প্রণতি এসে তাঁকে ডাকলেন, “মিষ্টি বমি করছে শুধু। চ্যাঁচামেচি করছে।”
জীবেন সান্যাল ভুরু কুঁচকে বললেন, “বড়দা ফিরেছে?”
প্রণতি বললেন, “না। বললেন, থানায় যাবেন। ফিরতে দেরি হবে।”
জীবেন বললেন, “চলো আমি যাচ্ছি।”
ঠাকুরদালান বাড়ির বাইরে। চন্দ্রিমাকে দোতলার কোনার ঘরে রাখা হয়েছে। প্রথমে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিল। এবার বমি শুরু করেছে।
প্রণতি ভয়ার্ত গলায় বললেন, “এভাবে বমি করলে কিন্তু ডাক্তারবাবুকে খবর দিতে হবে।”
জীবেনবাবু বললেন, “আজকে দেওয়া যাবে না। মেয়েকে সামলাতে হবে আগে।”
প্রণতি বললেন, “মেয়ে মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।”
জীবেনবাবু বললেন, “চলো দেখছি।”
দরজা বন্ধ ছিল। জীবেনবাবু দরজা ধাক্কালেন। দুজন মেয়ে চন্দ্রিমাকে সামলাচ্ছিল। কেউ একজন দরজা খুলে দিল।
জীবেনবাবু গলায় আদর ঢেলে বললেন, “কি রে মা, কেমন আছিস?”
চন্দ্রিমা চেঁচিয়ে উঠল, “ছোটোমামা, ওরা … ওরা…”
কথা শেষ করতে পারছিল না চন্দ্রিমা। জীবেনবাবু চন্দ্রিমার পাশে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর মা।”
চন্দ্রিমা বমি করার চেষ্টা করল। বেশ খানিকটা জল ফেলল মেঝের ওপর। জীবেনবাবু স্মিত মুখে চন্দ্রিমার মাথায় অক্লান্ত হাত বুলিয়ে যেতে লাগলেন। প্রণতি মেয়ে দুটোকে বললেন, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখ দেখছিস কী? মেঝেটা কে পরিষ্কার করবে?”
মেয়ে দুটো তড়িঘড়ি মেঝে মুছতে শুরু করল। জীবেনবাবু বললেন, “মার সঙ্গে কথা বলবি মিষ্টি?”
চন্দ্রিমা হাঁফাচ্ছিল। কিছু বলতে পারছিল না। জীবেনবাবু সোমাকে ফোন করলেন, দুটো রিং হতেই সোমা ধরল, “আমরা আসছি। ও ঠিক আছে তো?”
জীবেনবাবু বললেন, “কথা বল।”
ফোনটা চন্দ্রিমাকে দিলেন জীবেনবাবু। চন্দ্রিমা ফোনটা নিয়ে দেওয়ালে ছুড়ে মারল। একটা শব্দ হয়ে মোবাইলটা মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল। জীবেনবাবু সেদিকে তাকিয়ে প্রণতিকে বললেন, “ডাক্তার সাঁতরাকে খবর দাও। ঘুমের ওষুধ না দিলে মেয়েটাকে শান্ত করা যাবে না।”
প্রণতি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। একটা মেয়ে মোবাইলটা তুলে জীবেনবাবুর হাতে দিল। একটা দিক ভেঙে বেরিয়ে গেছে। ফোনটা গেল। জীবেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
চন্দ্রিমা বলল, “বড়োমামা ওকে মেরে ফেলল। মেরে ফেলল। মেরে ফেলল।”
জীবেনবাবু মেয়ে দুটোকে ইশারায় চন্দ্রিমাকে ধরতে বলে উঠলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে নিচের ঘরে এসে ল্যান্ডলাইন থেকে দাদাকে ফোন করলেন। রিং হতেই ফোন ধরলেন সত্যেনবাবু, “কে, জীবু?”
জীবেন বললেন, “হ্যাঁ। মিষ্টিকে সামলে রাখা যাচ্ছে না। ডাক্তার সাঁতরাকে ঘুমের ওষুধ দিতে ডাকলাম।”
“ভালো করেছিস। সাঁতরাকে বলবি গ্রামের একটা ছাগলকে ওদের গাড়ি মারায় গ্রামের কয়েকজন না বুঝে ওর হাজব্যান্ডকে মারধোর করেছিল। কেসটা সেভাবেই যাবে।”
“মিষ্টি ডাক্তারের সামনে উলটোপালটা বললে?”
সত্যেন বিরক্ত হলেন, “তাহলে তুই আছিস কী করতে? ডাক্তারকে আগে থেকেই বুঝিয়ে দিবি যে চোখের সামনে ওসব দেখে মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
“আচ্ছা। ওদিকে কী খবর?”
“চিন্তা নেই। মিটিয়ে এসে বলছি। তুই ওদিকটা সামলা। সোমা আর কল্যাণও আসছে।”
“শুনলাম।”
“চিন্তার কোনও কারণ নেই। কালকের মধ্যে সব ঠিক করে দেব। রাখ এখন।”
“আচ্ছা।”
জীবেন ফোন রাখলেন।
মাথার ওপর এমন দাদা থাকলে কোনও চাপকেই আর চাপ বলে মনে হয় না।
৬
সত্যেন ওসির বাড়ি এসেছেন। ছোটো ছোটো ঘর। ওসি নির্মল চৌধুরী একা থাকেন। ট্রান্সফারের চাকরি আর ছেলের স্কুলের ঝামেলা আছে বলে পরিবারকে নিয়ে বয়ে বেড়ান না।
থানায় সব কথা বলা যাবে না বলে নির্মলবাবু ওঁর বাড়িতে আসতে বলেছেন।
ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছেন সত্যেনবাবু। নির্মলবাবু কয়েকবার থানায় ফোন করে এসে বললেন, “ঝামেলা নেই স্যার। কেসটা দাঁড়িয়ে যাবে।”
সত্যেনবাবু বললেন, “বুঝতে পারছেন তো? আমার ভাগনিজামাই। মেরেছে গ্রামের লোক। কোনওরকম যেন হালকা না দেওয়া হয়।”
নির্মলবাবু হাসলেন, “বুঝেছি স্যার।”
সত্যেনবাবু বললেন, “শম্ভু কোথায়?”
নির্মলবাবু বললেন, “লক আপে।”
সত্যেনবাবু বললেন, “কেস কবে কোর্টে উঠবে?”
নির্মলবাবু বললেন, “পুজোর পরেই। ততদিন ও এখানেই থাকবে।”
সত্যেনবাবু বললেন, “রাখুন। আপনাকে পুজোর নেমন্তন্ন করতে এলাম। কাল থেকে আমার বাড়িতেই সেবা করবেন।”
নির্মলবাবু বললেন, “তা স্যার আবার বলতে? সেভাবে বলতে গেলে আপনিই তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। নইলে এই অজ গাঁয়ে কে এত করত?”
সত্যেনবাবু বললেন, “আপনার মাইনেপত্র ব্যাংক থেকে সব ঠিকঠাক আসছে তো?”
নির্মলবাবু মাথা নাড়লেন, “তা স্যার ঠিক আছে।”
সত্যেন একটা ব্যাগ বের করে নির্মলবাবুর হাতে দিলেন, “আমি চাই আমার ভাগনিজামাইয়ের কেসের খুনিকে যত তাড়াতাড়ি ফাঁসির কাঠে দেখতে। এর জন্য যা যা করার দরকার আপনি করবেন।”
নির্মল তাড়াতাড়ি ব্যাগটা নিলেন। কী করবেন স্থির করতে না পেরে ফ্রিজটা খুলে ফ্রিজে ব্যাগটা রেখে দিলেন। সত্যেন সেটা দেখলেন। তাঁর ঠোঁটের কোনায় একটা বিদ্রুপের হাসি এসেই মিলিয়ে গেল। নির্মল বললেন, “স্যার চা খাবেন?”
সত্যেন বললেন, “বানাবেন?”
নির্মল বললেন, “হ্যাঁ।”
সত্যেন বললেন, “বানান। আজ দিনটা বড়ো ব্যস্ত গেল।”
নির্মল চা বসালেন। সত্যেন নির্মলের ঘর দেখতে লাগলেন। আর পাঁচটা গৃহস্থর ঘর যেমন হয় তেমনই। শুধু দরজার ওপরে রাখা খাকি উর্দিটা জানান দিচ্ছে নির্মলবাবুর পরিচয়।
সত্যেন বললেন, “আপনার ছেলে কোন ক্লাসে পড়ে?”
নির্মল বললেন, “ক্লাস সেভেন স্যার। স্ট্যান্ড করে।”
সত্যেন খুশি হলেন, “বাহ। খুব ভালো। আপনি তো এখানেই থাকেন। ছেলের মাকে বলবেন ছেলের ওপর নজর রাখতে। এই প্রেম-ট্রেম খুব খারাপ। পরিবারের মানসম্মান মাটিতে মিশিয়ে দেয়।”
নির্মল বললেন, “তা স্যার ওর মা খুব কড়া। সবে তো ক্লাস সেভেন।”
সত্যেন বললেন, “তা হোক না। এখন থেকেই নজর রাখবেন। সবেধন নীলমণি।”
নির্মল চায়ের জল বসিয়ে এসে বসলেন। বললেন, “আমাদের চাকরি তো দেখতেই পাচ্ছেন স্যার। পুজো বলে কিছু নেই আমাদের। সবসময় ডিউটি। ছেলেও বাপকে পায় না। যতটা ওর মা চেষ্টা করে আর কি।”
সত্যেন বললেন, “তা ঠিক।”
নির্মল বললেন, “আচ্ছা স্যার, শম্ভু বিশ্বস্ত তো?”
সত্যেন বললেন, “কুকুর দেখেছেন? ওয়েল ট্রেইন্ড কুকুর?”
নির্মল বললেন, “হ্যাঁ স্যার। কেন বলুন তো?”
সত্যেন হাসলেন, “এরা সব আমার কুকুরের মতো। কাল যদি বলি তোর বউকে আমার বিছানায়…”
সত্যেন চুপ করে গেলেন।
নির্মল বললেন, “বুঝেছি বুঝেছি স্যার। চিনি ক চামচ স্যার?”
সত্যেন বললেন, “লাগবে না। রক্তে শর্করা যথেষ্ট পরিমাণে আছে। আলাদা করে আর দিতে হবে না। যেদিন ভাগনির বিয়ে হয়েছিল, সেদিন থেকে আমার…”
নির্মল চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন, “দেখুন স্যার ঠিক আছে নাকি।”
সত্যেন চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “বাহ ওসি সাহেব, আপনার হাত অসাধারণ। মাঝে মাঝে আপনার কাছে এসে চা খেয়ে যাব।”
নির্মল বললেন, “অবশ্যই স্যার। আমি আপনি এলে খুবই খুশি হব।”
সত্যেন আর কথা বললেন না। মন দিয়ে চা খেলেন।
চা শেষ করে কাপ নিয়ে উঠলেন। নির্মল বললেন, “না না স্যার আমি ধুয়ে নেব।”
সত্যেন বললেন, “কোনও দরকার নেই। নিজের কাজ নিজেকে করতে দিন।”
বেসিনে মন দিয়ে নিজের চায়ের কাপ ধুলেন সত্যেন। তারপর কাপটা গুছিয়ে রেখে বললেন, “আমি এলাম ওসি সাহেব। কোনও সমস্যা হলে ফোন করবেন।”
নির্মল চৌধুরী সত্যেনকে গাড়ি অবধি তুলে দিয়ে ঘরে এলেন।
ফ্রিজ থেকে প্যাকেটটা বের করলেন। প্যাকেটটা খুলতে খুলতে বললেন, “শালা…”
৭
রম্পার জ্বর এসেছে। শম্ভু যখন মেরে চলে যায়, রম্পার জ্বর আসে।