সুশোভন চিন্তিত চোখে চুপ করে থাকলেন কয়েক সেকেন্ড। সিগারেট ধরালেন। বেশ কয়েকটা টান দিয়ে বললেন, “আমিও আসলে হাতড়াচ্ছি বলতে পারিস। কনফিউজড আমিও। এরকম মানসিকতা নিয়ে কেউ যখন এগোয়, তাদের কীভাবে আটকাতে হবে আগে বুঝে উঠতে পারি না। একটা কেসে আমার ট্রান্সফার অবধি হয়ে গেল। আর কী কী অপেক্ষা করে আছে কে জানে।”
আদিত্য বলল, “এরকম হবে তা তো কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। কেউ যে ভালোবাসার ফাঁদ পেতে রেখে এত বড়ো ক্রাইম করবে, আমি কী করে বুঝব?”
সুশোভন বললেন, “দেখ আইন খুব ক্লিয়ার এই ব্যাপারে। যদি মিয়া বিবি রাজি, তবে আইন কিচ্ছু বলবে না। একজন অরাজি থাকলে, তার ওপর প্রতারণা হলে আইন অভিযুক্তকে ছাড়বে না। মেয়েটিকে ডাকুন। আমি কথা বলতে চাই।”
সুশোভন রুমকির দিকে তাকাল।
৪৫
জামান সাহেব চেম্বারে একাই ছিলেন। সুশোভন ঢুকতে জামান বললেন, “এসো। তোমার সন্দেশখালি না ডায়মন্ড হারবার কোথায় যেন একটা ট্রান্সফার হয়েছে না?”
সুশোভন হাসলেন, “আর কী বলব সাহেব।”
জামান বললেন, “বসো। কেসটার আপডেট কী?”
সুশোভন বললেন, “ভালো না। মেয়ের বাড়ির লোকও যথেষ্ট গোঁড়া। একবার বলছে দূরে কোথাও বিয়ে দেবে, আর-একবার বলছে শুদ্ধ করবে, এদিকে ইজাজ মল্লিকের লোকেরাও তো ছেড়ে কথা বলবে না।”
জামান সুশোভনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ দেশে মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই পাপ বুঝলে? আমার মেয়েদের আমি লন্ডনে পড়তে পাঠিয়েছি বলে ভাই-বেরাদরি থেকে কম কথা শুনতে হয় না। ইসলামে এই হারাম, ইসলামে ওই হারাম। এদের কী করে বোঝাব শিক্ষায় কোনও কিছু হারাম হয় না। মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত হবে, এর থেকে ভালো কিছু আর হতে পারে না। তোমার ওই রুবেল শেখ বা রিন্টু, ছেলেটা তো শিক্ষিত। কী লাভ হল? মেয়েটাকে রেপ করল। কনভার্ট করে দিল।”
সুশোভন বললেন, “স্যার লাদেন ইঞ্জিনিয়ার। আইসিসের মাথাগুলো প্রায় সবকটাই উচ্চশিক্ষিত।”
জামান বললেন, “তবেই ভেবে দ্যাখো। সাধে কি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো, এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো! একদিকে এদের গোঁড়ামি শুরু হয়েছে, আর-একদিকে শুরু হয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডব। কী, না গোরুর মাংস ফ্রিজে রেখেছে বলে কুপিয়ে খুন করে দিল। আর-একজন ট্রেনে যাচ্ছিল, টিফিন খুলে মাংসের গন্ধ বেরিয়েছে, তাকে মেরে দিল টিফিনে গোরুর মাংস আছে বলে। সিস্টেম কখন ভুল পথে যায় বল তো? এদের বিরোধীরা এখন বলছে মাংসটা গোরুর না। মানে গোরুর মাংস হলে খুন করাটা জায়েজ, অন্য কিছুর মাংস তুমি খেতেই পারো।”
সুশোভন বললেন, “পরিস্থিতিটা এমন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, শিক্ষিত মানুষেরাও ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে স্যার। ইসলামোফোবিয়া একটা রোগ, এটা বুঝছে না। যে লোকটা গোমূত্র খাচ্ছে, সে যেমন গোটা হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করছে না, তেমনি আজমল কাসভও কিন্তু গোটা মুসলিম ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করছে না।”
জামান বললেন, “উঁহুঁ। সমস্যাটা অন্য জায়গায় সুশোভন। আমাদের মধ্যে গোঁড়ামি বড্ড বেশি। এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েও সেটা বাড়ছে বই কমছে না। আমাদের দোষেই বাকিরা আমাদের দিকে আঙুল তুলতে পারছে। বাংলাদেশের অভিজিৎ রায়ের কেসটা বলো। ভদ্রলোক নিজের মতো করে নাস্তিকতাকে প্রমোট করতেন। বইমেলায় এসেছিলেন। জামাতিরা তাঁকে কুপিয়ে খুন করে দিল। শার্লি হেবদো? কার্টুন আঁকা যাবে না। আঁকলেই খুন করে দেবে। কেন? ধর্ম কবে থেকে এত ভয়ংকর হয়ে উঠল? ধার্মিক হওয়া মানে কি মানুষে মানুষে খুনোখুনি? এই দুহাজার কুড়িতে এসে যদি আমরা এসব নিয়ে পড়ে থাকি তাহলে কিছু বলার নেই। তুমি জানো, আমি এই কালকেও একটা মাইনর বিয়ে আটকে এলাম সাউথ টুয়েন্টি ফোর পরগনা থেকে? আমাদের চাচার বাড়ি ওখানে। গিয়ে দেখি চোদ্দো বছর বয়সি মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাকে গ্রামের লোক ঘিরে ধরে এই মারে কি সেই মারে। আমি চ্যাঁচামেচি করে, শাসিয়ে ব্যাপারটা আটকালাম। আমি মুসলমান বলে ওরা কথাটা শুনল। আমার জায়গায় তুমি থাকলে তোমাকে কুপিয়ে পুঁতে দিয়ে আসত। এই অশিক্ষিত ধর্মভিত্তিক দেশে মুক্তচিন্তা করা লোকেরা অপরাধী হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিভিন্ন গালাগাল দিয়ে সম্বোধন করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যারাস করা হচ্ছে। দিস ইজ ডিটোরিয়েটিং এভরিডে।”
জামান সাহেব হতাশভাবে মাথা নাড়লেন।
সুশোভন বললেন, “স্যার, আপনি ইজাজ মল্লিকের সঙ্গে বসুন। ব্যাপারটার একটা সুরাহা হোক। আমার বন্ধু, মানে আদিত্যর জীবনটা হেল হয়ে গেছে। সঙ্গে আমারও।”
জামান বললেন, “কাকে কাকে রাখতে চাও মিটিং-এ?”
সুশোভন বললেন, “আগে একটা প্রাইমারি মিটিং হোক। আমি আপনি আর ইজাজ মল্লিক থাকি। দরকার হলে ওই রিন্টু ছেলেটাকেও ডেকে নেওয়া যেতে পারে। যদি বুঝি আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে, তখন আমরা পরের স্টেপটা নিয়ে ভাবব।”
জামান বললেন, “ঠিক আছে। ইজাজ মল্লিক কিন্তু ঘুঘু লোক। সতর্ক থেকো সুশোভন।”
সুশোভন মাথা নিচু করলেন, “শিওর স্যার।”
৪৬
“আজকে ইউপিতে আমাদের তিনটে মহল্লা জ্বালিয়ে দিয়েছে হিন্দুরা।”
জামান সাহেবের চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে ইজাজ মল্লিক বলল। সুশোভন আর জামান আগে থেকেই বসে ছিলেন। জামান বললেন, “বসুন জনাব।”