আদিত্য রুমকির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কয়েকটা কথা পরিষ্কার করে বলি। এবার মনে হয় এগুলো বলার সময় হয়েছে। বলি?”
রুমকি বলল, “তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাবে।”
আদিত্য বলল, “হোক না। এতদিন তো যাওয়াই হয়নি। আজ নাহয় দেরি হবে। কিন্তু কথাগুলো বলা দরকার।”
রুমকি বলল, “বেশ। বলো।”
আদিত্য বলল, “ঝুমকি একটা ভুল করেছে। ঝুমকির বয়স আঠেরো বা উনিশ। এই বয়সে সবাই ভুল করে। ঝুমকিও করেছে। বয়সটাই খারাপ। কলেজে একজন সুপুরুষ ছেলে দেখে প্রেমে পড়েছে, সেটাকে আমি ভুল বলছি না। ভুল বলছি, কোনও কিছু যাচাই না করে, বাড়িতে কিছু না বলে, অন্ধের মতো ছেলেটার সঙ্গে চলে গেছে এবং যাওয়ার পরে বুঝেছে সে বিরাট ভুল করেছে। আমি ভুল বলছি ঝুমকি?”
ঝুমকি মাথা নাড়ল।
আদিত্য বলল, “আমি অনেক ভেবেছি। সুশোভনের সঙ্গেও কথা বলেছি। আমার মনে হয়েছে, আমাদের সমাজের মূল সমস্যা হল ভিক্টিম ব্লেমিং। একটা মেয়ের রেপ হলে দোষটা মেয়েরই হয়। কেন মেয়েটা রাত করে বাড়ি ফিরেছিল, কেন মেয়েটা ছোটো পোশাক পরেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ভিক্টিম ব্লেমিংটা শুধু সব দিক দিয়ে হল। এমনকি পালিয়ে গেছিল বলে রাগের মাথায় ঝুমকিকে ডিসওন অবধি করা হচ্ছিল। যাই হোক, সেসব মিটেছে। ঝুমকিকে জোর করে রিন্টু ধানবাদ নিয়ে গেল এবং ওর মতের অমতে ওকে রেপ এবং কনভার্ট করতে গেল। যদিও কনভার্ট করা অত সোজা না, ঝুমকির কনসেন্ট না থাকলে সেটা হবেও না, তবু, আমাকে বলো তো, এত কিছুর মধ্যে ঝুমকি কী করল? রেপ হলেই সব শেষ হয়ে যাবে? ঝুমকির কি রিন্টুর প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা আছে? থাকলে বলুক। কি রে ঝুমকি, আছে?”
ঝুমকি বলল, “আমি যখন জানতে পারলাম রিন্টু আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে, তখন থেকেই আমার ওর প্রতি সব ভালোবাসা নষ্ট হয়ে গেছে।”
আদিত্য বলল, “এবং অপরাধবোধ এসেছে। তাই তো?”
ঝুমকি মাথা নাড়ল।
আদিত্য রুমকির দিকে তাকাল, “তুমি ঠিক কী করে মনে করো ঝুমকির সর্বনাশ হয়ে গেছে?”
রুমকি কেঁদে ফেলে বলল, “ওকে কেউ বিয়ে করবে না। কে বিয়ে করবে বলো তো ওকে?”
আদিত্য বলল, “ঝুমকির ক্লাস টুয়েলভে নাইন্টি ফাইভ পারসেন্ট ছিল না?”
রুমকি বলল, “তাতে কী হয়?”
আদিত্য বলল, “একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে করাটাই কি সব? ঝুমকির যা মেধা আছে, ও চাইলে হায়ার স্টাডি করতে পারে। রিসার্চ করতে পারে। নিজের পায়ে চাকরি করতে পারে। তুমি কী করে ওকে একটা চার দেওয়ালের মধ্যেই কল্পনা করতে পারছ? এদিক দিয়ে ভাবলে ওই রিন্টু শেখ, আর আমাদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় রুমকি? ওরাও ওকে বাড়ির চাকর বানিয়ে রাখত, আমরাও তাই করছি।”
রুমকি বলল, “বাবা মানবে না।”
আদিত্য বলল, “মানতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমাদের সমাজের সবথেকে বড়ো সমস্যাই তো লোকে কী বলবে? এই লোকের দৃষ্টিকে পাত্তা যারা দেয়নি, তাদের জন্যই আমাদের সমাজটা পালটেছে। সতীদাহ প্রথা আটকালে লোকে কী বলবে ভাবেননি বলেই রামমোহন সেটাকে আটকাতে পেরেছিলেন। বিধবাবিবাহ হলে লোকে কী বলবে, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার হলে লোকে কী বলবে ভাবেননি বলেই বিদ্যাসাগরের কৃপায় এখনও দেশে পড়াশোনা জিনিসটা টিকে আছে। সিভিল সার্ভিস ছেড়ে দিলে লোকে কী বলবে ভাবেননি বলেই নেতাজি নেতাজি হতে পেরেছিলেন। বাবাকে মানতে হবে। ঝুমকিকে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কি রে ঝুমকি, পারবি না?”
রুমকি ঝুমকিকে ধরে কেঁদে ফেলল। আদিত্য বলল, “কেঁদো না। কেঁদে কেঁদে নিজেদের পজিটিভ এনার্জিগুলোকে ভাসিয়ে না দিয়ে মেয়েটাকে সাহস দাও। আর হ্যাঁ, তোমাদের দুজনের সামনে আমি বলে দি, ঝুমকি আমার বোনের মতোই। ওকে নিয়ে আমাকে সন্দেহ কোরো না দয়া করে। আমি তোমাদের খারাপ চাই না। ভালো চাই। প্লিজ। দয়া করে বোঝো। এই ক্রাইসিস সিচুয়েশনে আমার যা করণীয়, তা আমি করেছি। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।”
রুমকি চেয়ারে বসে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আসলে পরিস্থিতিটা এমন হয়ে গেছিল…”
আদিত্য বলল, “অফিস গেলাম। দয়া করে কোথাও বেরিয়ো না। ওরা নজর রাখছে, মাথায় রেখো।”
ঝুমকি বলল, “রাখব। সাবধানে যেয়ো।”
৪৮
বাদশাহ হুমায়ুন হারেমে প্রবেশ করেছেন। মেহজাবিনকে চোখ উপড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
হারেমের মেয়েরা তাঁকে শাহি স্নান করিয়ে রাধার কাছে নিয়ে গেছে। রুকসানা বাদশাহর সঙ্গে এসেছিল। হুমায়ুন রাধাকে বললেন, “ভালো আছ?”
রাধা ঘাড় নাড়ল।
বাদশাহ হাতের ইশারায় রুকসানাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। রুকসানা বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেল।
বাদশাহ বললেন, “মেহজাবিন তোমাকে নিয়ে এসেছিল। তুমি জানতে মেহজাবিন গদ্দার ছিল? আমার ভাই কামরান মির্জাকে ও এখানকার সব খবর পাচার করত?”
রাধা অস্ফুটে বলল, “না।”
বাদশাহ স্বগতোক্তি করলেন, “স্বাভাবিক। তুমি জানবেই বা কী করে? তোমার ভাষাশিক্ষা হল এই সেদিন। এসো।”
রাধা বাদশাহের কাছে এল।
বাদশাহ রাধার ওষ্ঠ চুম্বন করলেন। রাধা শিউরে উঠল। বাদশাহ রাধাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কী চাও তুমি?”
রাধা বাদশাহের বক্ষলগ্না হয়ে ছিল। সে ফুঁপিয়ে উঠল।
বাদশাহ রাধার চিবুক তুলে ধরে বললেন, “শাহি হারেম থেকে কাউকে বাড়ি ফেরানো সম্ভব নয়। আমি জানি তুমি কী চাও। আমি তোমার গৃহে শাহি উপহার পাঠিয়েছিলাম। তোমার পিতা সমস্ত দ্রব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন।”