সুশোভন বললেন, “সেটা ভালো হল না খারাপ হল?”
আদিত্য বলল, “অবশ্যই খারাপ হল। আমরা, মানে হিন্দুরা অহেতুক উদারতা দেখাতে যাব কেন?”
সুশোভন বললেন, “উদারতা দেখানোর প্রয়োজন নেই বলে। যদি বলি দেশটা ধর্মনিরপেক্ষ থাকল বলেই দেশের একটা পচা অংশ পার্টিশনের ফলে বেরিয়ে গিয়ে দেশটা শুদ্ধ হয়েছিল বলে? ভারতবর্ষ তো বরাবরই সব ধর্মের দেশ। এই সেই জায়গা যেখানে শাসকেরা শাসন করতে এসে এই দেশের প্রেমে পড়ে গেছিল। মুঘল শাসকেরা যদি এই দেশ লুটতে আসত, তবে তো তারা সব সম্পদ নিয়ে পালাতে পারত, যেটা ব্রিটিশরা করেছিল। কোহিনুর থেকে শুরু করে মুঘল স্থাপত্যের সব মণিমুক্তো খুঁটে খুঁটে নিয়ে পালিয়েছিল ব্রিটিশরা। এ দেশের সবথেকে বড়ো শত্রু তো তারাই। জাতের নামে, ধর্মের নামে সব ভাগ করে দিয়ে চলে গেল। সঙ্গে যুক্ত হল একজন রামমোহন না পাওয়া, একজনও বিবেকানন্দ না পাওয়া একটা জাতি। মুসলমানদের আমরাও কি কম উপেক্ষা করেছি? এই মধ্যযুগীয় লাভ জিহাদের কথা ওরা ভাবছে কী করে? আর কোনও উদ্দেশ্য নেই কেন ওদের? আমরাই আমরা-ওরা করে ওদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম বলেই তো। কেন এখনও ধর্মে ধর্মে বিয়েতে এত সমস্যা হবে? তুই জানিস, এক মুসলিম মেয়ে এক হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করবে বলেছিল বলে তার বাবা দাদা মেয়েটাকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে বড়ো রাস্তায় জাস্ট পাথর ছুড়ে মেরে ফেলেছে? কতটা অশিক্ষা, কতটা গোঁড়ামি থাকলে এই মানসিকতা আসে ভাব তো। ধর্ম জিনিসটাই এত সমস্যার কারণ। এর ফলেই এত চাপানউতোর চলছে চারদিকে। আমার তো মনে হয় এ দেশে অটোক্রেটিক কোনও শাসন আসা দরকার, যারা সবার আগে ধর্ম জিনিসটাকেই ব্যান করে শুধু যুক্তিবাদের চাষ করাতে বাধ্য করবে। জ্যোতিষ থেকে শুরু করে রাস্তায় রাস্তায় শনি মন্দির, পিরের মাজার সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিক। দাঙ্গা ছড়ানোর প্ল্যান করলে জাত ধর্ম না দেখে গুলি করে মেরে দিক। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে৷ ভাবা যায় একটা উন্নয়নশীল দেশে দাঙ্গা ছড়ানোর ভয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে হয়? হাউ রাবিশ!”
মিছিলে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। একদল মানুষ রাস্তায় টায়ার পোড়াচ্ছে। আদিত্য হতাশ চোখে সেদিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস। উই নিড অ্যান অটোক্রেটিক লিডার।”
৪৪
সুশোভনকে নিয়ে যখন বাড়ি পৌঁছল আদিত্য, তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে। রুমকি দরজা খুলে দুজনকে দেখে রাস্তা ছেড়ে দিল।
সুশোভন হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? সব ঠিক আছে?”
রুমকি একবার আদিত্যর দিকে তাকিয়ে থমথমে চোখে সুশোভনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী করে থাকবে? সমস্যা তো কিছু মেটেনি।”
আদিত্য বিরক্ত হল। রুমকি এখন সুশোভনের কাছে কাঁদুনি গাইতে শুরু করবে।
সুশোভন সোফায় বসে বললেন, “সমস্যাকে সমস্যা মনে করলে সমস্যা। প্রতিটা ফ্যামিলিতেই একটা না একটা সমস্যা হয়। যে বাড়িতে মেয়ে থাকে, সে বাড়ির লোকজনেরা টেনশনেই থাকে। তাই বলে আমরা যদি সব হাল ছেড়ে দি, তাহলে কী করে চলবে?”
আদিত্য বসেছিল। বলল, “ঝুমকি কোথায়?”
রুমকি বলল, “ঘরে আছে। থাক। সব জায়গায় ওর আসার দরকার নেই।”
সুশোভন বললেন, “কেন নেই? পর্দাপ্রথা মানছেন নাকি?”
রুমকি বলল, “তা নয়। আমি চাই না ওকে নিয়ে সব আলোচনায় ও থাকুক। একটা শকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তো!”
সুশোভন কাঁধ ঝাঁকালেন, “তা ঠিক। তো এবার কী করা যায়?”
রুমকি বলল, “হায়দ্রাবাদে আমার এক কাকু কাকিমা থাকেন। ওকে আপাতত ওখানে পাঠানো হবে।”
আদিত্য চমৎকৃত হল। এতক্ষণে তাহলে রুমকি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রুমকি একটু ইতস্তত করে বলল, “তা ছাড়া ঝুমকির মেডিক্যাল টেস্ট করা দরকার বলে আমার মনে হয়। ও যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে…”
রুমকি থেমে গেল।
সুশোভন বলল, “আচ্ছা, যদি ছেলেটা, কী নাম যেন, রিন্টু, ওর ভুল বুঝে ক্ষমা চায় আর ঝুমকিকে ফেরত নিতে চায়, তাহলে?”
রুমকি রাগল এবার, “কোনও মতেই মানা যাবে না। মানা সম্ভবই না এটা।”
সুশোভন মাথা নাড়িয়ে বললেন, “সেটাই স্বাভাবিক। তবু বোনের সঙ্গে কথা বলে নেবেন। পরে দুর্বল হয়ে পড়ে যদি?”
রুমকি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “প্রশ্নই আসে না।”
সুশোভন বললেন, “দেখুন এরকম হয় বলেই বলছি আমি। প্রশ্ন আসে না সবাই-ই ভাবে। তারপর দেবাকে সামনে দেখলে দেবী কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আপনার বোনের তরফ থেকে ছেলেটির বিরুদ্ধে স্ট্রং চার্জ আনা দরকার।”
রুমকি বলল, “তার আগে ওকে এই রাজ্য থেকে বের করা দরকার। সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন কি? আমার বাবা মা আসতে চাইছিল এখানে। ছেলেটার বাড়ি থেকে জেনে যাবার চান্স আছে বলে ওদের বহু কষ্টে আটকানো গেছে। এখন আমি চাই না ব্যাপারটা নিয়ে বেশি হইচই হোক।”
সুশোভন বললেন, “ধরুন আপনার বোনকে রাজ্য থেকে বের করে দিলেন। ফাইন। বিয়েও দিলেন। ফাইন। তারপর ওরা কোনও ক্ষতি করল? তখন? মেয়েটা তো একবারে উবে যাবে না!”
রুমকি দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, “তো? আপনি কী বলেন?”
সুশোভন বললেন, “দু পক্ষ বসুন। ঝামেলা মেটান।”
রুমকি শক্ত মুখে বলল, “অসম্ভব। আমরা ওই টেররিস্টদের সঙ্গে বসব না।”
আদিত্য বলল, “ঠিকই। ওরা সংখ্যায় বেশি থাকবে। সভ্যতা ভব্যতারও ধার ধারে না। ওদের কীভাবে বিশ্বাস করা যাবে?”