। তাকে চমকে দিয়ে বলল, “অবনীশের কথা দিদিকে বলেছ নিশ্চয়ই?”
তনয়া এতটা জোরে চমকাল যে ফোনটা তার হাত থেকে খাটের ওপর পড়ে গেল। একটু সামলে বলল, “হ্যাঁ, বলেছি।”
পিকলু বলল, “কাল আনন্দবাজারে বেরোবে। ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমনও হতে পারে। বাড়ির আর কারও জানার বাকি নেই।”
তনয়া ঠোঁট কামড়াল। বলল, “আমি অত ভেবে কিছু বলিনি।”
পিকলু বলল, “বলা উচিত।”
তনয়া কিছুক্ষণ পিকলুর দিকে তাকিয়ে থাকল। কোত্থেকে যেন চোখে জল চলে এল, “তোমারও বলা উচিত ছিল আমাকে। তুমি কী করে করলে ওটা?”
পিকলু তনয়াকে কাঁদতে দিল। বেশ খানিকক্ষণ পর বলল, “মানুষ তো। মানুষের কিছু জৈবিক প্রবৃত্তি থাকে। আমি তোমার কাছে সাফাই গাইব না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি খানিকটা বয়ে গেছিলাম, নিজেই চেয়েছিলাম হয়তো।”
তনয়া চুপ করে থাকল।
পিকলু বলল, “আমাদের বাড়ির পরিস্থিতি আমাদের সম্পর্কের থেকেও অনেক গুণ জটিল তনয়া। তুমি কি সেটা বুঝতে পারছ?”
তনয়া বলল, “আমার মাথায় কিছুই আসছে না।”
পিকলু বলল, “একটা লোক, তাকে তার অসংখ্য কুসংস্কার আর গোঁড়ামির সঙ্গে প্রচুর ক্ষমতা দিয়ে খোলা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে প্রভূত ক্ষমতা পেয়ে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াচ্ছে। তাকে সাহায্য করার জন্য আছে আমার নিজের বাবা, যে প্রত্যেকটা নির্দেশ পরম ভক্তিভরে পালন করে চলেছে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ সম্পূর্ণ লড়াইটাই ভীষণ অসম। এই সময় কি আমরা একটা যুদ্ধবিরতি নিতে পারি?”
তনয়া পিকলুর চোখে চোখ রেখে বলল, “যুদ্ধবিরতির পরে আমরা আবার যুদ্ধ করব?”
পিকলু বলল, “যুদ্ধ তো হয় সমানে সমানে। আমি তোমার কাছে প্রথম থেকেই তো হেরে গেছি।”
তনয়া চুপ করে রইল।
পিকলু বলল, “জানতে চাইলে না, কীভাবে যুদ্ধ করব?”
তনয়া বলল, “তুমিই জানো।”
পিকলু বলল, “আচ্ছা, তুমি অবনীশের সঙ্গে আবার কথা বলতে পারো, আমি ঘুমিয়ে পড়ি।”
তনয়া হঠাৎ পিকলুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল, “তুমি এমন অদ্ভুত কেন? কেন? কেন?”
পিকলু তনয়াকে বুকের কাছে নিয়ে তনয়ার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “মানুষ বলে।”
২৭
মেলায় টহল দিয়ে নির্মল চৌধুরী ঠিক করলেন ঘরে ফিরে একটু শুয়ে নেবেন। থানার মেজোবাবুকে দায়িত্ব দিয়ে নির্মলবাবুর বাড়ির সামনে যখন গাড়িটা দাঁড়াল তখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে।
কনস্টেবল বিকাশ সাহা বলল, “স্যার, আপনার বাড়ির বাইরে কে বসে আছে?”
নির্মল গাড়ি থেকে নেমে অবাক হলেন। বললেন, “কে বলো তো?”
বিপিন গাড়ি থেকে এগিয়ে গিয়ে দেখে এসে বলল, “শম্ভুর বউ স্যার।”
নির্মল বললেন, “এখানে কী করছে? আচ্ছা, তোমরা বেরিয়ে যাও, আমি দেখছি।”
গাড়িটা বড়োবাবুকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ঘরের চাবি পকেটেই থাকে নির্মলবাবুর। চাবি বের করে ঘরের দরজা খুলতে এগোলেন।
তাঁকে দেখে রম্পা উঠে দাঁড়াল।
নির্মলবাবু বললেন, “এখানে কী চাই?”
রম্পা বলল, “বিচার চাই বাবু।”বাড়ির বাইরের একশো পাওয়ারের বালবে রম্পার অবিন্যস্ত পোশাক দেখে নির্মল চ্যাঁচ্যাতে গিয়েও থমকে গেলেন। দরজা খুলে বললেন, “আয়, ঘরে আয়।”রম্পা ধরা গলায় বলল, “বিচার চাই বাবু। বিচার দ্যান।”নির্মল ঘরের ভিতর ঢুকে আলো জ্বালিয়ে সোফায় বসলেন। পিছন পিছন রম্পা ঢুকে মেঝেতে বসল। নির্মলের মনে পড়ে গেল বহুদিন বাড়ি যাওয়া হয় না। বউয়ের সঙ্গে কতদিন… নির্মল দীর্ঘশ্বাস ফেলে রম্পার দিকে তাকালেন। এখানে মেয়েদের কম বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। কত আর বয়স হবে মেয়েটার। খুব বেশি হলে তেইশ চব্বিশ। পাশের বাড়িটাও তাঁর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। ভিতরের পুরুষমানুষটা জেগে উঠছিল একটু একটু করে। নির্মল একটু সামলে দরজাটা বন্ধ করে সোফায় বসে বললেন, “নিচে বসিস না, ঠান্ডা লেগে যাবে, উপরে আয়।”
রম্পা গোঁজ হয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “বিচার চাই, বিচার চাই।”
নির্মল উঠে রম্পাকে ধরে তুলতে গেলেন, রম্পা ছিটকে গেল না, নির্মল খানিকটা উৎসাহিত হয়ে রম্পাকে সোফায় এনে বসালেন। শাড়ির আঁচল খসে গেছে, নির্মলের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। রম্পার পিঠে হাত রাখলেন, “আমরা তো আছি, আমি আছি, তোদের বাবু আছেন, সবাই আছে।”
রম্পা বলল, “সবাই বলল, কোনও ভয় নেই, শম্ভু যাবে, ফিরেও আসবে, কিন্তু শম্ভু ফিরল না আর। ওকে কে মেরেছে? সবার বিচার করতে হবে।”
নির্মল নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না, রম্পাকে জড়িয়ে ধরতে গেলেন।
রম্পা প্রাণপণে নির্মলকে ধাক্কা মারল। নির্মল ভেবেছিলেন রম্পা বাধা দেবে না। হঠাৎ করে ধাক্কা লাগায় জেদ চেপে গেল তাঁর। বললেন, “শোন, আমিই তোকে বিচার দিতে পারব, আর কেউ পারবে না, এদিকে আয়।”
রম্পা বিহ্বল চোখে নির্মলের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরোতে গেল। নির্মল সোফা থেকে উঠে রম্পাকে আটকাতে গেলেন। রম্পা নির্মলকে আবার ধাক্কা দিতে গেল, এইবারে নির্মল প্রস্তুত ছিলেন, রম্পার আক্রমণ প্রতিহত করে ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলেন।
রম্পা জোরে চেঁচিয়ে উঠল, নির্মল রম্পার মুখে হাত দিতে গেলেন, রম্পা নির্মলের হাতে কামড়ে দিল। নির্মল এবার মরিয়ে হয়ে উঠলেন, রম্পার গালে কষিয়ে এক চড় মারলেন।
রম্পা ছিটকে পড়ল ঘরের কোণে। দিনের পর দিন শম্ভুর চড় খেয়ে সেও অভ্যস্ত হয়ে গেছিল, সামলে উঠতে একটুও সময় না নিয়ে পরমুহূর্তেই উঠে প্রাণপণে চেষ্টা করল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। নির্মল দরজা আটকে দাঁড়ালেন। সার্ভিস রিভলভার বের করে রম্পাকে বললেন, “জানে মেরে দেব, একদম জানে মেরে দেব।”
রম্পা ফাঁদে পড়া বিড়ালের মতো নির্মলের দিকে তাকিয়ে ফুঁসতে লাগল। হাতের কাছে একটা ফুলদানি ছিল, নির্মলের দিকে ছুড়ে মারল।
নির্মল প্রস্তুত ছিলেন না। ফুলদানিটা কপালে এসে লাগল। বসে পড়লেন মাথায় হাত দিয়ে। কপাল থেকে রক্ত বেরোনো শুরু হয়েছে। টেবিলের ওপর আর-একটা ফুলদানি ছিল। রম্পা দৌড়ে এসে গায়ের সমস্ত জোর একত্রিত করে সম্মান বাঁচাবার তাগিদে নির্মলের মাথায় বারবার আঘাত করতে শুরু করল। নির্মল আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না।
রম্পাকে তাক করে তাঁর রিভলভার গর্জে উঠল। রাতের নিস্তব্ধতা মুহূর্তের মধ্যে খানখান হয়ে গেল। রম্পা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
নির্মলের মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। তিনি উঠতে গিয়েও মেঝেতে পড়ে গেলেন।
২৮
প্রণতি দেখলেন জীবেন একটু উত্তেজিত হয়ে দরজা বন্ধ করলেন।
চোখে ঘুম লেগে এসেছিল প্রণতির। জীবেনকে উত্তেজিত দেখে উঠে বসলেন, “কী হল আবার?”
জীবেন ঘামছিলেন।
খাটে বসে বললেন, “পিকলু কেমন একটা হয়ে গেছে। দাদার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলছে, আর…”
প্রণতি বললেন, “আর মানে? আর মানে কী বলতে চাইছ?”
জীবেন প্রণতির দিকে তাকালেন, “ও পুলিশের ওপরমহলে মিঠুনের ব্যাপারে জানিয়েছে। ব্যাপারটা নাকি নতুন করে তদন্ত হবে।”
প্রণতি বললেন, “দাদা কী বলছে এটা শুনে?”
জীবেন বললেন, “দাদা জানে না। দাদা বেরোনোর পর পিকলু আমাকে বলেছে। দাদাকে রাতে আর বলব না। এমনিতেই খুব কথা কাটাকাটি হল। সকালে বলব নাহয়।”
প্রণতি ধরা গলায় বললেন, “আমার ছেলেটার কোনও ক্ষতি করে দেবে না তো দাদা?”
জীবেন গম্ভীর হলেন, বললেন, “আমাকে এসব কথা বলবে না। ছেলে এখন লায়েক হয়ে গেছে। যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াচ্ছে।”
প্রণতি বললেন, “আমার প্রথম থেকেই কু গাইছিল মনটা। মিষ্টি যখন আসবে শুনছিলাম, তখন থেকেই আমার কেমন যেন একটা লাগছিল। তবু তোমার দাদা যে এত দূর ভেবে ফেলেছিল, সেটা আমার স্বপ্নেও মাথায় আসেনি।”
জীবেন কিছু বললেন না।
প্রণতি বললেন, “তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
জীবেন বললেন, “কী?”
প্রণতি বললেন, “তুমি জানতে না পুরো ব্যাপারটা কী হতে চলেছে?”
জীবেন বললেন, “এ আবার কেমন প্রশ্ন?”
প্রণতি বললেন, “তোমাদের যদি ছেলেটাকে পছন্দ না হত, না ডাকলেই পারত, ঘরে ডেকে এনে এটা কি না করলেই হচ্ছিল না? এ তো ঘোর পাপ। এত বড়ো পাপ পুজোর দিনে করতে পারলে? ছি ছি ছি, শেষে আমিও এত বড়ো পাপের ভাগীদার হলাম!”
জীবেন গম্ভীর হয়ে বললেন, “পাপ কে বলেছে তোমায়? এর থেকে পুণ্য আর কিছুতে নেই। আর পুজোর দিনই এর জন্য সেরা দিন।”
প্রণতি জীবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাদা ছাড়া কিছু বোঝো তুমি কোনও দিন? কাল যদি তোমার দাদা তোমাকে বলেন নিজের বউ ছেলেকে কুপিয়ে দিতে, তোমার বোধহয় হাতটুকুও কাঁপবে না, তাই না?”
জীবেন ভ্রূ কুঁচকালেন, “তোমার কী হয়েছে? এসব কেমন কথা বলা শুরু করেছ?”
প্রণতি বললেন, “পিকলুটার ওরকম অবস্থা, তোমাদের এরকম অবস্থা, আমি কোথায় যাই বলো তো? সারাবছর ধরে হাপিত্যেশ করে অপেক্ষা করে থাকি কখন ছেলেটা আসবে, নাতিটাকে দেখব, কিন্তু শেষে কী হল? ছেলেটা ওভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নাতিটাকে দেখতে পর্যন্ত পারলাম না ভালো করে বাড়ির কাজের চাপে। বউমাও কেমন হয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে সংসারটা কেমন হয়ে গেল।”
প্রণতি আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন।
জীবেন বিরক্ত গলায় বললেন, “মাঝরাতে যাত্রাপালা শুরু কোরো না তো, কাল অনেক কাজ আছে। আমি আর এত উত্তেজনা নিতে পারছি না, আমাকে ঘুমাতে দাও।”
প্রণতি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “ঘুমিয়ে পড়ো। আমিই জেগে থাকি সারারাত। আমার আর আজকে ঘুম হবে না। হ্যাঁ গো, তোমার জেল হবে না তো?”
জীবেন বললেন, “হলে হবে। আমি এসবে এত ভয় পাই না।”
প্রণতি বললেন, “সে তো কোনও কিছুতেই ভয় পাও না তুমি, কিন্তু যে বাড়ির সম্মানের কথা বলে সারাক্ষণ সবার কান মাথা খেয়ে নাও তোমরা, সেই তোমাদেরই যদি জেল হয়ে যায়, তাহলে সেই সম্মানের কী হবে সে সম্পর্কে কি কখনও ভেবেছ?”
জীবেন বললেন, “সম্মান বাড়বে।”
প্রণতি বললেন, “বাড়বে?”
জীবেন বললেন, “অবশ্যই বাড়বে, ওই ছেলেকে মারার দায়ে ফাঁসি হলেও পুণ্য হবে। স্বর্গে যাব।”
প্রণতি বললেন, “শোনো, আমি অত শিক্ষিত নই, কিন্তু আমি এটুকু বুঝি মানুষে মানুষে কোনও তফাত নেই। কাউকে মেরে কোনও দিন কোনও পুণ্যিলাভ করা যায় না। সবসময় তুমি, তোমার দাদা আমাকে পায়ের তলায় রেখে দিয়েছ, আমাকে কোনও কিছু নিয়েই কিছু বলতে দাওনি। তোমরা যা যা বলেছ, আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি, কিন্তু এইবারে অনেক হল। যদি এরকম দিন আসে, যদি কখনও মনে হয় আমার ছেলের দিকে কেউ চোখ তুলেও তাকাবে, তখন কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এই কথাটা তুমি আর তোমার দাদা মনে রেখে দিয়ো। ছোটো থেকে ছেলেটা জেঠুর বকা খেয়ে খেয়ে মানুষ। অত বড়ো চাকরি পেল বাইরে যাবার, যেতে দিল না। কই নিজের মেয়ে জামাইকে তো বাধা দিল না? এইসব আমার চোখে পড়ে না ভেবেছ? কিন্তু আমি মুখ বুজে থাকি। এবার আর না। পিকলুর যেন কোনও ক্ষতি না হয়। তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
জীবেন থমথমে মুখে বসে রইলেন।