রুমকি বলল, “আমার আর এসব নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে নেই। কাল আমি ঝুমকিকে বাড়ি নিয়ে যাব, ব্যস।”
আদিত্য বলল, “বেশ তো। তবে আমি আমার আপত্তিটা বলে রাখলাম। এতদিন কিছু বলিনি, কারণ লোকাচার মানাকে আমি কখনোই খারাপ চোখে দেখিনি। এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি। যেটুকু আস্তিকতা ছিল আমার মধ্যে, ঝুমকির ঘটনা তার সবটুকু নষ্ট করে দিয়েছে। মানুষকে বাঁচতে দিচ্ছে না এই নব্য ধার্মিকরা। এসব কী শুরু হয়েছে? একদল বিয়ে করার নামে ধর্মান্তর করবে, আর-একদল তার হাত ধরে টানাটানি করবে, এসব তো মধ্যযুগে হত? এই দুহাজার কুড়িতে আমরা কি আবার পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করলাম নাকি?”
ঝুমকি বলল, “বাবা যা চায় করুক, করে যদি মনে শান্তি পায়, করুক।”
আদিত্য হাসল, “হেরে গেলি দেখলি? সেই সেন্টিমেন্টের কাছেই হেরে গেলি।”
রুমকি বলল, “তোমাকে বললাম তো, আমাদের ফ্যামিলির ব্যাপার আমরাই বুঝে নেব।”
আদিত্য বলল, “এখন যখন ঝামেলা মিটেছে তখন ব্যাপারটা তোমাদের ফ্যামিলির হয়ে যাবে সেটা আমিও বুঝেছিলাম, তবে একটা জিনিস আমি এখন থেকেই তোমাকে বলে রাখলাম, তোমার বাবা যদি আমার সামনে রুমকির ঘর ওয়াপসির ব্যাপারে একটা কথাও বলেন, আমি কিন্তু শুনে আসব না। আমি প্রতিবাদ করব। তাতে তোমার বাবার প্রেশার বাড়লে আমাকে দোষ দেবে না।”
রুমকি থমথমে মুখে আদিত্যর দিকে তাকাল।
৫৮
রাত সাড়ে বারোটা।
রুমকি পাশে চুপ করে শুয়ে আছে। আদিত্য বুঝতে পারছে রুমকি ঘুমায়নি। সে চোখ বন্ধ করল। কারেন্ট এসেছে একটু আগে।
আদিত্যর রিন্টুর মুখটা মনে পড়ছিল। ও কি তার মানে সত্যিই ঝুমকিকে ভালোবেসেছিল? নাকি প্ল্যানটা অনেক আগে থেকেই ছিল? আগে ফাঁসাবে ভেবেছিল, পরে ভালোবেসে ফেলল!
অদ্ভুত মানুষের মন। এই মনের রহস্যের কিনারা করা হয়তো মিস্টার হোমসেরও অসাধ্য।
ঘরে নাইটবালব জ্বলছে। নাইটবালবের সবজেটে আলোয় একটা টিকটিকি দেখা যাচ্ছে। দেওয়ালেই ঘুমাচ্ছে। ঘুমাচ্ছে কি? নাকি শিকার ধরার জন্য বসে আছে? বোঝা যায় না। কে যে শিকারি, আর কে যে ঘুমিয়ে থাকে, কিছুই বোঝা যায় না। রিন্টু শহরের একজন প্রভাবশালী মানুষকে প্রকাশ্যে খুন করেছে। যাবজ্জীবন নিশ্চিত, ফাঁসিও হতে পারে। ওদের মধ্যে অস্ত্র পাওয়া এত সোজা? তারও তো মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেছে টিমলিডারকে গুলি করে উড়িয়ে দিতে, হয়তো রিন্টুর মতো অস্ত্র পেয়ে গেলে করেও ফেলত। আসল কথা তো অ্যাভেলেবিলিটি অফ ওয়েপন। সেটা পাওয়া গেলে অনায়াসে অনেক মানুষই রুবেল শেখ রিন্টু হয়ে যেতে পারত। পায় না বলে। আমেরিকায় কোনও কোনও কলেজ স্কুলে তো প্রায়ই কোনও ছেলে বন্দুক নিয়ে ঢুকে পড়ে একে তাকে মেরে দেয়। পুরোটাই হতাশা থেকে করে। রিন্টু ঝুমকিকে আদৌ ভালোবেসে কাজটা করেছে? নাকি হেরে যাওয়ার মানসিকতা ওকে এতটা হিংস্র করে দিল? সবাই গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার পর যে অসহায়তা আসে, তার থেকেই হয়তো এই কাজটা করে ফেলল সে। আদিত্যর এখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না, এরকম মানুষ সত্যিই আছে যারা শুধুমাত্র ধর্মের কারণে কাউকে বিয়ে করতে পারে। ভাব ভালোবাসার মধ্যে ধর্ম কেন আসবে? কী অদ্ভুত! ভালো লাগছিল না কিছুই। সময় বড়ো দ্রুত পালটে যাচ্ছে। পৃথিবীর সত্যিই গভীরতর অসুখ এখন।
“তুমি বাবার নামে কথাগুলো ঝুমকির সামনে না বললেই ভালো করতে।”
রুমকি হঠাৎ করে বলে উঠল।
আদিত্য শুধু বলল, “হুঁ।”
রুমকি বলল, “ওকে এখন বাড়ি নিয়ে যাওয়া দরকার। ও কি চিরকাল এ বাড়িতে থাকবে?”
আদিত্য বলল, “আমি শুধু বলেছি উলটোপালটা কিছু দেখলে আমি প্রতিবাদ করব। সেটা আমি করব।”
রুমকি বলল, “তুমি বুঝতে পারছ না। আমাদের মতো কনজারভেটিভ ফ্যামিলিতে এটা মেনে নিতে হবে। লোকগুলো অশান্ত হয়ে আছে। দিনের পর দিন এত মানসিক চাপ নিতে হয়েছে। এখন যদি ওরা একটু ভালো থাকতে চায় তাহলে সমস্যা কোথায়? এতদিনের বিশ্বাস কি তুমি একটা বিপ্লব করে ভেঙে দিতে পারবে?”
আদিত্য বলল, “কাল সকালে ক্যাব ডেকে দেব। তুমি ঝুমকিকে দিয়ে এসো। আর কিছু বলব না কোনও দিন। খুশি?”
রুমকি বলল, “হুঁ, আমি মাঝে মাঝে একটু বেশিই বলে ফেলি। কী করব, বাড়ির অবস্থাটা দেখা যায় না। আমি দেখতে পারি না।”
আদিত্য বলল, “ঠিক আছে, ঘুমাও এখন। আমার অফিসে ভাইটাল মিটিং আছে কাল। গুড নাইট।”
রুমকি বলল, “গুড নাইট।”
#
ভোরবেলা আদিত্যকে ঠেলে তুলল রুমকি, “এই শোনো, ওঠো, শিগগিরি ওঠো।”
আদিত্য ঘুমচোখে বলল, “কী হল?”
রুমকি বলল, “ঝুমকি চলে গেছে।”
আদিত্য অবাক হয়ে বলল, “মানে? কখন গেল?”
রুমকি একটা কাগজ আদিত্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “পড়ো।”
আদিত্য কাগজটা নিল। লেখা—
“দিদি,
আমি জানি আমি ভুল করেছি। আমি এও জানি, সারাজীবন আমার ভুলের জন্য আমার পরিবার আমায় কোনও দিন ক্ষমা করতে পারবে না। তোদের কষ্টটাও বুঝতে পারি। সবার সব চিন্তা, ঝগড়া, ঝামেলা আমাকে নিয়ে। আমি আর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। খুঁজতে চেষ্টা করিস না। ভালো থাকিস তোরা। জামাইবাবুকে সন্দেহ করিস না। আমার নিজের দাদার থেকেও বেশি সম্মান করি ওকে।
বাবা-মার খেয়াল রাখিস। ওরা জানুক, ওদের একটাই মেয়ে ছিল। আর-একটা মেয়ে নাহয় জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছিল। ধানবাদ থেকে পালিয়ে এসে ভেবেছিলাম ভুল শোধরানো গেল। বুঝলাম যা ভুল করেছি, তা তো শুধরালই না, বরং সবাইকে আরও অনেক ঝামেলায় ফেলে দেব যত দিন যাবে। এর থেকে না থাকাই ভালো।