ইজাজ মল্লিক চেয়ারে বসে সুশোভনের দিকে একবার তাকিয়ে জামানকে বলল, “উনি থাকবেন?”
জামান বললেন, “কেন? উনি হিন্দু বলে আপনার অসুবিধা?”
ইজাজ বলল, “আমার কোনও অসুবিধা নেই। হিন্দু, মুসল্লি, খ্রিস্টান সবই তো সামলাই। তবে এনাকে তো ট্রান্সফার করা হয়েছিল। ইনি নিজের কাজ না করে কলকাতায় কী করছেন সেটাই ভাবছি।”
সুশোভন বললেন, “আমরা মেটাতে চাইছি জনাব। আপনার হেল্প ছাড়া তো সেটা সম্ভব না।”
ইজাজ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “আমরা কি একবারও বলেছি আমরা মেটাতে চাই না? আপনি মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিন, মেয়েটা স্বামী সংসার করুক, বাচ্চা হোক, সুখ পাক, আর কিছু তো চাইনি।”
সুশোভন বললেন, “প্রথমত মেয়েটা কোথায় আছে, আমরা কেউ জানি না জনাব। দ্বিতীয়ত এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, মেয়েটা স্বেচ্ছায় বিয়েটা করেনি। ফোর টুয়েন্টি করে বিয়েটা হয়েছিল, তথ্য গোপন করে। এক্ষেত্রে ছেলেটি দোষী হয়।”
ইজাজ হাত বাতাসে ঘুরিয়ে সুশোভনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওতে কী হয়? কটা বিয়ে স্বেচ্ছায় হয়? মেয়েমানুষের আবার ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে কিছু হয় নাকি? বিয়ে হয়েছে মানে ও মেয়ে রুবেলের স্ত্রী, কনভার্শন হয়েছে মানে ও মেয়ে এখন মুসলিম। কহানি খতম।”
জামান এতক্ষণ চুপ করে বসে শুনছিলেন। ইজাজের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। ইজাজ বলল, “কী হল সাহেব?”
জামান বললেন, “আপনি দারুণ কথা বললেন কিন্তু মল্লিকবাবু। আই অ্যাম হাইলি ইমপ্রেসড। এত সোজা সব কিছু?”
ইজাজ বলল, “আপনি একজন মুসল্লি হয়ে এই কথা বলছেন জনাব? কিনে নেওয়া জাজ দিয়ে বাবরি মসজিদের রায় ঘুরিয়ে দেওয়া হল। আপনার খুন ঘুমিয়ে ছিল তখন? সবখানে আমাদের মুসলিম ভাইদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, আমরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছি, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?”
জামান সুশোভনের দিকে তাকালেন, “দেখলে সুশোভন, তুমি জাস্ট একজন গেরুয়াপন্থী আর আর-একজন ইজাজ মল্লিককে পাশাপাশি বসাও। দেখবে কথাগুলো জাস্ট রিফ্লেক্ট করে যাবে। গেরুয়াপন্থী বলে যাবে কাশ্মীরে যখন পণ্ডিতদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন তুমি কোথায় ছিলে? আর এখানে মল্লিকবাবুরা এসব বকে যাবেন। মল্লিকবাবু”, জামান সাহেব মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে এসব বলতে পারেন না। ঠান্ডা মাথায় ভাবুন সমস্যাগুলো কীভাবে বাড়তে চলেছে।”
ইজাজ মল্লিক বলল, “আপনি কী চান?”
জামান বললেন, “আমরা একটা স্থিতাবস্থায় আসি। মেয়েটাকে টিভির মাধ্যমে জানাই, তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই আমরা মেনে নেব। তুমি যদি চাও সংসার করতে, করো। না চাইলে ইউ আর ফ্রি টু গো। আর আমি চাই, এই অ্যানাউন্সমেন্টটা আপনি করুন।”
ইজাজ বাজে ভাবে হেসে উঠে বলল, “কী সব বলে যাচ্ছেন জামান সাহেব। নিজের ধর্মের মানুষের প্রতি আপনার কোনও সহানুভূতি নেই?”
জামান বললেন, “এই চেয়ারটায় বসলে আমার কাছে সবাই সমান। এ দেশের সংবিধান আমাকে সেটা শিখিয়েছে।”
ইজাজ বলল, “এ দেশের সংবিধান সবাই মানছে? খোদ হিন্দুরাই মানছে?”
জামান বললেন, “কুড়ি শতাংশ হিন্দুরা মানছে না। বাকি আশি শতাংশ হিন্দুরা মানছে বলেই এখনও দেশে শান্তি আছে। একটা মুসলিম কান্ট্রি আর একটা সেকুলার কান্ট্রি লাইক ইন্ডিয়ার মধ্যে এই কারণেই এখনও হেল অ্যান্ড হেভেন ডিফারেন্স মল্লিক সাহেব। আমি ভুল বলছি?”
ইজাজ রেগে গেছিল। জোরে জোরে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “আপনার ইমান আপনি বন্ধক রেখে দিয়েছেন জামান সাহেব। আপনি নিজেও জানেন না, আপনি কী ভয়ংকর কথা বলছেন।”
জামান ঠান্ডা গলায় বললেন, “আমি অনেক সহানুভূতিশীল হয়ে কথাটা বলছি। সত্যিকারের ভয়ংকর রূপ দেখাতে চাইলে ওই রুবেল শেখ নামের ছেলেটাকে লাঠি দিয়ে আগাপাশতলা পেটাতাম, সঙ্গে ওকে যারা মদত দিচ্ছে তাদেরও। পুলিশ কিছু করে না, আমাদের হাত পা বাঁধা বলে আমরা চুপ করে থাকি। আপনার কাছে একটা ফেবার চাইছি, আপনি সেটা দয়া করে করে দিন। নইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমাকে মাঠে নামতে হবে।”
ইজাজ গম্ভীর মুখে জামানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন জামান সাহেব।”
জামান বললেন, “হুমকি দিচ্ছি না, রিকোয়েস্ট করছি মল্লিকসাহেব। অত্যন্ত ভদ্রভাবে, হাতজোড় করে আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি। পুলিশের হুমকি এত নরমভাবে হয় না, জানেন বোধহয়। আপনার অন্যান্য ব্যবসাও তো আছে মল্লিকসাহেব। কেন সেগুলো অকারণ হ্যাম্পার করবেন বলুন?”
ইজাজ মল্লিক লাল চোখে জামান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল।
৪৭
খবরের কাগজ এসেছিল। আদিত্য স্নান করে এসে সেটাই দেখছিল। রুমকি আদিত্যকে খেতে দিয়ে বলল, “আজ ওদের মিটিং-এ কী হবে কে জানে।”
আদিত্য বলল, “পজিটিভ ভাবছি।”
রুমকি বলল, “কী পজিটিভ ভাবছ? আমার বোনটার তো যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে।”
আদিত্য বলল, “কীরকম সর্বনাশ? কোনও মেয়ে রেপড হলে কি সব শেষ হয়ে যায়?”
ঝুমকি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। রুমকি ঝুমকির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ঘরে যা।”
আদিত্য খাওয়া থামিয়ে বলল, “না। কোনও ঘরে যেতে হবে না। ঝুমকি। এদিকে আয়। বস।”
রুমকি থমথমে মুখে আদিত্যর দিকে তাকাল। ঝুমকি ইতস্তত করে চেয়ার নিয়ে বসল।