আদিত্য বলল, “কী ব্যাপারে?”
রুমকি বলল, “আমি তোমাকে যা নয় তাই বলেছি। ঝুমকিকেও বলেছি। খারাপ লাগছে। বোনটা আমার।”
রুমকি কেঁদে ফেলল।
আদিত্য ফোন হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
৫১
অফিসফেরতা আদিত্য শ্বশুরবাড়ি গেল। তপন তাকে দেখে খুশি হলেন, “ওহ, বাবা তুমি এসেছ? খবরে তো দেখাচ্ছে ওদের নেতা বলেছে মিউচুয়াল করে নেওয়া হবে। বাড়ির সামনে থেকে উটকো দলবলও সকালের পর আর দেখা যাচ্ছে না। সমস্যা কি মিটল?”
আদিত্য ঘরের ভিতর ঢুকে সোফায় বসল। রুমকির মা উদ্বিগ্ন চোখে তার দিকে তাকিয়ে। তাকে দেখে বললেন, “চা খাবে বাবা?”
আদিত্য বলল, “আপনি বসুন। আমি একটু কথা বলে যাই।”
তপন বসলেন। আদিত্যর শাশুড়িও বসলেন।
আদিত্য বলল, “আপাতত মনে হচ্ছে একটা সমঝোতায় আসা গেছে। আমার বন্ধু সুশোভন ওদের নেতার সঙ্গে কথা বলেছে। ওরা ঝুমকিকে ফেরত নেবার জন্য যে মরিয়া ভাবটা দেখাচ্ছিল, যে জ্বালাতনটা করছিল, মনে হয় না আর করবে। তবু নিরাপত্তার স্বার্থে আপাতত ঝুমকি আমাদের কাছেই থাকুক। দু-চারটে দিন গেলে নাহয় এখানে নিয়ে আসা যাবে।”
তপন খুশি হয়ে আদিত্যর হাত ধরে বললেন, “বাঁচালে বাবা। তুমি না থাকলে যে কী হত।” রুমকির মা ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করতে শুরু করলেন।
আদিত্য বলল, “ঠিক আছে। এখনই সব মিটে গেল ভেবে না নিলেই ভালো হয়। আমি ওদের ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না। ওদের মধ্যে একটা মরিয়া ভাব আছে তো, সেটা দুশ্চিন্তার।”
তপন বললেন, “ও পুলিশ যখন স্টেপ নিয়েছে আমি নিশ্চিন্ত। আসছে বুধবার একটা ভালো দিন আছে। ওই দিন শান্তি স্বস্ত্যয়ন করে ঝুমকির দোষ কাটিয়ে ঘরে তুলব।”
আদিত্য অবাক হয়ে বলল, “দোষ কাটাবেন মানে? কীসের দোষ?”
তপনও উলটে অবাক হলেন, “দোষ না? হিন্দু ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়েকে মুসলিম ছেলে ফাঁসিয়ে বিয়ে করল। তারপর আর যা যা হয়েছে সেগুলো নাহয় নাই বা বললাম। দোষ তো কাটাতেই হবে।”
আদিত্য বলল, “এটা হলেই দোষ কেটে যাবে? তারপর কী করবেন?”
তপন চিন্তিত মুখে বললেন, “সেটা আমরা সবাই মিলে ঠিক করব। সৎপাত্রে বিয়ে দিতে হবে। এখন তো আর ভালো ছেলে পাওয়া যাবে না। সেই দোজবরে বা…” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তপন।
আদিত্য শাশুড়ির দিকে তাকাল। কেমন দিশেহারা হয়ে আছেন ভদ্রুমহিলা। অবশ্য সারাক্ষণ দিশেহারাই থাকেন। নিজের কোনও মতামত কোনও কালেই দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
সে বলল, “ঠিক আছে। আমি উঠি। ফিরতে হবে।”
শাশুড়ি বললেন, “সে কী, কিছু মুখে দিয়ে যাও। গৃহস্থের অকল্যাণ হবে যে!”
তপনও বললেন, “হ্যাঁ। চা জলখাবার অন্তত খেয়ে যাও।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসল আদিত্য। তপন বললেন, “ওদের টার্গেট এটাই থাকে। হিন্দু বাড়ির মেয়েদের ট্র্যাপে ফেলে বিয়ে করবে, তারপর কনভার্ট। এ যে কত বড়ো চক্র, তা যদি আগে বুঝতাম। তাও মেয়েকে বুদ্ধিমতী বলতে হবে, পালাতে পেরেছে ঠিক করে। এখন একটা ঠিকঠাক ছেলে দেখে। আমার এক বোন আছে সাউথের দিকে। ওর কাছে পাঠাতে পারলে দোজবরেও খুঁজতে হত না, ঠিক একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া যেত।”
আদিত্য বলল, “মিথ্যা বলে বিয়ে দেবেন?”
তপন বললেন, “মিথ্যার কিছু নেই তো। নামমাত্র ডিভোর্সিরাও তো বিয়ে করে। আমার মেয়ের তো বিয়েই প্রপার পদ্ধতিতে হয় না।”
আদিত্য বলল, “তবু, ছেলের বাড়ি থেকে যখন জানতে পারবে, তখন সমস্যায় পড়তে পারেন।”
তপন হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বললেন, “ও কোনও সমস্যা হবে না। এখন সব আইন মেয়েদের পক্ষে।”
আদিত্য বিস্মিত চোখে তপনের দিকে তাকাল। আদর্শবাদী লোকেরা পার্সোনাল ক্রাইসিসে পড়লে এরকম হয়ে যাবে? শেষে মিথ্যে বলে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে?
শাশুড়ি চা নিয়ে এলেন।
বললেন, “একটু বসবে বাবা, লুচি করছি।”
আদিত্য বলল, “না, না, সেসব দরকার নেই। আমি চা খেয়ে রওনা দেব। অনেকটা রাস্তা ড্রাইভ করতে হবে আবার।”
তপন বললেন, “আচ্ছা, তোমার হাতে ভালো ছেলে আছে? অফিসে বা বন্ধু মহলে?”
আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মানুষ এরকম কেন? কেন?
৫২
রাতের খাবার পর আদিত্য বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।
মাথা গিজগিজ করছে অজস্র ভাবনাচিন্তায়। কোনও কিছু গভীরভাবে ভাবতে গেলে মাথা দিচ্ছে না। সে বুঝতে পারছিল, এই চার দেওয়ালের বাইরে কোথাও একটা যাওয়া দরকার। এই কংক্রিটের জঙ্গলে থাকলে মাথায় এসব কঠিন চিন্তাভাবনা ঘুরঘুর করবেই।
বাইরের রাস্তায় পাড়ার এক দাদু বাড়ি ফিরছেন হাঁটতে হাঁটতে। আদিত্য চোখ বুজল। জীবনটা কোথায় যেন আটকে গেছে এই সময়ে এসে। এত জটিল জীবন তো সে কোনও দিন কল্পনা করেনি! আজকাল কেন জটিলতাগুলো তাকে এরকম পরীক্ষার সামনে ফেলে দেয়?
রুমকি বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নরম গলায় বলল, “সিগারেট না খেলে হয় না?”
আদিত্য বলল, “এই একটাই। আর খাব না।”
রুমকি বলল, “ঝুমকিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এলাম। খুব কাঁদছিল। আমিও যা নয় তাই বলেছি। খারাপ লাগছে আমারও।“
আদিত্য কিছু বলল না।
রুমকি বলল, “শোনো না, একটা কথা বলব, রাগ করবে না তো?”
আদিত্য বলল, “বলো।”
রুমকি বলল, “আমি একটা ব্যাপার ভেবেছি। কাউকে বলিনি, নিজের মধ্যেই রেখেছি। কিন্তু কথা দাও, বললেই ঝাঁঝিয়ে উঠবে না।”
আদিত্য বলল, “বলো। আর কী ঝাঁঝিয়ে উঠব? এনার্জি নেই কোনও আর।”