মানুষটা যখন ভালোবাসে তখন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। যখন মারতে শুরু করে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফ্যালে। মারতে থাকে। বোঝে না যে মেয়েটাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল সে আর পাঁচটা ব্যাটাছেলের মতো না যাদের সঙ্গে ও গায়ের জোর ফলায়। মুখ ছাড়া আর কোনও অস্ত্রও নেই তার।
প্রথম যেদিন হাতে মুখে রক্ত নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল সেদিন তাদের বিয়ের পনেরো দিন পেরিয়েছে। অবাক হয়ে শম্ভুর দিকে তাকিয়ে ছিল সে। তাকে তো বলেছিল শম্ভু ভাগচাষি। সে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “এত রক্ত কীসের?”
শম্ভু হেসে বলেছিল, “বাবুর বাড়িতে মুরগি কেটেছি। রক্ত লেগে গেছে।”
রম্পা সরল মনে বিশ্বাস করে নিয়েছিল। দ্বিতীয়বারে তার কেন জানে না মনে হয়েছিল এ রক্ত মুরগির রক্ত হতে পারে না। সারারাত জেগে বসেছিল সে। অদ্ভুত একটা ভয় জাঁকিয়ে বসেছিল তার মনে। কার সঙ্গে বিয়ে হল তার?
বিয়ের তিনমাসের মাথায় একদিন মদ গিলে এসে শম্ভু গড়গড় করে বলে ফেলেছিল তাকে বিয়ের পনেরো দিনের মাথায় সে কী করেছিল। রম্পা কেঁদে উঠেছিল। কান্না শুনে শম্ভু সে কী মার তাকে! সেই প্রথম গায়ে হাত তোলা। তারপর তো কারণে অকারণে লেগেই আছে।
অথচ এমনটা হওয়ার ছিল না। তার বাবা এত ভালো কীর্তন শিল্পী। মানুষ খুঁজে খুঁজে এসে তাকে নিয়ে যেত। গ্রাম থেকে যখন সান্যালবাড়িতে কীর্তনের জন্য ডাক এল, বাবা তাকেও নিয়ে এসেছিল। বড়ো বায়না ছিল। রম্পা সবে গান শুরু করেছে। কীর্তনের শেষে শম্ভুর সঙ্গে আলাপ। কালো শরীরটার মধ্যে কত মায়া! রম্পা লজ্জা পেত। একদিন গাঁ খুঁজে হাজির ছেলেটা। তার মাকে নিজের মা পাতিয়ে কত গল্প। বাপ আসতেই মেয়ের জন্য বিয়ের কথা পেড়ে ফেলল রম্পার মা। রম্পার বাবার ইচ্ছা ছিল না। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন মেয়ে হাতের বাইরে চলে গেছে। অগত্যা মেনে নিলেন।
নিতান্ত অনাড়ম্বর বিয়ে। আশেপাশের একশো লোকও খায়নি।
কিন্তু বিয়ের পর আদর ছিল। ভালোবাসা ছিল। প্রথম মার খাবার পর রম্পা বুঝে উঠতে পারেনি কী করবে। শম্ভু বেরিয়ে যাবার পর হা হা করে কেঁদেছে। ভাবেনি বাড়ি যাবার কথা। মা কানের কাছে বারবার বলে দিয়েছে বিয়ের পর মেয়েদের কোনও বাড়ি হয় না। মন্ত্রের মতো মনে প্রবেশ করে গেছে কথাগুলো। হয় না, হয় না, হয় না। বিয়ের পর মেয়েদের কোনও বাড়ি হয় না।
রম্পা উঠল। জ্বর গায়ে শম্ভুর ফেলে যাওয়া থালাবাসন পরিষ্কার করল। সেই সকালে রান্না করেছিল। ভেবেছিল শম্ভুর খাওয়ার পর খাবে। খাওয়াটাও হল না।
রম্পা খাটে এসে শুল। মাটির ঘর। রম্পার সংসার। ঘরের বাইরে রান্না হয়। জ্বরের সঙ্গে অস্বাভাবিক মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। এরকম মাথাব্যথা হলে রম্পা ছটফট করতে থাকে। আজকে ছটফটানি হচ্ছিল না। সে মড়ার মতো শুয়ে থাকল।
কিছুক্ষণ পর রমেনের বউ এল, “কি রে, ঘুমাস নাকি?”
দরজা খোলাই ছিল। বনা ঘরে ঢুকে গেল। রম্পা বলল, “মাথা ধরেছে রে খুব।”
বনা হেসে হেসে বলল, “শম্ভুরে তো ধরসে। শুনছস তো?”
রম্পা উত্তর দিল না। শুয়ে থাকল। মাথাব্যথার সময় কোনও কথা শুনতে ইচ্ছা করে না।
৮
রাত সাড়ে এগারোটা। কল্যাণ এবং সোমা পৌঁছলেন। সত্যেন এবং জীবেন বসে ছিলেন বৈঠকখানায়।
সোমার হাঁটতে কষ্ট হয় পায়ের জন্য। কল্যাণ সোমাকে ধরে বসালেন।
সোমা বিহ্বল চোখে দাদার দিকে তাকালেন, “জামাই?”
সত্যেন গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন।
সোমা মুখে আঁচল চাপা দিলেন।
কল্যাণ বললেন, “বডি কোথায়?”
সত্যেন চমকে তাকালেন কল্যাণের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পরে সামলে বললেন, “পোস্টমর্টেম চলছে।”
সোমা সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছেন। চোখ মুখ ফুলে গেছে। বললেন, “মিষ্টি কোথায়? ওর কিছু হয়নি তো?”
প্রণতি এলেন। সোমা প্রণতিকে দেখে কেঁদে উঠলেন, “এই কদিন আগে মেয়েটার বিয়ে হল।”
সত্যেন উঠলেন, “তোমরা খেয়ে নাও। আমাদের সকালে পুজোর কাজ আছে।”
কল্যাণ মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। বললেন, “মিঠুনের বাড়ির লোককে কিছুক্ষণ আগে খবর দিয়েছি। ওঁরা রওনা দিয়েছেন। কাল সকালে এসে পড়বেন।”
সত্যেনের মুখ ফ্যাকাশে হল, “বেশ তো। এত বড়ো বাড়ি। কোথাও না কোথাও জায়গা হয়ে যাবে।”
জীবেন একটু গলা খাঁকরে বললেন, “দাদা, আমাদের ফার্ম হাউসটা ফাঁকা পড়ে আছে। ওঁরা বরং ওখানে থাকুন। পুজোর বাড়িতে…।”
কল্যাণ স্থির চোখে জীবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরাও তাহলে ওখানেই থাকব। আজ থাকা যাবে?”
প্রণতি ব্যস্ত হয়ে বললেন, “না না, আজ কী করে হবে, ওখানে আজ থাকা যাবে না। কাল পরিষ্কার করা হলে নাহয় দেখা যাবে।”
সত্যেন সোমার দিকে তাকালেন। বললেন, “খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নে। কী আর করবি, যা হবার তা তো হয়েই গেছে।”
কল্যাণ বললেন, “পুলিশ কিছু করতে পারল?”
সত্যেন বললেন, “থানা খুব ভালো কাজ করেছে। কালপ্রিট বিকেলেই অ্যারেস্ট হয়েছে।”
কল্যাণ বললেন, “কালপ্রিট কে কী করে জানলে? মব লিঞ্চিং শুনলাম।”
সত্যেন বললেন, “গ্রামে একটা পাতা নড়লেও আমার কাছে খবর আসে।”
কল্যাণ কয়েক সেকেন্ড সত্যেনের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিষ্টির সঙ্গে দেখা করব। কোথায় ও?”
প্রণতি ইতস্তত করে বললেন, “ওকে ঘুমের ওষুধ দিতে হয়েছে। দোতলার কোনার ঘরে আছে।”