রুমকি বলল, “দ্যাখো সুশোভন তো প্রোগ্রেসিভ মাইন্ডেড ছেলে। বিয়ে থা করেনি। আবার পুলিশেও কাজ করে। ও যদি ঝুমকিকে বিয়ে করত, তাহলে ওই ছেলেটাও পুলিশের বউ বলে বেশি জ্বালাতন করত না…”
আদিত্য হেসে ফেলল।
রুমকি বলল, “হাসছ কেন?”
আদিত্য বলল, “আচ্ছা, আমরা শেষ কোথায় বেড়াতে গেছিলাম?”
রুমকি বলল, “কোদাইকানাল। কী দারুণ লংকার চপ খেলাম বলো?”
আদিত্য বলল, “তুমি এক কাজ করো। চোখ বন্ধ করে কোদাইকানালের সেই ঝরনাটার কথা মাথায় আনো। আর ঝুমকিকে পুরো মাথা থেকে বের করে দাও। দ্যাখো তো পারো নাকি।”
রুমকি অবাক হয়ে বলল, “এ আবার কী? না পারার কী আছে?
আদিত্য বলল, “না না, করো। পারা না পারার কিছু না। এই নাও, এই চেয়ারটা নাও, আমি তোমার কাঁধ ম্যাসাজ করে দিচ্ছি, তুমি ভাবো। বসো চেয়ারে।”
রুমকি চেয়ারে বসল। আদিত্য বলল, “চোখ বন্ধ করেছ?”
রুমকি বলল, “হুঁ।”
আদিত্য বলল, “কী দেখতে পাচ্ছ?”
রুমকি বলল, “দেখতে পাচ্ছি মেঘলা আবহাওয়া। বৃষ্টি পড়ছে, তবু আমি ঝরনার সামনে থেকে নড়ছি না। তুমি আবার আমার হাত ধরে টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বলছ ঠান্ডা লাগাবে নাকি? এখানে ঠান্ডা লাগলে ডাক্তার কোথায় পাব? তারপর চপ এনে দিলে… আহা… কী ভালো… কলকাতায় কোথায় পাওয়া যাবে লংকার চপ?”
আদিত্য বলল, “এরপর দ্যাখো গাড়িটা চলল। আমরা টিটিডিসির গেস্ট হাউজের কটেজে পৌঁছলাম। ওখানে ওরা আমাদের মাছভাজা খেতে দিল। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। তুমি আবার ব্যাগ থেকে মাখন বের করে বললে মাখন দিয়ে ভাত খেতে ভালো লাগবে। মনে পড়ছে?”
রুমকি বলল, “হ্যাঁ। আমি মাখন ছাড়া খেতেই পারছিলাম না। ওদের তরকারিতে ওই কী সব মশলা দেয়, আমি জাস্ট নিতে পারি না। তুমি তো ওইসবই সোনা মুখ করে গিলে ফেলছিলে।”
আদিত্য বলল, “মাছভাজা আর মাখন দিয়ে ভাত খেয়ে তুমি কম্বল নিয়ে একটা জম্পেশ ঘুম দিলে। আমি হাঁটতে বেরিয়ে সাইকেলের খোঁজ পেয়ে সাইক্লিং করে যখন সন্ধেয় ফিরলাম তুমি আমাকে খুঁজে না পেয়ে কেঁদেকেটে একশা করে গেস্ট হাউজের লোকদের পাগল করে দিচ্ছ।”
রুমকি বলল, “ওরে বাবা, তুমি কী জঘন্য। ফোনটাও পাওয়া যাচ্ছিল না। উফ। কী বিচ্ছিরি!”
আদিত্য বলল, “তারপরের আদরটা?”
রুমকি আদিত্যর হাত ধরল, “হুঁ।”
আদিত্য রুমকির পাশে বসল, “চোখ খোলো।”
রুমকি চোখ খুলল।
আদিত্য বলল, “চলো ভুলে যাওয়া যাক আপাতত। এত টেনশন আর নেওয়ার দরকার নেই। আর সুশোভন তো ঝুমকিকে পছন্দ করেনি। এজ ডিফারেন্সও অনেক। জোর করে কাউকে কোনও সম্পর্কে জড়াবার কী দরকার? সময় দিই মেয়েটাকে? পড়ুক?”
রুমকি আদিত্যর হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। কত বাজে বাজে কথা বলেছি। ইশ… আমিও আর পারছিলাম না বিশ্বাস করো।”
আদিত্য রুমকিকে জড়িয়ে ধরে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বেশ করেছ যা করেছ। এবার একটু শান্তিতে ঘুমাও যাও। ভেবো না আর অন্য কিছু।”
রুমকি আদিত্যর হাত শক্ত করে ধরে থাকল।
৫৩
অফিস ঢোকার মুখে আদিত্যর ফোনটা বেজে উঠল। ধরল সে, “হ্যালো।”
“আমি রিন্টু বলছি।”
আদিত্যর চোয়াল শক্ত হল, “বলো।”
“বলছি দাদা আপনার সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে?”
আদিত্য বলল, “কী, গুন্ডা মস্তান নিয়ে আসবে নাকি?”
“না না, দাদা, সেসব না। মিটমাট তো হয়ে গিয়েছে। মল্লিকচাচা তো বলে দিয়েছেন সব ভুলে যেতে। আমি শুধু একটু দেখা করতে চাই আপনার সঙ্গে। বিশ্বাস করুন আমি একা আসব।” গলায় আর্তি স্পষ্ট।
আদিত্য বলল, “ঠিক আছে। তুমি এসো, এতদিন আমায় ফলো করেছ, অফিসের ঠিকানা তো জানো নিশ্চয়ই, চলে এসো।”
ফোনটা রাখল আদিত্য। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সুশোভনকে ফোন করল। সুশোভন ধরলেন, “বল।”
আদিত্য বলল, “ওই রিন্টু ছেলেটা ফোন করে দেখা করতে চাইছে। এতদিন হুমকি দিত, এখন রিকোয়েস্ট করছে। আমি আসতে বলেছি।”
সুশোভন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বললেন, “ঠিক আছে, শোন কী বলে। নিজে থেকে কিছু বলতে যাস না।”
আদিত্য বলল, “হুঁ।”
অফিসে কিছুক্ষণ বসার পর রিন্টুর ফোন এল। আদিত্য অফিসের বাইরে বেরিয়ে দেখল রিন্টু দাঁড়িয়ে আছে। একাই এসেছে। সে চারদিকে তাকাল। কোনও গাড়ি নেই। সে বলল, “বলো কী বলতে চাও।”
রিন্টু বলল, “দেখুন, আমি মানছি আমি যেটা করেছি ঠিক করিনি।”
আদিত্য রিন্টুর দিকে তাকাল। মুখে উগ্রতার ভাবটা কম লাগছে কি? বুঝল না।
সে বলল, “বুঝলাম। তো কী দাবি এখন তোমার?
রিন্টু বলল, “দেখুন, আমি ওকে সত্যি ভালোবাসি। আমি চাই ওকে নিয়ে সংসার করতে। আপনি দেখুন না, ওর বাড়ির লোককে বুঝিয়ে।”
আদিত্য বলল, “আমি তো জানি না ঝুমকি কোথায় আছে। আমার পক্ষে ওর বাড়ির লোককে বোঝানোও সম্ভব না। আমি ওদের ফ্যামিলিতে আউটসাইডারের মতো।”
রিন্টু মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে বলল, “আমাদের দিক থেকে যেগুলো হয়েছে, সেগুলো সত্যিই বেশি বেশি হয়ে গেছে। আমি ক্ষমা চাইছি তার জন্য।”
আদিত্য হাসল, “তুমি শিক্ষিত ছেলে না? যেগুলো করেছ, সেগুলো তো জেনেবুঝেই করেছ, তাই না?”
রিন্টু বলল, “দেখুন, আপনাকে আমি একটা কথা বলি। আমি যে ওকে ভালোবাসিনি তা নয়। শুধু আমার ধর্মটা বলতে ভয় পেয়েছি। লুকোতে চাইনি বিশ্বাস করুন। ভয় পেয়েছি এ কারণেই যে, আমি যদি ওকে আমার ধর্মটা বলতাম, ও আমাকে বিয়ে নাও করতে পারত। তারপর আমি যে কাজটা করেছি সেটাও ওকে আটকে রাখার জন্যই। জানি গর্হিত কাজ, কিন্তু আমার বন্ধুরা বলেছিল, ওর পেটে বাচ্চা চলে এলে ও আর কোথাও যেতে পারবে না। কনভার্শনটাও প্রি-প্ল্যানড ছিল না। আমার ধানবাদের মুরুব্বিরা যখন জানতে পারল, ওরা জোর দিতে লাগল যে আগে কনভার্ট করিয়ে নে। ও ধানবাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আমার আর মাথা কাজ করছিল না। আমি মল্লিকচাচাকে জানালাম। ওরা কেসটা এমনভাবে টেক আপ করে নিল যে আমার হাতে কিছুই রইল না। আমি রাগের মাথায় আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, পশুর মতো কাজ করেছি ওর সঙ্গে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি এখনও ওকে ভালোবাসি। ওর সঙ্গে সংসার করতে চাই।”