কল্যাণ সোমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার দোতলায় ওঠার দরকার নেই এখন। আমি দেখা করে আসছি।”
সোমা চুপ করে বসে রইলেন।
প্রণতি বললেন, “তা কী করে হয়, মিষ্টি তো এখন ঘুমাচ্ছে।”
কল্যাণ বললেন, “ঘুমাক না। মেয়ে তো আমার। দেখতে ক্ষতি কী?”
সত্যেন প্রণতিকে বললেন, “নিয়ে যাও।”
প্রণতি কল্যাণকে নিয়ে গেলেন।
জীবেন সত্যেনকে বললেন, “কাল রিংকু, পিকলুরাও আসছে।”
সত্যেন সোমার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “চিন্তা করিস না বোন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সোমা বিহ্বল চোখে দাদাকে দেখল।
চন্দ্রিমা নিস্তেজ হয়ে ঘুমাচ্ছিল। ঘরে দুজন মেয়ে চুপচাপ বসে আছে। ঘরের মধ্যে একটা বমির গন্ধ নাকে এল কল্যাণের। প্রণতিকে বললেন, “খুব বমি করেছে?”
প্রণতি বললেন, “হ্যাঁ দাদা। বারবার বমি করছিল মিষ্টি। শেষমেশ ডাক্তারকে ডাকতেই হল।”
কল্যাণ মেয়ের পাশে বসলেন। চুল এলোমেলো হয়ে আছে। মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। চন্দ্রিমা শিউরে উঠল ঘুমের ঘোরেই। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “মেরো না ওকে বড়োমামা, মেরো না, মেরো না বড়োমামা, মেরো না।”
কল্যাণ প্রণতির দিকে স্থির চোখে তাকালেন।
প্রণতি ব্যস্ত হয়ে “যাই, আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করি”, বলে তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কল্যাণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন।
৯
ভোর পাঁচটা।
সারাদিনে যত কাজই থাক, প্রতিদিনই এই সময় ঘুম ভেঙে যায় সত্যেনের। উঠে প্রাতঃভ্রমণে বেরোনো তাঁর চিরকালীন অভ্যাস। বর্ষাকালটায় নিজের ঘরেই শরীরচর্চা সেরে নেন।
পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও বার্ধক্য ধরেনি। গিন্নি জবা পাঁচ বছর আগে চলে যাবার পর (শম্ভুর বউকে বলেছিলেন গিন্নির দেখাশোনা করতে) কিছুদিন ম্রিয়মাণ ছিলেন। সেসব সামলে উঠেছেন অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই। শক্ত মনের মানুষ তিনি। শোক দুঃখ বেশিদিন কাবু করে রাখতে পারেনি।
স্পোর্টস ট্রাউজার আর টিশার্টটা পরে ঘর থেকে বেরিয়ে বৈঠকখানায় এসে দেখলেন কল্যাণ বসে আছেন। সত্যেন অবাক হলেন, “ঘুমাওনি?”
কল্যাণ বললেন, “বসো। কথা আছে।”
সত্যেন বললেন, “আমি তো মর্নিং ওয়াকে যেতাম।”
কল্যাণ বললেন, “কথা বলে যাবে। অসুবিধা আছে কোনও?”
সত্যেন বসলেন। বললেন, “বলো।”
কল্যাণ বললেন, “মিঠুনের বাড়ির কেউ আসবে না। কাল রাতে জানিয়ে দিয়েছে।”
সত্যেন অবাক হলেন, “কেন?”
কল্যাণ বললেন, “ওর বাড়ি থেকে বিয়েটা মেনে নেয়নি। ও বেঁচে আছে কি মরে গেছে তা নিয়ে ওরা চিন্তিত নয়। ওর বাবা আমাকে এই ভাষাতেই কথাটা জানিয়েছেন।”
সত্যেন বললেন, “তুমি তো কাল বললে ওরা আজ আসবে। সেইমতো ফার্ম হাউস ক্লিন করতে বলে দিয়েছিলাম।”
কল্যাণ বললেন, “রাত্রে আবার ফোন করেছিল।”
সত্যেন নির্বিকার মুখে বললেন, “তাহলে এখানেই সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে?”
কল্যাণ বললেন, “কীভাবে করবে?”
সত্যেন বললেন, “ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমার কথা শেষ হয়েছে? আমাকে বেরোতে হবে।”
কল্যাণ বললেন, “শুনে কি খুশি হলে?”
সত্যেন বললেন, “কেন বলো তো?”
কল্যাণ বললেন, “এমনি জিজ্ঞেস করলাম। আমার কথা হয়ে গেছে। তুমি যেতে পারো।”
সত্যেন উঠলেন। বললেন, “মিষ্টিকে সামলাও। ওর এখন তোমাদের দরকার।”
কল্যাণ বললেন, “তা বটে। তবে আমাদের তো বয়স হচ্ছে। ওর সবার আগে মিঠুনকেই দরকার ছিল।”
সত্যেন বললেন, “বয়স কম, শোক সামলে উঠলে আর-একটা বিয়ে দিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কল্যাণ বললেন, “হুঁ। জীবন তো সরলরেখাতেই চলে, তাই না?”
সত্যেন বললেন, “আমি তো তোমাদের কাল বললাম। থানায় কথা বলা আছে। খুনির শেষ দেখে ছাড়ব আমরা।”
কল্যাণ বললেন, “রিংকুরা কখন আসছে?”
সত্যেন বললেন, “ভোরে ট্রেন হাওড়া ঢোকার কথা। এখানে দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে যাবে। রিংকু এলে মিষ্টি খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে আশা করা যায়।”
কল্যাণ বললেন, “চলো তোমার সঙ্গে আমিও হাঁটি। বহুদিন হাঁটা হয় না।”
সত্যেন বললেন, “চলো।”
দুজনে বেরোলেন। বিরাট বাড়ির সামনের ঘরে দুজন চাকর ঘুমায়। সত্যেন বেরোনোর আগে তারা জেগে যায়।
তাদের দেখে তটস্থ হয়ে দরজা খুলে দিল।
দুজনে রাস্তায় নামলেন। ভোরের দিকে হালকা একটা ঠান্ডা ভাব। সত্যেন খেতের দিকে তাকিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন।
কল্যাণ বললেন, “আজ সপ্তমী।”
সত্যেন বললেন, “হ্যাঁ, আজ থেকে চাপ বাড়বে পুজোর। গোটা গ্রাম খাবে।”
কল্যাণ বললেন, “গোটা গ্রাম কথাটা ভুল। কয়েকটা ঘর বাদ দিয়ে।”
সত্যেন কল্যাণের দিকে তাকিয়ে শ্লেষাত্মক গলায় বললেন, “গোটা গ্রামের মানুষদের ডেকেছি। তাদের বাইরে কাউকে ডাকিনি।”
কল্যাণ সত্যেনের দিকে না তাকিয়ে বললেন, “বুঝলাম। আমরা আজ চলে যাব।”
সত্যেন বললেন, “বেশ। আমারও মনে হয় মিষ্টি তোমাদের ওখানে থাকলে সামলাতে সুবিধা হবে।”
কল্যাণ বললেন, “কার সামলাতে? তোমার? কী সামলাবার কথা বলছ বলো তো?”
সত্যেন একটু থমকে বললেন, “আমি মিষ্টিকে সামলাবার কথা বলেছি।”
কল্যাণ বললেন, “ওহ। বুঝেছি। ঠিক আছে। দুপুর নাগাদ আমরা চলে যাব।”
সত্যেন কিছু বললেন না। গম্ভীর মুখে হাঁটতে থাকলেন।
১০
রম্পার ঘুম ভাঙল সাতটা নাগাদ। উঠে দেখল রাত্তিরে দরজা খোলা ছিল। মাথা এতটাই ধরেছিল যে খেয়াল ছিল না। অবশ্য আজকাল আর ভয়ও লাগে না তার। প্রথম প্রথম শম্ভু রাতে বাইরে থাকলে সারারাত জেগে থাকত। কোথাও একটু শব্দ হলে ভয়ে কাঁটা হয়ে যেত। হাতে একটা লাঠি রেখে দিত। সকাল হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত।
বাড়ির উঠোনে শরতের রোদ এসে পড়েছে। রম্পা উঠে বাইরে গিয়ে বসল। দাঁতন বাকি। পুজোয় কত কিছু করার কথা ছিল। সান্যালবাড়ি যাবে। পাশের গ্রামে মেলা হয়। সেখানে কত কিছু কিনবে বলে ঠিক করেছিল।
পুজোর সময়টা গ্রামের রূপ পরিবর্তন হয়ে যায় অনেকটাই। কেমন একটা মায়াবী হয়ে ওঠে চারপাশটা। আকাশটা নীল হয়ে আছে। ঘরের সামনের মাঠে কাশফুল ফুটেছে। সান্যালবাড়ি থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছে। রম্পা বেশ খানিকক্ষণ সব কিছু ভুলে চুপচাপ মুগ্ধ হয়ে বসে রইল।
তার একটা নেড়ি কুকুর আছে। কাল ভালো খাবার পেয়েছিল। শম্ভু সেভাবে খায়নি। অনেকটা ফেলা গেছিল। সব খেয়েছিল কুকুরটা। তাকে দেখে লোভাতুর দৃষ্টিতে লেজ নাড়াচ্ছিল। রম্পার মনখারাপ হল। ঘরে গিয়ে দেখল কিছুই নেই। বিস্কুট পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে।
সে দাঁতন সেরে ঘর ভেজিয়ে সান্যালবাড়ির দিকে রওনা দিল। কিছু না কিছু খাওয়া পেলেই হল। পুজোর দিনে ও বাড়িতে বসে থাকলে খাওয়ার সময় ঠিক কেউ না কেউ ডেকে নেয়।
রম্পার পিছন পিছন কুকুরটাও আসছিল। খানিকটা রাস্তা আসার পর কুকুরটা দাঁড়িয়ে গেল। অন্য এলাকা এসে গেছে। এর পর থেকে অন্য কুকুরদের রমরমা। তাকে দেখলে খেদানি খাবার সমূহ সম্ভাবনা।
ঢাকের শব্দ কাছে আসছে ধীরে ধীরে। রম্পা পা চালাল। সান্যালবাড়ির কাছে এসে দেখল বেশ কিছু লোক ভিড় করেছে। সে চুপচাপ ঠাকুরদালানের চেয়ারে গিয়ে বসল। প্রতিমাকে ঘিরে রয়েছে কয়েকজন বউ। রম্পা সবাইকে চিনল না। পুজোর সময় অনেকেই শহর থেকে আসেন। সবাইকে তার চেনার কথাও নয়।
সত্যেন ঠাকুরদালানে তদারকি করছিলেন। তার দিকে চোখ পড়তে এগিয়ে এলেন, “তুমি শম্ভুর বউ না?”
রম্পা মাথায় ঘোমটা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করল। কোনও কথা বলল না।
সত্যেন হাত বাড়িয়ে একজনকে ডেকে কানে কানে কিছু বললেন। রম্পা দেখল শম্ভুরই বন্ধু দেবু। সত্যেন কথাটা বলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। দেবু এসে তার কানে কানে বলল, “বউদি, চিন্তার কোনও কারণ নেই, শম্ভুকে থানায় বেশিদিন রাখবে না। ছেড়ে দেবে।”
রম্পার দেবুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, “ঘরে কিছু নেই । চাল ডাল তরিতরকারি।”
দেবু গলা নামিয়ে বলল, “বাইরে এসো।”
রম্পা বাইরে গেল। সান্যালবাড়ির পাঁচিলের বাইরে।
দেবু পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করে বলল, “জ্যাঠা এই টাকাটা দিয়েছেন। যা যা কেনার কিনে নাও। আমি কাল গিয়ে দিয়ে আসব। এখানে এখন বারবার এসো না।”
রম্পা অবাক গলায় বলল, “কেন?”
দেবু বলল, “জ্যাঠা বলেছেন। কেসটা চলবে তো। পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে।”
রম্পা বলল, “কী বলবে?”
দেবু বিরক্ত হল, “আহ, তোমাকে এখন অত বোঝাতে পারব না। শুধু বুঝে নাও, তুমি এখানে এলে শম্ভুর সমস্যা হবে।”
রম্পা বলল, “শম্ভু তো বাবুর কাছেই থাকে। আমি এলে কী হবে। ভোগের প্রসাদ খাব না বলছ?”
দেবু বলল, “আমি গিয়ে দিয়ে আসব তোমায় ভোগের প্রসাদ। ঠিক আছে? আজ বাড়ি যাও।”
দেবু বাড়ির ভিতর চলে গেল।
রম্পা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
ঢাকের শব্দটা আবার দূরে যেতে শুরু করেছে।
১১
জীবেন সান্যাল হিসেব করছিলেন। সপ্তমী থেকে প্রচুর লোক খাবে। আনাজ, চাল, ডাল আসা শুরু হয়েছে। এই কটা দিন নাওয়াখাওয়া মাথায় ওঠে। অনেক নেতারাও আসবেন সদর থেকে। সান্যালবাড়ির পুজো বলে কথা। বড়দা তাঁকে ভরসা করেন, জীবেন যথাসাধ্য চেষ্টা করেন ভরসার মর্যাদা দেবার।
বাইরে থেকে ছেলে, ভাইঝিরা আসবে। ওদের জন্য আবার আলাদা খাবার ব্যবস্থা। জল আনাতে হচ্ছে সদর থেকে। এমনি জল খাবে না ওরা মিনারেল ওয়াটার ছাড়া। জামাইয়ের আবার হাজারখানেক বায়নাক্কা থাকবে। এটা দাও রে সেটা দাও রে। জীবেন সান্যালের মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয় এই সময়টা।
জীবেনের পাশে সত্যেন এসে বসলেন। জীবেন বললেন, “সব ঠিক আছে তো?”
সত্যেন বললেন, “মিষ্টির ঘুম ভেঙেছে।”
জীবেন বললেন, “দেখা করলি?”
সত্যেন বললেন, “হ্যাঁ।”
জীবেন বললেন, “কী বুঝলি?”
সত্যেন বললেন, “শান্ত হয়েছে। বাপ আছে মেয়ের সঙ্গে। ঠান্ডা হয়ে যাবে। আজ চলে যাবে।”
জীবেন অবাক হয়ে বললেন, “আজই? দুদিন থাকলে ভালো হত না?”
সত্যেন হালকা গলায় বললেন, “যাক, কেস থিতিয়ে যাবে। কিছুই হবে না।”
জীবেন বললেন, “তবু। মেয়ে যেরকম ভায়োলেন্ট ছিল কাল…”
সত্যেন বললেন, “থাম তো। ওর বাবা মা জানে মেয়ের ভালো কীসে। জলঘোলা করে কোনও লাভ হবে না।”
জীবেন বললেন, “বডি কী হবে?”
সত্যেন বললেন, “ও থানা থেকে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
জীবেন একটু ইতস্তত করে বললেন, “পোড়াবে?”
সত্যেন ঠান্ডা চোখে জীবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সেটা জেনে তুই কী করবি? যা পারে করুক।”
জীবেন বললেন, “পিকলু আসছে আজ, রিংকুরও তো আসার সময় হয়ে গেল।”
সত্যেন একটু খুশি হলেন। বললেন, “হ্যাঁ। রিংকুদের ঘর গোছানো হয়ে গেছে তো?”
জীবেন বললেন, “সেসব কালই প্রণতি করে রেখেছে। ওসব নিয়ে ভাবিস না।”
সত্যেন বললেন, “শোন, আমার তো খেয়াল থাকবে না কাজের চাপে, নজর করিস শম্ভুর বউ যেন বারবার না আসে এখানে। দেবুকে বলে দিয়েছি।”
জীবেন বললেন, “সে দেখে নিচ্ছি। শম্ভুকে সদরে চালান করে দিলে বাঁচি। এখানে থাকা মানে আরও ঝামেলা বাড়বে।”
সত্যেন জীবেনের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলেন, “শম্ভু বেঁকে বসে যদি?”
জীবেন নড়েচড়ে বসলেন, “সে তো হতেই পারে। না হবার কিছু নেই। জেলে কানে মন্ত্র দেবার লোকের কি অভাব আছে? গাঁয়ে একরকম, ওখানে গেলেই সাপের পাঁচ পা দেখাবার লোকের অভাব হবে না। তখন এই শম্ভুই দেখা গেল কোর্টে বেগড়বাঁই করে বসল।”
সত্যেন বসে বসে গম্ভীর মুখ পা নাচাতে লাগলেন। জীবেন চুপচাপ বসে রইলেন।
১২
কিছু লোক আছে যাদের নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর নিজেরই ভরসা নেই। অন্য কেউ ঠিক করে না দিলে তারা বলতে পারে না কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল।
দীপক লাহিড়ী বিয়ের আগে মায়ের কথায় উঠবোস করত। বিয়ের পরে নিজের জাঙিয়ার রং কী হবে, সেটাও রিংকু ঠিক করে দেয়। দীপক একটু নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ। রিংকুর মুড খারাপ হলে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়।
যশোর রোড ছেড়ে গাড়ি সান্যালবাড়ির দিকের রাস্তায় ঢোকার পরে রিংকু বলল, “শোনো, বাড়িতে একটা প্রবলেম হয়েছে। মিষ্টিদের গাড়ির নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। মিষ্টির বর আর বেঁচে নেই। তুমি আবার এই নিয়ে কোথাও কোনও বেফাঁস কথা বলে ফেলো না। বুঝেছ?”
দীপক অবাক গলায় বলল, “মিষ্টির বর বেঁচে নেই? কই আমাকে বলোনি তো?”
রিংকু গম্ভীর বলায় বলল, “এখন বলেছি তো। জেনে গেছ। কোনও প্রবলেম?”
দীপক বলল, “না। তবে ছেলেটা ভালো ছিল। খারাপ লাগছে।”
রিংকু বলল, “ভালো ছিল কী করে বুঝলে? কবার দেখা হয়েছে তোমার সঙ্গে?”
দীপক থতোমতো খেয়ে বলল, “না, মানে চন্দ্রিমার সঙ্গে যখন ওর অ্যাফেয়ার চলছিল তখন যেবার চন্দ্রিমা পুজোতে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলিয়েছিল ফোনে, ভুলে গেলে?”
রিংকু বলল, “সব মনে আছে, কিন্তু মিষ্টি অনেক কিছু লুকিয়েছিল। সেটা মনে আছে তো? আর যারা লুকোয় তারা ভালো হয় কী করে?”
দীপক একটু ভীত গলায় বলল, “চন্দ্রিমা লুকিয়েছিল, মিঠুন তো আমাদের কিছু লুকোয়নি।”
রিংকু কয়েক সেকেন্ড দীপকের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, “দিন দিন তুমি একটা যা তা হয়ে যাচ্ছ। সেটা বুঝতে পারো?”
দীপক কিছু বলল না। কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল, “এবছর মেলা দেখতে যাবে তো?”
রিংকু দীপকের দিকে জ্বলন্ত একটা দৃষ্টি হেনে সামলে বলল, “হ্যাঁ।”
দীপক বলল, “আমার মেলা বেশ ভালো লাগে।”
রিংকু বলল, “গিয়ে একগাদা পাঁপড়ভাজা খাবে আর পেটখারাপ করবে। এ বছর আমি যাব তোমার সঙ্গে।”
দীপক খানিকটা চুপসে গিয়ে বলল, “সে যেয়ো। তুমি গেলে তো আমি খুশিই হব। তোমার বাবা না গেলেই হল।”
রিংকু দীপকের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন? বাবা গেলে কী হবে?”
দীপক বউকে একবার মেপে বলল, “তাহলে সবাই যেরকম তটস্থ হয়ে থাকে, মেলাটা ঠিক দেখা হয়ে ওঠে না। নিজেরা নিজেরা মেলা দেখার মজাই আলাদা, তাই না?”
রিংকু বলল, “তাই কোরো। তুমি একা একাই ঘুরো। আমিও যাব না। বাবাও যাবে না। তবে পেটখারাপ করলে এবার আর ডাক্তার ডাকব না। একদম হাসপাতালের জেনারেল বেডে পাঠিয়ে দিতে বলব বাবাকে। মাঝরাতে ভূতে ধরবে।”
দীপক বলল, “হাসপাতালে ভূত আছে নাকি?”
রিংকু বলল, “না থাকলেও তোমাকে ধরবে ঠিক। এক তোমাকে দেখলাম, বউকে ছাড়া কত আনন্দে থাকো। পরশুও তো অফিসের পার্টিতে খুব খেয়েছিলে, তাই না? আমাকে অদিতি বলেছে।”
দীপক শঙ্কিত গলায় বলল, “এমন কিছু না। অদিতি শঙ্করের সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছে। ও তো নিজেই বলে ও প্রায়ই কনফিউজ হয়ে যায় কে শঙ্কর আর কে দীপক।”
রিংকু বলল, “সে যা ইচ্ছা করো। কিন্তু যা বললাম সেটা মাথায় রেখো। মিষ্টির সঙ্গেও এই নিয়ে কোনও কথা না। পারলে দূরে দূরে থাকবে। ওকে?”
দীপক বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল, “ওকে।”
গাড়ি সান্যালবাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। সত্যেন বাইরেই ছিলেন। রিংকু ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। দীপক গাড়ি থেকে নেমে শ্বশুরকে প্রণাম করল। সত্যেন দীপকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দিন দিন এত মোটা হয়ে যাচ্ছ কী করে? শুধু খাও আর ঘুমাও নাকি?”
দীপক কুঁচকে গেল খানিকটা, ক্যাবলার মতো হেসে বলল, “আসলে অফিসে এত চাপ থাকে, ওয়ার্ক আউট হয়ে ওঠে না।”
সত্যেন ভুরু তুললেন, “আমার থেকেও বেশি কাজ? জানো পঞ্চায়েতে কত ঝামেলা থাকে?”
দীপক শ্বশুরের সাথে কোনও তর্কে না গিয়ে হাসার চেষ্টা করল। রিংকু বলল, “পিসিরা চলে গেছে?”
সত্যেন বললেন, “না। ঘরে আছে। যাবে আজকেই।”
প্রণতি আর জীবেন এসে গেছিলেন। রিংকু আর দীপক দুজনকেই প্রণাম করল। সত্যেন বললেন, “তোরা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। সকালের পুজোটা মিস করে গেলি।”
রিংকু বলল, “কী করব বাবা,রাস্তায় যা জ্যাম ছিল! পিকলুরা আসেনি?”
জীবেন বললেন, “রাস্তাতেই আছে। চলে আসবে যে-কোনো মুহূর্তে।”
কল্যাণ বাড়ির ভিতর থেকে ঠাকুরদালানে আসছিলেন। রিংকুকে দেখে থমকে গেলেন। রিংকু হাসার চেষ্টা করল, “মিষ্টি শুয়ে আছে পিসেমশাই?”
কল্যাণ বললেন, “হ্যাঁ। উঠেছে। তুমি দেখা করতে গেলে যেতে পারো।”
রিংকু আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ পিসেমশাই, আমি ফ্রেশ হয়েই যাচ্ছি।”
দীপক সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে কল্যাণকে প্রণাম করল। কল্যাণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
১৩
জীবেন ঠাকুরদালানে তদারকি করছিলেন এমন সময় প্রণতি তাঁকে ডাকলেন। জীবেন বললেন, “কী হল?”
প্রণতি বললেন, “একটু এদিকে এসো।”
জীবেন প্রণতির কাছে এলেন, “কী হল?”
প্রণতি থমথমে গলায় বললেন, “পিকলুর সঙ্গে বউমার মনে হচ্ছে কোনও সমস্যা চলছে।”
জীবেন বললেন, “কেন? কী দেখে বুঝলে?”
প্রণতি বললেন, “তুমি দেখোনি? দুজনে তো কথাই বলছে না।”
জীবেন বললেন, “মরুক গে যাক, ওদের নিজেদের নিজেদের ব্যাপার, নিজেদের মিটিয়ে নিতে দাও। এদিকে আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়।”
প্রণতি বললেন, “বাচ্চাটাকে এনেই ঘুম পাড়িয়ে দিল।”
জীবেন বিরক্ত হয়ে বললেন, “এতটা রাস্তা এসেছে, ক্লান্ত হয়েছে হয়তো। তুমি সব ব্যাপারে চিন্তা করছ কেন? এদিকে কত বড়ো ঝামেলা ঘোঁট পাকিয়ে আছে সেটা ভুলে গেলে?”
প্রণতি বললেন, “ঝামেলাটা তো তোমার দাদা নেমন্তন্ন করে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। আমি বলেছিলাম ঝামেলাটা আনতে?”
জীবেন চারদিকে সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন, “চুপ করো। বেশি জোরে কথা বোলো না। সোমার সঙ্গে কথা বলেছ?”
প্রণতি বললেন, “উনিও তো ঘরে গুমরে গুমরে কেঁদে চলেছেন। পুজো আচ্চার দিন এসব অলুক্ষুনে কাণ্ড চলছে বাড়িতে। আর সহ্য হয় না বাপু। ওদিকে আর-এক কাণ্ড হয়েছে।”
জীবেন বললেন, “কী?”
প্রণতি বললেন, “আমাদের বউমা মিষ্টির ঘরে গিয়ে বসে আছেন।”
জীবেন সচকিত হয়ে বললেন, “সে কী! এ কথা তুমি এতক্ষণ পরে বলছ? এই হল তোমাদের মেয়েমানুষের দোষ। আসল কথা পেটে রেখে যত উলটোপালটা গৌরচন্দ্রিকা করে চলেছ। পিকলুকে আমি পইপই করে বলে দিলাম বউমাকে বলে দিতে, যেন মিষ্টিদের ধারেকাছে না যায় এখন। এর মধ্যে এত কিছু হয়ে গেল? চলো চলো চলো, আগে ওই ঘরে যাই।”
জীবেন তড়িঘড়ি বাড়ির ভিতর ঢুকলেন। সদর থেকে দুজন নেতৃস্থানীয় লোক এসেছেন। সত্যেন বৈঠকখানায় তাঁদের সঙ্গে বসে আছেন। জীবেনকে শশব্যস্ত হয়ে ঘরের ভিতর ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “তুই আবার কোথায় যাচ্ছিস?”
জীবেন দুজনের দিকে তাকিয়ে সত্যেনকে বললেন, “দোতলায়।”
সত্যেন “ওহ” বলে দুজনের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জীবেন ছুটলেন। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে প্রণতিকে বললেন, “পিকলু কোথায়?”
প্রণতি বললেন, “সে তো দেখলাম কিছুক্ষণ আগে পুকুরের দিকে গেল। মাছ ধরবে নাকি!”
জীবেন বিরক্ত গলায় বললেন, “আমার হয়েছে বুড়ো বয়সে যত জ্বালা, কোথায় একটু মায়ের কাছে দু দণ্ড বসব সে খেয়াল আছে?”
প্রণতি নিচু গলায় বললেন, “আরও দাদার ধুতি ধরে চলো, এমন লক্ষ্মণ ভাই দেখিনি বাপু।”
জীবেন কড়া চোখে প্রণতির দিকে তাকালেন। প্রণতি চুপ করে গেলেন।
দরজা ভেজানো ছিল। জীবেন দরজা খুলে দেখলেন মিষ্টি, পিকলুর বউ আর কল্যাণ বসে আছে। প্রণতি হাসিমুখে বললেন, “এ কী বউমা, ভোগের ওখানে তোমাকে দরকার আর তুমি এখানে বসে আছ?”
পিকলুর বউ তনয়া হাসিমুখে বলল, “আমি একটু মিষ্টির কাছে এসে বসেছিলাম।”
জীবেন কল্যাণের দিকে তাকালেন। বললেন, “তোমাদের গাড়ি দুপুরে বলা হয়েছে। দুটোর সময় রওনা দিলে ঠিক আছে?”
তনয়া অবাক গলায় বলল, “সে কী! মিষ্টি এই অবস্থায় যাবে কী করে?”
জীবেন প্রণতির দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “না মানে ওরাই তো যেতে চেয়েছিল।”
তনয়া একবার চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়ে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলল, “না না, আজকে তো কিছুতেই ওদের নিয়ে যাওয়া যাবে না। পিসেমশাই, কী করে যাবেন বলুন তো?”
তনয়া কল্যাণের দিকে তাকাল। কল্যাণ হাসার চেষ্টা করলেন, “সে ব্যবস্থা করা যাবে।”
তনয়া বলল, “না না, বাবা আপনি ক্যানসেল করে দিন। ওরা অন্তত দুদিন থাকুক, মা আপনি বাবাকে বোঝান না।”
প্রণতি কী বলবেন বুঝতে না পেরে জীবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সেই তো, আমি তো সেটাই…”
জীবেন থমথমে মুখে একবার তনয়ার দিকে, আর-একবার প্রণতির দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তনয়া উঠল, “চলুন মা, ভোগের ওখানে যাই।”
প্রণতি চন্দ্রিমার দিকে তাকালেন। মেয়ে মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছে।
১৪
শম্ভুর ঘুম ভেঙেছে সকাল নটায়। একটা লোম ওঠা কম্বলের ওপর শুয়েছিল। শেষরাতের দিকে ঘুম এসেছে।
একই সেলে পাশের গ্রামের ঘেঁটুও আছে। ঘুম থেকে উঠে শম্ভু দেখল ঘেঁটু তার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। শম্ভু বলল, “কী হল, ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
ঘেঁটু বিড়ি খাচ্ছিল। একটা সুখটান দিয়ে বলল, “কত পাপ করলাম তার হিসেব করছি। নইলে পুজো আচ্চার দিনে এরকম জেলে পচতে হয়?”
শম্ভু বলল, “বিড়ি দে একটা।”
ঘেঁটু বলল, “নেই আর। ওই কনস্টেবল দাদার থেকে একটাই ম্যানেজ করতে পেরেছি। আমি একটু টেনে নি, তারপর দিচ্ছি। নইলে গুরু তোমার যা শরীর, একটান দিলেই বিড়ি শেষ হয়ে যাবে।”
শম্ভু তেজ দেখাল, “লাগবে না তোর বিড়ি। ও কাকা, কে আছ?”
বিপিন কনস্টেবল বিরক্ত গলায় এসে বলল, “কী হয়েছে?”
শম্ভু বলল, “একটা বিড়ি দাও তো।”
বিপিন পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে শম্ভুর দিকে ছুড়ে মারল। শম্ভু প্যাকেটটা ক্যাচ নিয়ে একটা বিড়ি বের করে ধরাল। ঘেঁটু বলল, “এইজন্য বড়ো গাছে নৌকো বাঁধতে হয়। আমাকেও দিয়ো একটা গুরু।”
শম্ভু অবহেলাভরে বিড়ির প্যাকেটটা ঘেঁটুর দিকে ছুড়ে মারল। ঘেঁটু বলল, “দ্যাখো না গুরু একটু চা পাওয়া যায় নাকি। সকাল থেকে মনটা খুব চা চা করছে।”
বিপিন কথাটা শুনতে পেয়ে একটা খিস্তি মেরে বলল, “বেয়াইবাড়ি এসেছিস তো! এরপর বলবি একটা মেয়েছেলে জোগাড় করে দাও।”
শম্ভু খুব হাসল বিপিনের কথা শুনে। বলল, “মালটা ব্লাউজ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। শুয়ার।”
ঘেঁটুও হাসল। বলল, “মেয়েছেলের খপ্পরে পড়লে যা হয়। কান খেয়ে নিল মাগি কাল সকাল থেকে। কী করব বলো?”
শম্ভু বলল, “সব মাগি এক। দাও দাও দাও দাও। না দিলে ঝাঁপ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়বে। কী কাকা, তোমার বউ চায় না?”
বিপিন খইনি ডলছিল। শম্ভুর কথা শুনে বলল, “আমি বাইরে গেলাম। এসব কথা বলছি বড়োবাবু জানতে পারলে আমার পেছনে রুল ভরে দেবে।”
শম্ভু বলল, “আরে কিচ্ছু হবে না, তুমি দাঁড়াও। আমি আছি তো।”
বিপিন শুনল না। বেরিয়ে গেল।
ঘেঁটু গলায় এক্সট্রা এফোর্ট দিল, “দ্যাখো না ভাই, যদি সত্যেনদা আমাকেও নেন।”
শম্ভু বলল, “দাঁড়া আগে হেগে নি।”
ঘেঁটু বলল, “জল কম আছে। বালতির জল শেষ করে দিয়ো না।”
শম্ভু বিরক্ত মুখে বলল, “এইজন্য হাজত পোষায় না মাইরি। আমার আবার মাঠে না হাগলে হয় না।”
ঘেঁটু খুশি হয়ে বলল, “আমারও। মেয়েছেলেটার জন্য যত ঝামেলা হয়ে গেল।”
শম্ভু বলল, “তোর বউ?”
ঘেঁটু বলল, “মেয়েছেলে। ওই… তুমি বললে চিনবে না।”
শম্ভু বলল, “বউদি?”
ঘেঁটু মন দিয়ে বিড়ি টানতে লাগল।
শম্ভু হাজতের বাথরুমে ঢুকেই বেরিয়ে এল, “ঈশ, বাঁড়া জল দিসনি?”
ঘেঁটু বলল, “বললাম না জল নেই।”
শম্ভু নাক টিপে ভেতরে ঢুকল। ঘেঁটু ফিসফিস করে বলল, “জমিদার এয়েচেন। হাজতে ওঁর ফাইভস্টারের মতো হাগতে হবে।”
খানিকক্ষণ পরে শম্ভু বেরোল।
বলল, “বউটা যে কখন আসবে।”
ঘেঁটু বলল, “তোমার বউ আসবে নাকি?”
শম্ভু বলল, “এর আগে যখন এসেছিলাম তখন এসেছিল তো।”
শম্ভু চেঁচাতে লাগল, “ও কাকা, শোনো না।”
তাদের অবাক করে নির্মলবাবু এলেন। বললেন, “কী ব্যাপার শম্ভু, কিছু বলবে?”
শম্ভু বড়োবাবুকে দেখে একটু সামলিয়ে বলল, “স্যার, বলছি আমার বউকে একটু খবর দেওয়া যাবে?”
নির্মলবাবু বললেন, “আচ্ছা, আমি সত্যেনবাবুকে বলে দিচ্ছি।”
শম্ভু খুশি হয়ে বলল, “খুব ভালো হয় স্যার, আমাকে কবে ছাড়বে স্যার?”
নির্মলবাবু হাসিমুখে বললেন, “শিগগিরি। চিন্তা কোরো না, কাল যা যা বললাম মনে আছে তো?”
শম্ভু বলল, “হ্যাঁ স্যার। বাবু আছেন যখন আমি জানি তো কোনও চিন্তা নেই। বাবু বললে বাসের সামনে গলা দিয়ে দেব।”
নির্মল বললেন, “আমরা একটা চেষ্টা চালাচ্ছি। সেরকম হলে আজ বিকেলেই তোমাকে ছেড়ে দিতে পারে।”
শম্ভু খুশি হয়ে বলল, “তাহলে তো ভালো হয় স্যার। বুঝতেই পারেন পুজো আচ্চার দিন।”
ঘেঁটু বলে উঠল, “স্যার আমাকেও ছেড়ে দিন না স্যার। আমিও সত্যেনবাবুকে ভোট দি।”
নির্মল কয়েক সেকেন্ড ঘেঁটুর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
শম্ভু বসল।
ঘেঁটু শম্ভুর পা টিপে দিতে লাগল।
শম্ভু গম্ভীর মুখে বিড়ি টানতে লাগল।
১৫
এলাকার দুই নেতা এসেছেন। তাঁদের খেতে দেওয়া হয়েছে। লুচি, ছোলার ডাল, পায়েস, তিনরকম মিষ্টি। সত্যেন নিজে তদারকি করছিলেন।
জীবেনকে দোতলা থেকে নেমে আসতে দেখে সত্যেন বললেন, “কি রে, কী হল?”
জীবেন চোখের ইশারায় সত্যেনকে ডাকলেন। সত্যেন দেবুকে ডেকে গেস্টদের দায়িত্ব দিয়ে জীবেনের কাছে গেলেন, “কি রে, কী হল? উপরে গেলি কেন তখন হঠাৎ?”
জীবেনের শ্বাস জোরে পড়ছিল। বললেন, “একটা প্রবলেম হয়ে গেছে।”
সত্যেন বললেন, “কী প্রবলেম?”
জীবেন বললেন, “বউমা ওদের যেতে বারণ করছে।”
সত্যেন অবাক হয়ে বললেন, “মানে?”
জীবেন সংক্ষেপে বললেন, সত্যেন কয়েক সেকেন্ড বিস্মিত হয়ে জীবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এত সাহস পায় কী করে?”
জীবেন মাথা নিচু করলেন। সত্যেন বললেন, “পিকলু কোথায়?”
জীবেন বললেন, “মনে হয় পুকুরে গেছে।”
সত্যেন বললেন, “চল।”
দুজনে বেরোলেন বাড়ি থেকে। একের পর এক গ্রামের লোক এসে ভিড় জমাচ্ছিল ঠাকুরদালানে, সত্যেন সেদিকে তাকালেন না। অন্যান্য দিন বাইরে থেকে দেখলে তাঁর রাগ বোঝা যায় না, এবারে তিনি যে বিচলিত তা বোঝা যাচ্ছিল।
সান্যালবাড়ির পেছনে বিরাট পুকুর। মাছ চাষ হয়। পিকলু চেঞ্জ না করেই মাছ ধরতে চলে এসেছে। সত্যেন আর জীবেন পৌঁছে দেখলেন পিকলু নির্লিপ্তভাবে ফাতনার দিকে তাকিয়ে আছে।
সত্যেন বললেন, “পিকলু।”
পিকলু বলল, “বলো জেঠু। তখন তোমার সঙ্গে দেখা করা হয়নি, ব্যস্ত ছিলে দেখলাম।”
সত্যেন বললেন, “তোকে জীবেন বলেনি তনয়াকে বলার জন্য যে, মিষ্টিদের ধারেকাছে যেন ও না ঘেঁষে?”
পিকলু সত্যেনের দিকে তাকাল, “বলেছে।”
সত্যেন বললেন, “তাহলে তনয়া ওদের ঘরে কী করছিল? তুই কি জানিস তনয়া ওদের যাওয়াটা পর্যন্ত পিছিয়ে দিয়েছে?”
পিকলু বলল, “আমার সঙ্গে ওর অনেকদিন হল কথা হয় না জেঠু। তবু বাবা যখন বলেছিল তার পরে আমি ওকে হোয়াটসঅ্যাপে সেটা জানিয়ে ছিলাম। ও মেসেজ সিন অবধি করেছিল। আমি ভেবেছিলাম বুঝেছে।”
সত্যেন বললেন, “কী সব বলছিস, সিন করেছে-টরেছে এসব কী?”
পিকলু বলল, “মানে দেখেছিল।”
সত্যেন বললেন, “তোরা দুজনে কথা বলিস না? কেন?”
পিকলু একটু অস্বস্তির সঙ্গে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেসব পার্সোনাল কথা।”
সত্যেন জীবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পার্সোনাল ব্যাপার মানে কী? পিকলুর আবার কী পার্সোনাল ব্যাপার থাকতে পারে?”
জীবেন সত্যেনের হাত ধরে শান্ত করতে চাইলেন, “আচ্ছা, দাঁড়া, আমি দেখছি, পিকলু।”
পিকলু বলল, “বলো।”
জীবেন বললেন, “সেরকম বুঝলে তোর তনয়াকে এখানে আনাই উচিত হয়নি। তুই বুঝতে পারছিস তো ব্যাপারটার গুরুত্ব?”
পিকলু বলল, “কী করেছে তনয়া?”
জীবেন বললেন, “মিষ্টিদের থাকার ব্যাপারে জোর করেছে। অথচ ওরা আজকে চলে যেত। ঝামেলাটাও মিটে যেত। ওরা আমাদের বাড়িতে থাকা মানেই তো চোরা টেনশন কাজ করবে দাদার মনে।”
পিকলু বলল, “থাকলেই বা কী সমস্যা? বরং ওরা চলে গেলে তো ব্যাপারটা আর-একটু দৃষ্টিকটু হত, তাই না?”
সত্যেন পিকলুর চোখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, “তোমরা বড়ো হয়েছ, ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছ, বড়োদের সিদ্ধান্তের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়া শিখেছ ভালো কথা, কিন্তু মনে রেখো, ভবিষ্যতে এর ফলে যদি কোনও সমস্যা তৈরি হয়, তার সমস্ত দায় তোমাকে নিতে হবে।”
জীবেন সত্যেনকে বললেন, “আমি কি একবার কল্যাণকে বলব চলে যাওয়ার কথা?”
সত্যেন হাত তুললেন, “না। আর কাউকে কিছু বলতে হবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে দ্বিতীয়বার আমি এরকম কিছু বরদাস্ত করব না। সেটা মনে রাখবি।”
সত্যেন দাঁড়ালেন না। জীবেন পিকলুকে বললেন, “দাদা রেগে গেছে বুঝতে পারলি?”
পিকলু কিছু বলল না। জীবেন বললেন, “বউমার সঙ্গে কথা বলিস না কেন?”
পিকলু চোখ মুখ শক্ত করে বলল, “বললাম তো, ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
জীবেন অবাক চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ছেলে কবে বড়ো হয়ে গেছে খেয়ালই করেননি!