ঝুমকি একবার রুমকির দিকে তাকিয়ে তার দিকে তাকাল, “আমাকে এখন বাবা যা বলবে তাই তো করতে হবে। আমার হাতে কি কিছু আছে? এমনিতেই বাড়িতে কী অপেক্ষা করছে কে জানে।”
আদিত্য দুই বোনের দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করল। রুমকি বলল, “অকারণ রাগারাগি না করে স্রোতের সঙ্গে চলো আপাতত। অকারণ ঝামেলা করে কি আর লাভ আছে? পাড়ায় মুখ দেখানোরও তো ব্যাপার আছে একটা। ঝুমকি লাইভ করেছে (লাইভ করল কোথায়?) বলে, নইলে দেখিয়ে দিতাম ছেলেটা ওকে ছোঁয়ওনি।”
আদিত্য বলল, “তাতে কী হবে? পাড়ার লোকে কী বলল, তাতে কী আসে যায়?”
রুমকি বলল, “সারাক্ষণ এ কাকিমা, সে জেঠিমা আমাদের বাড়ি আসে। মাকে ইনিয়েবিনিয়ে উলটোপালটা কথা শোনায়। ভালো লাগে? তুমি মেয়েদের দিকটা বুঝবে না। মা এতদিন বড়ো মেয়ের জামাই নিয়ে কত গর্ব করেছে, এদিকে ছোটো মেয়ে যে কী করে বসল…”
রুমকি বাঁ হাত দিয়ে চোখ মুছল। ঝুমকি একটা কথাও না বলে পাথরের মতো মুখ করে খেতে থাকল।
আদিত্যর মাথায় রক্ত চড়ছিল। সে আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাল।
ফোন বাজছিল। সে দেখল সুশোভন, বলল, “কী রে? বল।”
সুশোভন বললেন, “টিভি দেখছিস?”
আদিত্য বলল, “না না। কেন?”
সুশোভন বললেন, “নিউজ চ্যানেল দেখ। তারপর ফোন কর।”
আদিত্য বেডরুমের টিভি অন করে নিউজ চ্যানেল দিল। ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে খিদিরপুরে হত্যাকাণ্ড। রুবেল শেখ নামের এক যুবক ইজাজ মল্লিককে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ধৃত যুবক রশিদ আলি মোল্লা নামের এক যুবককেও গুলি করে আহত করেছে। এলাকায় সন্ত্রস্ত পরিবেশ।
রুমকি খবর শুনে এঁটো হাতেই বেডরুমে চলে এসেছিল। খবরটা দেখে আর্তনাদ করল। ঝুমকিও এল। নির্লিপ্ত চোখে খবরটা দেখে মেঝেতে বসে পড়ল। আদিত্য রুমকিকে বলল, “তুমি ঝুমকিকে সামলাও। আমি সুশোভনকে ফোন সেরে আসি।”
টিভি বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে সুশোভনকে ফোন করল আদিত্য। সুশোভন ফোন ধরেই বললেন, “দেখলি?”
আদিত্য বলল, “তার মানে আমার সঙ্গে কথা বলার পরে ছেলে এ কাণ্ড করল?”
সুশোভন বললেন, “হুঁ। তোদের জন্য ভালোই হল। এক ঢিলে দুই পাখি টাইপ। আপাতত এদিক দিয়ে তোর শ্বশুরবাড়ির দিকে আর কোনও ক্যাচাল যাবে না যা বুঝলাম।”
আদিত্য বলল, “হুঁ। সব কি এত সোজা হবে?”
সুশোভন হাসলেন, “লেটস হোপ।”
৫৭
রাত এগারোটা।
লোডশেডিং হয়েছে। ইনভার্টার কাজ করছে না। রুমকি মোমবাতি খুঁজে জ্বালিয়েছে ডাইনিং টেবিলে। তারা তিনজন অন্ধকারে বসে আছে।
ঝুমকি চুপ করে বসে আছে।
রুমকি বলল, “ঝুম, তোর মনের মধ্যে কী চলছে বলবি?”
ঝুমকি বলল, “কিছু চলছে না।”
রুমকি বলল, “আমাদের কী হয় জানিস তো, যখন কোনও ইনফ্যাচুয়েশন আসে, তখন তার সব ভালো লাগে। সেই ঝড়টা যখন চলে যায়, আমরা বুঝতে পারি কত বড়ো ভুল করেছিলাম। তুই আমাকে খুলে বল। তোর কি এখনও ওর প্রতি কোনও ফিলিংস আছে?”
ঝুমকি চুপ করে থাকল। ঘরবাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু রাস্তায় গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
আদিত্য বলল, “ঝুমকি কিছু বলতে না চাইলে থাক। জোর করে বলার দরকার নেই।”
ঝুমকি এবার মুখ খুলল, “না, ঠিক তা নয়। জোর করার কিছু নেই। একটা কুকুর পুষলেও তার ওপর মায়া জন্মায়। ভুল করে হোক আর যে করেই হোক, আমি তো ওকে ভালোবেসেছিলাম। ওকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেছিলাম। তারপর আমার সব কিছু ভেঙেচুরে দিল ও।”
রুমকি বলল, “তুই কী চাইছিস?”
ঝুমকি বলল, “আমার কী চাই সেটা তো বরাবর বাবাই ঠিক করে এসেছে। একবার শুধু আমি ঠিক করেছিলাম। সেটা এত বড়ো একটা সমস্যা তৈরি করল। আমার আর নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই, সাহসও নেই।”
আদিত্য বলল, “এই মুহূর্তে রিন্টু জেলে থাকবে। আত্মসমর্পণ করেছে মানে এই অধ্যায় ফুরাল। কাল তোকে তোর বাড়ি নিয়ে যাব। নতুন করে সব শুরু করার চেষ্টা কর। তোর বাবা যেসব লোকাচার বা ঘর ওয়াপসি টাইপের জালি জিনিসপত্র করবে, মেনে না নিলেও চুপ করে সহ্য কর। আর কী বলব?”
রুমকি রেগে গেল, “তুমি আমার বাবাকে জালি বললে কেন?”
আদিত্য শান্ত গলায় বলল, “তোমার বাবাকে বলিনি। তোমার বাবার কাজকর্মকে বলছি। ওসব শুদ্ধি-ফুদ্ধি করে এতদিন যন্ত্রণা সহ্য করা মেয়েটাকে যে আরও যন্ত্রণা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে, সেটা বোঝার চেষ্টা করো।”
রুমকি বলল, “তুমি যেটা বোঝো না সেটায় ঢুকতে যাও কেন? আমাদের পরিবারের ব্যাপারে তোমাকে ঢুকতে হবে না। কোনও ধর্মকে ছোটো করার অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি।”
আদিত্য বলল, “ধর্ম যখন কোনও মানুষের বেঁচে থাকাটাকেই নষ্ট করে দেয়, দুমড়ে মুচড়ে দেয়, তখন সে ধর্মের আমার কাছে কানাকড়িও মূল্য নেই। যে ধর্ম ভালোবাসাকে ব্যবহার করে একটা সদ্যযৌবনা মেয়েকে ধর্মান্তরিত করে, তাকে ফেরাতে আর-একদল তাকে আবার কোনও প্রাণীর পেচ্ছাপ খাওয়ায়, সেসব ধর্ম আমার কাছে মূল্যহীন। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”
রুমকি বলল, “তুমি আমার বাবাকে, আমাদের বাড়ির সমস্ত কিছুকে অপমান করছ তুমি বুঝছ?”
আদিত্য বলল, “আর ধর্মের নামে কতগুলো বিকৃত কাজকর্ম করে তোমরা যে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাকেই নষ্ট করে দিচ্ছ, সেটা কি বুঝছ?”