সৌম্য বলল, “সতু ভালো থাকত। তোমরাও ভালো থাকতে। কী করবে মা, কপালে নেই। আমার কাছে দুজনে থাকো এখন। খারাপ রাখব না। কলকাতা আর এই বাড়িটা মিস করবে, এই যা।”
রোহিণী বললেন, “সে তো জানি। তুই কেন আমাদের খারাপ রাখবি সমু? তবে বাবা রাগটা কমা। তোর রাগটা বড্ড লাগামছাড়া হয়ে যায় আজকাল। জিনিয়ার কাছে ভাগ্যিস ক্ষমা চেয়েছিলি, নইলে আমি আর তোর বাবা বড্ড লজ্জায় পড়ে যেতাম।”
সৌম্য বলল, “পরিস্থিতিটাই এমন, মাথা ঠিক রাখা যায় না আসলে। সব কিছু কেমন হাতের বাইরে চলে গেল।”
রোহিণী বললেন, “কথাটা ওকে আমিই বলে ফেলেছিলাম সমু। আমিও তো বুঝতে পারছিলাম না, আমরা চলে গেলে জিনিয়াকে কী বলে সান্ত্বনা দেব। দোষটা আমারই। বয়স হচ্ছে তো, কী বলতে কী বলে ফেলি বুঝি না। ও মেয়েও যে সব কথাই মাথার ভিতরে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, কী করে বুঝব?”
রোহিণীর গলা ধরে এল।
সৌম্য বলল, “ঠিক আছে। এখন আর এ কথা ধরে বসে থাকতে হবে না। বাদ দাও।”
রোহিণী বললেন, “মনে আছে সমু, ছোটোবেলায় একটা ডিমকে দুভাগ করে তোদের দুভাইকে খাওয়াতাম ভাত আর মাখন দিয়ে। এক গ্রাস তুই, আর-এক গ্রাস সতু। গ্রাসগুলোকে আলাদা আলাদা করে রাখতাম। তুই সবসময় ফার্স্ট হতিস। সতু জল খেয়ে ফেলত কতটা করে। আজকাল সারাক্ষণ এসব কথা মাথায় ঘুরপাক খায়।”
সৌম্য থমকে গেল। উঠে রোহিণীকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।
১৪
শেয়ালদা স্টেশনে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হল উদ্দালকের। মা তাকে দেখেই বলল, “কত রোগা হয়ে গেছিস! খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস তুই?”
উদ্দালক বলল, “ওজন তিন কিলো বেড়েছে। কী যে বলো না!”
মা বলল, “ওরকম বলতে নেই। নজর লাগে।”
বাবা বলল, “হ্যাঁ, পারলে সারাজীবন আঁচলেই বেঁধে রাখো। ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ছেলেটা বিয়ে করবে না, সেটাও তোমার জ্বালাতনে শিকেয় উঠল।”
মা রেগে গেল, “একদম পিছু ডাকবে না। ভালো সিদ্ধান্ত? বুড়ো বয়সে কে ওকে খাওয়াবে?”
বাবা বলল, “বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে। এনাফ রোজগার করে নেবে। একা থাকার মজাই আলাদা। দেশ বিদেশ ঘুরবে। বিয়ে করা মানেই ঝামেলা।”
মা বাবার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, “তুমি কি চাও, আমি এখান থেকে যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাব? চাও?”
বাবা বলল, “ওরে বাবা থাক। খচে যেয়ো না।”
মা গজগজ করতে লাগল।
#
অগ্নি অপেক্ষা করছিলেন বারান্দায়। তাদের ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “আমি ভাড়াটা দিয়ে দি।”
উদ্দালক বলল, “না না, সে কী, এসব একদম না। আমি দিয়ে দিচ্ছি।”
অগ্নি উদ্দালকের উষ্মা প্রকাশ দেখে খুশি হলেও মুখে কিছু বললেন না।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে অগ্নি বললেন, “আসুন।”
তারা ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসল। জিনিয়ার এক মেসো-মাসিও এসেছেন। মালতী চা দিলেন। উদ্দালক চারদিক দেখছিল। এই প্রথম তার কোথাও বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়া। অস্বস্তি হচ্ছিল। লজ্জাও হচ্ছিল। কোত্থেকে লুচি ভাজার গন্ধ আসছিল। তার মন সেদিকে চলে গেল। সে বা পল্টু, কেউ ভালো লুচি ভাজতে পারে না। লুচি ভাজতে গিয়ে সেটা বিভিন্ন আকারের হয়ে যায়। পরোটা তাও চলে যায়।
এ কথা সে কথার পর জিনিয়া একেবারে ন্যূনতম প্রসাধনে এল। মালতীর শত অনুরোধেও জিনিয়া সাজেনি।
উদ্দালক জিনিয়ার দিকে তাকাতে পারল না। অস্বস্তি হচ্ছিল। জিনিয়াও তার দিকে একবারও তাকাল না। শক্ত হয়ে বসে রইল।
আবার কিছুক্ষণ খেজুরে আলাপের পরে অগ্নি বললেন, “তিন্নি, তুই উদ্দালককে নিয়ে তোর ঘরে যা। কথা বল।”
জিনিয়া উদ্দালককে না ডেকেই উঠে গেল। উদ্দালক কী বলবে বুঝতে না পেরে বাবার দিকে তাকাল। বাবা ইশারা করল জিনিয়াকে অনুসরণ করতে।
সে জিনিয়ার পিছন পিছন জিনিয়ার ঘরে গেল।
ছোটো ঘর। সম্ভবত তারা আসবে বলেই সাজানো হয়েছে। উদ্দালক দেখল খাটের ওপর নীললোহিত সমগ্র। সে খুশি হয়ে বলল, “বাহ, আপনি নীললোহিত পড়েন?”
জিনিয়া তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, পড়ি। সৌপ্তিক দিয়েছিল। ওর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ঠিক হয়ে গেছিল। ও ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। আমার বাবা, মা বা রুনুমাসি কেউই আপনাদের এ কথা বলবে না। আমি বলে দিলাম।”
উদ্দালক বলল, “খুব খারাপ লাগল শুনে। আপনাদের লাভ ম্যারেজ হত?”
জিনিয়া মাথা উপর-নিচ করল।
উদ্দালক বলল, “স্বাভাবিক। তাহলে আপনাকে আজকে জোর করা হয়েছে?”
জিনিয়া বলল, “হুঁ। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল। আমার কী হবে ভেবে আমার মায়ের ঘুম হচ্ছে না। সবাই বোঝাতে শুরু করেছে আমার মুভ অন করা উচিত। আমি এসবের অত্যাচার থেকে বাঁচতেই শেষমেশ রাজি হয়েছি। আমি আর এসব নিতে পারছি না।”
উদ্দালক বলল, “স্বাভাবিক। মানুষ একা ভালো থাকলে কেউ দেখতে পারে না। যেভাবেই হোক তাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। ভাবটা এমন, আমরা নিজেরা খারাপ আছি, তোরাও খারাপ থাক। অদ্ভুত ব্যাপার যাই বলুন।”
জিনিয়া এবার একটু হেসে গম্ভীর হয়ে গেল।
উদ্দালক বলল, “আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কম বেশি একই। বিয়ে করতে আমারও তেমন ইচ্ছা নেই।”
জিনিয়া বলল, “আপনার কোনও অ্যাফেয়ার?”
উদ্দালক বলল, “নাহ। ওসব হয়নি। প্রচুর পড়াশোনা করেছি এক কালে। কিন্তু স্কুলে পড়ানো ছাড়া আর কোনও চাকরি পেলাম না। সে কাজও ভালো লাগে না। ছাত্র পেটানো অপেক্ষা ভ্যারেন্ডা ভাজা ভালো।”