ভালো থাকিস।
তোর ঝুম।”
৫৯
দ্বিপ্রহর।
শীত পড়ছে গ্রামে।
ব্রাহ্মণ হরি মিশ্র ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে ক্লান্ত শরীরে মন্দিরে বসে আছেন।
রাধা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে শরীর ভঙ্গুর হয়েছে। নিজেই বুঝতে পারছেন এ জীবন আর বেশি দিন নেই। হরির স্ত্রী কাত্যায়নী মন্দিরে এসে বললেন, “খাবেন না?”
হরি বললেন, “ইচ্ছে করচেনে বামনী, তুমি খেয়ে নাও।”
কাত্যায়নী বললেন, “আপনি না খেলে আমি খেতে পারি? আসুন। খেয়ে নিন।”
হরি উঠলেন না। বিমর্ষ মুখে বসে রইলেন।
কাত্যায়নী বললেন, “কৈবর্তদের কে একজন কাশী থেকে এয়েচে, সংবাদ দিল বিশ্বম্ভর আসতে পারে।”
হরি বললেন, “আসুক। ওকেই এই মন্দিরের দায়িত্ব নিতে হবে।”
কাত্যায়নী খানিকটা শিউরে উঠে বললেন, “এ কথা কেন বলচেন আপনি?”
হরি ম্লান হেসে বললেন, “সময় ফুরিয়েচে বামনী। আমার আয়ু শেষ হয়ে এসেচে।”
কাত্যায়নী মুখে আঁচল চাপা দিলেন, “এমন অশুভ কথা বলতে নেই। বিশ্বনাথ আমাদের মরণ বাঁচনের ভার নিয়েচেন। তিনি আমাদের দেখবেন, আপনি চিন্তা করবেন না।”
তাঁদের চমকে দিয়ে দুজন অশ্বারোহী মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছল। হরি সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাত্যায়নী ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ালেন।
হরি বললেন, “কী চাই?”
অশ্বারোহী অত্যন্ত উদ্ধতভাবে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল। হরি কাত্যায়নীকে বললেন, “তুমি ঘরে যাও বামনী।”
কাত্যায়নী আতঙ্কিত সুরে বললেন, “গ্রামের লোকেদের ডেকে আনব?”
হরি বললেন, “তুমি ঘরে যাও। কাউকে ডাকতে হবেনে।”
কাত্যায়নী সভয়ে কুটিরে রওনা হলেন।
অশ্বারোহী দুজন নিজেদের মধ্যে পুস্তু ভাষায় আলাপ করছিল বলে হরি মিশ্র কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি গঙ্গার জল ছিটিয়ে দিলেন মন্দিরের সামনে, যাতে জাত না জানা ওই দুজন বুঝতে পারে মন্দিরের কাছে তাদের আসতে বারণ করা হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরেই বেশ কয়েকজন সৈনিক পরিবেষ্টিত হয়ে একটা পালকি মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল। হরি মিশ্র বিস্ফারিত চোখে দেখলেন রাধা পালকি থেকে নামল। নিজের মেয়েকেই চিনতে পারলেন না তিনি। কোথায় সেই গ্রাম্য রূপ আর কোথায় এই সুললিত সাজ। রাধার শিক্ষক ব্রাহ্মণকে বাদশা রাধার সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। তিনি হরি মিশ্রকে বললেন, “আপনার মেয়েকে বাদশা আপনার কাছেই ফেরত পাঠিয়েছেন।”
গ্রামের লোকজন খবর পেয়ে চলে এসেছিল। তারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে রাধাকে দেখছিল। কিছু বলতে পারছিল না সৈনিকদের দেখে। মোগলরাজের সৈনিক তারা আগে দেখেনি, কিন্তু তাদের অস্ত্রবর্মপরিবৃত চেহারা ভয় ধরাবার মতোই।
রাধা হরির দিকে ছুটে আসতে গেলে হরি হাত তুলে বারণ করে বললেন, “ওখানেই দাঁড়া। বাদশা পাঠিয়েছেন মানে?”
বাঙালি ব্রাহ্মণ জানালেন রাধা বাদশার হারেমে সসম্মানে ছিল। তাকে বাদশা ফেরত পাঠিয়েছেন।
হরি মিশ্র শিউরে উঠে কাঁপতে কাঁপতে মন্দিরের ভিতরে গিয়ে বসে বললেন, “ও মেয়ে আমার মরে গেচে। ওকে নিয়ে যাও।”
রাধা মাটিতে বসে কাঁদতে শুরু করল। কাত্যায়নী এসেছিলেন। দূর থেকে রাধাকে দেখে দৌড়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
মা বাপ আর মেয়ে কত কাছে থেকেও তাদের দূরত্ব যেন কয়েক কোটি কিলোমিটারের হয়ে গেল।
হরি মিশ্র বললেন, “ওকে নিয়ে যান। এখানে ওর কোনও জায়গা নেই।”
রাধার দুচোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছিল। সে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেল।
কাত্যায়নীর কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না। কলসি এনে সৈনিকদের একজনকে দিলেন। তারা রাধার মুখে জলের ছিটা দিয়ে রাধার জ্ঞান ফেরাল।
রাধা অসহায় চোখে বাবা-মার দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে পুনরায় পালকিতে গিয়ে বসল।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাদশার সৈনিকরা পালকি নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হরি মিশ্র মন্দিরের চারদিকে গঙ্গাজল দিয়ে শুদ্ধ করে ঘরে যেতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।
গ্রামের বৈদ্য হরির নাড়ি দেখে মাথা নেড়ে বিমর্ষভাবে কাত্যায়নীকে বললেন, “শেষ মা জননী। সব শেষ।”
কাত্যায়নী পাথরের মতো বসে রইলেন।
৬০
গঙ্গার ধারে ওরা দুজন বসে ছিল।
সুশোভন আর আদিত্য।
সুশোভন সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “আমরা একটুও এগোইনি। কিংবা এগিয়ে ছিলাম, আবার পিছিয়ে যাচ্ছি। ধর্ম, ধর্ম, ধর্ম করেই সব শেষ হয়ে যাবে।”
আদিত্য কিছু বলল না। রুমকি ভীষণ কান্নাকাটি করছে। সর্বত্র খোঁজ নেওয়া হয়েছে। ঝুমকির কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সুশোভন বললেন, “মানুষ ভুল করে। প্রায়শ্চিত্তও হয়। কিন্তু মেয়েদের ভুলে মনে হয় কোনও প্রায়শ্চিত্ত হয় না। তোর শ্বশুর খুশি নিশ্চয়ই এখন? তিনি তো বলেই দিয়েছিলেন তেনার মেয়ে মারা গেছে ধরে নিয়েছেন।”
আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “বাদ দে। মানুষ যদি মনুষ্যত্ব ভুলে তার মস্তিস্ককে কুসংস্কার দিয়ে ঢেকে রাখে তখন তার আর কিছু পড়ে থাকে না। মেয়েটা পালিয়ে বেঁচে গেল। থাকলে যে লাঞ্ছনা সহ্য করতে হত, তা কহতব্য না।”
দুজন প্রেমিক প্রেমিকা হেঁটে যাচ্ছিল। সুশোভন দেখে বললেন, “মানুষ প্রেম করার সময় কখনও ভেবে প্রেম করে জাত ধর্ম কী? যারা করে, তারা কি আদৌ প্রেম করে? এরা জানে কী হতে চলেছে?”
আদিত্য বলল, “আমার মনে হয় খুব শিগগিরি আমাদের এই জায়গাগুলোও উত্তরপ্রদেশ বা হরিয়ানা টাইপের হয়ে যাবে। লোকে আবার নতুন করে জাত নিয়ে মারপিট শুরু করবে। অনার কিলিং করবে। এর সপক্ষে বলারও লোক থাকবে। এবং দেখবি, আমার মনে হয় খুব শিগগিরি সতীদাহ প্রথাও হয়তো শুরু হয়ে যাবে। ধর্মরক্ষার্থে সব যখন হচ্ছে, এটা আর বাকি থাকে কেন?”